Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ভালোবাসার দ্যুতি

শতাব্দী দাশ

 

আপাতভাবে সহজ ও স্বাভাবিক একটি ঘটনা৷ ভারতের এই মুহূর্তের দ্রুততম মানবীদের অন্যতম, এশিয়ান গেমস সহ নানা ইভেন্টে পদকপ্রাপ্ত দ্যুতি চাঁদ, ওড়িশার গ্রামের মেয়ে। তিনি ঘোষণা করলেন, মনের মানুষ খুঁজে পেয়েছেন। দ্যুতি ক্রীড়া জগতের সেলিব্রিটি। সুতরাং পেজ-থ্রি-খবর হতেই পারে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক, প্রেম ইত্যাদি ঘিরে। যদিও ক্রিকেটার নন এবং পুরুষ নন, তবুও এসব হয়ত হতেই পারত। কিন্তু ঘটনাটি আসলে সূচনা-লগ্ন থেকেই তেমন সহজ ছিল না। দ্যুতির স্বীকারোক্তির লিঙ্গরাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম৷ তাই কখনও সংবাদপত্রের প্রথম, দ্বিতীয় পাতায়, কখনও বা প্রথম সারির নিউজ-পোর্টালগুলিতে জায়গা করে নিচ্ছিল খবরটি৷ ষাটের দশকে দ্বিতীয় তরঙ্গের ফেমিনিজমের উত্থানের সময় স্লোগানে, ফেস্টুনে, প্লাকার্ডে যে বহুপ্রচলিত বাণীটি শোভা পেত, সেটির যাথার্থ্য যেন আরেকবার প্রতিষ্ঠিত হল। Personal is Political. ব্যক্তিগতই রাজনৈতিক।

কারণটি এখন আমরা সবাই জানি। দ্যুতি নেহাত পরিচিত বা বন্ধুমহলে সম্পর্কের কথা ঘোষণা করেছেন, এমনটা নয়। রীতিমতো সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে তিনি তা করেছেন। তেইশ বছরের দ্যুতি বলেছেন, কোনও পুরুষকে নয়, নিজের রাজ্যের, নিজের এলাকারই এক মেয়েকে ভালোবাসেন তিনি, গত কয়েক বছর ধরে৷ বিবৃতি দিয়েছেন:

“I have found someone who is my soulmate. I believe everyone should have the freedom to be with whoever they decide they want to be with. I have always supported the rights of those who want to be in a same-sex relationship. It is an individual person’s choice.”

অতঃপর? প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন দ্যুতির ভক্ত ও অনুগামীরা। সমাজকর্মীরা ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকরা তাঁর সৎসাহসের প্রশংসা করেছেন। অভিনন্দন জানিয়েছেন ক্যুয়ার কমিটির মানুষরাও। কারণ দ্যুতির মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বর একটা প্রেস বিবৃতি তাঁদের লড়াই-এর জেদ, সাহস অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। ‘নজরিয়া’ সংস্থার রেয়াংশ নারঙ্গ যেমন মনে করেন, এরপর অন্যান্য সমকামী অ্যাথলিটরাও জড়তা ভেঙে ঘুরে দাঁড়াবেন। আবার, যে কিশোর-কিশোরীরা নিজের সমকামিতা বুঝে ফেলার পর প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও ক্রীড়াজগতে পদার্পণ করতে ভয় পাচ্ছে, তারাও ভরসা পাবে বলে তাঁর বিশ্বাস। প্রখ্যাত হকি-খেলোয়াড়, এককালে ভারতীয় হকি দলের অধিনায়ক, বীরেন রাসকিয়া বলেছেন, এটি এক অভূতপূর্ব ঘটনা৷ বলেছেন, ভারতীয় ক্রীড়াজগতে লিঙ্গ-সচেতনতা প্রায় শূন্য এবং সমকাম-ভীতি যথেষ্ট। পুরুষরাও মুখ ফুটে বলে উঠতে পারেন না যে তাঁরা সমকামী। বরং টিভিতে হার্দিক পাণ্ড্যর টক্সিক ম্যাস্কুলিনিটির যে প্রদর্শন শোরগোল ফেলেছিল, সেটাই ক্রীড়াজগতে একরকম স্বাভাবিক ৷ তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে বেশি পেশিশক্তি প্রয়োজন যেসব খেলায়, যেমন রাগবি, সেসব খেলার খেলোয়াড়দের মধ্যেও কেউ কেউ সমকামী। কিন্তু তাঁরা ‘ক্লজেট’ থেকে বেরোতে ভয় পান। এখানে মৃদুভাষী পুরুষকেই ‘মেয়েলি’ বলে অপমান করা হয়, ‘সমকামিতা’ জানাজানি হলে তো কথাই নেই৷ দ্যুতির সৎসাহস সেক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। দ্যুতিই প্রথম ভারতীয় অ্যাথলিট যিনি ‘ক্লজেট’ ভেঙে বাইরে এলেন।

