পরিমল ভট্টাচার্য
প্রিয় চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম,
২০১৩ সালে ‘বারোমাস’ পত্রিকায় ছাপা একটি লেখা, সেটি আপনারা আবার প্রকাশ করতে চাইছেন। তার কারণ জানিয়েছেন, লেখাটি এখনও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে আপনাদের। অনেক ধন্যবাদ। লেখাটার সঙ্গে এক-দুই লাইনের একটা ধরতাই চাইছেন। কিন্তু কী লিখি?
চার বছর আগের একটি পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন গোছের একটি লেখা, চার বছর পরেও যদি সেটা কারও প্রাসঙ্গিক মনে হয় তাহলে লেখক হিসেবে বোধহয় আত্মপ্রসাদ অনুভব করা উচিৎ। কিন্তু বিশ্বাস করুন তেমন কিছু অনুভব করতে পারছি না। চার বছর, ন বছর, উনিশ বছর… সেই এক ছবি–– সেই খালি গায়ে লেখা শ্লোগান, সেই ফর্সা চামড়ায় গড়িয়ে নামা টাটকা রক্ত, সেই হাসকুটে মুখগুলো বজ্রমুঠির মতো পাকিয়ে ওঠা… একটা দমচাপা অস্বস্তি ভেতরে গুলিয়ে উঠছে কেবল, জানেন।
Déjà vu শব্দটার বোধহয় কোনও লাগসই বাংলা প্রতিশব্দ নেই। তর্জমা করলে দাঁড়াবে–– বর্তমান পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে আগেও গিয়েছি এমন একটা অনুভূতি। কিন্তু এই অনুভূতির একটা খুব সুন্দর বিবরণ আমরা অনেকেই ছেলেবেলায় ইস্কুলপাঠ্য বইয়ে পড়েছি। এস ওয়াজেদ আলির লেখা, রচনার নামটা মনে নেই, বোধহয় ‘ভারতবর্ষ’। পাড়াগাঁয়ে এক মুদি রোজ সন্ধ্যাবেলা তাঁর নাতিকে রামায়ণ পড়ে শোনাতেন। অনেক বছর পরে লেখক ফিরে গিয়ে দেখছেন সেই মুদির দোকানটা হুবহু একই আছে, সেই একইভাবে দোকানি এক শিশুকে রামায়ণ শোনাচ্ছে, কেবল সেই নাতি এতদিনে দাদু হয়ে গিয়েছে। সেই ট্রাডিশান সমানে চলেছে।
কিন্তু সত্যিই কি দেজা ভূ-র অনুভূতি সবসময় এমন মনোরম হয়? একটা অন্য গল্পের কথা বলি, হয়তো পড়েছেন, রে ব্র্যাডবেরির লেখা। সম্ভবত মারশিয়ান ক্রনিকল থেকে। পৃথিবী থেকে একদল মহাকাশচারী একটি অচেনা নতুন গ্রহে এসে নামছে। সেই গ্রহে প্রাণ আছে এটা জানা গিয়েছে, ফলে তারা সতর্ক, সশস্ত্র। কিন্তু গ্রহের মাটিতে পা দেবার পর দেখছে হুবহু যেন আরেকটা পৃথিবী। সেই চেনা গাছপালা, আকাশ, অপূর্ব শরতের বিকেল হচ্ছে, পাখি ডাকছে। সেই চেনা ডাক, ভিজে মাটির গন্ধ, হুবহু যেমন তাদের ছেলেবেলার খামারবাড়িতে ছিল। এমনকি শাদা কটেজগুলোও ঠিক সেইরকম, সেই লাল টালির ছাদ, এবং–– কী আশ্চর্য!