Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পেশোয়ার এক্সপ্রেস, ছুটছে বর্ধিত বগি

রুখসানা কাজল

 

এঁটো থালাবাসন ধুতে ধুতে অ্যানাউন্সমেন্টটা শুনতে পায় ওরা। ফাইনালি তাহলে আজই শেষ হল রোজা! কাল ঈদ। উহ্‌ বাঁচলাম আল্লাহ্‌! মনে মনে হাঁফ ছাড়েন রাবেয়া মির্যা।

শরীর আর নিতে পারছিল না। বুকের কাছে দমটা যেন আটকে ছিল এই কটা দিন। রোদদগ্ধ গাছের মত নেতিয়ে পড়ছিল শরীর। পানি পানি করে হাহাকার জুড়েছিল প্রাণ।

কিচেনে হালিমের বাটি ধুয়ে মুছে রাখছিল নাসিমাবুয়া। ঈদ মোবারক বলে ওর দিকে তাকিয়ে মন ভাল হয়ে যায় রাবেয়া মির্যার। কিচেনের সাদা আলোয় বুয়ার মুখে হাসি উথলে পড়ছে। স্ক্রাবে সাবান লাগিয়ে কেমন আনন্দিত ফুর্তিতে বাটিগুলো ধুয়ে মুছে র‍্যাকে রাখছে। ওর হাসি দেখে এখন মনে হচ্ছে, ঈদ মানে খুশি কথাটা সত্যি।

বিশাল লবিতে পপকর্ণ খেতে খেতে ছেলে রায়হান টিভি দেখছিল। বাটি মোছা শেষ হতেই ছুটে আসে নাসিমবুয়া, ও ভাইয়া শুনিছ, কালকে কিন্তুক ঈদ। সত্যি সত্যি ঈদ। বিটিভি ধরো তো একবার! দেখি চান্দ দেখা হুজুররা কী বলতিছে!

অনেকদিনের বুয়া। রায়হানকে কোলে পিঠে করে বড় বোনের মত লালন করেছে। ছোটবেলা থেকেই রায়হান ওকে খালাবুবু বলে ডাকে। টিভি দেখা নিয়ে নিত্যদিন ঝগড়া লেগেই থাকে দুজনের। আজ কিন্তু অন্যদিনের মত কোনওরকম ওজর আপত্তি তর্ক না করেই স্পোর্টস ওয়ার্ল্ড ছেড়ে বিটিভি ধরে চেঁচিয়ে ওঠে রায়হান, ওয়াও ওয়াও! ঈদ মোবারক খালাবুবু। ঈদ মোবারক আম্মু। খালাবুবু আপনার স্পেশাল চিকেন ফ্রাই কিন্তু মাস্ট মাস্ট মাস্ট। ইয়াহু—

নাসিমবুয়ার মুখে হাসি ছলকে ওঠে। মায়ের চাইতে বুবুর উপর রায়হানের বায়না বেশি। কুলকুল করে ওঠে মন। একুশ বছরের ভাইয়াটাকে একুশ মাসের শিশুর মত লাগছে এখন। কি ছেলেমানুষ! খাওয়ার লোভে নাচছে দেখো। আহারে সোনামোনা ভাইটা আমার!

পাড়ায় পাড়ায় মাইকিং করতে বেরিয়ে পড়েছে মসজিদ কমিটির লোকেরা, ঈদ মোবারক! ঈদ মোবারক! ঈদ মোবারক!

গ্যাস বার্নার মুছতে মুছতে নাসিমাবুয়া হাসে, এখন আর মাইনসেরে ঈদের জন্যি চান্দ হুজুরগো উপর হাপিত্যস করি বসি থাকতি হয় না বোঝছেন খালাম্মা। বছরে একেক জায়গায় একেক দিন ঈদ হতিছে তা দেখিতিছেন তো? হুজুররা ভাগ করি নেছে গোডা দেশডারে—

রাবেয়া মির্যা কিচেন টাওয়ালে ভিজে হাত মুছে ধমক দেন, যার যেমন খুশি ঈদ করুক। তুই তোর কাজ কর তো নাসিমা। কাউতারি করিস না এসব নিয়ে। তোর খালুআব্বা শুনলে কিন্তু চেঁচামেচি শুরু করে দেবে।

গরমজলে লিকুইড সাবান ঢালতে ঢালতে নাসিমা রাগ দেখায়, খালুআব্বার মাথাটা এক্কেরে গেছে গ্যা। হুজুরগেরে কেউ বিশ্বেস করে! ও খালাম্মা অই হারামজাদারা না যুদ্ধের সময় পাকিস্তানিগোর কাছে আমাগের মাইয়াগো ধইরা ধইরা দিছিল! মাগো মা এগের যে ক্যান খালুআব্বা এত এত চান্দা দেয় বুঝি না কিছু!

