রাণা আলম
লোকসভা ভোটের কয়েকমাস আগের কথা। কলকাতাগামী একটি এক্সপ্রেস ট্রেনের সংরক্ষিত কামরা বেশ ফাঁকা। জনাকয়েক যাত্রী মাত্র। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ভব্যিষৎ নিয়ে আলোচনা চলছে। তাদের মধ্যে কথাপ্রসঙ্গে একজন ঘোষিত বাম সমর্থক এবং আরেকজন নিজেকে বিজেপির আইনি সেলের সঙ্গে যুক্ত আছেন বলে জানিয়েছেন। কারা বেশি জনদরদী, বিজেপি না বামেরা, তাই নিয়ে মূলত তর্ক করছিলেন এই দুই সমর্থক। আচমকা, বিজেপি সমর্থক গলা নামিয়ে পাশের বাম সমর্থককে বললেন,
“যাই বলুন, ওদের টাইট দিয়ে রাখতে একমাত্র বিজেপিই পারে। নইলে, এই সরকারের আমলে যে ওদের যা বাড় বেড়েছে…”
এই প্রথম ঘোষিত বাম সমর্থকটি একমত হলেন। অল্প মাথা নাড়িয়ে গলাটা আরেকটু খাদে নামিয়ে সায় দিলেন,
“যা বলেছেন…”
এবার পরের ছবিতে আসা যাক। লোকসভা ভোটের রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরির পরীক্ষায় পাশ করে সদ্য জয়েন করেছেন এক তরুণ। ঘটনাচক্রে যে ঘরে তিনি ঠাঁই পেয়েছেন সেখানে তার সহকর্মীটিও তারই মতন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। ভোটের রেজাল্টের পর অফিস ক্যান্টিনে খেতে গিয়ে সদ্য জয়েন করা তরুণটিকে শুনিয়ে জনৈক কর্মী একটি নির্দিষ্ট ঘরের কথা উল্লেখ করে বললেন,
“শ্লা…ও ঘরটা তো এখন পাকিস্তান হয়ে গেছে।”
প্রসঙ্গত, উল্লেখিত ঘরটিতে সেই সদ্য জয়েন করা তরুণ এবং তার সহকর্মীই বসেন।
সহনশীল পাঠক, এই অব্দি পড়ে যদি আপনার মনে হয় লেখার শিরোনামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নিছক মুসলিমবিদ্বেষের ব্যখ্যান দিতে বসেছি তাহলে আগাম মাফ চাইছি। আর যদি চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের সম্পাদক মশাই ইতিমধ্যেই তার অকৃপণ কাঁচি চালিয়ে থাকেন তাহলে লাইনগুলো বাদ চলে গেছে নিশ্চয়। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে গোটা দেশে বিজেপির নিরঙ্কুশ জয়ের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটিতে গেরুয়া ঝড় উঠেছে। মোট ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস ২২টি আসন পেলেও, ১৮টি আসন নিয়ে ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে বিজেপি। মালদা ও মুর্শিদাবাদে গোটা দুয়েক আসন পেয়ে অস্তিত্ব বজায় রেখেছে জাতীয় কংগ্রেস আর গত চল্লিশ বছরে, সম্ভবত এই প্রথমবার, বামেদের প্রতিনিধি হয়ে এই রাজ্য থেকে কোনও প্রতিনিধি যাচ্ছেন না। স্বভাবতই, কার ভোট কার দিকে গেল তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। আপাতভাবে মনে হচ্ছে বামেদের ভোটের একটা বড় অংশই বিজেপির দিকে গেছে। যথারীতি, ভোট-পরবর্তী হিংসার মধ্যেই দল ভাঙানো রাজনীতির কারিগর মুকুল রায় তৃণমূল কংগ্রেসকে ভাঙাতে শুরু করেছেন। ইতিমধ্যেই জনাকয়েক তৃণমূল বিধায়ক এবং বেশ কিছু কাউন্সিলর বিজেপিতে যোগ দিয়েছে। শাসকের হাতছাড়া হয়েছে চারটি পৌরসভা।
