Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

জম্মু-কাশ্মির থেকে আলিগড়

শ্রীপর্ণা ভাদুড়ি

 

উত্তরপ্রদেশ। আলিগড়। জাহিদ, আসলাম। আর সেই বাচ্চা মেয়েটা। স্যোশাল মিডিয়ার দৌলতে এই নাম ক’টা এখন প্রায় সবার মুখে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কারণ? গত ৩০ মে দশহাজার টাকার ঋণ শোধ না করতে পারার ‘অপরাধে’ আড়াই বছরের মেয়েটিকে বর্বরোচিত উপায়ে খুন করেছে প্রতিবেশী জাহিদ আর আসলাম। নিঃসন্দেহে খুব মারাত্মক ঘটনা যা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে এই উত্তাল সময়ে আমাদের চারপাশের লোকজন, আমরা কতটা অসহিষ্ণু হয়ে পরছি। টাকা আমাদের কাছে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে যে ভুলে যাচ্ছি ন্যূনতম মানবিকতাবোধ। এই একবিংশ শতাব্দীর নিও লিবারেল সমাজ কেড়ে নিচ্ছে আমাদের থেকে মনুষ্যত্ববোধ, বানিয়ে তুলছে আমাদের আরও যান্ত্রিক, জটিল।

কিন্তু তার চেয়েও মারাত্মক ঘটনা যেভাবে খবরটাকে সাম্প্রদায়িক রং চড়িয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা চালাচ্ছে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের মানুষ। কীরকম? খবরটি সামনে আসার পরপরই আপামর ‘হিন্দুত্ববাদী’ জনগণ ভার্চুয়াল দুনিয়ায় নেমে পড়েছে বলতে যে ঋণ শোধ না করতে পারার অপরাধে মুসলিম সম্প্রদায়ের দুজন মানুষ ধর্ষণ করে খুন করেছে বছর আড়াইয়ের হিন্দুঘরের শিশুটিকে। যেখানে ঘটনার নৃশংসতা নয়, মুসলিম কর্তৃক হিন্দু মাইনরিটির ধর্ষণ ও খুন অ্যাজেন্ডাটি অনেক বেশি প্রচারে হচ্ছে। কিরকম চেনা চেনা লাগছে না ছবিটা? ফ্ল্যাশব্যাকে চলে যাই জম্মু কাশ্মিরে। আগের বছরের জুন মাসে সামনে আসে জম্মু কাশ্মিরের একইরকম ঘটনাটি। আট বছরের মেয়েটিকে মন্দিরে আটকে লাগাতার ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল শুধুমাত্র মুসলিম উপজাতি কাঠুয়া সম্প্রদায়কে ভয় দেখানোর জন্য। সেই সময় এই ঘটনার নৃশংসতা নাড়িয়ে দেয় গোটা সমাজকে। আরও নাড়া দেয় দোষীদের বাঁচাতে হিন্দুত্ববাদের ধ্বজাধারী লোকজনের নির্লজ্জ ও প্রকাশ্য চেষ্টা। সেদিন এই ঘটনার প্রতিবাদে ও দোষীদের শাস্তির দাবীতে উত্তাল হয়েছিল সারা দেশ। ঘটনার বর্বরতা নাড়িয়ে দিয়েছিল আপামর ভারতবাসীকে। আর সেই ঘটনার পাল্টা ঘটনা হিসেবে আজকের ঘটনাটাকে প্রোপাগান্ডা করছে ‘হিন্দুত্ববাদীরা’। যদিও কোনও দৈনিক সংবাদপত্র বা পুলিশ পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বলা হয়নি যে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে।

কিন্তু একথাও মাথায় রাখতে হবে যে গ্রেপ্তার হওয়া অপরাধী নাকি নিজের মেয়েকেই ধর্ষণ করেছিল৷ তাই মেয়েটির বাড়ির লোক যদি সন্দেহ করে যে তাকে ধর্ষণও করা হয়েছিল, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমরা সত্যি জানি না,  ধর্ষণ হয়েছে কিনা৷ জানি শুধু, ধর্ষিতা না হলেও তার উপর নির্মমতা বড় কম হয়নি৷ শুধু সেটুকুই আলোচনায় আসা উচিত ছিল৷ সাম্প্রদায়িক কোনও দ্বেষ তার মধ্যে না থাকাই শ্রেয় ছিল।

