প্রশান্ত ভট্টাচার্য
বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার পরদিন বাংলায় সভা করতে এসে রা না কাড়লেও বৃহস্পতিবার বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা নিয়ে সেই মোদিই দিলেন নতুন প্রতিশ্রুতি। আর সেটা বাংলায় নয়, উত্তরপ্রদেশে। সেখানকার মউতে নির্বাচনী জনসভায় দাঁড়িয়ে নরেন্দ্র মোদির ঘোষণা, কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজের ওই একই জায়গায় পঞ্চধাতু দিয়ে তৈরি হবে বিদ্যাসাগরের নতুন সুরম্য মূর্তি। পাশাপাশি অনুচর অমিত শাহর মতোই মূর্তি ভাঙার দায় ঝেড়ে চাপিয়ে দিলেন তৃণমূলের ঘাড়ে। এই হচ্ছে মোদি-এথিক্স। এটাই তিনি তাঁর পাঁচ বছরের জমানায় চালিয়ে গেলেন। হাতের পুতুল করে রাখলেন স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে। কিন্তু আর নয়!
ক’দিন আগেই এক সাক্ষাৎকারে বিজেপি সাংসদ সুব্রহ্মণ্যম স্বামী বলেছেন, বালাকোট–হানা না হলে বিজেপি ১৬০ আসনও পেত না। হক কথা বলে ফেলেছেন স্বামী। বোধহয় এই কারণেই মোদি-শাহ জুটি তাঁকে দেখতে পারেন না। ধরে নিতেই পারি, স্বামীর মতো রিসোর্সফুল ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধির মানুষ সততার সঙ্গেই ওই সংখ্যাটি উচ্চারণ করেছেন। তাঁর বিবেচনায় মোদির পতনের কারণ– ক্ষমতার অতিকেন্দ্রীকরণ। শরিকদের নিয়ে চলার ক্ষেত্রেও মোদি হিটলারি স্বভাবের পরিচয় দিয়েছেন বলে মনে করেন স্বামী। এখন প্রশ্ন হল, বালাকোট ১৬০ থেকে কতটা ঠেলে তুলতে পারবে মোদিকে? আরও ৪০? বা ৬০? তাহলেও ২২০’ তেই সিল হয়ে যাচ্ছে বিজেপি বা এনডিএ।
এই অবস্থায় ভোটের ফল কী হতে পারে নিয়ে বাক্যবিস্তার ছাড়া এই কলমচিরও গতি নেই। ইংরেজিতে প্রবাদ আছে, ‘ম্যান প্রপোজেজ গড ডিসপোজেজ, এখানেও বলা যায় রাজনৈতিক দলগুলোও যা ভাবে ভোটাররা তা বদলে দেয়। তাই সব উত্তর ইভিএমে রুদ্ধ হয়ে আছে। তবু হিসেবনিকেশ। যোগবিয়োগের পাটিগণিত, জাত-সম্প্রদায়ের রসায়ন চলছে সাধারণ মানুষের আড্ডা থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর দফতরে।শ্মশানে। রাজদ্বারে। একই সঙ্গে সমানভাবে তেতে উঠেছে সাট্টা বাজারও। কোন দল এগোবে, কারা পিছোবে, সরকার গড়বে কারা, তাই নিয়েই কোটি কোটি টাকার খেলা চলছে সাট্টা বাজারে।
সাত দফা ভোটের মধ্যে বাকি আর এক। তার আগেই গরম বাজার। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলগুলোরও দৌত্য শুরু হয়ে গেছে। প্রথমেই ময়দানে নেমেছেন তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও (কেসিআর)। ৬ মে ছিল দেশে পঞ্চম দফার ভোট। সেদিন রাতেই কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনরাই বিজয়নের তিরুবনন্তপুরমের বাসভবনে বৈঠক করেন কেসিআর। খবর পাওয়া গিয়েছে দিল্লিতে অবিজেপি ও অকংগ্রেসি ফেডারেল ফ্রন্টের সরকার গড়ার বিষয়ে তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতির