Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মনসান্টো বনাম ভারতীয় কৃষক

ড. বন্দনা শিব

 

অনুবাদ : স্রোতা দত্ত আচার্য

“আমরা যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, তবে আমাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতাও অত্যন্ত জরুরি। মনসান্টো-র মতো এক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত বিনা বিচারে মেনে নেব না কি, আমরা নিজেরা ঠিক করব, আমাদের জন্য ঠিক কী ধরণের প্রযুক্তি উপযুক্ত। মুষ্টিমেয়কে আরও বিত্তশালী করে তুলতে ব্যবহৃত প্রযুক্তি বেশি গ্রহণযোগ্য নাকি প্রকৃতি ও মানবসমাজের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা প্রযুক্তির গ্রহণযোগ্যতা বেশি। সেই ভারসাম্যের উপরেই নির্ভর করছে আমাদের স্বাস্থ্য, খাদ্যাভ্যাস এবং এই পৃথিবীতে আমাদের ভবিষ্যৎ।”

মনসান্টো: আ চেকারড হিস্ট্রি, ব্রায়ান টোকার

দ্য ইকোলজিস্ট, ভল্যুম ২৮, নং ৫, সেপ্টেম্বর / অক্টোবর ১৯৯৮

 

কৃষিকাজের একেবারে গোড়ার কথা বীজ। শস্য উৎপাদনের প্রাথমিক হাতিয়ার এবং কৃষকদের জীবনের ভিত্তি। প্রায় দু’দশক হতে চলল, ভারতীয় কৃষকদের হাত থেকে তুলোর বীজ কেড়ে নিয়েছে মনসান্টো। তুলো চাষের জন্য, স্থানীয় বীজ বৈচিত্র্যকে তছনছ করে জিএমও (জেনেটিক্যালি মডিফায়েড) বিটি কটন চালু করেছে। তার রয়্যালটি-র নামে বীজের দাম বাবদ কৃষকদের কাছ থেকে লাগামছাড়া টাকা আদায় করেছে। ১৯৯৮ সালে মনসান্টো ভারতে ব্যবসা শুরু করে। তারপর থেকে তুলোর দাম বেড়েছে ৮০, ০০০ শতাংশ (প্রতি কেজি ৫-৯ টাকা থেকে ৪৫০ গ্রামের দাম ১৬০০ টাকা)। ফলনে ক্ষতি এবং ঋণ এই দুইয়ের জাঁতাকলে পড়ে ৩০০,০০০০ চাষী আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে ৮৪ শতাংশ মৃত্যুর জন্য সরাসরি দায়ী মনসান্টো।

২০১৬-র খরিফ মরসুমে ফসল বোনার জন্য ন্যায্য দামে, ঠিক সময়ে বীজ হাতে পাওয়াটাই ৮০ লক্ষ কৃষকের কাছে হয়ে দাঁড়িয়েছিল মরণবাঁচনের সমস্যা। যে পরিস্থিতি ৮০ লক্ষ ভারতীয়ের জীবনধারণ বিপন্ন করে তোলে তা জাতীয় বিপর্যয়। কারণ বীজের দামের বিষয়টি সরাসরি কৃষকের অধিকারে আঘাত হানে। তাছাড়া রয়্যালটিসহ বীজের মাত্রাতিরিক্ত দাম বহু চাষীকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিয়েছে। তারপরই কেন্দ্র রাজ্য সরকারগুলি বীজের দাম কমানোর বিষয়ে তৎপর হয়েছে।

বীজের অবস্থা নিয়ে মনসান্টো, ভারতীয় কৃষক এবং ভারত সরকারের মধ্যে বর্তমান বিরোধে তিনটি বিষয় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। প্রথমত, ভালো এবং সহজলভ্য বীজ কৃষকের অধিকার। সেই সঙ্গে কৃষকদের জীবন ও জীবিকার অধিকার রক্ষা সরকারের কর্তব্য। সংবিধানের ২১ ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের জীবনের ও নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের। তাই কৃষকদের অধিকার রক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার তুলো বীজের দাম নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে যে নির্দেশ জারি করেছে তা বিচার্য।