রাবেয়া মির্যা চাপা ধমক দিয়ে বেরিয়ে আসেন কিচেন ছেড়ে।

তার স্বামী মসজিদবাসী। গোটা রোজার মাস তিনি মসজিদেই থাকছেন। যাওয়ার আগে কড়া করে বাসায় বলে গেছেন, সবাই যেন সহিমত রোজা নামাজ করে। ছেলে রায়হান অবশ্য রোজা করে তের চৌদ্দ বছর বয়েস থেকে। কিন্তু এবার ক্ষেপে গেছে। আব্বু কি জোর করে আমাদের ধর্ম পালন করাতে চায় নাকি আম্মু! করব না রোজা। দেখি কী করে!

অনেক অনুরোধে রায়হান সেহরি খাচ্ছে বটে কিন্তু মসজিদে যাচ্ছে না। রাবেয়া মির্যার সন্দেহ, নাসিমাবুয়া লুকিয়ে চুরিয়ে লাঞ্চও বানিয়ে দিচ্ছে রায়হানকে!

তিনি বুঝেও না বোঝার ভান করে তসবিহ গোনেন। কিন্তু বার বার তার গণনায় ভুল হয়ে যায়। তার আঙুলের ডগায় অসন্তোষ ফণা তোলে। সত্যি তো জোর করে কেন ধর্মের জুজু দেখাবে আমানুল্লাহ মির্যা? সে কি ভুলে গেছে এই ধর্মের জুজুর ধাওয়া খেয়ে তারা সেই কবে নিজের দেশ গুজরাট থেকে পালিয়ে এসেছিল এই দেশে? খুব বেশিদিনের ঘটনা কি? মাত্র তো সত্তর বছর।

তার মনে অজান্তেই একটা ভয় জাগে, তার স্বামী দেশটাকে পাকিস্তান আফগানিস্তান বানানোর দলে নাম লিখিয়ে ফেলেনি তো! এত ধর্মের বাড়াবাড়ি আগে তো ছিল না! তাদের পরিবারে ধর্মপালন ছিল নিত্য জীবনের সঙ্গে আনন্দ নিয়ে। এমন জুলুম কখনও ছিল না।

রায়হানদের দোতলা বারান্দার কোল ঘেঁষে হুজুরদের ছোটখাটো একটি মিছিল এসে থেমে যায়। একজন তরুণ হুজুর হ্যান্ড মাইকে চেঁচিয়ে ওঠে, মুমিন মুসলমান ভাইসব আস্লামুআলাইকুম। শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেছে। ঈদ মোবারক। ঈদ মোবারক। আগামীকাল পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঈদের প্রথম জামাত শুরু হবে সকাল আটটা নাগাদ।  নামাজী মুসুল্লিভাইদের সবিনয়ে অনুরোধ জানানো হচ্ছে, পবিত্র ঈদের নামাজ পড়তে তারা যেন কেবলমাত্র জায়নামাজ সাথে নিয়ে মসজিদে আসেএ এ এএন।

ভাইসব আমি আবার বলতেছি, মনোযোগ দিয়ে শুনেন সবাই। মসজিদ কমিটির নির্দেশ মোতাবেক আপনারা কেবলমাত্র জায়নামাজ সাথে নিয়ে নামাজ পড়তি আসবেএএএন।

রাবেয়া মির্যা রোযার ধকলে ক্লান্ত অবসন্ন। শুয়ে পড়েন ডিভানে। মনে মনে ভাবেন, কী দিন যে আসল! ঈদের জামাতও এখন সেভ নয়। গত ঈদে শোলাকিয়ায় যা হয়ে গেল! তার আগে গুলশানের হলি আর্টিজানের দেশবিদেশ কাঁপানো ঘটনায় তার প্রিয় বান্ধবী জিনাত খুন হয়ে গেছে। নৃশংস সে খুন। সত্যি মানুষ অমানুষ হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। জঙ্গি জংলিগুলো উৎসব আনন্দের দিনগুলোকেই টার্গেট করছে মানুষ হত্যার জন্যে। এভাবে কি কখনও কোনও ধর্ম জিততে পারে!