কিন্তু শুধুই কি সাহস? অসহায়তা নয়? প্রাথমিকভাবে দ্যুতির প্রেমের খবর জানার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আমরা এটাও জানতে পারলাম যে দ্যুতি আসলে ভয় পেয়েছিলেন। উৎকণ্ঠায় বাঁচছিলেন তিনি অনেক দিন ধরেই৷ দিদি সরস্বতী চাঁদ ক্রমাগত আর্থিকভাবে শোষণ করছিল তাঁকে৷ পরিবারের মানুষই ভয় দেখাচ্ছিল, তাঁর সমকামী পরিচয়ের কথা জানিয়ে দেবে সবাইকে৷ এভাবেই নাকি দ্যুতির কেরিয়ার নষ্ট করে দেওয়া যাবে৷ দ্যুতি স্বীকার করেন, নিত্যদিন উদ্বেগে কাটত তাঁর। ফ্যানকুল ঘৃণা করবে না তো তাঁকে? সহ-অ্যাথলিট, কোচরা কী বলবেন? কিন্তু শেষ পর্যন্ত, দু’তিন মাস আগে দিদি পঁচিশ লক্ষ টাকা দাবি করে৷ দ্যুতির ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। ঠিক করেন, সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে নিজেই স্বীকার করবেন নিজের সম্পর্কের কথা। শুধু তাই নয়, নিয়মিত মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের কথাও দ্যুতি বলেছেন। বলেছেন, পরিবারে টাকা দিতে দেরি হলেই তাঁর যৌনতা ঘিরে বাঁকা কথা শুনতে হত। বলেছেন দিদির হাতে মার খেয়ে থানায় যাওয়ার কথাও। পুলিশ নাকি তাঁদের ‘পারিবারিক বিষয়’ পরিবারেই মিটিয়ে নিতে বলে।

দ্যুতি কি তাঁর পরিবারকে অবহেলা করতেন? উত্তরে দ্যুতি বলেন, ন’জনের পরিবারে মোট ছয় বোন। কেন শুধু মা আর সরস্বতীই কথা বলছে মিডিয়ায়? বাকিদের জিগ্যেস করা হোক। দ্যুতি ওএমসি-তে চাকরি পেয়েছেন বছর দুয়েক আগে৷ মাইনে ত্রিশ হাজার। সংসার তিনিই চালাতেন বলে দাবি তাঁর। কিন্তু ২০১৮ সালে মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক তিন কোটি টাকা দেন দ্যুতিকে, এশিয়ান গেমসে রুপো জিতে আসার পুরস্কার হিসেবে। দ্যুতির কথায়, এরপরেই লোভ লাগামছাড়া হয় মা-বোনের। দ্যুতি তাঁর পরিবারকে পুরষ্কারের অর্থের কতখানি ভাগ দিয়েছিলেন, আমরা জানি না৷ কিন্তু জানি, ভারতীয় ধারণা অনু্যায়ী, মা-বাবা বা পরিবার সন্তানের সমস্ত অর্জনের উপর অধিকার দাবি করতে পারেন, তার সমস্ত পছন্দ-অপছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন৷ এঁদের সমালোচনা সচরাচর সামাজিকভাবে বরদাস্ত করা হয় না। আর জানি, দ্যুতি যদি তাঁর পরিবারের সঙ্গে আদৌ সহযোগিতা না করেও থাকেন, তাহলেও তাঁর যৌন পছন্দের কথা বারবার তুলে তাঁকে লজ্জিত করা যায় না। ব্ল্যাকমেইল তো অবশ্যই করা যায় না৷