এই রাজ্যে বিজেপির জয়ের কারণ নিয়ে একাধিক কারণ উঠে আসছে। প্রথম এবং প্রধান কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে শাসকদলের নিচুতলার নেতাদের সীমাহীন ঔদ্ধত্য এবং দুর্নীতি। গত পঞ্চায়েত ভোটে শাসকের গা জোয়ারি করে বিরোধীশূন্য করার রাজনীতির খেসারত দিতে হল এই ভোটে বলেও অনেকে বলছেন। তৃতীয় কারণটি যেটি বলা হচ্ছে সেটি হল তৃণমূলের মুসলিম তোষণ এবং তার প্রতিক্রিয়াতে বিজেপির পরিকল্পিত হিন্দুত্ববাদ। এখন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা প্রথম দুটি কারণ নিয়ে নিশ্চয়ই যুক্তিসম্মত মতামত দেবেন। এই লেখাতে চোখ রাখার চেষ্টা করছি তৃতীয় কারণটিতে, মুসলিম তোষণ এবং পালটা হিন্দুত্ববাদের উত্থানে।
ভবিষ্যতে সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করে কিভাবে ধর্মীয় মেরুকরণ করা যায় তা গবেষণার বিষয়বস্তু হবে। এবং সেক্ষেত্রে বিজেপি দলটি রীতিমত পেটেন্ট দাবী করতে পারে। তাদের প্রশিক্ষিত এবং পেশাদার আইটি টিম হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, টুইটার, মেসেঞ্জার ইত্যাদি সোসাল মিডিয়া ব্যবহার করে তাদের রাজনৈতিক মতামত ধর্মীয় বিদ্বেষের মাধ্যমে ছড়াতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে তাদের উল্লেখ্য আসন জয়ের পিছনে আইটি সেলের অবদান অনস্বীকার্য। আইটি সেল ধারাবাহিকভাবে ধর্মীয় মেরুকরণের উদ্দেশ্যে একের পর এক খবর ছড়িয়ে গেছে যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল মুসলিম তোষণ।
সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশের মধ্যেই বিজেপি এই ধারণাটা ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে যে এই রাজ্যে সাঙ্ঘাতিকরকম মুসলিম তোষণ হয়। এখানে মুসলিম তোষণ বলতে সাধারণ অর্থে এটাই বোঝানো হয় যে এরাজ্যে মুসলিমদের বাড়তি সুবিধে দেওয়া হয়। খুব শিক্ষিত এবং সচেতন, আপাতভাবে বিজেপি নন, এমন লোকজনকেও বলতে শুনেছি রাজ্যের বর্তমান শাসকদল মুসলিম তোষণ করেন।
কিন্তু এই রাজ্যে মুসলিমরা কী এমন বাড়তি সুবিধে পান যেটা অন্যরা পান না?
উত্তরটা খোঁজার চেষ্টা করছি।
এমনিতে ‘প্রগতিশীল’ পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের নিয়ে যে খুব কারও মাথাব্যথা ছিল এমনটা নয়। ২০০৬ সালে জাস্টিস রাজেন্দ্র সাচার যখন তার রিপোর্টে মুসলিমদের আর্থ সামাজিক হাল হকিকত নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট বের করলেন তখন ‘আহারে বেচারাদের অ্যাদ্দিনেও কিস্যু হয়নি’ বলে একটু সাড়া পড়ল। ২০১২ সালে এ রাজ্যে সংখ্যালঘু প্রধান জেলাগুলি নিয়ে স্কুল এডুকেশন সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট ইন্ডিয়ান ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিটিউট, কলকাতা বের করে। তাতেও যে বিশাল কিছু উন্নতি হয়েছে তা দেখা যায়নি। বরং সংখ্যালঘু এলাকায় স্কুলের অপ্রতুলতা, বেহাল স্বাস্থ্যপরিকাঠামো ইত্যাদিই ধরা পড়ে।