অভ্যাসমত মাথার কাছে মোবাইল রেখে বুকচেরা একটি ভেজা শ্বাস ফেলেন তিনি। পা গুটিয়ে নিজেকে ছোট করে চোখ বন্ধ করে রাখেন। ঈদের কয়েকটা দিন নিঃশ্বাস ফেলা দায় হবে। রান্নাবান্না গেস্ট সামলাতে কোমর ভেঙে যাবে প্রায়। আগেভাগে কিছু করে রাখলে তবু কিছুটা রিলিফ পাওয়া যেত। শরীরটাও কেমন অবসন্ন লাগছে। কিছুই করতে ইচ্ছা করছে না তার।

তার উপর আজ সকাল থেকেই জিনাতকে বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে। সানরাইজ প্লাজার ‘বিশাল বাংলা রং’-এর দোকানে সেদিন শাড়ি দেখতে গিয়ে মনে হয়েছিল, জিনাত বেঁচে থাকলে নীল হলুদ পাড়ের কটন লাল শাড়িটা ফার্স্ট চয়েসেই কিনে ফেলত। লাল খুব প্রিয় রং ছিল জিনাতের। সেলস গার্লের তির্যক দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে অনেকক্ষণ ধরে শাড়িটাকে ধরে ধরে দেখছিলেন রাবেয়া। কী যে উথালপাথাল কান্না পাচ্ছিল তার!

সেদিন হলি আর্টিজান হোটেলে তারও থাকার কথা ছিল। হালকা শপিং শেষে ইফতারিটা একটু অন্যরকম করবে বলে জিনাতের সঙ্গে প্রোগ্রাম ফিক্স করা ছিল। কিন্তু তিনি যেতে পারেননি। হঠাত কিছু গেস্ট এসে পড়েছিল বাসায়। আরেক দিন হবে বলে তিনি জিনাতকে ফোনে বলেছিলেন, স্যরি রে দোস্তো। হঠাত গেস্ট এসে পড়েছে। চান রাতে বেরুব। কথা দিচ্ছি সিওর। টেক কেয়ার। বাইইইই—

পেটের ডানদিকে সেই ব্যথাটা আবার জানান দিচ্ছে। হাত দিয়ে চেপে রেখে চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকেন তিনি। তার দুচোখ জুড়ে অকাল শিশির কান্না হয়ে বয়ে যাচ্ছে শরীর আর মনে।

দীর্ঘ রোজাকাল। তায় সারাটা দিন আগুনের মত মাথার উপর সূর্য তাপাচ্ছে। একেবারে এলিয়ে পড়েছেন রাবেয়া মির্যা। শরীরের প্রতিটি সুতো খুলে পড়তে চাইছে যেন। আজ দুপুরের দিকেই মনে হচ্ছিল, আর পারছেন না। রোজা মনে হয় ভেঙেই ফেলতে হবে। ডানদিকের পেটে থেকে থেকেই চিলিক মেরে উঠছিল একটা তীব্র ব্যথা। গরম হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছিল সমস্ত পেট জুড়ে। এরকম আগে কখনও হয়নি। এই প্রথম। তবে ব্যথাটা তেমন মারাত্মক হয়ে ওঠেনি এই যা রক্ষে।

ছুটকাছাটকা ব্যথাবেদনাকে তিনি অবশ্য তেমন পাত্তা দেন না। বয়েস পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে এই সেদিন। ডাক্তারি জার্নাল পড়ে জেনেছেন এখন শরীর বুড়ো হচ্ছে। এরম অফ অন মাঝেমধ্যেই হবে। হতেই থাকবে। মানুষের শরীর তো একরকম যন্ত্রই।

এভাবেই একদিন চিরকালের স্লিপ মুডে চলে যাবে শরীর। এ তো দুনিয়ার চিরন্তন নীতি। তাই ভয় তিনি তেমন পান না। স্বাভাবিক মৃত্যুকে ভয় কী!