–– তাদেরই ছেলেবেলার বাড়ি সব। আর তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছেন তাদের বাবা-মায়েরা, যারা অনেককাল আগে মারা গিয়েছেন, পৃথিবী থেকে হারিয়ে গিয়েছেন। তাদের ডাকনাম ধরে ডাকছেন, মা রান্নাঘরে লেমোনেড বানাচ্ছেন, ঠিক যেমন শরতের বিকেলগুলোয় বানাতেন, মাঠে বল খেলে আসার পর। বাবার গায়ে সেই একই তামাকের গন্ধ। সেই ছেলেবেলার পোষা কুকুর… এবং এভাবে ঘরের ছেলেরা সব স্মৃতির ঘরে ফিরে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে যখন, তখন ঘটছে গল্প। স্নেহাতুর বাবামায়েদের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে অদ্ভুত অচেনা সব ভিনগ্রহের প্রাণী। তাদের হাতে ধারালো ছুরি।
আসলে ওই গ্রহের জীবেরা মানুষের থেকে সভ্যতায় অনেকগুণ উন্নত। পৃথিবীর মহাকাশযান ওদের বায়ুমণ্ডলে ঢোকার আগেই তারা মহাকাশচারীদের একান্ত স্মৃতিগুলো নিঃসাড়ে চুরি করেছিল, আর তারপর বানিয়ে তুলেছিল ছেলেবেলার স্মৃতির মরীচিকা। যা আসলে মরণফাঁদ।
কিছু কিছু দেজা ভূ আতঙ্কজনক হয়, জানেন। তেমনই একটা আতঙ্ক চারপাশ থেকে চেপে ধরছে এখন। খুব চেনা মানুষজনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে ভিনগ্রহের জীব, আস্তিনের ভেতর থেকে ছুরি। সেই ছুরির গায়ে রক্ত লেগে আছে কী না, সেই রক্ত মহেশের নাকি জুনেইদের, এই আলোআঁধারিতে সেটা বোঝার উপায় নেই। দু-লাইন চেয়েছিলেন, অনেকগুলো লাইন লিখে ফেললাম। অপ্রাসঙ্গিক বকলাম হয়তো। আশাকরি কিছু মনে করবেন না।
ইতি—পরিমল ভট্টাচার্য
_________________________________________________________________________________________
এই লেখাটি যবে প্রকাশিত হবে, ততদিনে, আশা করা যায়, দার্জিলিং সম্পূর্ণরূপে ফিরে এসেছে পুরনো জীবনছন্দে। ইংরেজি নববর্ষকে স্বাগত জানাতে সেজে উঠেছে দোকান-রেস্তোরাঁগুলো, ম্যালের রাস্তায় পর্যটকের ভিড়। চকবাজারের দেয়ালে শ্লোগানগুলো ফিকে হয়ে এসেছে, মিশে গিয়েছে পুরনো অক্ষরের ভিড়ে। স্থানীয় মানুষের মুখের থেকেও সরে গিয়েছে ছায়া, আশা করা যায়, হাসিতে ফিরেছে অমলিন ঔজ্জ্বল্য। দার্জিলিংবাসীর সেই বিখ্যাত হাসি, যা দেখে ইন্দিরা গান্ধী নাকি বলেছিলেন– এখানকার মানুষের তো কোনও সমস্যাই নেই দেখছি!