ঋতুপর্ণ ঘোষ বলেছিলেন,’সমকামী’-র থেকে ‘সমপ্রেমী’ কথাটাই বেশি পছন্দের তাঁর৷ কারণ বিষমকামী সম্পর্কের মতো এই সম্পর্কও শুধু বিছানা ঘিরে আবর্তিত না-ই হতে পারে। দুজন মানুষ পরস্পরকে ভালোবেসে পাশাপাশি হাঁটতে, একসঙ্গে সময় কাটাতে, বই পড়তেও চাইতে পারেন৷ যৌনতাও থাকে,কিন্তু শুধু তা-ই থাকে, এমন নয়। থাকে পারস্পরিক নির্ভরতাও৷ বিষমকামীদের মতোই সমকামীরা অনুভূতিপ্রবণ হতে পারেন। তাঁদের অসহায়তা, দুর্বলতা, ভালোবাসা পাওয়ার আর্তি থাকতে পারে। সেই আর্তিই শোনা গেল না কি দ্যুতির গলায়, যখন বললেন, ‘মুঝে ভি কিসিকা সাহারা চাহিয়ে?’ বার বার হরমোনাল কারণে বাদ পড়া দ্যুতি, দীর্ঘ লড়াই জিতে আবার ফিরে আসা দ্যুতি, এশিয়াডে রুপো জেতা দ্যুতি, পরিবারের নির্যাতনে বিধ্বস্ত দ্যুতি কোনও এক মানুষকে আঁকড়ে বাঁচতে চাইছেন এই মুহূর্তে, মনে হল। এবং তাঁর মনে হচ্ছে, সেই মানুষকে খুঁজে পাওয়া গেছে অবশেষে। এই উপলব্ধিই শাশ্বত তাঁর কাছে। শুভেচ্ছা,ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু প্রাপ্য হতে পারে না তাঁর। টিটকিরি বা ঘৃণা তো নয়ই।

ভুবনেশ্বরের প্রেস-কনফারেন্সে সাংবাদিকদের তিরষ্কারও করেন দ্যুতি, বিনা অনুমতিতে তাঁর সম্ভাব্য প্রেমিকার নাম প্রকাশ করার জন্য৷ বিয়ে করবেন কি তাঁরা? ভারতে সমকামী বিবাহ আইন নেই। আবার সামাজিকভাবে একসঙ্গে থাকতে বাধাও তো নেই কুখ্যাত ৩৭৭ ধারার সংশোধনের পর। কিন্তু দ্যুতির সামনে এখন টোকিও অলিম্পিকস৷ তাঁর প্রস্তুতিই এখন পাখির চোখ৷ ভবিষ্যতে অবশ্যই ঘর বাঁধতে চান প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গে৷

ওড়িশার জয়পুর জেলার চক গোপালপুর গ্রামের দ্যুতি চাঁদ কখনও ভাবেননি, ভারতীয় লিঙ্গরাজনীতির ইতিহাসে তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠবেন। একবার নয়, বার বার। ২০১৮ সালে এশিয়াডে ১০০ মিটারে রুপো এনেছিলেন যখন, তখন তা ছিল এমনকি সৌরভ গাঙ্গুলির চেয়েও বড় এক কামব্যাক, ভারতীয় খেলাধুলোর ইতিহাসে।

কেন? কারণ ২০১৪ সালেও অপ্রত্যাশিত কিছু ঝড় উঠেছিল দ্যুতির জীবনে। কমনওয়েলথে তাঁর যাওয়ার বন্দোবস্ত তখন চূড়ান্ত। এমন সময় খবর পেলেন, তাঁকে অ্যাথলেটিক ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া বাদ দিয়েছে। একই বছর এশিয়ান গেমস-এও যাওয়া হয় না তাঁর। কারণ হিসেবে বলা হয়, তাঁর Hyperandrogenism আছে। ওড়িশার মেয়েটি জানতেনও না তার আগে, ‘টেস্টাস্টেরন’ কাকে বলে! ‘ইন্টারসেক্স’-ই বা কী! লোক ঠকাননি। পুরুষ হয়ে নারীর ছদ্মবেশ ধরেননি। ডোপিং করেননি৷ তাও শুনতে হল, তিনি হলেও হতে পারেন ‘পুরুষ’। অন্য নারীদের থেকে বেশি ‘পুরুষ হরমোন’ থাকায় তিনি অন্য মহিলাদের থেকে বাড়তি সুযোগ পাবেন। তাই তিনি নাকি বাদ পড়তে পারেন অলিম্পিকের নিয়ম অনু্যায়ী। সুতরাং কমনওয়েলথ বা এশিয়ান গেমসেও তাঁকে খেলিয়ে লাভ নেই। এভাবেই ভেবেছিলেন ভারতীয় কর্মকর্তারা৷

