চিত্রদীপ সোম
ঐতিহাসিক যশোর রোড। এক আন্তর্জাতিক মহাসড়ক। কলকাতার শ্যামবাজার থেকে শুরু হয়ে বাংলাদেশের যশোর অবধি যার বিস্তৃতি। দু দেশের যোগাযোগ রক্ষার অন্যতম মাধ্যম। প্রতিদিন কয়েকশো লরি ও কয়েকহাজার মানুষ এদেশ থেকে ওদেশ যাতায়াত করেন এই রাস্তা দিয়ে। ভারতের সবচেয়ে বড় স্থল-বন্দর পেট্টাপোল এই সড়কের উপরেই বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল এই মহাসড়ক। সারি দিয়ে ভারতীয় মিলিটারি ট্রাক, কামান আর ট্যাঙ্কের সারির যাতায়াত দেখেছিল দুই দেশবাসী এই রাস্তা দিয়েই। আবার ওপারে সর্বস্ব হারিয়ে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী এই রাস্তা ধরেই এদেশে এসে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন কোনও একখানে।
যশোর রোডের অন্যতম আকর্ষণ বা সম্পদ এর দুপাশের বিশালাকার মহীরূহগুলি। প্রায় দেড়শো বছরের বেশি পুরানো অতি বৃহদাকার এই বৃক্ষগুলি যেকোনও বৃক্ষপ্রেমী তথা পরিবেশপ্রেমীর মুগ্ধতার সৃষ্টি করবেই। বিশেষ করে বনগাঁ থেকে হাবড়া অবধি যশোর রোডের এই ত্রিশ কিলোমিটার অংশটির দু পাশে লাইন দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এইসব শতাব্দীপ্রাচীন বিশালাকার গাছের সারি। বাজি রেখে বলা যায়, অন্তত এই দেশের কোনও রাস্তায় এত বিশালাকার প্রাচীন গাছের সারি কোথাও নেই। এর নয়নাভিরাম সৌন্দর্য ও শীতল ছায়া মোহিত করে সৌন্দর্যপিপাসু মানুষকে। সন্ধ্যাবেলায় বিশালাকার এইসব গাছের নীচে দাঁড়ালে কানে আসবে নীড়ে প্রত্যাবর্তনরত অজস্র পাখির কাকলি। সংখ্যায় তারা অগুনতি। সারাদিনের ক্লান্তিকর কাজের শেষে এক তৃপ্তির আবেশ নিয়ে পথিক ঘরে ফিরবেন তার প্রিয়জনেদের কাছে।
অথচ প্রশাসনিক একটি তুঘলকি সিদ্ধান্তে আজ এই রাস্তার পাশের গাছগুলি বিপদগ্রস্ত। প্রায় বছর দুই আগে যশোর রোড চওড়া করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সিদ্ধান্ত নিয়েছে এর ফলে বনগাঁ থেকে বারাসাত অবধি প্রায় সাড়ে চার হাজার প্রাচীন গাছ কাটার, যা যেকোনও পরিবেশপ্রেমী মানুষের আঁতকে ওঠার পক্ষে যথেষ্ট। বলাবাহুল্য, এই খবর সামনে আসতেই সোচ্চার হয়ে ওঠেন পরিবেশপ্রেমী বিভিন্ন মানুষ। সোচ্চার হয়ে ওঠে বিভিন্ন পরিবেশপ্রেমী সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠন। সোচ্চার হয় এপিডিআর-ও। গাছ কাটা বন্ধ করতে দ্রুত গড়ে ওঠে ‘যশোর রোডের গাছ বাঁচাও কমিটি’। ছাত্র যুব থেকে শুরু করে মহিলা, গৃহবধূ, অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী, কে নেই সেখানে। বিভিন্ন জায়গায় পথসভা, মিটিং মিছিল, মানববন্ধন করে গাছ কাটার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। ক্রমশ দাবি ব্যাপ্তি পেতে শুরু করে। কলকাতার নাগরিক সমাজেও গুঞ্জন তোলে যশোর রোডের গাছ বাঁচানোর আন্দোলন। আন্দোলনের পাশে দাঁড়ান একাধিক শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী। আন্দোলনকারীদের ডাকে সাড়া দিয়ে ছুটে আসেন পল্লব কীর্তনীয়ার মতো স্বনামধন্য শিল্পীরা। গাছ বাঁচিয়ে কীভাবে রাস্তা চওড়া করা যেতে পারে সেই বিকল্প প্রস্তাবও আন্দোলনকারীদের তরফে সরকারকে