গত জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় সরকার পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্যের কথা ঘোষণা করার পর এই হাসি মুছে গিয়েছিল, দার্জিলিং অচল হয়ে গিয়েছিল মাসাধিক কাল। দোকানপাট স্কুলকলেজ অফিস-আদালতে তালা, মোড়ে মোড়ে অবরোধ, খালি-গা যুবকদের দণ্ডি কাটা, রাতে মশাল মিছিল, পুলিশচৌকিতে আগুন– উনিশশো আশির দশক রক্তঝরা দিনগুলোর চেনা ছবি মনে পড়িয়ে দিয়েছে।
রাজ্য প্রশাসনও পদক্ষেপ করেছে চেনা পথেই: কেন্দ্রীয় বাহিনী নামানো হয়েছে, চলেছে ব্যাপক ধরপাকড়– যাকে বলে, কঠোর হাতে মোকাবিলা। আশির দশকে সুবাস ঘিসিঙের নেতৃত্বে আন্দোলনের শেষে তৈরি হয়েছিল পার্বত্য পরিষদ। এক্ষেত্রে অবশ্য তেমন কোন প্রাপ্তির সুযোগ ছিল না। বর্তমান সরকার রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে-পরেই গঠন করেছে গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। ফলে দরকষাকষির কোনও পরিসর ছিল না। রাজ্য মোর্চা দুপক্ষই নিজের নিজের অবস্থানে ছিল অনড়, অচলাবস্থা কাটার কোনও পথ দেখা যাচ্ছিল না, স্তব্ধ হয়ে ছিল পাহাড়ে জনজীবন। সেই জট যে কাটল, মোর্চা নেতারা সরকারের সঙ্গে আলোচনায় এবং জিটিএ-তে ফিরল, বনধ-এর রাজনীতি থেকে সরে আসার মৌখিক প্রতিশ্রুতি অন্তত দিল, এটা নিশ্চিতভাবেই বর্তমান সরকারের একটি সাফল্য। আর এই সাফল্য শুধু কঠোর ও কৌশলী হাতে সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য এসেছে তা নয়। প্রথম থেকেই একটি সুস্পষ্ট অবস্থান নেওয়া হয়েছে, এবং সেটা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করাও হয়েছে। কথাকে কাজে পরিণত করতে বিলম্ব হয়নি।
একটি বিষয়ে আন্দোলনকারীদের সাফল্যও উল্লেখযোগ্য: প্রায় কোনও সময়েই আন্দোলনকে তার ঘোষিত শান্তিপূর্ণ পথ থেকে সরে হিংসার চোরাগলিতে যেতে দেওয়া হয়নি, যদিও তার সম্ভাবনা ছিল। এখানে স্মর্তব্য, আশির দশকে প্রায় বারোশো তরুণ তাজা প্রাণ ঝরে গিয়েছিল।
এই লেখাটি এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত, যদি গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে লোককাহিনীর সুরে বলা যেত– তারপর তারা সুখে শান্তিতে বাস করিতে লাগিল। কিন্তু বিগত এক দশকে দার্জিলিঙের রাজনৈতিক ঘটনাবলীর দিকে তাকালে তেমন কোনও প্রত্যয় অতি বড় আশাবাদীর পক্ষেও খুঁজে পাওয়া কঠিন।
২
দুবছর ধরে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে প্রায় বারোশো তরুণ প্রাণের বিনিময়ে দার্জিলিঙে শান্তি ফিরেছিল উনিশশো অষ্টআশি সালে। সেই আন্দোলনের অবিসংবাদী নায়ক ছিলেন সুবাস ঘিসিং। এরপর গোর্খা পার্বত্য পরিষদের চেয়ারম্যান হয়ে তিনি একনায়কের মতো পাহাড়ে রাজত্ব করেছেন দুই দশক। তারপর একদিন, ২০০৮ সালের গোড়ার দিকে, তার রাজ্যপাট ভেঙে পড়ল তাসের দুর্গের মতো। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেও যে মানুষটির অঙ্গুলি হেলনে পাহাড়ের মানুষের জীবনের চাকা ঘুরত, তিনি আর দার্জিলিঙে ফিরতেই পারলেন না। ইণ্ডিয়ান আইডল নামে টিভিতে একটি গানের প্রতিযোগিতায় এক স্থানীয় যুবকের অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে পাহাড়ে এক নাটকীয় নাগরিক অভ্যুত্থান ঘটল, যার আগাম হদিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সমতলের কোনও রাজনৈতিক দল বা রাজ্যবাসী কারও কাছেই ছিল না।
এই নিয়ে বিশদে একটি বইতে লিখেছি, এখানে শুধু দুয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয় উল্লেখ করব। দার্জিলিঙের রাজনীতিতে সুবাস ঘিসিঙের সবচেয়ে স্মরণীয় অবদান কি? একটি শ্লোগান:
ভোটে লাপচে নেপালি
হামি সবোই গোর্খালি
অর্থাৎ– ভুটিয়া লেপচা নেপালি, আমরা সবাই গোর্খা। দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে স্বতন্ত্র গোর্খা রাজ্যের দাবিটি বহু পুরনো, কিন্তু গোর্খা বলতে দীর্ঘকাল ধরেই সাধারণভাবে বোঝাত নেপাল থেকে আগত হিন্দুরা। ‘গোর্খা’ নামটি শৌর্যের প্রতীক হিসেবে ব্রিটিশ শাসকদের সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছিল। স্বাধীন ভারতে তা হয়ে যায় ‘বাহাদুর’, যা আসলে এক নীরব যান্ত্রিক আনুগত্যের প্রতীক। আশির দশকে ঘিসিং ‘গোর্খা’ শব্দে একটি নির্দিষ্ট জাতিপরিচয়ের সূচককে রূপান্তরিত করলেন একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিচয়ে, আর এভাবে তিনি পাহাড়ের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়কে বেঁধে ফেললেন একটি সার্বজনিক আইডেন্টিটিতে। আন্দোলনের ভেতর দিয়ে রচিত হল এক নতুন গোর্খা অস্মিতা।
দার্জিলিং পাহাড়ে অসংখ্য জনজাতি, সম্প্রদায়, গোষ্ঠী ও বর্ণের মানুষ রয়েছে, তাদের অনেকেরই নিজস্ব ভাষা, স্বতন্ত্র ধর্মাচরণ ও লোকাচার রয়েছে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশদের গড়া নগরায়নের চুম্বকে সিকিম, নেপাল ও ভুটানের পাহাড় থেকে বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ এসেছে বর্ণবিভাজিত সমাজ ছেড়ে, বিচ্ছিন্ন প্রকৃতির মাঝে আবহমান জীবনছন্দ ছেড়ে, এমনকি ক্রীতদাসেরাও পালিয়ে এসেছে। উনিশ ও বিশ দু-দুটো শতক জুড়ে চলেছে এই আসা। কালে কালে জাতি সম্প্রদায়ের নানান রঙের সুতো দিয়ে বুনে উঠেছে এক বর্ণময় জনবৈচিত্র্যের নকশি কাঁথা, যা প্রকৃত অর্থে কসমোপলিটান। ক্রমশ আন্তর্বিবাহের ভেতর দিয়ে, পেশাবদলের ভেতর দিয়ে, নেপালি ভাষাকে আপন করে নেওয়ার ভেতর দিয়ে এই সুতোগুলো পরস্পরে মিলে এসেছে। সেই বুননে শ্রেণীক্রম নিশ্চয়ই আছে, বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রসরতার তারতম্য আছে, যেমন সর্বত্রই থাকে, কিন্তু সব মিলিয়ে গড়ে উঠেছে এক নতুন সমাজ।