ভেবে দেখুন, ছয় ফুট লম্বা একজন অ্যাথলিটও কিন্তু পাঁচফুটের চেয়ে কিছু ‘বাড়তি সুযোগ’ পান৷ অন্য নানা শারীরিক কারণেও নানা রকম ‘সুবিধা’ পাওয়া যেতে পারে খেলাধুলোয়, ঠিক যেমন ভাবে উচ্চমেধাসম্পন্ন ছাত্রছাত্রী বাড়তি সুযোগ পান পড়াশুনোয়। এঁদের খেলাধুলা বা পড়াশুনোর অধিকার কিন্তু কেড়ে নেওয়া হয় না৷

দায়িত্বপ্রাপ্তরা ভেবেও দেখেননি হয়ত, হঠাৎ আজন্মলালিত লিঙ্গপরিচিতি ছিনিয়ে নিলে মানুষ দিশেহারা বোধ করতে পারে, তার পায়ের তলা থেকে জমি সরে যেতে পারে। এমতাবস্থায়, ভুক্তভোগীর সামনে একদিকে থাকে নিজের পরিচয় নিয়ে নিজেরই বিভ্রান্তি। অন্যদিকে প্রতারণার অভিযোগ। তদুপরি সমাজের নানা প্রশ্ন— তিনি কি তবে পুরুষ? বৃহন্নলা? রূপান্তরিত? অন্য কেউ হলে ভেঙে পড়তে পারতেন৷ কেরিয়ারের সেখানেই ইতি ঘটতে পারত। কিন্তু দ্যুতি রুখে দাঁড়ালেন। বাকিটা ইতিহাস। অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারসেক্স লয়ার-রা দ্যুতির হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। দ্যুতি মামলা দায়ের করেন আন্তর্জাতিক সিএএস (Court of Arbitration for Sports)-এ। শেষপর্যন্ত, মহিলাদের খেলার ক্ষেত্রে, ডাক্তারি পরীক্ষায়, টেস্টাস্টেরনের মাত্রাকে বহিষ্কারের কারণ হিসেবেই নাকচ করা হয়। এবং তা করা হয় “Dutee Chand vs. Athletics Federation of India (AFI) & The International Association of Athletics Federations (IAAF)”-এই মামলার ভিত্তিতে, ২০১৫ সালে, সিএএস-এর দরবারে। তার তিনবছর পরেই ঘটেছিল সেই রুপো জয়ের ঘটনা৷ তাই শুধু দ্যুতির নিজের নয়, পিঙ্কি প্রামাণিক বা শান্তি সৌন্দর্যায়ন-এর মতো আজন্ম-নিজেকে-মেয়ে-বলে-জানা-কিন্তু-হঠাৎ-পরীক্ষায়-‘অ-নারীসুলভ’-হিসেবে-নাকচ-হওয়া আরও বহু খেলোয়াড়ের কামব্যাক ছিল সেটি। সেই ছিল প্রথমবার। তারপর ২০১৯ সালে আবার একবার ভারতের লিঙ্গ-রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠলেন দ্যুতি, শুধু নিজের ভালোবাসার কথা মুক্তকণ্ঠে উচ্চারণ করে৷

সদ্য প্রকাশিত হয়েছে লোকসভা নির্বাচনের ফল৷ এলজিবিটিকিউ মানুষের দাবিদাওয়া বড় একটা জায়গা পায়নি বিজয়ী দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিপত্রে৷ বরং ৩৭৭ ধারার সংস্কার মেনে নিতে বিজেপি নেতাদের আপত্তি ছিল বলেই জানা গেছিল। নির্বাচনী প্রচারে তাঁরা শুধু ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের ক্ষমতায়নের অস্পষ্ট, নামমাত্র ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।