দ্বিতীয়ত, ঝুটো দাবী এবং ব্যর্থ প্রযুক্তির সূত্র ধরে একাধিক আইপিআর (ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইট), পেটেন্টস, রয়্যালটি ও   প্রযুক্তির জন্য খরচের মতো বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় পেটেন্ট আইনের ৬৪ এবং ৬৬ ধারা মোতাবেক পেটেন্ট প্রত্যাহার করার বিষয়টিও ভারত সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। বলে রাখা ভালো, পেটেন্ট নিয়ে মনসান্টোকে ইতিমধ্যেই কারণ দর্শাও বা ‘শো কজ’ নোটিস ধরিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।

তৃতীয়ত, বীজের উপর একচেটিয়া অধিকার (মোনোপলি)। যে একচেটিয়া ক্ষমতা কায়েমের চেষ্টা চলছে তা রোধ করা সরকারের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। সেই কারণেই এর আগে এমারটিপি কমিশন ছিল এবং বর্তমানে হয়েছে কম্পিটিশন কমিশন।

একচেটিয়া ক্ষমতায়ন বিষয়টি এখন ভারতীয় প্রতিযোগিতা কমিশনের হাতে। এই কমিশন জানিয়েছে, মনসান্টো প্রতিযোগিতা আইন লঙ্ঘন করেছে। বাজারদখলে মনসান্টোর বিরুদ্ধে হাতেনাতে প্রমাণও মিলেছে।

মনসান্টো একই সঙ্গে বিভিন্ন আদালতে মামলা চালিয়ে সময় ও সমর্থন কিনছে, এবং জনমত নিজের দিকে নেবার চেষ্টা করছে। প্রথমত, মনসান্টো ভারতের লাইসেন্সধারী বীজ ব্যবসায়ী কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বীজের দামের ফারাক ক্রমাগত কমিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। এই ভাবে কৃষকদের এবং তাঁদের মৌলিক অধিকার পুরোপুরি মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। দ্বিতীয়ত, বিটি কটনের পেটেন্ট প্রত্যাহার বিষয়ে ভারত সরকার যে কারণ দর্শাও নোটিস জারি করেছিল, মনসান্টো তা যেমন লুকোচ্ছে, তেমনই ভারতীয় প্রতিযোগিতা কমিশনের মামলাটিও জনগণের চোখের আড়ালেই রেখেছে মনসান্টো । এই সব বিষয়গুলিই কৃষকের জীবিকা এবং তাঁর অধিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

 

বীজের অধিকার = জীবনের অধিকার

কৃষকদের ক্ষেত্রে তাঁদের জীবনের অধিকারের মূলে রয়েছে বীজের অধিকার। কিন্তু সমস্যা হল, শেষ পর্যন্ত রয়্যালটি বাবদ টাকা কৃষকের ট্যাঁক থেকেই যায়। রয়্যালটি মূল্যসহ বীজের দাম অত্যধিক বেশি। তারপরেও যে বীজ কৃষকের হাতে আসে, তাকে বিশেষ ভরসা করা যায় না। দুটি কারণই কৃষকের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে মরণফাঁদ। বাজারে বীজের সহজলভ্যতার জন্য যে বিধিনিয়ম রয়েছে, মনসান্টোর রয়্যালটি তা লঙ্ঘন তো করছেই উপরন্তু কৃষকদের ঋণ, তাঁদের দুর্গতি এবং আত্মহত্যার কারণও মনসান্টোর রয়্যালটি। প্রথমে বিটি ১, এখন বিটি ২, দুই ধরনের বীজই এখন পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। পিঙ্ক বোলওয়ার্মের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে গিয়েছে। বিটি তার গ্রহণযোগ্যতার পরীক্ষায় তোলায় পুরোপুরি ব্যর্থ।