এমনকি একটি নাগরিক সমাজও। এই নাগরিক সমাজের জেগে ওঠা দেখা গেল একুশ শতকের গোড়ায়, ঘিসিং যখন নকশি কাঁথার সুতোগুলোকে আলাদা করে খুলতে চাইলেন।
ঘিসিঙের শাসনকালে শুরু থেকেই দুর্নীতি স্বজনপোষণ ছিল, অনুন্নয়ন ছিল, অগণতান্ত্রিক পেশি সংস্কৃতি ছিল। (এব্যাপারে রাজ্য সরকারের ভূমিকা আদিবাসীটোলার গাঁওবুড়ার প্রতি উদাসীন জমিদারের মতো।) এই নিয়ে পাহাড়বাসীর মনে হতাশা আর ক্ষোভও জমা হয়েছিল বিস্তর। কিন্তু তা কখনওই তাঁর কুর্সি টলিয়ে দেবার মতো করে মুঠি পাকিয়ে ওঠেনি। সেটা ঘটল যখন তিনি ষষ্ঠ তফসিল আদায়ের লক্ষ্যে পাহাড়ের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে আলাদা আলাদা ভাবে জনজাতিসত্তা প্রমাণের আয়োজন করতে ফতোয়া দিলেন, শুরু করে দিলেন শিলাপুজো, ওঝানাচ, এথনিক পোষাক আর ছাং-পানের উৎসব। দুই দশক আগে যিনি পাহাড়ে বিভিন্ন জনজাতিকে বেঁধেছিলেন একটি নতুন রাজনৈতিক আত্মপরিচয়ে, তাঁর এই বিচিত্র পশ্চাদগামী কর্মসূচি প্রত্যাখান করল নাগরিক সমাজ। বাকিটা ইতিহাস।
এই সময়েই বিভিন্ন জনজাতির সংগঠন জন্ম নেয় এবং শীতঘুম থেকে জেগে ওঠে। সক্রিয় হয় তামাং, লিম্বু, ভুটিয়া, গুরুং, মগর, রাই ইত্যাদি গোষ্ঠীর সংগঠন। আর হ্যাঁ, লেপচাদের সংগঠন। লেপচারা দার্জিলিঙে আদি বাসিন্দা– এই যুক্তি দিয়ে ‘গোর্খাদের’ স্বতন্ত্র রাজ্যের দাবি ঠেকানোর একটা প্রয়াস শোনা যাচ্ছিল বিগত সরকারের আমলে, শেষ পাঁচ-সাত বছরে। দার্জিলিঙে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর লেপচা সংগঠনের নেতাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়, কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে এসে তাঁরা অনশন করেন ২০১০ সালে। এবং সেটা ঘটে প্রায় সকলের অগোচরে।
লেপচারা দার্জিলিঙের আদি বাসিন্দা, এ কথা উনিশ শতকে দার্জিলিং নিয়ে ব্রিটিশদের লেখায় আছে। বিজন গহীন কুমারী অরণ্য পাহাড় আর মাঝে মাঝে একটি-দুটি লেপচা বসতি– এমন বর্ণনা দার্জিলিং পাহাড়ে স্বাস্থ্যনিবাসের সম্ভাবনা প্রথম খতিয়ে দেখতে যাওয়া দুই অফিসার কর্নেল লয়েড আর ডক্টর চ্যাপম্যানের রিপোর্টে আছে। প্রায় সমসাময়িক জোসেফ হুকারের হিমালয়ান জার্নালে কিম্বা তার কিছু পরে তিব্বতবিদ শরৎ চন্দ্র দাসের বইতেও লেপচা বসতির উল্লেখ রয়েছে (পাশাপাশি লিম্বু বসতির কথাও আছে)। পরবর্তীকালে এই উল্লেখগুলো তথ্যের আকারে ই সি ডোজির আ কনসাইজ হিস্ট্রি অব দার্জিলিং কিম্বা ও ম্যালির দার্জিলিং ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে সঙ্কলিত হয়ে প্রামাণিক হয়েছে।
এখানে দু-একটি বিষয় স্মর্তব্য। লয়েড, চ্যাপম্যান, হুকার কিম্বা দাস, এঁরা কেউই নৃকুলবিদ ছিলেন না।