সুপ্রিমো কেসিআর ২ ঘণ্টা ধরে আলোচনা করেন সিপিআই(এম) পলিটব্যুরো সদস্য বিজয়নের সঙ্গে। অবিজেপি, অকংগ্রেসি সরকার গড়ার সলতে পাকানো ছাড়াও এই বৈঠকের একটি প্রধান লক্ষ্য নাকি এবার দক্ষিণ ভারত থেকে কাউকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে আওয়াজ তোলা। কোনো বিশেষ নাম নিয়ে আলোচনা না হলেও, প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে দক্ষিণ ভারতের কাউকে বসানোর সওয়াল করেছেন তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী। ১৩মে তিনি ডিএমকে প্রধান স্ট্যালিনের সঙ্গেও বৈঠক করেন। চেন্নাইয়ে স্ট্যালিনের বাসভবনে দুই নেতার সাক্ষাৎ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে কৌতূহল ছির গভীর। তবে উল্লেখ্য, কেসিআর অকংগ্রেসি ও অবিজেপি সরকার গঠনের সওয়াল করলেও স্ট্যালিন তা খারিজ করে দিয়েছেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, কংগ্রেসের সঙ্গে তার দল জোট করে ভোট করেছে, সেখান থেকে সরে আসার কোনও কারণ ঘটেনি। কেসিআর ও তাঁর তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি বিজেপির বন্ধুভাবাপন্ন বলেই ভারতীয় রাজনীতিতে পরিচিত। তাই দুই বিপরীত মনোভাবাপন্ন পার্টি প্রধানের এই সাক্ষাৎকার যে বিশেষ ফলপ্রসূ হবে না, সেই ধারণা ছিল রাজনৈতিক মহলে। তবে কেসিআর আশা ছাড়ছেন না। জানিয়েছেন, তিনি কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী কুমারস্বামীর সঙ্গেও বৈঠক করবেন। তপে কেসিআর ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, দেশের মানুষ এবার তৃতীয় ফ্রন্টের পক্ষে রায় দিয়েছে। এবার সময় এসেছে ফেডারেল ফ্রন্ট গড়ে আঞ্চলিক দলগুলোর এক জায়গায় হওয়ার। সর্বভারতীয় দল কংগ্রেস ও বিজেপিকে তাহলেই শাসনকেন্দ্র থেকে দূরে রাখা যাবে। এই প্রতীতি থেকেই তাঁর এই তোড়জোর। লোকসভা ভোট শুরুর পর সোমবারের বৈঠককে অবিজেপি ও অকংগ্রেসি নেতৃত্বের মধ্যে আগামী পন্থা নিয়ে প্রথম আলোচনা বলা যায়।
তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রীর এই বিশ্বাস ও তৎপরতা একটা দিক পরিষ্কার করে, ‘এনডিএ যে ম্যাজিক ফিগারে পৌঁছোতে পারছে না, সেই বার্তা পেয়ে গেছেন কেসিআর। আর সেই কারণেই জল মাপতে নেমে পড়েছেন চন্দ্রশেখর রাও। বিজেপি ও কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ার আশায় বিরোধী দলগুলিকে এক ছাতার নীচে আনার জন্য ভোটের আগেও তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজেডি সভাপতি নবীন পট্টনায়েকের সঙ্গে একদফা আলোচনাও সেরেছেন কেসিআর। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মমতাও জানান, এ ব্যাপারে আলোচনার জন্য কয়েক দিনের মধ্যে ফের বাংলায় আসছেন কেসিআর। যদিও তৃতীয় ফ্রন্টের পক্ষে সওয়াল করলেও, গত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে বিভিন্ন ইস্যুতে টিআরএস বিজেপি সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে। আবার কেসিআরের তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি (টিআরএস)কে বিজেপির ‘বি টিম’ বলে কটাক্ষ করে কংগ্রেসের দাবি, শুধুমাত্র বিজেপিকে সুবিধা করে দেওয়ার জন্যই ফেডারেল ফ্রন্ট গড়ার চেষ্টা করছেন কেসিআর। যদিও কংগ্রেসের সমালোচনায় কান দিতে নারাজ তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী।
অন্যদিক, কংগ্রেসের সঙ্গে কথা বলে নেমে পড়েছেন আরেক দক্ষিণী নেতা, টিডিপি সুপ্রিমো চন্দ্রবাবু নায়ডু-ও। কয়েকটা মিটিংও সেরেফেলেছেন। চন্দ্রবাবু নায়ডুর সঙ্গে এরইমধ্যে রাহুল গান্ধী, আহমেদ প্যাটেলদের কথা হয়েছে। তাঁর এই তৎপরতায় সাড়াও মিলেছে। ১৯ মে সপ্তম তথা শেষ দফার ভোট মিটলেই বিরোধীরা নাকি দল বেঁধে রাষ্ট্রপতির কাছে নতুন সরকার গড়ার পদ্ধতি নিয়ে আগাম বক্তব্য জানাতে যাবেন। উদ্দেশ্য, বিরোধীরা মিলে একযোগে রাষ্ট্রপতির হাতে একটি চিঠি তুলে দেওয়া। যাতে রাষ্ট্রপতি একক বড় দল হিসেবে আগেই বিজেপিকে সরকার গড়ার আমন্ত্রণ না জানান। যদি সেটা হয় তবে তা হবে এই পর্বে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, রাষ্ট্রপতি স্বয়ং বিজেপির নেতা এবং বিজেপির প্রস্তাবিত প্রার্থী ছিলেন। তবে রাহুল ও তাঁর সেনানীরা যে তৎপরতা দেখিয়ে বিরোধীদের বৈঠক করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন তাতে জল ঢেলে দিয়েছেন মমতারা। চলেছেন, তার সবটা সফল না-ও হতে পারেন। কেননা, ভোটের ফল বেরোবার আগে এই ধরনের বৈঠকে রাজি নন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মায়াবতী ও অখিলেশ যাদব। মোদি বিরোধী লড়াইয়ের এই তিন মহারথীই জানিয়ে দিয়েছেন, ভোটের ফল বেরোবার পর পরিস্থিতির যথার্থ মূল্যায়ন করতেই বৈঠকের সার্থকতা, তার আগে বসাটা মূল্যহীন। এই তিনজনের মধ্যে অখিলেশ আগেই জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রিত্বের লড়াইয়ে তিনি নেই উপরন্তু এই ক্ষেত্রে তিনি তাঁর বুয়া মায়াবতীর পাশে। অন্যদিকে মমতা মুখে প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবি না করলেও বাংলার গোটা নির্বাচনী প্রচারে তাঁর দলের নেতা-কর্মীরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর কুরশিতে বসবেন, আপনারা তাই তৃণমূলকে ভোট দিন। এই অবস্থায় রাহুল গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী করার সওয়াল করে আসা ডিএমকে প্রধান স্ট্যালিন ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়া বৈঠকে এই প্রসঙ্গ তুললে, একটা ভুল বোঝাবুঝির আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে বলেই বৈঠক থেকে তফাত থাকার কথা বলেছেন মমতা-মায়াবতী-অখিলেশ। পাঠক মনে রাখবেন, টানা নির্বাচনী প্রচারে মমতা দাবি করে আসছেন, কেন্দ্রে সরকার গড়বে বাংলা ও উত্তর প্রদেশ। এই দাবি যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী। অর্থাৎ বিজেপিহীন সরকার হলে তার প্রধান এই দুই প্রদেশের থেকে কেউ হবেন। এই বিবেচনায় দাঁড়িয়েই রাহুলদের উদ্যোগ থেকে দূরে তাঁরা।