২০১১-র সেন্সাস অনুযায়ী এরাজ্যে জনসংখ্যার শতাংশ অনুপাতে মুসলিমরা হচ্ছে ২৭% মতন। এবং ২০১৬ সালে পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সরকারি চাকরিতে তাদের উপস্থিতি ৬%-এর নীচে। মোট ৩,৩১,২৪৯ জন সরকারি কর্মচারীর মধ্যে মুসলিম কর্মচারী ১৮৯৯১ জন। (তথ্যসূত্র: https://www.thehindu.com/news/cities/kolkata/Bengal-records-more-Muslims-in-govt.-jobs/article16439342.ece)। বাম আমলে এই সংখ্যাটা ছিল ৪%-এর কাছাকাছি। অর্থাৎ, বিগত একদশকে সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের সংখ্যা বেড়েছে ২% মতন। এইটে-কে তোষণ বলা যায় কিনা সেটা প্রশ্নযোগ্য। এক্ষেত্রে আরেকটি প্রশ্ন তোলা হয় ওবিসি সংরক্ষণ নিয়ে। ওবিসি-এ ক্যাটেগরিতে নাকি মুসলিমদেরই শুধু রাখা হয়েছে। কথাটা সর্বাংশে সত্য নয়। আদার ব্যাকওয়ার্ড কাস্ট বা ওবিসিতে দুটি ক্যাটেগরি আছে— এ এবং বি। এ ক্যাটেগরিতে বেশিরভাগ মুসলিম এবং বি ক্যাটেগরিতে বেশিরভাগ সংখ্যাগুরু রয়েছেন। এবং অবাক ব্যাপারটা হল ওবিসি-এ ক্যাটেগরি নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও ওবিসি-বি বা এসসি ক্যাটেগরি, যেখানে সংখ্যাগুরুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেটা স্বাভাবিক বলেই ধরে নেওয়া হয়। সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা, আর্থিক ক্ষেত্রে সংরক্ষণের দাবী ইত্যাদি প্রসঙ্গ আলাদা আলোচনার দাবি রাখে তাই এই লেখায় সে প্রসঙ্গ টানছি না। সংখ্যালঘুদের জন্য স্কলারশিপ, এডুকেশন লোন ইত্যাদিকেও তোষণের মধ্যে ধরেন অনেকে।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান— তিনটি ক্ষেত্রে মুসলিমরা আগের থেকে খানিকটা হলেও এগিয়েছে। আল আমীন মিশন নামের একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সৌজন্যে খুব প্রত্যন্ত প্রান্ত থেকেও মুসলিম ছেলেমেয়েরা ভালো সংখ্যায় ডাক্তার এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন। এই অগ্রগতিতে সহায়ক হিসেবে মাইনরিটি ডেভেলপমেন্ট স্কিম, শিক্ষা ঋণ, স্কলারশিপ ইত্যাদির ভূমিকা আছে। কিন্তু যেকোনও পিছিয়ে থাকা মানুষজনেদের সমাজের মূলস্রোতে ফেরানোর জন্য সরকারি স্কিম অতি স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত প্রক্রিয়া। সেটাকে তোষণ বলাটা কতটা যুক্তিসঙ্গত?
আরেকটি পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায় হলেন সিডিউল কাস্টরা, তাদের জন্যেও একাধিক ডেভেলপমেন্ট স্কিম রয়েছে। যেহেতু তারা ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর মধ্যে পড়েন, তাই কি তাদের ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু তোষণ শব্দবন্ধটি ব্যবহার হয় না?