তবে শরীরের চেয়ে তার মন বেশি খারাপ। শেষ পর্যন্ত তার স্বামী এতটা ধর্মান্ধ হয়ে যাবে এটা তিনি ভাবতেও পারছেন না। জঙ্গিদের হাতে প্রিয় বান্ধবী খুন হয়ে যাওয়ায় আজকাল বড় নির্জীব লাগে তার। নিজের কাছে নিজেকে বড্ড ভারী লাগে যখনতখন। তার সুখপাখি বন্ধুটা যে নেই আর।

মাঝে মাঝে অজানিত একটি ভয় শিরদাঁড়া বেয়ে চিনচিন করে ওঠে। জিনাত খুন হওয়ায় তিনি আর রায়হান প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলেন। পাগলের মত কেঁদেছিলেন। ফেসবুক থেকে প্রেসক্লাব, শাহবাগের প্রতিটি প্রতিবাদ সভায় তারা মা ছেলে নাসিমাবুয়া সরবে অংশ নিয়েছিল। নাসিমাবুয়া তো হায় হায় করে মাতম করে উঠেছিল। কিন্তু তার স্বামী আমানুলাহ মির্যা কেমন নির্লিপ্ত মুখে খবরগুলো দেখে উঠে চলে গেছিল নিজের রুমে। অথচ পারিবারিকভাবে জিনাত তারও বন্ধু ছিল। বেশ ভালো বন্ধু। কত কথা, গল্প। খুনসুটি। তবে!

তবে কী?

আজকাল রাবেয়া মির্যা ঘরেই থাকেন বেশিটা সময়। জিনাতের উপহার দেওয়া শাড়ি, হিজাবগুলো নেড়েচেড়ে দেখেন। মাঝে মাঝেই কাজে বা ঘুরতে এদেশ ওদেশ যেতে হত জিনাতকে। নানা রঙের অনেকগুলো হিজাব এনে দিয়েছিল তাকে। যদিও জিনাত কোনওদিন হিজাব পরেনি।

রাবেয়া মির্যা প্রথম যেদিন হিজাব পরা ধরলেন, জিনাত হেসে বলেছিল, তুই কি শান্তি পাচ্ছিস হিজাব পরে? যদি পাস, তো পরবি না কেন? যে যেভাবে বেঁচে সুখ খুঁজে নিক এই পৃথিবীতে। জীবন তো একটাই তাই না রে দোস্তো!

সেই জিনাতকে খুন করে ফেলল ছেলের বয়সি কয়েকজন জঙ্গি! ছেলেগুলোর মন একবারের জন্যেও কি কেঁপে উঠল না! ওরাও তো মানুষ ছিল! নাকি–

বুক ভেঙে কান্না উঠে আসে। হিজাবগুলো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। আলমারির আব্রু খুলে সেগুলো তলোয়ারের মত উড়তে থাকে সমস্ত ঘর জুড়ে। রাবেয়া মনে মনে ভাবেন, এগুলো কি আদতে হিজাব, নাকি জঙ্গিদের খুনাস্ত্র!

বুকের ভেতর কুশন জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। অঘোর ঘুম। শ্রান্ত ক্লান্ত। গোপন দুশ্চিন্তাকে সাথে নিয়ে তিনি হারিয়ে যান ঘুম সম্মোহনের অতল তলে।

ঘুমের ভেতরে তিনি স্বপ্ন দেখেন, ডিভানটা দুলছে। ছন্দিত দোলন। ভালো করে খেয়াল করে দেখেন, কেবল যে দুলছে ডিভানটা তা নয়! কেমন একটা গতির আওয়াজ করে ডিভানটা যেন চলে চলে চলছে। যেন একটা ট্রেন। তিনি ট্রেনের কামরার ভেতর, মধ্যসারির সিটে পা গুটিয়ে বহুদূরের যাত্রীদের মতন নিশ্চিন্ত অভ্যাসে ঘুমিয়ে আছেন।

কিন্তু তিনি যাচ্ছেন কোথায়? ঘুমের ভেতরেই তার মনে প্রশ্ন জাগে, তার এই যাত্রার গন্তব্য কোথায়? বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, জার্মান, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, আফ্রিকা, ফ্রান্স, মায়ানমার! সে কী এ যে চট্টগ্রামের বাঁশখালি এসে পড়েছেন তিনি। কিন্তু তা কী করে হয়! তিনি তো ঘুমুচ্ছিলেন নিজের ঘরে।

