Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দুটি দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু, আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক দায়

অনিকেত চট্টোপাধ্যায়

 

গাইনিকোলজি নিয়ে মুম্বাইয়ের টোপিওয়ালা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে এমডি পড়তে ঢুকেছিলেন ড. পায়েল তাড়ভি। এমবিবিএস শেষ করে মে মাসে পোস্টগ্রাজুয়েট করতে আসা ডাক্তারি ছাত্রী, জাতিবৈষম্যমূলক হেনস্থা সহ্য করতে না পেরে বাধ্য হলেন শেষ পথ বেছে নিতে। দিনের পর দিন হোস্টেলের সিনিয়রদের কাছ থেকে অপমান, গালিগালাজ, ঘর থেকে তাড়িয়ে দেওয়া, যোগ্যতা নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ— চারদিক থেকে বিঁধে ফেলা হচ্ছিল তাঁকে, ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছিলেন গত কয়েকমাস ধরেই, জানা যায় পায়েল তাড়ভির ‘প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা’র পর। এই ঘটনা ঘটে মাত্র এক মাস আগে।

আবার, রোহটক মেডিক্যাল কলেজের পোস্টগ্রাজুয়েট স্তরে পাঠরত ডাক্তারি ছাত্র ওঙ্কার বরিদাবাদের আত্মহত্যার ঘটনা সামনে আসে এক সপ্তাহ আগে। প্যাটার্নটা একই। গালিগালাজ, অপমান, হুমকি, সবার চোখে নীচু প্রতিপন্ন করা— ‘othering’ করা হয়েছিল একই ছাঁচে। পেডিয়াট্রিক্স বিভাগের প্রধান ওঙ্কারের থিসিস পেপার জমা নেননি কোনওভাবেই, এবং তার সঙ্গে ‘ছোটলোক’-এর প্রাপ্য হিসেবে জোটে জাত তুলে গালাগালি!

This was not the first time, Omkar was subjected to harassment, said his friends. Rajesh B, fellow PG mate of Omkar. “Omkar was made a scapegoat in an infant missing case reported in the hospital two years ago. He was under pressure and embarrassment whenever the police came looking for him at the college.”

ভাবুন দিকি, ডাক্তার! ওই, ওই ঠিক ভগবানের নীচটাতেই ধ্যানমগ্ন হয়ে গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে যিনি বসে থাকেন, সেই ডাক্তার। কী তাঁর সোশ্যাল স্ট্যাটাস, কী তাঁর সম্মান, কী তাঁর ক্রেডিট কার্ড! এইসব লোকজনের আবার জাতপাত বিচার হয় নাকি! জাতিবৈষম্যের সঙ্গে অর্থনৈতিক অবস্থা বা চাকরিকৌলীন্যকে মিশিয়ে দিতে চাওয়া জনগণকে আবারও ভুল প্রমাণ করে দিয়ে গেলেন এই দুই ডাক্তারি ছাত্র-ছাত্রী।

কথাটা ভেবে দেখবার মতো। ডাক্তারির মতো একটা ক্ষেত্রে, যেখানে রোগীকে তাঁর ধর্ম-বর্ণ-জাতি-ভাষা-লিঙ্গ নির্বিশেষে সমানভাবে চিকিৎসা করা হয়, সেই কর্মক্ষেত্রের ভেতরেই এরকম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা কীভাবে বেঁচে রয়েছে? শুধুমাত্র জাতপাতগত সমস্যাই নয়, এরকম অন্যান্য কাঠামোগুলোও (যেমন লিঙ্গগত বৈষম্য) ডাক্তারদের মধ্যে যথেষ্ট খোলাখুলিভাবেই বর্তমান।

বাইরের বিভিন্ন রাজ্যে এই জাতিগত বিদ্বেষ-হিংসার খবর যখন বারবার এসে পৌঁচ্ছছে এরাজ্যে, তখন এরাজ্যে আমরা ভাবছি পশ্চিমবঙ্গের সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে জাতপাতগত বৈষম্য খুব একটা ‘prevalent’ নয়— এই ধারণার অন্যতম কারণ হল জাতিহিংসার তীব্রতা সেরকমভাবে না থাকা।

এই রাজ্যের একজন ডাক্তারি ছাত্র হিসেবে তাই এখানকার পরিস্থিতিটাই একটু দেখার চেষ্টা করি।

কোনওরকম ইনফেকশন বা রোগকে বর্ণনা করতে গিয়ে চিকিৎসাবিদ্যায় ‘সাবক্লিনিক্যাল’ শব্দটা প্রায়ই ব্যবহার হয়। ‘সাবক্লিনিক্যাল’— অর্থাৎ, ক্লিনিক্যালের নীচে। ঠিক যে অবস্থায়, রোগ বা অসুখটা রয়েছে রোগীর শরীরে, বহাল তবিয়তে— কিন্তু শরীর বা মনে তার লক্ষণগুলোর প্রতিফলন এখনও গুরুত্বপূর্ণভাবে ফুটে ওঠেনি, যার জন্য চিকিৎসা শুরু করতে হবে।