বিটি ১ এর কোনও পেটেন্ট না থাকলেও ২০০২ সাল থেকে রয়্যালটি বাবদ টাকা আদায় করেছে মনসান্টো। রয়্যালটি-র বকলমে ‘প্রযুক্তি বৈশিষ্ট্য’ (টেকনোলজি ট্রেইট) নামে নতুন ব্যবস্থায় আদায় হয়েছে ট্রেইট ফী। আসলে তা রয়ালটিরই অন্য নাম।

আমেরিকায় যেমন প্রত্যেক কৃষকের সঙ্গে চুক্তি করে মনসাণ্টো, ভারতে সেভাবে আলাদা করে প্রত্যেকের সঙ্গে চুক্তি করা সম্ভব নয়। কারণ, ১) তাহলে বিশাল সংখ্যায় চুক্তি করতে হবে। ২) ধরা যাক বিটি জিন(MON 531 event of Cry1Ac) -এর ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি চুক্তির আওতার মধ্যে পড়ে। কিন্তু মনসান্টো তার স্বত্বাধিকারী নয়। বলা ভাল, মনসান্টোর কাছে তার পেটেন্ট নেই। ঠিক যেমন করে আমাদের সুজলা-সুফলা জমি নিংড়ে, চাষীদের নিঃস্ব করে কর ও রাজস্ব আদায়ের জন্য খেয়ালখুশি মতো জমিদারদের নিয়োগ করেছিল ব্রিটিশ শাসক। প্রায় সেইভাবেই মনসান্টো রয়্যালটির নামে টাকা আদায়ের জন্য সমঝোতায় বেঁধে ফেলেছে ভারতের লাইসেন্সপ্রাপ্ত ২৮টি কোম্পানিকে। ব্রিটিশ ভারতে ঠিক যে ভাবে চাষীরা জমিদার বা কালেক্টরের মাধ্যমে ব্রিটিশদের খাজনা দিত, এখনও সেইভাবেই ভারতের লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে মোসান্টোকে চড়া দাম দেয় কৃষকেরা। একদিকে কৃষকদের স্বার্থরক্ষায় বীজের দাম নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ অন্যদিকে হয় রয়্যালটির নামে বেআইনিভাবে নয়গুণ টাকা দাবি করছে মনসান্টো, নয়তো একতরফাভাবে কিছু কিছু লাইসেন্স চুক্তি একেবারে বাতিল করে দিচ্ছে। এই দুইয়ের মাঝে পড়ে নাজেহাল ভারতীয় বীজ কোম্পানিগুলোও।

অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার এমআরটিপিসি (মোনোপলিজ অ্যান্ড রেস্ট্রিকটিভ ট্রেড প্র্যাকটিস কমিশন)-তে একটি মামলা করে। মামলায় রিসার্চ ফাউন্ডেশন মধ্যস্থতা করে। এর ফলে ২০০৬ সালে প্রযুক্তিমূল্য সহ বীজের দাম কমে। সে সময়ে এমএমবি (মেহিকো মনসান্টো বায়োটেক) প্রতি প্যাকেট ২৯ মার্কিন ডলারে বীজ বেচছিল। অন্যান্য বীজ কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করে অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার প্রযুক্তিমূল্য-সহ হাইব্রিড বিটি কটন বীজের দাম প্রতি প্যাকেটে (৪৫০ গ্রাম) ১৮ মার্কিন ডলারে নামিয়ে আনে। তার দেখাদেখি, অন্যান্য রাজ্য সরকারগুলিও এই নীতি গ্রহণ করে।

বর্তমানে মহারাষ্ট্রে ৪৫০ গ্রামের বিটি কটনের প্যাকেট মোটামুটি ৮৩০টাকায় বিক্রি হয়। সেই একই পরিমাণ বীজ কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, গুজরাত এবং তামিলনাড়ুতে বিক্রি হয় ৯৩০টাকায়। আবার, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থানের মতো উত্তরের রাজ্যগুলিতে তার দাম ১০০০ টাকা। এই মুহূর্তে বিটি বোলগার্ড-১ এবং বিটি বোলগার্ড-২ বীজের জন্য এমএমবি ট্রেইট ফী বাবদ প্রতি প্যাকেটে যথাক্রমে ১২২.৯৬ টাকা এবং ১৮৩.৪৬ টাকা নিয়ে থাকে।