এই অবস্থায় মোদিবিরোধী শিবিরকে এককাট্টা রাখতে হাল ধরেছেন ইউপিএ চেয়ারপার্সন সনিয়া গান্ধী। মমতা-মায়াবতী-অখিলেশদের আপত্তিকে মান্যতা দিয়ে তিনি বিরোধীদের বৈঠক ডেকেছেন ভোটের ফল বেরোবে যে ২৩ মে, সেই সন্ধ্যায়। এবং এই বৈঠক ইউপিএ’র নামে ডাকা হয়নি। কেননা, চেষ্টা আছে বিজেপি বিরোধী সব দলগুলোকে গেরুয়াহীন শিবিরে নিয়ে আসা। এমনকী, কেসিআরের টিআরএস, নবীন পট্টনায়কের বিজেডি, জগন্মোহনের ওয়াইএসআর কংগ্রেসকেও। দক্ষিণ ভারতের থেকে প্রধানমন্ত্রী করতে চাওয়ার পিছনে কেসিআরের আকাঙ্খার কথা কংগ্রেসের কাছেও অজানা নয়। আর কেসিআরের মনোবাসনাটাও অনুমেয়। তিনি স্বয়ং যে দাবিদার, সেটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। তাই সব দিক বিবেচনা করে কেসিআরের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন কংগ্রেস ম্যানেজাররা। আর সেটা যে কিছুটা ইতিবাচক, তা বোঝা যাচ্ছে ২৩ মে’র বৈঠকে সনিয়ার আমন্ত্রণ থেকেই। জগন্মোহন রেড্ডির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন রাহুল-দূত কে ভি টমাস। এরমধ্যেই নাকি, টমাসের সঙ্গে জগনের কাকা সুধাকর রেড্ডির কথা হয়েছে। ২৩ মে’র যে বসার কথা আছে তাতে জগন্মোহনকে নাকি আসার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। আসলে কংগ্রেস চাইছে এনডিএ’র যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হচ্ছে না, তা বুঝে গিয়ে মোদি-শাহ এনডিএ পুনর্গঠনের সংকল্পে টিআরএস, ওয়াইএসআর কংগ্রেস বা বিজেডির সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসার আগেই এই দলগুলোর সঙ্গে একটা সেতু গড়ে তুলতে। কেসিআরের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন উড়িয়ে না দিয়ে বরং উস্কে দিতে চাইছে কংগ্রেস।
কেননা, কংগ্রেসের কাছে খবর আছে, নিদেন পক্ষে উপপ্রধানমন্ত্রী হতে চান কেসিআর। সে বার্তা কেসিআরের পক্ষ থেকে দক্ষিণের কিছু দলকেও দেওয়া হয়েছে। এরপরই বিশ্বস্ত কাউকে পাঠিয়ে কংগ্রেস তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। আকবর রোডের প্রধান যুক্তি, বিজেপির সঙ্গে গেলে কেসিআরের প্রধানমন্ত্রী বা উপপ্রধানমন্ত্রী হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং বিরোধী শিবিরের সঙ্গে থাকলে তাঁর স্বপ্ন পূরণ হলেও হতে পারে।