রাবেয়া মির্যা ঘুমের ভেতরেই বুঝতে পারেন, তিনি স্বপ্ন দেখছেন। কাল ঈদ। অনেক কাজ পড়ে আছে। শিক কাবাবের জন্যে স্পেশাল মশলা বানাতে হবে। রাজ্যির পেঁয়াজ রসুন আদা ব্লেন্ড করতে হবে। পুরনো মশলায় রান্না করা তিনি একদম পছন্দ করেন না।

খাসির রেজালা, চিকেন রোস্ট, ফ্রাইড চিকেনের মশলা আলাদা আলাদা বানাতে হবে। ছেলে রায়হান মুন্নার দোকান থেকে স্পেশাল কাট্‌ দিয়ে গরুর মাংসের স্টেক এনে রেখেছে। ছেলের বন্ধুদের জন্যে ক্র্যাব ফ্রাই, পোস্তবড়া, বিফ সিজলিং, প্রণ আর ভেজিটেবল আইটেম করতে হবে! আজকাল ছোট বড় কেউই মিষ্টি খেতে চায় না। তবু প্রথা মেনে কিছু মিষ্টির আইটেমও বানাতে হবে। ভাগ্যিস প্রচুর পরিমাণ টিকিয়া বানিয়ে রেখেছিলেন বলে টিকিয়া নিয়ে এখন চিন্তা নেই। কিন্তু ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্নে ভর দিয়ে এরম নিরুদ্দেশের দেশে বেড়াতে গেলে তার এত এত কাজ কে করে দেবে শুনি! তিনি জোর করে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠেন।

আড়মোড়া ভেঙে পা নামিয়ে শিউরে উঠে পা তুলে নেন রাবেয়া মির্যা, আরে একি! একি করে সম্ভব! সমস্ত ট্রেন জুড়ে এত রক্ত কেন? রক্তে থকথক করছে ট্রেনের ধাতব ফ্লোর। কাঁচা রক্তের গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে তার।

চরম ভয় আর আতঙ্কে আঁতকে তিনি চিৎকার করে ডাক দেন, রায়হান রায়হান। তুই কোথায়? এদিকেএকটু আয় তো বাবু। নাসিমা কই গেলি তুই? শিগগির আয়। দেখে যা। একি সর্বনাশ হচ্ছে এখানে।

জমাট থকথকে রক্তের উপর ধোঁয়ার মত ভেসে ওঠে জিনাতের মুখ। আগের মত কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনছে। চোখে মুখে সেই স্নিগ্ধ আলো। তিনি চিৎকার করে ডাক দেন, জিনাত জিনাত… এই জিনাত তুই এখানে! আমরা কোথায় যাচ্ছি রে? এত রক্ত কেন ট্রেনের ভেতর? কোথায় কী সর্বনাশ হল আবার জানিস কিছু?

জিনাতের স্নিগ্ধ মুখে ভয়ের ইশারা। তিনি তাকিয়ে দেখেন টকটকে রক্তে ভেসে যাচ্ছে রায়হান।

আর্তনাদ করে ওঠেন রাবেয়া মির্যা, কী হয়েছে তোর বাবু? এত রক্ত কেন! তোর মাথা মুখে যে রক্তের ফোয়ারা ছুটছে! অ্যাক্সিডেন্ট করেছিস নাকি? কখন? কোথায়? কী করে হল? হায় আল্লাহ, আমি কেন ঘুমিয়ে পড়লাম! আমার ছেলে যে অ্যাক্সিডেন্ট করে মরতে বসেছে! নাসিমা মুখপুড়ি গেলি কোথায়!

উদ্ভ্রান্ত মুখে মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখেন রায়হানের পাশে ফারাজ, তারুশি, অবন্তিকার মুখ। ম্যাম ভয় কী! এই যে আমরাও তো আছি! ওদের তাজা শরীরে রক্তের ফোয়ারা। একিরে! তোরা? তোদের তো নির্বাসরা মেরে ফেলেছিল?

ওরা একসাথে বলে ওঠে, হ্যাঁ, ম্যাম, হলি আর্টিজান ক্যাফেতে জিনাত ম্যামের সঙ্গে জঙ্গিরা আমাদেরকে মেরে ফেলেছিল। কিন্তু আমরা এসেছি আরো লাশ কুড়াতে। ধর্ম ধর্ম করে যারা মারছে, যারা মরছে আমরা তাদের নিয়ে যেতে এসেছি এই ট্রেনে করে।

ট্রেন? আরিব্বাস! তাইতো! কী ট্রেন রে এটা?