২০১৬-র ৮ মার্চ, কেন্দ্র সরকার বীজের মূল্য নিয়ন্ত্রণে একটি নির্দেশিকা জারি করে বিটি কটনের বীজে মনসান্টোর রয়্যালটি ৭৪% শতাংশ কমিয়ে দেয়। কিছু কিছু পোকামাকড়ের আক্রমণ প্রতিহত করায় মনসান্টোর প্রযুক্তি কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলায় বিফল প্রযুক্তিতে রয়্যালটি ফী কমানো ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।

কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার একাধিকবার বীজের দাম নিয়ে নিয়ম বেঁধে নজির তৈরি করায়, মরিয়া হয়ে মনসান্টো কেন্দ্রের মূল্য নিয়ন্ত্রণের নির্দেশিকাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দিল্লি হাইকোর্টে মামলা করে। কিন্তু বীজের দামে নিয়ম নিগড় ও রয়্যালটির অংশ বিষয়ে সরকারি নির্দেশিকায় স্থগিতাদেশ জারি করতে অস্বীকার করে দিল্লি হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে নিজেদের লবি গ্রুপ ‘এব্‌ল’-এর মধ্যস্থতায় মনসান্টো কর্ণাটক হাইকোর্টেও আপিল করে। অবশ্য কর্ণাটক হাইকোর্টও বীজের দাম নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত কেন্দ্র সরকারের নির্দেশিকাকেই মান্যতা দিয়েছে। তবে এক অন্তর্বর্তী আদেশে, কর্ণাটক হাইকোর্ট জানিয়েছে, দুই কোম্পানির সমঝোতার ভিত্তিতে রয়্যালটি স্থির হয় বলেই সরকার রয়্যালটির দাম ধার্য করতে বা বেঁধে দিতে পারে না। যদিও এই রায়ে, কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য, বিটি কটন বীজের সর্বাধিক বিক্রয়মূল্য (এমএসপি) স্থির করার ক্ষমতাও সরকারকেই দেওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞান ও আইনের ফোকর গলে, বীজের থেকে জিনকে আলাদা করে দেখানোর এবং বীজের দামের থেকে ট্রেইট ফী-কে আলাদা করে দেখানোর চক্রান্ত করে মনসান্টো আসলে ভারতীয় কৃষকদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা লুটে নিয়েছে।

 

বিটি প্রযুক্তি নয়, জিন : বিটি জিন, বিটি কটন বীজের একটা অংশ এবং এর ট্রেইট ভ্যালুও বীজের দামেরই একটা অংশ

বীজ অন্যান্য উৎপাদিত পণ্যের থেকে আলাদা। অন্যান্য পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রযুক্তি, উৎপাদিত পণ্যের থেকে আলাদা। কিন্তু বিটি কটনের মতো জেনেটিক্যালি মডিফায়েড বীজে, একবার বিটি জিন প্রবেশ করলে তা বীজেরই অংশ হয়ে ওঠে। তখন আর তাকে আলাদা করা যায় না। বিভ্রান্তি ছড়ানোর উদ্দেশ্যে মনসান্টো বিটি জিনকে প্রযুক্তির তকমা দিয়েছে। ফলে প্রযুক্তি ট্রেইট বিটি কটনের অংশ হয়ে গিয়েছে তাকে আর আলাদা করা যাচ্ছে না। একই বৈজ্ঞানিক যুক্তির ভিত্তিতে প্রযুক্তি ট্রেইট-এর জন্য বীজের দামের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হয়ে পড়ছে প্রযুক্তি ফী। তাকে আলাদা করা যাচ্ছে না। আর তা ব্যয় করতে হচ্ছে কৃষককেই।