তাহলে ধর্ষণের ঘটনাটিকে অতিরিক্ত ফোকাস করা হচ্ছে কেন? কারণ দুটো। প্রথমত, মুসলিম সম্প্রদায়ের হাতে হিন্দু মাইনরিটির ধর্ষণকে সামনে আনলে আরও প্রকট করা যাবে ‘মুসলিম’রা আসলে কত খারাপ এবং তারা সমাজের কত ক্ষতি করছে এই তত্ত্ব। তাতে সাধারণ জনগণের মধ্যে মুসলিমবিদ্বেষ আরও বাড়বে। জিতে যাবে হিন্দুত্বের প্রোপাগান্ডা। কোণঠাসা করা যাবে মুসলিম সম্প্রদায়কে। দ্বিতীয়ত, কোনও একটি মেয়েকে (সে যে বয়সেরই হোক না কেন, কারণ যাইহোক না কেন) ধর্ষণ করাটাই যেন মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকের সময়ে। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে কোনও একটি মেয়ের খুনের ঘটনা ঘটলেই খুনির মধ্যে কোথাও ধর্ষকাম মানসিকতাই কাজ করেছে। আর এইদিকটাই আমাকে, আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে ধর্ষণের মতো ঘটনা আমাদের কাছে কতটা স্বাভাবিক একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকের দিনে। পরিসংখ্যান বলছে ভারতবর্ষে প্রতি ৩ মিনিটে একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। তার মধ্যে একজন মাইনর। অর্থাৎ ভিক্টিমের বয়স ১৮ বছরের কম। শুধু তাই নয়, ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী Protection of Children from Sexual Offences Act (POCSO) এর আন্ডারে মোট ৩৮,৯৪৭টি কেস দাখিল হয় যার মধ্যে আবার ৭০ শতাংশ কেসেই আক্রান্ত ব্যক্তি তফসিলি জাতি উপজাতি বা মুসলিম জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত। এ তো গেল রিপোর্টেড হওয়া ধর্ষণের পরিসংখ্যান। ফলে খুব সহজেই অনুমান করা যায় তাহলে এই পোড়া দেশে নথিভুক্ত না হওয়া ধর্ষণের ঘটনার সংখ্যাটা ঠিক কত…। এবার স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে ধর্ষণের ঘটনার এত বাড়বাড়ন্ত কেন? এবং পরিসংখ্যানের গ্রাফ যে শুধু আমাদের দেশেই ঊর্ধ্বমুখী তা নয় প্রায় সমগ্র বিশ্বেই ধর্ষণের ঘটনা সংখ্যার নিরিখে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। আসলে ধর্ষণের কারণ খুঁজতে গেলেই আমরা বুঝব আলিগড়ের এই ঘটনার ক্ষেত্রেও কেন হিন্দুত্ববাদীরা ধর্ষণকেই ফোকাস করে এগোচ্ছে। কারণ ধর্ষণ, এক ধর্মের নারীর শরীর অন্য ধর্মের পুরুষের জোর করে ভোগ করে নেওয়া, একরকম ভাবে প্রথম ধর্মের ‘পৌরুষের’ উপর আঘাত বলে ধরা হয়।

বিশ্বে যত ধর্ষণের ঘটনা ঘটে তার প্রায় অর্ধেকেরও বেশি ঘটনার পিছনে মূলত কাজ করে ভিক্টিমকে, ভিক্টিমের পরিবারকে, ভিক্টিমের জাতিকে মায় একই ধর্মাবলম্বী মানুষদের অবধি ‘শিক্ষা’ দেওয়ার মানসিকতা। যেহেতু আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যেখানে শুধুমাত্র পিতৃতান্ত্রিক সমাজের জাঁতাকলেই আমরা পিষে চলেছি তা নয়, তার সাথে নিও লিবারেলিজম, ক্যাপিটালিজম, আমাদের ক্ষেত্রে আবার বাড়তি ‘উদীয়মান ফ্যাসিজম’ সবাই তার তার মতো করে আমাদের শোষণ করে চলেছে। সেখানে নারীশরীর কেবলই ভোগ্যবস্তু। আর তারই একদিকের নির্লজ্জ প্রকাশ যদি জম্মু কাশ্মিরের ঘটনাটি হয় তাহলে আরেকটি দিক আলিগড়ের ঘটনা, যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে ৮ থেকে ৮০, জীবিত হোক বা মৃত যেকোনও নারীশরীরই আসলে বাজারি মিডিয়ায় এবং সোশাল মিডিয়ায় বিক্রি হয়।

আলিগড়ের ঘটনার পরেও শিশু-নিগ্রহ, শিশু-ধর্ষণের বহু ঘটনা খবরের কাগজে দেখেছি যেমন হয়। একটি ঘটনা ভালো বিকোলে, অনুরূপ ঘটনার রিপোর্ট ছাপার ধুম লাগে। কিন্তু সচেতনতা সেই তিমিরেই আছে। এই অবস্থায় মাথায় শুধু একটাই কথা ঘোরে। আমাদের শিশুদের নিয়ে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক এই দাবাখেলা আর কতদিন চলবে? অন্তত শিশুদের সুরক্ষার কারণেও কি আমরা একজোট হতে পারি না?