কান থেকে হেডফোন খুলে জিনাত হাসে, পেশোয়ার এক্সপ্রেস! সেই যে তুই পড়তে দিয়েছিলিস! কৃষাণ চন্দরের বই! ওটা এখন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেন হয়ে গেছে জানিস তো রাবি! আমরা যারা লাশ হয়ে গেছি, তারা দেশে দেশে ধর্মের জন্যে খুন হয়ে যাওয়া নতুন নতুন লাশ কুড়িয়ে ফিরি এই ট্রেনে। অই দেখ!

চোখের সামনে রক্তাক্ত হয়ে ওঠে ওরা। রক্তাক্ত দেহ। কান থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। বাঁ চোখ গলে  বেরিয়ে এসেছে প্রায়। হাত পা ভাঙা, কাটা। বুক থেকে গলগলিয়ে বেরুচ্ছে রক্ত। রাবেয়া দুহাতে ওদের জড়িয়ে ধরে হাহাকার করে কেঁদে উঠেন, এ কী হল! ও আমার আল্লাহ, এ কী করলে তুমি! দুদিন পরেই যে ঈদ। ওরা কত খুশি হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কত কিছু প্ল্যান করেছিল। আর আজকেই ওদের খুন হতে হল!

চিৎকার করে কাঁদতে গিয়ে বিহ্বল বিস্ময়ে তিনি আমূল কেঁপে ওঠেন।

সমস্ত কামরা জুড়ে কেবল লাশ আর লাশ। নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধের অসংখ্য লাশ। তাদের হাত পা মাথা মুখ পেট বুক ছিন্নবিচ্ছিন্ন। কিছু মুণ্ডুহীন ধড়, নিজেদের কাটা মুণ্ডু কোলে নিয়ে ঘড়ঘড়ে আওয়াজে কী যেন বলতে চাইছে। অন্যরা চেয়ে আছে তার দিকে।

কেউ এক চোখে, কারও চোখ নেই গলে গেছে। কারও দু চোখের কোটরে রক্ত ভাসছে। কারও পেটকাটা। বেরিয়ে এসেছে নাড়িভুঁড়ি। ছিন্নভিন্ন যোনি, কাটা স্তনে রক্ত ঝরছে। শিশুরা চূর্ণবিচূর্ণ। কারও কারও শরীরে স্কুল ইউনিফর্ম। রক্তে ভিজে গেছে, মুছে গেছে নামঠিকানা। ওরা লাশ হয়ে গেছে, কেবল লাশ। নিরুপায়। ভয়াবহ। উৎকট বীভৎস।

রাবেয়া মির্যা আশ্চর্য হয়ে দেখেন, ট্রেনের জানালা, দরোজায় অনেক কাল আগের শুকনো কালো রক্ত নতুন করে গলে গলে পড়ছে। টকটকে লাল তাজা রক্তের পাশে পুরনো কালো রক্তের ধারা মিলেমিশে অগাধ বিভ্রম তৈরি করে নড়ছে, চড়ছে, দুলে যাচ্ছে। চেনা অচেনার ভাপ উঠছে রক্তের ধারা থেকে। এই রক্তসাগর কাদের শরীর থেকে বয়ে এসেছে এখানে? এই লাশগুলো কাদের? কারা এরা?

জিনাত হাসে, অবাক হচ্ছিস কেন রে! তোর তো অনেকেই চেনা! তোর একুশের বইমেলা, প্রিয় আজিজ সুপার মার্কেট। প্রিয় মুখগুলো মনে পড়ে? সেই যে দেশভাগ দেশভাগ আন্দোলন! তোর দাদা দাদির লাশ পড়েছিল গুজরাটে। পাকা ফসলের মাঠে আরও অনেকের সঙ্গে মনে নেই? জ্বলে উঠেছিল হিন্দুপাড়া, মুসলিমমহল্লা। তারপরেই তো শুরু!