গাছে জিনের প্রবেশ ঘটানোর জন্য যে ‘প্রযুক্তি’-র যে ক্ষতিকর ব্যবহার চলছে, তা আসলে দুটো গুরুত্বপূর্ণ তথ্যকে আড়াল করে। ১) জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিঙে যে যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়, মনসান্টো তা ব্যবহারের লাইসেন্স ভারতীয় বীজ কোম্পানিগুলোকে দিচ্ছে না (গাছের সঙ্গে আপাত সম্পর্কহীন কোন জিনের প্রবেশ ঘটাতে ব্যবহৃত সরঞ্জাম)। এই সরঞ্জাম মতে দুটো ঃ একটা জিন বন্দুক অথবা একটি অ্যাগ্রোব্যাক্টেরিয়াম। মনসান্টো ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে যা দিচ্ছে, তা ট্রান্সজেনিক গাছ তৈরির প্রযুক্তি নয়। তার বদলে দিচ্ছে বিটি কটনের বীজ। সেই বীজে নিহিত আছে, মনসান্টোর একচেটিয়া ক্ষমতার বৃদ্ধি, ব্যবসা এবং হাইব্রিড করে ফেলার জিন। বোঝাই যায়, প্রযুক্তি ফী এবং প্রযুক্তি ট্রেইট-এর মতো শব্দবন্ধ ব্যবহার করে, বীজ এবং বীজের দামের মতো সাদামাটা একটা বিষয়কে আড়াল করে তাকে জটিল এবং রহস্যময় করে তোলা হচ্ছে। বীজের দাম এখন ভারতীয় কৃষকদের জন্য জীবন-মরণের মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২) প্রতি মরসুমে প্রযুক্তি ট্রেইট-এর মূল্যে রদবদল ঘটিয়ে মনসান্টো বুঝিয়ে দেয় আল বিষয় হল বীজের দাম।

কমডিটি চ্যানেল ইনডেক্স (সিসিআই)-এর রেকর্ড বলছে –

প্রসঙ্গত তথ্য প্রমাণ অনুযায়ী, বিটি কটন প্রযুক্তি করায়ত্ত্ব করতে ইনফরম্যান্ট-সহ ভারতের একাধিক বীজ কোম্পানি এমএমবিএল-এর সঙ্গে অগ্রিম বাবদ এককালীন, ফেরত অযোগ্য ৫০ লক্ষ টাকার ও ট্রেইট ভ্যালু নামে রেকারিং ফী সহ সাব-লাইসেন্স-এর চুক্তি করেছে। এই ট্রেইট ভ্যালু হল, বিটি জিনের প্রযুক্তির মাধ্যমে পোকামাকড়ের প্রতিরোধের ক্ষমতা সংক্রান্ত ব্যবস্থার আনুমানিক মূল্য। এর উপরেই বিটি কটন বীজের দামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ নির্ভর করে। বলা হয়েছে যে, কোনও ফলনের মরসুমের আগে ৪৫০ গ্রামের একটি প্যাকেটের সর্বোচ্চ পাইকারি মূল্যের ভিত্তিতে তার ট্রেইট ভ্যালু স্থির করে এমএমবিএল। সেই সঙ্গে এও জানা গিয়েছে যে, ট্রেইট ভ্যালু হিসবে পাওয়া টাকার কিছু অংশ রয়্যালটি বাবদ এমআইইউকে দেওয়া হয়। এ ছাড়াও ট্রেট ভ্যালু হিসেবে সংগৃহীত টাকর সামান্য অংশ (১৫-২০ শতাংশ) মনসান্টো ইউএস-কে দেয় এমএমবিএল।