ছ’ দফা ভেটের শেষে যে হাওয়া আর দলের অভ্যন্তরীণ রিপোর্ট, তার ভিত্তিতে কংগ্রেসের কোর টিমের অনুমান, বিজেপি ১৬০-১৭০টির বেশি আসন পাবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কিন্তু ১৬০ সংখ্যাটি ধরেই এগোচ্ছেন। কংগ্রেসি নির্বাচনী–পণ্ডিতদের ধারণা, ২০১৪’র তিনগুণ বেশি পেতে পারেন রাহুল গান্ধী। সেক্ষেত্রে দাঁড়ায় ১৩২। এটা হয়তো বেশি প্রত্যাশা হচ্ছে। তবে ১০০ আসনের যত ওপরে উঠবে কংগ্রেস, ততই হার্ট বিট বাড়বে নরেন্দ্র মোদির। ক্ষীণতর হবে মোদির ফেরার সম্ভাবনা। পাঠক মনে রাখবেন, গতবার বিজেপির জেতা ২৮২টি আসনের মধ্যে ১৬৭ কেন্দ্রে কংগ্রেস হয়েছিল দ্বিতীয়। এখন কংগ্রেসকে ১০০ পেরোতে হলে বিজেপির হাত থেকে ৬০টি আসন ছিনিয়ে নিতে হবে। ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাট, বিহার, ঝাড়খণ্ডের দিকে নজর রাখলে তার অর্ধেকের বেশিটা তুলে নেওয়া অসম্ভব মনে হচ্ছে না। এরপর তামিলনাডুতে ডিএমকের সঙ্গে জোট হওয়ার ফলে এবং কেরালাতে রাহুল স্বয়ং প্রার্থী হওয়ায় দক্ষিণ ভারত থেকে ১০টা অতিরিক্ত আসন পেলেও পেতে পারে কংগ্রেস। এছাড়া পঞ্জাবেও ২০১৪’র তুলনায় রাহুলের আসন বাড়বে। আর এটা যে স্রেফ বায়বীয় অনুমান নয়, তার প্রমাণ বিজেপির দীর্ঘদিনের শরিক অকালি দলের নেতা নরেশ গুজরাল প্রকাশ্যে বলেছেন, বিজেপি গতবারের মতো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। নির্ভর করতে হবে শরিকদের ওপরেই। আমি বলব শুধু বর্তমান শরিক নয়, সরকার গড়তে হলে মোদি-শাহদের নতুন বন্ধু খুঁজতে হবে। কেননা, এনডিএ ২১০-২২০ তেই আটকে যাবে। যদিওবিজেপির দাবি, তারাই সরকার করবে। ফলপ্রকাশ হলেই বিরোধীদের যাবতীয় প্রয়াস মাঠে মারা যাবে। বাংলায় শেষ দফার প্রচারে এসেও নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ, দু’জনেই হুঙ্কার দিয়েছে, তাঁরা ৩০০ টপকে যাবেন। আশা করতে দোষ কী! তবে, আমার বিশ্বাস, ইভিএম-এ বড়সড় ষড়যন্ত্র না করলে মোদি ফিরে আসাটা দুরাশা। তাই এমন একটি অনুকূল আবহে কংগ্রেস ভোটের পরে মোদির জন্য সব পথ বন্ধ করে দিতে চাইছে। তাই হচ্ছে বিরোধীদলগুলোর বৈঠক। এমনকী, নির্বাচন কমিশনের নজিরবিহীন ভাবে বাংলার শেষ দফা ভোটের জন্য সংবিধানের ৩২৪ প্রয়োগ করা নিয়ে কংগ্রেস-সহ বিরোধীরা একযোগে বিরোধিতা করেছে এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমার বলতে দ্বিধা নেই এরকম রবার স্ট্যাম্প মার্কা জাতীয় নির্বাচন কমিশন আমি আমার ৪৫ বছরের রাজনৈতিক সচেতন জীবনে দেখিনি। সুনীল অরোরাদের মোদি-শাহ সম্পর্কে অবস্থান থেকেই পরিষ্কার নির্লজ্জ স্তাবকতা তাঁদের ওঙ্কার। ফ্যাসিবাদের ইতিহাস যাঁরা জানেন, তাঁরা আমারই মতো বলবেন, নির্বাচন পরিচালন সংস্থাগুলো হিটলারের উত্থানের সময় এরকমই ভুমিকা নিয়েছিল। ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামের অদম্য নেতা জর্জি ডিমিট্রফের আমাদের দেশীয় সন্তানরা যেভাবে এই নির্বাচন কমিশনের কাছে কাকুতিমিনতি করেন, তাতে আমার বিবমিষা জাগে। আমি মুকুল রায়ের মতো ফ্যাসিস্ট আগাছার সঙ্গে আলিমুদ্দিনের পিওন রবীন দেবের কোনও তফাত খুঁজে পাই না। যেন পরস্পর ‘রামরেড’!