আমাদের রাজ্যে ডাক্তারি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে অন্তত জাতপাতগত বিদ্বেষ এবং ‘অপর’ মানসিকতার স্তর এখনও সাবক্লিনিক্যাল অবস্থায় রয়েছে। যদিও ঘরের লোক-আত্মীয়-পরিচিত মিলিয়ে চারপাশের সমাজে কান পাতলেই শোনা যায়, ‘কোটার ডাক্তার দেখাব না’, এবং সমাজেরই অংশ হিসেবে এই মানসিকতার কিছুটা প্রতিফলন ডাক্তার এবং ডাক্তারি ছাত্রদের মধ্যেও চুঁইয়ে পড়ছে প্রতিনিয়ত— তবু জাতিবৈষম্য এখনও সেই চরম তীব্রতায় পৌঁছে উঠতে পারেনি, যেখানে হেনস্থার জন্য, সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের থেকে ‘অপর’ করে তোলার জন্য একজন ‘এসসি-এসটি’ বা দলিত ডাক্তারকে পেশা থেকে, বা জীবন থেকেই সরে যেতে হয়। এজন্য কিছুটা দায়ী হয়তো পশ্চিমবঙ্গের কিছুটা অসংলগ্ন কাস্ট সিস্টেম যেটা খুব একটা ‘defined’ নয়, কিছুটা দায়ী ডাক্তারি হোস্টেলগুলোতে পরম্পরায় চলে আসা সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক, কিছুটা দায়ী ডাক্তারি শিক্ষা ব্যবস্থার কঠিন পড়াশুনো-পরীক্ষার ব্যবস্থা যেখানে সবার হাতে হাত রেখে চলাটা অনেক সহজ করে দেয় মেডিক্যাল কলেজের সাড়ে পাঁচ বছর।

কিন্তু ‘সাবক্লিনিক্যাল’ বলে কি সিস্টেমের ভেতর দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলা এই বৈষম্যের ধারাবাহিকতা আলোচনার দাবি রাখে না? পুরুলিয়ার গ্রাম থেকে উঠে আসা আদিবাসী ছাত্র বা ছাত্রীটিকে পরীক্ষায়, ভাইভাতে কি বারবার তার ইংরেজি উচ্চারণের জন্য, তার কথাবলার ধরনের জন্য উপহাসের পাত্র হতে হয় না? কাস্ট বলতেই যে মেধাবী ডাক্তারি ছাত্রছাত্রীদের পরের শব্দ মাথায় আসে ‘রিজার্ভেশন’ এবং জাতিবৈষম্য ও জাতিহিংসা নিয়ে বাস্তব বোঝাপড়া না রেখেও যাঁরা অবলীলায় রিজার্ভেশন নিয়ে বক্তব্য রেখে চলেন, তাঁদের একটু খোঁচা মেরে দেখলেই বোঝা যায়, কীভাবে ভেতরে ভেতরে দানা বেঁধে চলেছে অপরায়ন এবং জাত্যাভিমান। সেক্ষেত্রে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে ‘মেরিট’ বা ‘মেধা’ এবং কেন শুধুমাত্র মেধা অনুযায়ী ডাক্তারি পড়ার যোগ্যতা বিচার হবে না— সেই নিয়ে চলতে থাকে কমেন্টযুদ্ধ। দলিত আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যে আলাদাভাবে দেখার, আলাদা আচরণ করার প্রবণতা চলে সমাজের মধ্যে, সেই ‘othering’ খুব সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গেঁড়ে বসে কোণায় কোণায়, যা আসলে মান্যতা দেয় তথাকথিত বড় আকারের জাতিহিংসাগুলোকে। সেটা কখনও হোস্টেল/কর্মক্ষেত্র থেকে তাড়িয়ে দেওয়া, কখনও হেনস্থার মধ্যে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত করে তোলা, কখনও ‘নিজের জায়গা’ বুঝিয়ে দেবার জন্য ধর্ষণ, আত্মহত্যায় প্ররোচনা, এবং অনেকক্ষেত্রে হত্যা।

সম্প্রতি জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন শেষ হল। নিরাপত্তার দাবিতে, সুরক্ষার দাবিতে, এবং এর হাত ধরেই একটা দূর পর্যন্ত পরিকাঠামোর দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন ইন্টার্ন-হাউসস্টাফ-পোস্টগ্র্যাজুয়েট ট্রেনি সহ সিনিয়র ডাক্তাররা। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ফেটে পড়া এই আন্দোলন চলাকালীনই সামনে আসে ড. ওঙ্কারের আত্মহত্যার কথা। পায়েল, ওঙ্কাররা আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, ‘সাদা কোট’-এর এই ডাক্তার গোষ্ঠীর মধ্যে এই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা সদর্পে বিরাজমান, এবং তার সঙ্গে লড়াইটা করতে হবে ভেতর থেকেই। শুধুমাত্র আন্ডারগ্র্যাজুয়েট এবং পোস্টগ্র্যাজুয়েট সিট এবং সিটের সঙ্গে জড়িয়ে ব্যক্তিস্বার্থের কথা ভাবতে ভাবতে ডাক্তারি ছাত্র-ছাত্রীরা আলোচনার পরিসরটুকু যদি রিজার্ভেশনেই আটকে দেন, এবং সেইটুকু গণ্ডির মধ্যে থেকেই চলে বিতর্ক-মতামত-মতানৈক্য, তাহলে বোধহয় আগামীদিনে আমরা মূল সমস্যা থেকে অনেকটাই চোখ ঘুরিয়ে ফেলব।

বাড়তে থাকা সমস্যাকে দেখেও না দেখার ভান করে, সাবক্লিনিক্যাল ইনফেকশনকে নিজের গতিপথ ধরেই ক্লিনিক্যাল হতে দিয়ে, আমরা নিজেরাই নিজেদের পায়ে স্ক্যালপেল ছুঁড়ে মারছি না তো?

রাজ্যে যখন বিজেপির মতো বিভাজনের রাজনীতিতে বিশ্বাসী শক্তি ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে, তখন এই সমস্যার সমাধানে ডাক্তারসমাজকে আরও উদ্যোগী হয়ে উঠতেই হবে, আপন স্বার্থে।