গোড়ার দিকের রিপোর্টগুলিতে দার্জিলিং পাহাড়কে প্রায় জনমানবহীন, রাজস্ব আদায়ের সুযোগহীন অঞ্চল হিসেবে দেখিয়ে সিকিম রাজার কাছ থেকে প্রায় বিনামূল্যে আদায় করার নৈতিক ভিত্তি খাড়া করা গেছে। তাছাড়া দার্জিলিঙের জনবিরল কুমারী পাহাড় ব্রিটিশদের ‘আবিষ্কার’– এইভাবে দেখার পেছনে কাজ করেছে ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গিও। মোদ্দা কথা, আটের শতকে জর্জ বোগলের তিব্বত যাত্রার ডায়েরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন লেখাপত্রে এই অঞ্চলের যে সামগ্রিক ছবি পাওয়া যায়, তা হল– বিভিন্ন ছোট ছোট জাতিগোষ্ঠী আবহমানকাল ধরে ঝুমপ্রথায় চাষ ও পশুপালনের প্রয়োজনে পাহাড় থেকে পাহাড়ে ঠাঁইবদল করে এসেছে।
আজকের দার্জিলিঙে সকল লেপচারাই ভূমিপুত্র, এমন কথা স্বয়ং লেপচারাও মনে করে না। তার থেকে বড় কথা, পশ্চিমবঙ্গের মতো একটি রাজ্য, যার জনবিন্যাস নির্ধারিত হয়ে চলেছে দেশভাগ আর প্রচরণের মধ্যে দিয়ে, সেখানে ভূমিপুত্রের ধারণাটাই বেশ গোলমেলে। এবং বিস্ফোরক।
৩
রাজ্যের একটি অঞ্চলে শান্তিশৃঙ্খলা বজাত রাখতে, সেখানকার জীবনযাত্রা সচল রাখতে সরকার দায়বদ্ধ। অনেক সময় সেই দায়বদ্ধতা পালন করতে গিয়ে উপায়কে ছাপিয়ে বড় হয়ে দেখা দেয় উদ্দেশ্য। কিন্তু এ ব্যাপারে নাগরিক সমাজের দায়বদ্ধতা কী? নাগরিক সমাজে জনমত প্রভাবিত করে যে মিডিয়া, তার দায়বদ্ধতা কী?
দার্জিলিং সমস্যা নিয়ে বেশ কিছুকাল ধরেই সমতলের খণ্ডিত, আমরা-ওরায় বিভাজিত বাঙালি নাগরিক সমাজে শোনা যায় এক আশ্চর্য ঐক্যমত্যের সুর– একই রকম চড়া গ্রামে বাঁধা, কোনও উচ্চাবচতা নেই, প্রায়শই যা পাক খায় নির্দিষ্ট দু-তিনটি ধুয়োর আবর্তে। এবারেও তার ব্যাতিক্রম ঘটেনি।
এবারের অশান্তি গণমাধ্যমে যেভাবে উঠে এসেছে, তাতে মনে হতে পারে যে পাহাড়ের মানুষকে ভয় দেখিয়ে গায়ের জোরে রাস্তায় নামতে, কিম্বা ঘরবন্দী হয়ে থাকতে, বাধ্য করেছে জনমুক্তি মোর্চার নেতারা। টেলিভিশনে দার্জিলিঙে বিক্ষুব্ধ মানুষের মিছিল দেখা গেছে দু-এক ঝলক, সংবাদপত্রের ছবিতে দেখা গিয়েছে জানালার ফাঁকে ‘ঘর-ভিতরনু-জনতার’ সন্দিগ্ধ চোখ, তাদের কারও কথা শোনা যায়নি কখনও। যে বিষয়টা গুরুত্ব পায়নি, পেতে পারত, তা হল এবার আন্দোলনের প্রথমদিকে মোর্চার পাশে সামিল হয়েছিল পাহাড়ের প্রায় সবকটি রাজনৈতিক দল, তাদের সমর্থকদের সংখ্যা যাই থাক। তার মধ্যে অল বেঙ্গল গোর্খা লীগও ছিল, যার প্রধান নেতা মদন তামাং হত্যায় মোর্চার কয়েকজন অভিযুক্ত। যে ঘটনাটি স্মরণ করা হয়নি, করা যেতে পারত, তা হল সেই হত্যাকাণ্ডের পর এই বিমল গুরুঙ-রোশন গিরিদের ঝাঁটা-জুতো দিয়ে অভ্যর্থনা করেছিল পাহাড়ের সাধারণ মানুষ। সেইসব মানুষেরা এবার পথে নেমেছিল কি? খোঁজা যেতে পারত। খোঁজা যেতেই পারত কোন্ সেই শক্তি, যার চাপে পাহাড়ের সব রঙের রাজনৈতিক দল– তা সে তালপাতার সেপাই বিরোধীই হোক বা ক্ষীরননী-খাওয়া ক্ষমতাভোগী– বার বার আলাদা রাজ্যের জিগির তুলে একযোগে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়?