যাই হোক, আবার ফিরে যাই আসনের হিসাবে। সাট্টা বাজারের হিসেব অনুযায়ী এনডিএ পেতে পারে ১৮৫-২২০-টি আসন আর ইউপিএ পেতে পারে ১৬০-১৮০টি আসন। ১৪০-১৬০ টা আসন থাকবে এই দুই জোটের বাইরের দলগুলোর হাতে। এর পরিণাম, ফল প্রকাশের পরে ঘোড়া কেনাবেচা এবার একটি বাড়তি মাত্রা পাবে। সেদিক থেকে বেনিয়াদের দল বিজেপির অ্যাডভান্টেজ। এর সঙ্গে আছে সিবিআই, ইডি, আইটি’র মতো চাপ তৈরি করার সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়াও এই আঞ্চলিক দলগুলো তেমনভাবে কোনও জাতীয় নীতির ওপর দাঁড়িয়ে রাজনীতি করে না, আন্দোলন গড়ে তোলে না। এরা কতগুলো আঞ্চলিক স্বার্থপূরণের, কিছু সমস্যা মোচন করার জন্য মূলত নিজেদের রাজনীতিকে চালিত করে। সেই নিরিখেই ফল প্রকাশের পরেও চলবে তাদের বোঝাপড়া। ফলে ঘোড়া কেনাবেচা শুরু হলে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে কংগ্রেসকে। ২৩ মে ফলাফল যাই হোক, বিজেপি সেঁটে গেলেও নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর উপগ্রহ অমিত শাহ কিন্তু হারার পাত্র নন। ওঁরা নবীন-কেসিআর-জগন্মোহনকে এক ব্রাকেটে এনে একটা মোক্ষম চাল দেওয়ার চেষ্টা করবেন। এই জুটির যে তৎপরতা ও ধূর্ততা আছে, এই সময়ের কংগ্রেসে তেমন কোনও খেলোয়াড় নেই। আবার অন্যদিকে, বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী এটাও তো ঠিক আঞ্চলিক দলগুলো সব মিলিয়ে ২৭২ এর কাছে পৌঁছোতে পারবে না। দেশে অবিজেপি সরকার গড়তে তাদের কংগ্রেসের সমর্থন লাগবে। সেটা ১৯৯৬ সালের মতো বাইরে থেকে হোক বা অন্য কোনও উপায়েই হোক।
এককথায়, সুসময় আসলেও কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিরোধী শিবিরের আঞ্চলিক দলগুলি সরকার গড়তে পারবে না। আর সেই রাস্তা খোলা রেখেই এগোচ্ছেন দুই প্রভাবশালী মহিলানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও মায়াবতী। সম্প্রতি একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে মমতা স্পষ্ট বলেন, যতই চেষ্টা করুক, কোনওভাবেই সফল হবে না বিজেপি। তাঁর সাফ কথা মোদি সরকার তো হচ্ছেই না। মোদি-শাহকে সরিয়ে অন্য কাউকে সামনে এনেও আর লাভ হবে না। কাউকে পাশে পাবে না বিজেপি। এই প্রসঙ্গে বলা ভালো, আপ নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল মোদি-শাহকে সরালে বিজেপিকে সমর্থন দিতে পারেন বলে মন্তব্য করেছেন। একই মানসিকতা মমতারও বলে এক দল রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন। তেমন কোনও সম্ভাবনা আছে কি না, প্রশ্নে মমতার সোজাসাপ্টা জবাব ‘বিজেপিকে সমর্থন নৈব নৈব চ। কাকে সমর্থন করব, এখন তো অটলজি নেই!’
মমতার এই স্পষ্টভাষণকে বাস্তবে অস্বীকার করারও জায়গা নেই। কেননা, মোদি-দিদি দ্বৈরথ এবারের নির্বাচনে এমন এক মাত্রা পেয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী শুধু ডেইলি প্যাসেঞ্জারের মতো কলকাত-দিল্লিই করছেন না, দেশের যে কোনও প্রান্তে বক্তৃতায় বা সাক্ষাৎকারে মমতার নাম টেনে আনছেন। পাশাপাশি সিপিএম ছাড়া বিরোধী শিবিরের নেতারাও সম্মিলিতভাবেই তাঁর পাশে আছেন। আর আগামী লোকসভা যে হাং হচ্ছে, তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই, মোদি-শাহর আগ্রাসী মনোভাব দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। ফলে ভবিষ্যৎ সরকার নির্ভর করবে মমতা ও মায়াবতীর স্থানাঙ্কে।