বিষ লক্ষণযুক্ত বিটি বীজের জন্য অগ্রিম টাকা দেওয়ার পর প্রযুক্তি ফী-র নামে বীজের দাম বাড়িয়ে বাজার থেকে টাকা আদায় আসলে একচেটিয়া বাজারে বেআইনিভাবে, লোভীর মতো লাভের অঙ্ক বাড়ানোর উপায় ছাড়া আর কিছু নয়। এমআরটিপিসি( মোনোপলিজ অ্যান্ড রেস্ট্রিকটিভ ট্রেড প্র্যাকটিস কমিশন)-র পর্যবেক্ষণেও একই জিনিস ধরা পড়ায় মনসান্টোকে ‘ট্রেইট ফী-র মতো মিথ্যা সাজাতে হয়েছে।

ইতিমধ্যে, ২০০৬-এর ১১ মে, এমআরটিপিসি-র পাশ করা অন্তর্বর্তী আদেশের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী “রয়্যালটি এবং ট্রেট ভ্যালুর মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে… এ দুটি সমার্থক নয়… এককালীন প্রদেয় থোক ৫০ লক্ষ টাকাকে রয়্যালটি হিসেবে মেনে নেওয়া গেলেও, কিন্তু ভবিষ্যতে বিক্রির দামকে রয়্যালটি বলা যায় না।” এবং জানিয়ে দেয়, “মামলা চলাকালীন এমএমবিএল ৪৫০ গ্রামের এক প্যাকেট বিটি কটনের জন্য ৯৯০ টাকার ট্রেইট ভ্যালু ধার্য করতে পারবে না। চিনের মতো পড়শি দেশে, যে ভাবে মূল কোম্পানি ট্রেইট ভ্যালু স্থির করেছে, সেভাবে এখানেও ন্যায্য মূল্যে তা স্থির করতে হবে।

কর্ণাটক হাইকোর্টের বিচারে, বীজের রয়্যালটির বিষয়টি “নিজেদের মধ্যে (দুই কোম্পানির মধ্যে) সমঝোতার ভিত্তি” এবং তা ভারত সরকারের এক্তিয়ারের বাইরে।

মনসান্টোর অতিরিক্ত লাভের মূল্য ভরতের কৃষক নিজের জীবন দিয়ে চোকাচ্ছে। বীজের দাম নিয়ন্ত্রণ করে কৃষকদের আত্মহত্যার মতো বিপর্যয় রোধে সরকারের হস্তক্ষেপ অবশ্য প্রয়োজনীয়।

 

বিটি কটন এক ব্যর্থ প্রযুক্তি, মনসান্টোর পেটেন্ট রদ করা উচিত

কর্ণাটক সরকারের অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দুটো বিষয়কে এড়িয়ে গিয়েছে। প্রথমত, পিঙ্ক বোলওয়ার্ম নিয়ন্ত্রণে বিটি-২ ব্যর্থ হইয়ার কারণে মনসান্টোর পেটেন্ট কেন প্রত্যাহার করা হবে না তা কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করেছে সরকার। পেটেন্ট আইনের ৬৪ এবং ৬৬ ধারা অনুযায়ী সরকার পেটেন্ট প্রত্যাহার করার ক্ষমতা রাখে।

দ্বিতীয়ত, ভুয়ো দাবির ভিত্তিতে তৈরি পেটেন্ট কাজে লাগিয়ে মনসান্টো বাজারে একচেটিয়া দখলদারি কায়েম করে, বীজের দাম বাড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, কৃষকদের জন্য অপেক্ষাকৃত কম দামে বিশ্বাসযোগ্য যে সব বিকল্প রয়েছে, তা ধ্বংস করছে মনসান্টো। তুলো চাষের এলাকায় চাষীদের সঙ্কটের মূল কারণ এটাই।

যদি এই সংস্থা জনস্বার্থ লঙ্ঘন করে অথবা তাদের দাবি মিথ্যে প্রমাণিত হয় তবে তাদের পেটেন্টের অনুমতি না দেওয়া অথবা পেটেন্ট প্রত্যাহার করা সরকারেরই দায়িত্ব।

 

বানানোআবিষ্কার

 

 