রাবেয়া চেঁচিয়ে ওঠেন ভয়ে, তুই থাম, থাম জিনাত। আমি এই দাঙ্গা খুন হত্যা চাই না চাই না।

সরফরাজ, বেটা ছুটে চল্‌, পালিয়ে যা বেটা। রাবেয়া মির্যা দেখেন, তার দাদা দাদি পালাচ্ছে পালাচ্ছে। ধানবতী জমি ভেঙে ছুটছে তারা অনেকেই। দাদির কোল থেকে ছিটকে গেল লায়লাবানু নামের মেয়েটি। দাদার কোলে ছিল আহসান রাজ নামের ছেলেটি। মূহূর্তে টুকরো টুকরো হয়ে গেল সবাই। তার বাবা সরফরাজ, ছোট ভাই শাহনেওয়াজকে নিয়ে লুকিয়ে পড়েছিল পাকা ধানগাছের নিচে। কেউ একজন তাদের বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছিল এই দেশে। দাঙ্গাকে তাই ভীষণ ভয় রাবেয়া মির্যার।

মরিয়া হয়ে চেন টানার চেষ্টা করলে হেসে ওঠে লাশগুলো, এ ট্রেন থামবে না এখুনি। লাশ কুড়াতে যেতে হবে আরও অনেক অনেক দেশে।

সাদা কালো নারী পুরুষ শিশু লাশ হাত নাড়ছে, আরও আরও অনেক দূরে অনেক দেশে যাবে এই ট্রেন। আরও অনেক অনেক লাশ পড়ে আছে পৃথিবীর অনেক দেশে। আরও অনেকেই লাশ হবে। এই ট্রেন আমরাও থামাতে পারিনি ম্যাম।

এ এক লাশটানা ট্রেন আম্মু। রায়হানের সবুজ টিশার্টে বাংলাদেশ লেখা লাল অক্ষরগুলো ভিজে গেছে রক্তে, এই সেই ট্রেন আম্মু। সাতচল্লিশে লাশ টেনেছে, পঞ্চাশ, পঁয়ষট্টিতে লাশ টেনেছে। আবার বেরিয়ে এসেছে লাশ কুড়াতে। এবার আমরা লাশ হয়ে গেছি মাগো।

দিদি গো এই যে আমি, রায়হানের পাশে রক্তাক্ত কোটালিপাড়ার সদাচারী পুরোহিত, গভীর রাইত নামি নামি করিছে, শ্যামাসঙ্গীতের শেষ পদডা কেবল গাতিছি গো দিদি, এমুন সুমায় ওরা আসি গলাডা কাডে ফেলাল। কয় কি শালা মালাউন যা তোগের দেশে চলি যা শুয়োরের বাচ্চারা।

পুরোহিতের পেছনে, সুবল, দীপালি, নারাণ আরও কত মুখ, দুডে একডা মুরতি ভাঙ্গি দেয়, তা সই কিন্তুক ওরা যে আমাগের মারি ফেলাতিছে, ইজ্জত কাড়ি খুনখারাপি করি মারতিছে মাগো।

আম্মিজী, এই যে আমরা আমরা, মোরাদাবাদ, শতাধিক নামাজীর রক্তাক্ত বিপন্ন অসহায় মুখ, ঈদের নামাজ পড়ছিলাম। জামাত শুরু হতেই কারা যেন শুয়োর ছেড়ে দিল নামাজের ময়দানে। তারপর রক্ত আর রক্ত। সেই ময়দানে আর নামাজ হয় না গো। রাতারাতি ফুলকপি হয়ে গেছি আমরা। কেউ আমাদের খুঁজে পায়নিকো।

আম্মিজী আমরা হাসিমপুর, জলগন্ধভরা অর্ধশত লাশ জলগেলা গলায় বলে ওঠে, কেন কী কারণে আজও জানি না, আমাদের মেরে ফেলে দিয়েছিল ওরা এই নদীতে।

পোড়া গন্ধে ভরে উঠে কামরা। নতুন পুরানো হিন্দু মুসলিম শিখ জৈন খ্রিস্টান লাশগুলো ভাইয়ের মত, বোনের মত হাত বাড়িয়ে দেয়, এসো এসো। অসংখ্য পোড়া লাশ পরম যত্নে, আত্মিক আদরে সাবধানে ধরে ধরে একজন আরেকজনকে বসিয়ে দেয়। গলে গলে পড়ছে তাদের মাংস। ধোঁয়াগন্ধ গলায় ককিয়ে ওঠে লাশগুলো, আমরা আম্মিজী আমরা গুজরাট, সবার চোখের সামনে পুড়ে গেলাম আমরা।

আমরা মোজাফফরনগর, আমরা সিলেট, চট্টগ্রাম, বাঁশখালি, নাসিরনগর। খলখল করে জেগে ওঠে বরিশাল, নোয়াখালি, পাঞ্জাব, পেশোয়ার, রাওয়ালপিন্ডি, হরিয়ানা, লংগদু, ভোলা, রংপুর—