দেওয়া হয়। বলা হয়, রাস্তার প্রসার আমরাও চাই, তবে তা গাছ বলি দিয়ে নয়। গাছের সারিকে মাঝখানে রেখে দুপাশে রাস্তা বানানোই যায়। যশোর রোডের উপরেই পেট্রাপোল বর্ডারের কাছে তাই-ই করা হয়েছে অতীতে। দৃষ্টান্ত হাতের সামনেই রয়েছে। অনুসরণ করতে শুধু প্রয়োজন একটু সদিচ্ছা, পরিবেশের প্রতি একটু ভালোবাসা ও সহমর্মিতাবোধ। এছাড়াও যশোর রোডের উপর থেকে যানবাহনের চাপ কমাতে একগুচ্ছ বিকল্প প্রস্তাবও আন্দোলনকারীদের তরফ থেকে সরকারকে দেওয়া হয়। তাছাড়া যেহেতু ইতিপূর্বে গাছের পুরানো ডাল ভেঙে পড়ে মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে যা স্থানীয় কিছু মানুষের ক্ষোভের কারণ হয়েছে, তাই প্রস্তাব দেওয়া হয় বৃক্ষবিশেষজ্ঞ এনে গাছগুলির স্বাস্থ্যের পরীক্ষানিরীক্ষা করিয়ে তাদের নিয়মিত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং দুর্বল, অশক্ত ও পুরানো ডালপালাগুলি নিয়মিত ট্রিম করানোর, যাতে ভবিষ্যতে এ জাতীয় দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। পাশাপাশি দাবি ওঠে যশোর রোডের গাছগুলিকে ‘ন্যাশানাল হেরিটেজের’ তকমা দেওয়ার। গণ আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টার পাশাপাশি কলকাতা হাইকোর্টেও মামলা করা হয় গাছ বাঁচানোর জন্য। বলা বাহুল্য এ লড়াই এক অসম লড়াই। কারণ একদিকে প্রবল শক্তিধর সরকার, দুর্নীতিপরায়ণ নেতামন্ত্রী, আমলা, আর তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা, আর অন্যদিকে সহায় সম্বলহীন কিছু জেদী, একগুঁয়ে পরিবেশপ্রেমী মানুষ। যাদের সম্বল বলতে শুধু বিশালাকার এই গাছগুলির প্রতি বুকভরা ভালোবাসা ও আবেগ। তবুও এই অসম আন্দোলন চলতেই থাকে। অবশেষে হাইকোর্ট গাছ কাটার উপর স্থগিতাদেশ দেয়। সাময়িক জয় হয় আন্দোলনকারীদের।
কিন্তু এখানেই শেষ নয় এ গল্পের। শিকার ফসকে যেতে থাকায় ক্রমশ হিংস্র ও অধৈর্য হয়ে উঠতে থাকে সরকার। হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ অমান্য করেই শুরু হয় বিভিন্ন জায়গায় গাছ কাটা। বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণ নামিয়ে আনতে থাকে আন্দোলনকর্মীদের উপর। পুলিশকে দিয়ে আন্দোলনকারীদের নানাভাবে হেনস্থা করা, থানায় নিয়ে গিয়ে আটকে রাখা ইত্যাদি চিরাচরিত আন্দোলন ভাঙার পদ্ধতির প্রয়োগ করতে শুরু করে সরকার। আসলে এই গাছ কেটে রাস্তা চওড়া করার সিদ্ধান্তের সাথে স্বার্থ জড়িয়ে আছে স্থানীয় নেতামন্ত্রীদের, স্বার্থ জড়িয়ে আছে স্থানীয় কাঠমাফিয়াদের। দেড়শো বছরেরও বেশি প্রাচীন এইসব এক একটি গাছের বাজারমূল্য প্রায় কয়েকলক্ষ টাকা। সোনার মত দামী কাঠ সব। কিন্তু সাধারণ অবস্থায় এসব গাছে হাত দেওয়া কাঠমাফিয়াদের পক্ষে সম্ভব নয়, সরকারি গাছ কাটা আইনত নিষিদ্ধ। অথচ কাঠব্যবসায়ীদের লুব্ধ দৃষ্টি এসব বৃক্ষগুলির উপর বহুদিন ধরে ছিলই। এখন সরকার নিজেই গাছ কাটতে উদ্যোগী হওয়ায় হাতে চাঁদ পায় তারা। কয়েকলক্ষ টাকা দামী এসব গাছের কাঠ জলের দরে মাত্র তিরিশ পঁয়ত্রিশ হাজার টাকায় কিনে নিতে থাকে কাঠ মাফিয়ারা। অর্থাৎ এক একটি গাছ থেকেই লক্ষাধিক টাকার বেশি মার্জিন! সাড়ে চার হাজার গাছ মানে মোট অঙ্কটা প্রায় একশো কোটির কাছাকাছি! ফলে রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘের মতো কাঠমাফিয়ারা সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এই প্রোজেক্টকে বাস্তবায়িত করতে। ঝাঁপিয়ে পড়ে গুন্ডা লেলিয়ে, পুলিশ লেলিয়ে আন্দোলনকে ভাঙার খেলায়।