বিটি ২-তে মনসান্টোর দুটি পেটেন্ট আছে। IN 214436 (Methods for transforming plants to express Bacillus thuringiensis) এবং Patent No. 232681 এটি বোলগার্ড-২ প্রযুক্তির আইপিআর (ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইট)-এর সুরক্ষার জন্য।

মনসান্টোকে দেওয়া পেটেন্ট ভারতীয় পেটেন্ট অ্যাক্ট ১৯৭০কে লঙ্ঘন করে। বিশেষত সেকশন ৩ (জে) ধারা। তা গাছ, বীজ ওঃ বৈচিত্র্যের জীবনবিজ্ঞানসংক্রান্ত পদ্ধতি পেটেন্টের আওতাধীন নয়। এবং ৩ (এইচ) বাগান করা ও কৃষিকাজের কৌশলকে পেটেন্টের আওতার বাইরে রেখেছে।

৩ (জে) ধারা কাজে লাগিয়ে জলবায়ু স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে মনসান্টোর পেটেন্ট খারিজ করেছে ভারতের পেটেন্ট অফিস।

পেটেন্ট আইনের ৬৪ এবং ৬৬ ধারায় পেটেন্ট প্রত্যাহার করা যায়। আর্টিক্‌ল ৬৪-এর নিম্নলিখিত উপধারায় বিটি কটনের পেটেন্ট প্রত্যাহার করা উচিত।

৬৪। পেটেন্ট প্রত্যাহার

১) সংশ্লিষ্ট আইন চালু হওয়ার আগে বা পরে পেটেন্ট দেওয়া হলেও তা যে কোনও আগ্রহী মানুষের আবেদনের ভিত্তিতে অথবা অ্যাপালেট বোর্ডের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার কিম্বা…

ভারতীয় কটন রিসার্চ ইন্সটিটিউট এবং ধারওয়াড কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিঙের মাধ্যমে বিটি জিনের সূচনার কথা জানতে পেরেছিল ভারত। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিঙে দক্ষ যে কারও পক্ষে দুটি বিটি জিন যোগ করা বিশেষ কঠিন কাজ নয়। ফলত এই তুলোয় বিটি জিনের ভূমিকার তথাকথিত আবিষ্কার প্রমাণ করে দিয়েছে যে তা পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে কার্যকারী নয়।

(জে) মিথ্যা পরামর্শ ও উপস্থাপনার ভিত্তিতে পেটেন্ট নেওয়া হলে

বিটি কটন পোকামাকড়, বিশেষত বোলওয়ার্ম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই ধরণের মিথ্যা আশা দিয়ে পেটেন্ট নেওয়ায় আর্টিক্‌ল ৬৬ অনুযায়ী জনস্বার্থে তা প্রত্যাহার করা সম্ভব।

কেন্দ্রীয় সরকার যদি মনে করে যে, পেটেন্ট অথবা তার মাধ্যমে কোনও দুরভিসন্ধিমূলক অথবা জনস্বার্থ বিরোধী কাজকর্ম চলছে, তবে পেটেন্টধারীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়ার পর সরকারি গেজেটে নির্দেশনামা জারি করে পেটেন্ট বাতিল ঘোষণা করতে পারে।

বীজের অতিরিক্ত দাম, মিথ্যা প্রতিশ্রুতির জন্য হাজার হাজার ভারতীয় কৃষকের আত্মহত্যা করেছে। মনসান্টোর বিটি কটন প্রত্যাহার করার জন্য এটাই কি যথেষ্ট নয়? একটা ব্যর্থ প্রযুক্তির জন্য কেন কৃষকদের এরকম চড়া দাম দিতে বাধ্য করা হবে? মনসান্টোর ব্যর্থ প্রযুক্তি কে কেন তাদের লবিগ্রুপ আবিষ্কার বলে নিরন্তর প্রচার করে?