রাজ্যের শাসকদলের বিরুদ্ধে মুসলিম তোষণ সংক্রান্ত আরেকটি বড় অভিযোগ হল ইমামভাতা। প্রথমবার ক্ষমতায় আসার অব্যবহিত পরেই মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের মসজিদের ইমাম এবং মুয়াজ্জিনদের ইমামভাতা দেওয়ার ঘোষণা করেন। ইমামভাতা দেওয়ার জন্য তার কাছে কোনও আবেদন করা হয়েছিল বা মাস পিটিশন জমা পড়েছিল এমনটা নয়। মুসলিমদের কালেক্টিভ ইউনিট হিসেবে দেখার প্রবণতা আছে। এবং শুধু মুসলিম নয়, সংখ্যালঘু মাত্রেই তাদের কালেক্টিভ ইউনিট হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হয়। শাসকদল হয়ত ভেবেছিলেন ইমাম মুয়াজ্জিনদের হাতে রেখে ‘মুসলিম ভোটবাক্স’ (যা কিনা আরেকটি বিতর্কিত শব্দবন্ধ) দখলে রাখবেন। ইমামভাতা দেওয়া হয় ওয়াকফ বোর্ড থেকে। ওয়াকফ বোর্ড আদতে উচ্চবিত্ত মুসলিমদের দান করা জমি সম্পত্তির দেখভাল করে, যার উদ্দেশ্য হল সাধারণ মুসলিমদের জন্য সেই পরিকাঠামো ব্যবহার করা। প্রসঙ্গত ওয়াকফ বোর্ডের অনেক সম্পত্তিই বেদখল হয়ে পড়ে আছে এবং এর সঠিক ব্যবহারে কারুরই খুব একটা উৎসাহ দেখা যায় না। কিন্তু মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী যখন ইমামভাতা দেওয়ার কথা বিভিন্ন জনসভায় ঘোষণা করেন তখন তিনি বা তার সরকার কখনওই এটা যে ওয়াকফ বোর্ডের টাকা থেকে দেওয়া হয়, রাজ্যের টাকা থেকে নয়, সেইটে উল্লেখ করেন না। তাতে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর মুসলিমদরদী হিসেবে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হলেও বিজেপি স্রেফ ইমামভাতা সংক্রান্ত এই মিসইনফরমেশনটিকে কাজে লাগিয়ে তাদের মেরুকরণের রাজনীতিতে কয়েক পা এগিয়ে গিয়েছিল। এবং যেটা আক্ষেপের, গুটিকয়েক শিক্ষিত সচেতন মুসলিম ছাড়া বাকিরা এই ইমামভাতা সংক্রান্ত কুরাজনীতির প্রকাশ্য বিরোধিতা করেননি। ব্যক্তিগতভাবে কথা বলতে গিয়ে দেখেছি তারা অনেকেই এটা সমর্থন করেননি, কিন্তু প্রকাশ্যে বিরোধিতা করতে গিয়ে থমকেছেন। সেটা সংখ্যালঘুর চিরাচরিত মুখ নামিয়ে থাকার অভ্যেসের ফল কিনা সেটা বিবেচনার বিষয়।
একটি প্রসঙ্গ এখানে অল্প ছুঁয়ে যাব সেটি হল মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক। প্রচলিত ধারণা হচ্ছে মুসলিমরা জোট বেঁধে ভোট দিয়ে থাকে। রাজ্যের মুসলিম প্রধান জেলাগুলির একটিতে আমার জন্ম এবং একটি ধর্মীয় সংখ্যালঘু পরিবারের অংশ হিসেবে কিছুতেই মনে করতে পারছি না যে এভাবে কখনও মুসলিমদের মিটিং করে কাকে ভোট দেব সেটা ঠিক করতে দেখেছি বা শুনেছি। এরাজ্যের মুসলিম ভোট মূলত বিজেপি বাদে বাদবাকি প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে বিভাজিত হয়, সেটা ভোট পার্সেন্টেজের হিসেব দেখলেই বোঝা সম্ভব। এবং যেটা উল্লেখ্য যে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় মুসলিম নামধারী কিছু ধর্মীয় সংগঠন তাদের প্রার্থী দাঁড় করায়, তারা কিন্তু নামমাত্র ভোট পান। মুসলিম ভোট সর্বদা শাসকপন্থী হয় এই অভিযোগ প্রমাণিত নয়। বামেদের স্বর্ণযুগেও মালদা, মুর্শিদাবাদে জাতীয় কংগ্রেসের আধিপত্য ছিল।