রাবেয়া মির্যার আঁচল দীর্ঘতর হয়। কারা যেন হেঁকে বলে, এইইইই খান্ডাওয়ালা খান্ডাওয়ালা, বল্লভগড় হরিয়ানা।

বড় সাজানো গোছানো একটি ছেলে সজল চোখে ঊঠে আসে ট্রেনে। নালিশভরা মুখ। জিনাত ডেকে নেয় কাছে, এসো জুনেইদ। মনখারাপ কোরো না বাছা। অই দেখো ফারাজ, তারুশি—

সদাচারী পুরোহিত জুনেইদের চোখ দেখে কেঁদে ফেলে ঝরঝর করে, গোপাল, ওরে গোপাল আমার। তুমি আসিছ ঠাকুর। এসো এসো। পরম যত্নে তুলে নেয় বুকে।

ফারাজ অবন্তি হাসে, জানিস জুনেইদ গেল বছর আমরাও ঈদ মানাতে পারিনি রে। কাঁদিসনে ভাই। দেখবি? এই দেখ অস্ত্রের দাগ! পুরোহিতের বুকে মুখ লুকোয় জুনেইদ, আম্মি বসে থাকবে। আম্মিকে নতুন কাপড় পরে সালাম করা হল না ভাইয়া !

ট্রেনের ইঞ্জিনে যেন সোঁদা মাটির গন্ধ। কেমন যেন, ‘বাংলা বাংলা, হেঁইয়ো বাংলা, এই তো বাংলাদেশ বলে থেমে গেল ট্রেনটা। ধূমায়িত সন্ধ্যা। আজানের ধ্বনির সাথে নমিত আনন্দে বেজে উঠছে মন্দিরা। মোষের কালো চোখে বিষণ্ণ সন্ধ্যার লালগোলা আলো। কাছেপিঠে কোথাও আত্রাইয়ের বুকে ধীর লয়ে বৈঠা বাইতে বাইতে দিনের মাঝি গান ধরেছে।

লাল গামছায় ঢাকা সদ্য বানানো প্যাড়া হাতে হেঁকে ওঠে এক ফেরিওয়ালা, দিনাজপুর দিনাজপুর এই দিনাজপুর। মা বোনেরা ভাই বেরাদররা প্যাড়া খান। লিন, লিন কে লিবেন গো—

মিষ্টির গন্ধকে ছাপিয়ে ভেসে আসে সদ্য গজানো ধানগাছের তাজা ঘ্রাণ। চঞ্চল হয়ে ওঠে লাশগুলো। ধর্মান্ধ লোকদের হাতে মার খাওয়া ভাঙা দুহাত বাড়িয়ে দেয় জুনেইদ, আয় ধান্য। আয় ভাই।

ভীরু পায়ে উঠে আসে এক কিশোর। মাথায় বুকে খুচরো ধানের ছড়া, ছেঁড়া জামা, ছেঁড়া বোতামঘাট, খালি পা, ঠোঁটের কোণে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত, দুই চোখে সমুদ্র ভাসিয়ে কেঁদে উঠে ধান্য, ওরা আমার মাকে—

রাবেয়া মির্যা বুকের ভেতর জড়িয়ে রাখেন সদ্য খুন হওয়া তখনও উষ্ণ দুটি শরীরকে। খান্দাওয়ালা, হরিয়ানা বল্লভগড়ের জুনেইদ আর দিনাজপুর কাহারোলের ধান্যরাম রায়। দুটি মুখ যেন তার ছেলে রায়হানের মতই।

কে মেরেছে রে তোকে? মুসলমানরা মেরেছে।
কে মেরেছে রে তোকে? হিন্দুরা মেরেছে।

আমি তবে কে? কে আমি? কিশোর ধান্য রায় আর জুনেইদ একসঙ্গে জড়িয়ে ধরে রাবেয়া মির্যাকে। বুকভাঙা হাহাকারের সঙ্গে ট্রেনের দরজায় আছড়ে পড়ে অগুন্তি শব্দ—

আইকাম বাইকাম তাড়াতাড়ি
মরছে মানুষ, পুড়ছে বাড়ি,
রেলগাড়ি ঝমাঝম
তুচ্ছ মানুষ ধর্ম দামী!

 

[ছবি: https://www.dawn.com/news/1208856]