২০১৬-র ১৪ মার্চ-এর ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’- এ ‘হেডিং ব্যাকওয়ার্ড’ শিরোনামে অশোক গুলাটির লিখেছেন, মনসান্টো যদি ভারত ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, বোলগার্ড ৩ হয়তো আসবে না এবং ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে বোলগার্ড ২ তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে।

বোলগার্ড ১ বিফল, বোলগার্ড ২- ও বিশেষ কাজের নয়, তাও ইতিমধ্যে বোঝা গিয়েছে। তা সত্ত্বেও আমাদের অধিকার আমাদের সার্বভৌমত্ব/ স্বাধীন মতামত বিসর্জন দিয়ে বোলগার্ড ৩ আসার পথ সুগম করে দেব যাতে করে আগামী কয়েক বছরেই আগের বোলগার্ডের মতো বিফল প্রমাণিত হয়? যতবার আরও বেশি বিষাক্ত জিন দেবে ততবার এরা রয়্যালটি বাড়াবে। আইনস্টাইন বলেছিলেন, “অন্য ফলের আশা করে একই কাজ বারবার করে যাওয়া পাগলামোরই নামান্তর।” আমরা কি সেই পাগলামোকেই ‘আবিষ্কার’ বলে চিহ্নিত করছি?

বিটি কটনের প্রযুক্তি এমনই যে, যে সব পোকামাকড়ের কথা মাথায় রেখে তা বানানো হয়নি, গাছে শ্বে সব পোকা মাকড়ের আক্রমণ বাড়বে। আর বোলওয়ার্ম- যে কইতের কথা মাথায় রেখে তা বানানো, তার নিত্য নতুন প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করবে। আরও বিষাক্ত জিনের মাধ্যমে আরও তাড়াতাড়ি বিবর্তনের মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা উঠে আসবে। বেআইনিভাবে বাজারে জিএমও চালু রাখার জন্য যারা একে বরাবর ‘বিজ্ঞান’ আখ্যা দিচ্ছে, তারা জিএমও প্রযুক্তির প্রভাব ও তার গ্রহণযোগ্যতার বিরুদ্ধে বিবর্তনের মৌলিক বিজ্ঞানটাকেই স্বীকার করছে না। তা ভারতে বিটি কটন প্রতিরোধী সুপারপেস্ট হোক বা আমেরিকায় রাউন্ড আপ প্রতিরোধী সুপারউইড।

মনসান্টোর জন্য বিটি কটন চালু রাখা এবং একমুখী সমঝোতায় ভারতীয় কোম্পানিগুলিকে আটকে রাখা, বীজের বাজারে একচেটিয়া অধিকার কায়েম করার উপায় ছাড়া আর কিছুই নয়। ব্যাস!

অচল বিটি কটনের জন্য পেটেন্ট প্রত্যাহার করার বিষয়টি ছাড়াও পেটেন্ট নিয়ে বাজারের একচেটিয়া দখলদারিও গুরুত্বপূর্ণ। মনসান্টো জানে, যে প্রযুক্তির উপর ভরসা করা যায় না, তার জন্য পেটেন্টের গাজর দেখিয়ে রয়্যালটির নামে কৃষকদের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে টাক আদায় করতে পারে। ভারতীয় কোম্পানিগুলোর দেশের বাজারে কম দামে, নির্ভরযোগ্য বীজ বিক্রি করার স্বাধীনতা থাকলে এবং দেশের কৃষকদের যদি নিজেদের তৈরি জৈব বীজ উৎপাদনের স্বাধীনতা থাকলে, মনসান্টোর বিটি কটনে কেউ হাত দেবে না। তাই অযৌক্তিকভাবে রয়্যালটি কামাতে এবং লাইসেন্স সমঝোতায় ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে সীমাবদ্ধ করে রাখতেই মনসান্টো বেআইনিভাবে পেটেন্ট ব্যবহার করে। গোটা বিষয়টি এখন ভারতীয় প্রতিযোগিতা কমিশনের হাতে।

 

মূল রচনাটি ইংরাজিতে পড়ার জন্য এইখানে দেখুন

(ছবি: ইন্টারনেট)