দার্জিলিং তেতে উঠলে পাহাড়ের যে মুখগুলোকে আমরা বারবার টিভির পর্দায় সরকারি মঞ্চে দেখে আসছি, তারা আসলে মুখ নাকি মুখোশ? সেই মুখোশের ভেতর দিয়ে একটি জনগোষ্ঠী কিছু বলার চেষ্টা করছে কি? সেই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলার কোনও ক্ষেত্র আমরা তৈরী করতে পেরেছি কি এত বছরে?
ষষ্ঠ তফশিলের লক্ষ্যে পাহাড়ের নিবিড় জনবিন্যাস বিভাজনের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন সুবাস ঘিসিং, তার বিরুদ্ধে জেগে ওঠে দার্জিলিঙের নাগরিক সমাজ। সেই নাগরিক সমাজকে ফের পথে নামতে দেখা গেল মদন তামাং হত্যার প্রতিবাদে। বিশাল নীরব মোমবাতি মিছিলে শামিল হয়েছিল দলমত নির্বিশেষে মানুষ। মজার ব্যাপার হল, তার কিছুকাল আগে কলকাতায় জেগে উঠেছে নাগরিক সমাজ, মোমবাতি মিছিল হয়েছে। কিন্তু দুই নাগরিক সমাজের মধ্যে কোনও সেতুবন্ধন হল না, কোনও আদানপ্রদান হল না। অথচ পাহাড়ে শিক্ষিত বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ মানুষ নেই এমন তো নয়। তাদের কাউকে কোনওদিন দেখা গেল না কলকাতার কোনও সভাসমিতিতে (তা সে পর্বতারোহণ নিয়েই হোক বা পরিবেশরক্ষা), মিডিয়ায়, তাদের কণ্ঠস্বর শোনা গেল না কোথাও। আর তার ফলেই দার্জিলিং সমস্যাটা সবসময়েই দেখা হতে লাগল সরকার বনাম একটি দল বা কয়েকজন নেতার দ্বৈরথের ভেতর দিয়ে, এই প্রসঙ্গে আমাদের সমস্ত কথাবার্তার সুরও পাক খেতে লাগল দু-তিনটি ধুয়োর আবর্তে।
এর মধ্যে প্রধান হল দার্জিলিং নিয়ে মধ্যবিত্ত নাগরিক বাঙালির এক হিমালয়-প্রমাণ নস্টালজিয়ার নির্মাণ, যার বিচিত্র রহস্যময় শক্তির কাছে মাথা নোয়ায় রাজ্যের সবকটি রাজনৈতিক দল।
আজকাল তো কতকিছু নিয়েই জনমত সমীক্ষা হয়। এমন কোনও সমীক্ষা করে দেখা যায় কি, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামেগঞ্জে দিনমজুর ভাগচাষি বাঙালির কাছে, পুরুলিয়ার কাটুনি মেঝেন কিম্বা সুন্দরবনের ভ্যানচালকের কাছে, হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্ত্যের কাছে এই নস্টালজিয়ার মূল্য কতটা? তাদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির তালিকায় ঠিক কত নম্বরে রয়েছে?