প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস ‘নাজ ফাউন্ডেশন’-এর সঙ্গে কিছু কাজ করেছিল, এলজিবিটিকিউ মানুষের দাবিদাওয়া জেনেছিল এবং ৩৭৭ ধারার সংস্কারেও তাদের ভূমিকা ছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ের “Effective implementation” করা হবে, এরকম ধোঁয়াশাপূর্ণ প্রতিশ্রুতি ছাড়া তাদের ম্যানিফেস্টোতেও কিছু ছিল না৷ সমলিঙ্গ বিবাহের কথা ছিল না, সমকামী মানুষের দত্তক নেওয়ার অধিকার, পারিবারিক সম্পত্তিতে অধিকার ইত্যাদির কথাও ছিল না৷ বরং সিপিআইএম-এর ম্যানিফেস্টো পড়লে বোঝা যায়, এঁরা এই গোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন, তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে তাঁদের সঙ্গেই সভা করেছেন। ট্রান্সজেন্ডার বিল সংশোধন, সমলিঙ্গ বিবাহ আইন, এলজিবিটিকিউ মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করবে এরকম বৈষম্যবিরোধী আইন আনার প্রতিশ্রুতি সেখানে ছিল৷

কিন্তু ক্ষমতায় এল সেই দলই, যাদের লিঙ্গসাম্যের বোধ, এলজিবিটিকিউ আন্দোলন নিয়ে সহানুভূতি সবচেয়ে সন্দেহজনক। এই হতাশার মুহূর্তেই দ্যুতিদের ভালোবাসাবাসির কথা জানলাম আমরা। সংবিধান বৈষম্য শেখায় না— যাপনে না, আচরণে না, অধিকারে না, প্রেমে না, যৌনতায় না৷ সেই মেয়েদুটি যারা নন্দীগ্রামে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়েছিল, সেই মেয়েদুটি যারা ঝাঁপ দিয়েছিল সবরমতীতে, সেই ছেলেটি যার বিয়ে দেওয়া হয়েছিল জোর করে, সেই ছেলে যে প্রকাশ্যে প্রেমিকের হাত ধরতে ভয় পায়, সেই মেয়ে যাকে ‘নারী’ করে তুলতে ধর্ষণ করেছিল কাকা বা দাদা, সেই বালক বা বালিকা যে বয়ঃসন্ধিতে নিজের অন্য যৌন ইচ্ছা চিনতে পেয়ে লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে, সেই অধ্যাপক যাঁর চাকরি গিয়েছিল আলিগড়ে আর তারপর মারা গেছিলেন রহস্যজনকভাবে— তারা/তাঁরা সকলে ‘বিপ্লবী’ নয়/নন, স্বভাবত৷ সকলে হয়ত সাহস করে রামধনু মিছিলে হাঁটতে পারেনি বা পারেননি৷ কেউ কেউ প্রেমকে বরণ করতে চেয়েছিলেন নিভৃতে, রাজপথে নয়। তাঁরা মরে গেছেন, হতাশায় তলিয়ে গেছেন। তাঁদের অনেকের স্বর হয়ে উঠলেন ক্ষিপ্রগতি দ্যুতি চাঁদ।

প্রয়োজনীয় প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ হয়ত আজ তাঁকে প্রেমের প্রকাশের ক্ষেত্রেও চিৎকৃত করে ছেড়েছে। অথচ ভালোবাসা তো সবচেয়ে কোমল আশ্রয়। পাখির বুকের মতো ওম তার৷ ভাবতে ভালো লাগে, টোকিওতে দৌড়চ্ছেন এক কৃষ্ণহরিণী৷ আর সুদূর ওড়িশায় টিভির পর্দায় চোখ রেখে তাঁর জন্য প্রার্থনা করছেন কেউ। এই ‘ব্যক্তিগত’ পাওয়াটুকুর জন্যই সব ‘রাজনৈতিক’ প্রতিরোধ। এই হয়ত ‘Personal is Political’ স্লোগানের কাঙ্খিত পরিণতি!