তৃতীয় অভিযোগ যেটি আসে সেটি হল এরাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনায় মুসলিমদের প্রতি পুলিশের পক্ষপাত থাকে। বসিরহাটের সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ ছিল। এই প্রসঙ্গে দুটি কথা বলার আছে। কোনও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষই একপাক্ষিক হয় না। কিন্তু বিজেপির আইটি সেলের প্রচারের কল্যাণে দায়টা বরাবরই একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের উপর পড়ে থাকে। এবং এই ক্ষেত্রে মুসলিমদের একাংশের অবদানও কম নয়। রাজ্যের বর্তমান শাসকদল সংখ্যালঘু মুখ হিসেবে এমন কিছু মুখ তুলে এনেছেন যাদের ভূমিকা প্রশ্নাতীত নয়। সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী বাংলাদেশের জামাতের সমর্থনে প্রকাশ্যেই বক্তব্য রেখেছেন, আহমেদ হোসেন ইমরানের সঙ্গে নিষিদ্ধ সংগঠন ‘সিমি’র যোগাযোগের অভিযোগ রয়েছে, ইদ্রিশ আলি’র বিরুদ্ধে ধর্মীয় উত্তেজনায় উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ আছে এবং এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অমুক পীরজাদা বা তমুক মসজিদের ইমাম যারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির টাকা স্রেফ খেয়ে তাদের দালালি করেন। রাজ্যের শাসকদল এই মহাপুরুষদের মুসলিম সমাজের মুখ হিসেবে তুলে ধরলেও এদের সার্বিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। রাজ্যের কিছু পকেট এরিয়াতে হয়ত এদের নিজস্ব কিছু পরিচিতি বা জনপ্রিয়তা আছে কিন্তু নিজস্ব স্বার্থে শাসকের অন্ধ দালালি করার জন্য এরা কখনওই আপামর সংখ্যালঘুর মুখ হয়ে উঠতে পারেননি। উলটে এদের কাজকর্মের প্রতি শাসকের অবাধ প্রশ্রয় বিজেপিকে মেরুকরণে সুবিধে দিয়েছে বরাবর। বাংলাদেশ সরকার সেদেশের জামাতি জঙ্গিদের প্রতি কড়া ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করাতে সেখানকার অনেক উগ্রবাদী নেতারা সীমান্ত পেরিয়ে এপার বাংলায় লুকিয়েছেন বলে শোনা যায় এবং তাদের আশ্রয়দাতা হিসেবে শাসকদলের নেতাদের নাম অভিযোগের লিস্টে আছে। বীরভূমের এক আলাপী একবার কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন শাসকদলের ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনীর অধিকাংশই কিন্তু সংখ্যালঘু। সুতরাং, বিজেপির পক্ষে এই ন্যারেটিভ দাঁড় করাতে বেশ সুবিধেই হয়েছে তৃণমূল মোল্লাদের দিয়ে হিন্দুদের উপর অত্যাচার করছে। একবার এক আলোচনাসভাতে এক শিক্ষিত মুসলিম বক্তা অভিযোগ করেছিলেন যে মুসলিমরা শুধু পলিটিক্যাল স্বার্থে ‘ইউজড’ হয়। সেমিনার শুনতে এসেছিলেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক। মাথায় ফেজ টুপি পরা সেই ভদ্রলোক কিঞ্চিৎ হেসে জিজ্ঞেস করেছিলেন,
“মুসলিমরা ইউজড হয় বুঝলাম। কিন্তু তারা নিজেদের ইউজড হতে দেয় কেন?”
এই প্রশ্নটার উত্তর আসমানি কেতাবে নেই।
এবার আসি শেষ প্রসঙ্গে। অর্থাৎ, রাজ্যের শাসকদলের মুসলিম তোষণ এর পালটা হিসেবে বিজেপির হিন্দুত্ববাদের উত্থান। যারা এই ঢাকটি পেটাচ্ছেন তারা হয়ত বোঝাতে চাইছেন যে তৃণমূলের মুসলিম তোষণের আগে এরাজ্যে সাম্প্রদায়িকতা বানানটাই অভিধানে ছিল না, দাঙ্গা কোনওকালে হয়নি, সব্বাই সবাইকে ভাই বলে ডেকে হেঁসেল খুলে দিত ইত্যাদি ইত্যাদি।
সত্যিই কি তাই? ২০১৭ সালে দাঁড়িয়ে যাদবপুরে এই অধমের নিজের নামে ঘরভাড়া পেতে যথেষ্ট অসুবিধে হয়েছে। একের পর এক জায়গায় বাদ গেছি শুধু নামের জন্য। তৃণমূলের আসার আগেও কি নিজের নামে ঘরভাড়া পাওয়াটা সুগম ছিল? অভিজ্ঞতা কিন্তু তা বলে না। মুসলিম অতিথির জন্যে চায়ের কাপ কি আগেও পালটে যেত না?