প্রায় দু বছর ধরে চলা এই আন্দোলন সাময়িক ধাক্কা খায় হাইকোর্টের পরবর্তী রায়ে। এত আন্দোলন, এত কাকুতিমিনতি, তবু হাইকোর্টে শেষ অবধি বিস্ময়করভাবে গাছ কেটে রাস্তা চওড়া করার পক্ষেই রায় দেওয়া হয়। হুকুম দেওয়া হয় রাস্তা প্রসারণের স্বার্থে সাড়ে তিনশো মতো গাছকে বলি দেবার। হাইকোর্টের এমনতর অবাক করা রায়ে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে আন্দোলনকারীদের। যাই হোক, সাময়িক বিহ্বল ভাব কাটিয়ে উঠে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আন্দোলনকে আরও প্রসারিত করার, আরও বৃহত্তর অংশের জনগণকে এই আন্দোলনে যুক্ত করার। আন্দোলনকারীদের বক্তব্য ছিল পরিষ্কার, তাঁরা এর শেষ দেখেই ছাড়বেন। রাষ্ট্রশক্তি তথা তার পোষ্য মাফিয়া, পুলিশ আর নেতামন্ত্রীদের যা কিছু করার আছে করে নিক, তবু একটি গাছও তাঁরা কাটতে দেবেন না। দরকার হলে রক্ত দিয়ে পরিবেশ ধ্বংসকারী এই মারণযজ্ঞ রুখবেন তাঁরা।
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে এবার আপিল করা হয় সুপ্রিম কোর্টে। গাছ বাঁচাতে এগিয়ে আসেন প্রশান্তভূষণ, বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের মতো লব্ধপ্রতিষ্ঠ দুঁদে আইনজীবীরা। পাশাপাশি নেট দুনিয়ায় আবেদন করা হয় পাশে দাঁড়ানোর। আবেদন করা হয় মামলা ও অনান্য আনুষঙ্গিক কাজের জন্য সাধ্যমত অর্থদানের। এবারও আশাতীত সাড়া মেলে। এগিয়ে আসেন অজস্র মানুষ। এগিয়ে আসে একাধিক গণসংগঠন। এপিডিআর তো প্রথম থেকে এই আন্দোলনের পাশে সক্রিয়ভাবে ছিলই, মূলত তাদের কারণেই আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে এতদিন। পাশাপাশি এগিয়ে আসে যুক্তিবাদী সমিতি, সারা বাংলা গণপ্রতিরোধ মঞ্চ, যুক্তিবাদী মুক্তমনা যুক্তফ্রন্ট সহ একাধিক সংগঠন। আন্দোলন ক্রমশ আরও ব্যাপ্তি পেতে থাকে। ইতিমধ্যে আন্দোলনে নতুন প্রাণ সঞ্চার হয় আন্দোলনের অন্যতম মুখ ঋতব্রত ঘোষ (পাভেল)-এর উদ্যোগে। যশোর রোডের দুটি গাছকে দত্তক নেন তিনি। গাছের নীচেই বানান তাঁর অস্থায়ী আশ্রয়। বৃক্ষচ্ছেদনের বিরুদ্ধে আশেপাশের গ্রামের মানুষদের সচেতন করার উদ্যোগ চলতে থাকে। পাশাপাশি চলতে থাকে গাছেদের নিয়ে জনশুনানিরও, যার প্রথম শুনানি অনুষ্ঠিত হয় গত ২৬শে মে অশোকনগর বিল্ডিং মোড় সংলগ্ন অঞ্চলে।
আগামী ১লা জুলাই সুপ্রিম কোর্ট রায় দেবে এই মামলার। সেদিনই স্থির হয়ে যাবে গাছগুলির ভাগ্য। জানা যাবে এত দৌড়ঝাঁপ, এত আন্দোলনের পরেও গাছগুলিকে বাঁচানো যাবে কিনা। তবে আন্দোলনকারীরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, কোর্টের রায় যাই হোক, গাছ কাটা তাঁরা আটকাবেন যে করেই হোক। প্রয়োজনে নিজেদের জীবন দিয়েও।
কে বলতে পারে, হয়ত আগামী একটা চিপকো আন্দোলনের সূচনা হতে চলেছে এই রাজ্যে।