এই নস্টালজিয়ার সঙ্গে যুক্ত দ্বিতীয় একটি বিষয়: পর্যটন। দার্জিলিং তেতে উঠলে তৎক্ষণাৎ বিষয়টি মিডিয়ার যাবতীয় উৎকণ্ঠার কেন্দ্রে চলে আসে, নেপথ্যে চলে যায় উত্তপ্ত পাহাড়ে সাধারণ মানুষের দুর্দশা আর অনিশ্চয়তার প্রসঙ্গ। দার্জিলিঙের পর্যটনশিল্পে পুঁজি নিয়ন্ত্রণ করে কারা, সেই শিল্প থেকে মুনাফা তারা কোথায় বিনিয়োগ করে, পাহাড়ের কত শতাংশ মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত, কোন্ স্তরের শ্রমে যুক্ত, এই নিয়ে কোনও সমীক্ষা হয়েছে কি? দার্জিলিঙে পর্যটনের যা চরিত্র, তা পরিবেশ ও স্থানীয় অর্থনীতির ওপর কী ধরণের প্রভাব ফেলে, এই শিল্পে যুক্ত নন এমন মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কী প্রভাব ফেলে, এই নিয়েই কি কোনও সমীক্ষা হয়েছে? বিস্ময়ের যেটা, বেশ কিছুকাল হল আলাদা রাজ্যের দাবির বিরুদ্ধে পর্যটনকে লড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না, তা হল– ফি বছর যত বাঙালি প্রতিবেশী রাজ্য সিকিমে বেড়াতে যান, তার কত ভগ্নাংশ দার্জিলিঙে আসেন?
পশ্চিমবঙ্গ থেকে দার্জিলিং-তরাই-ডুয়ার্সকে নিয়ে স্বতন্ত্র একটি রাজ্য গড়ার বিরুদ্ধে অনেক যুক্তি থাকতে পারে, যুক্তি আছেও। কিন্তু সেই যুক্তিগুলি দাঁড়িয়ে আছে সুরক্ষা, জনবিন্যাসগত জটিলতা, অর্থনৈতিক বাস্তবিকতা কিম্বা যুক্তরাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতার ওপর। সমতলের মুষ্টিমেয় নাগরিক শ্রেণীর নস্টালজিয়ার মরীচিকার ওপরে নয়। ঐতিহাসিক বঙ্গভঙ্গের ছায়ার আড়ালেও নয়।
সেই নস্টালজিয়ার চশমাটা চোখ থেকে খুলে যদি দার্জিলিংকে রাজ্যের যে কোনও একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের মতো করে দেখা যায়, যদি ম্যাল-কাঞ্চনজঙ্ঘার পিকচার পোস্টকার্ড থেকে চোখ ফেরানো যায় রাস্তাঘাটে, চা-বাগানের কুলিবস্তিতে, জলসরবরাহ কিম্বা নিকাশিব্যবস্থায়, যদি সেখানকার কর্মসংস্থান, পরিষেবা, সামাজিক সুরক্ষা ইত্যাদি বিষয়গুলো উঠে আসে আমাদের নাগরিক চর্চার বৃত্তে, নিয়মিত, কেবল অস্থিরতা কিম্বা পর্যটনের মরশুমে নয়, যদি সেই অঞ্চলের মানুষেরা অংশ নেন সেই চর্চায়, যদি তাঁদের মাঝেমাঝে অন্তত দেখা যায় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সম্মানপ্রদান মঞ্চে, যদি দার্জিলিঙের দিল্লি-বেঙ্গালুরুমুখী ছেলেমেয়েদের বেশি করে দেখা যায় এই রাজ্যের বিভিন্ন কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে অফিসে, মিডিয়ায় প্রতিবেদকের ভূমিকায়, যদি ঘোর নস্টালজিক বাঙালি সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী দার্জিলিঙে বদলিকে নির্বাসন মনে না করেন, যদি সেখানে থেকে ঠিকমতো কাজ করেন, যদি পাহাড়ের কর্মচারীরা সমতলে বদলি হন স্বাভাবিক নিয়মে, তাহলে হয়তো ‘আমাদের পাহাড়ি ভাইবোনেরা’ কখনও ‘আমরা’ হয়ে উঠতেও পারে। আর ওরা আমরা হয়ে উঠলে দার্জিলিংকেও আমাদের বলতে আটকাবে না কোথাও।
ছবি সৌজন্যঃ শ্রী চন্দন হাজরা