সাম্প্রদায়িকতার বিষ আকাশ থেকে এসে পড়েনি। এটা আমাদের মধ্যে বরাবরই ছিল। কবিগুরু তো কোনকালে লিখে গেছেন যে স্বদেশি আন্দোলনের সময় জল খাবেন বলে জনৈক স্বদেশি প্রচারক তার মুসলমান সহযোগীকে দাওয়া থেকে নেমে যেতে বলেছিলেন। বিজেপি এসে আমাদের লুকোনো দাঁতনখগুলোকে প্রকাশ্যে বের করতে সাহায্য করেছে মাত্র। আগে মানুষ নিজের সাম্প্রদায়িকতাকে বের করতে লজ্জা পেত, এখন সেটা গর্বের চেহারা নিয়েছে, এই যা ফারাক হয়েছে। এবং সাম্প্রদায়িকতা কোনওদিনই শুধুমাত্র সংখ্যাগুরুর মনোপলি নয়, সংখ্যালঘুও সাম্প্রদায়িক হয়, কেবল সংখ্যায় কম বলে তারা সেটা চেপে রাখার চেষ্টা করে। হিন্দু যেমন মুসলিমকে বাড়িভাড়া দিতে চায় না, মুসলিম মহল্লাতেও কিন্তু হিন্দুর বাড়ি ভাড়া পেতে সমস্যা হয়।
বিজেপি ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি করে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ইত্যাদিতে বেহাল দশা ঢাকতে এটাই তাদের সর্বোচ্চ অস্ত্র। কিন্তু এরাজ্যের শাসকদল তাদের ফাঁদে পা দিয়ে একই রাজনীতি করে গেছে বিগত কয়েকবছর ধরে। বিজেপি রামনবমী করলে তৃণমূলকেও রামনবমী করতে হবে কেন? সংখ্যালঘুপ্রেম দেখানোর জন্য ইফতারে হিজাব পরে যাওয়ার দরকারটাই বা কী? শাসকদল কি আদৌ বুঝতে পেরেছে যে তারা আদতে বিজেপির ন্যারেটিভ ফলো করে বিজেপিকেই বাড়তি সুবিধে দিচ্ছে। এবারের লোকসভা ভোটে প্রতিটি জনসভায় মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী দশ মিনিট ধরে মন্ত্রোচ্চারণ করে গেছেন, ইনশাল্লাহ বলেছেন। তিনি যদি উন্নয়নের খাতেই ভোট চেয়ে চাইতেন, তাহলে এই ধর্মীয় ন্যারেটিভ নির্ভরতা জরুরি ছিল না। বরং, তৃণমুলের এই হনুমান পুজো, পুরোহিত সম্মেলন, ইফতার পলিটিক্স সবই বিজেপিকে বাড়তি ডিভিডেন্ড দিয়ে গেছে।
তাহলে আমরা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? মেরুকরণের রাজনীতির সন্ধিক্ষণে আমাদের তথাকথিত প্রগতিশীল রাজ্যের ভব্যিষত কোন দিকে যাবে? দ্য অ্যানসার ইজ ব্লোইং ইন দ্য উইন্ড বলে কাব্যি করা যায়, কিন্তু দায় এড়ানো যায় না।
সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘুর বিবাদের কুরাজনীতির সুফল সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি ঘরে তুলেছে। সময় এখন সংহত থাকার। এ লেখা সম্পাদকের মেলে যাওয়ার আগেই কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি আয়োগের কর্তাব্যক্তিরা ঘোষণা করেছেন আগামী ১০০ দিনের মধ্যেই ৪২টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে বেচে দেওয়া বা বেসরকারিকরণের কথা ভাবছেন তারা। বিগত ৪৫ বছরে বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ। নোটবন্দি আর জিএসটির সৌজন্যে কাজ হারিয়েছেন বহু মানুষ। সংখ্যালঘু আর দলিতদের উপর অত্যাচার বেড়েছে। ধর্মীয় মেরুকরণ আর উগ্র জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে সব ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আগামী সম্ভবত আরও সঙ্কটময়। শুভবোধের জাগরণ ঘটুক।