সৌমিত্র দস্তিদার
এখনও, এতবছর বাদেও ভোর রাতে শব্দটা যেন আমি শুনতে পাই। সিনেমার ভাষায় একস্ট্রিম লংশট ক্রমে ক্রমে ক্লোজ, বিগ ক্লোজ আপ হয়ে ঘরের দরজায় ধাক্কা দেয়— খুলুন, দরজা খুলুন। না হলে ভেঙে ঢুকব। ধড়মড়িয়ে জেগে ওঠে পাড়া। মা নীরবে আমার ও বাবার দিকে তাকিয়ে ধীর পায়ে দরজা খোলেন। মাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ঘরের দখল নেয় সরকারের উর্দি।
১৯৭৫ সাল। ছাব্বিশে জুন। জরুরি অবস্থা।
অন্ধকার নেমে আসে ভারতীয় গণতন্ত্রে। যাবতীয় মানবাধিকার কেড়ে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি স্বৈরতান্ত্রিক পথ নিলেন। তারপরের দু বছর একদা এশিয়ার মুক্তিসূর্যের তাপ ঝলসে যেতে লাগল সারা দেশ।
অথচ মাত্র চার বছর আগে ১৯৭১ সালে শ্রীমতি গান্ধির জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হতে লাগল— ইন্দিরাই ভারত, ভারতই ইন্দিরা।
সম্ভবত ওই বিপুল জনপ্রিয়তার মধ্যেই ছিল তার পতনের সম্ভাবনা। চার বছরের মধ্যে আকাশ থেকে সরাসরি মাটিতে। একদিকে নকশাল আন্দোলন দমনে কংগ্রেসের হিংস্র আক্রমণ। অন্যদিকে রাজ্যে রাজ্যে অর্থনৈতিক সঙ্কট, দেশের পশ্চিমভাগে অসহায় খরা— সবমিলিয়ে এক অচলাবস্থা ইন্দিরা প্রশাসনকে ক্রমেই ত্রস্ত করে তুলছিল। ১৯৭৪ সালে রেল শ্রমিকদের সর্বাত্মক ধর্মঘট ও গুজরাত থেকে প্রবীণ গান্ধিবাদী জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে ছাত্র যুবদের আন্দোলন শ্রীমতি গান্ধির ক্ষমতার ভিত এতটাই নাড়িয়ে দিল যে তিনি বেছে নিলেন সংঘাতের পথ।
সমস্ত বিরোধী কণ্ঠস্বর বন্ধ করে দেওয়া হল। গোটা দেশকে প্রায় জেলখানা করে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে চাইলেন ইন্দিরা। জেল ও বাইরে অজস্র মানুষ খুন হলেন। কেরলের মেধাবী ছাত্র রাজন ও অন্ধ্রের অভিনেত্রী স্নেহলতা রেড্ডি রহস্যজনকভাবে মারা গেলেন।
সাংবাদিক স্বাধীনতাও ভারতে তখন অদৃশ্য। অনেক বিশিষ্ট সাংবাদিক জেলে গেলেন। ভারতীয় গণতন্ত্রের ওই গভীর অন্ধকারের কথা কখনও ভোলা যায় না। ১৯৭৭ সালের লোকসভা ভোটে হার মানলেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি। কেন্দ্রে প্রথম অকংগ্রেসি সরকার তৈরি হল মোরারজি দেশাইয়ের নেতৃত্বে।
ইন্দিরা গান্ধির স্বৈরশাসনের মধ্যেই আজকের নরেন্দ্র মোদির স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতার বীজ লুকিয়ে ছিল। যে মোরারজি দেশাইয়ের কথা আগে লিখলাম, তিনি, নিজলিঙ্গাপ্পা প্রমুখ প্রাচীন নেতারা বহুদিন ধরে ইন্দিরাবিরোধী। একদা কংগ্রেস ভেঙে যখন দুটুকরো হয়ে যায় তখন মোরারজি দেশাইয়দের অংশের পরিচয় ছিল সিন্ডিকেট কংগ্রেস আর অপরটি স্বয়ং শ্রীমতি গান্ধির নামেই।
নির্মোহ চোখে দেখলে এখন মনে হয় কংগ্রেসের ভাঙন নিছক ক্ষমতা বা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ছিল না। অনেকটাই ছিল দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক কৌশলগত লড়াই। মোরারজি ও তার অনুগামীরা ছিলেন কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠী। অতীব পিতৃতান্ত্রিক, পুরুষতান্ত্রিক। কোনওরকম আধুনিকতায় বিন্দুমাত্র বিশ্বাস তাদের ছিল না। তার ওপর তারা প্রায় সবাই ছিলেন মার্কিন ঘেঁষা।
আজকের চরম দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সঙ্গে প্রবল সাযুজ্য সেদিনের মোরারজি গোষ্ঠীর। স্বাভাবিকভাবেই ৭৭ সালের রাজনৈতিক পরিসর চমৎকারভাবে কাজে লাগিয়ে জনমনে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে বিজেপির পূর্বসূরি জনসঙ্ঘ। অথচ গান্ধিহত্যার পর থেকে জনসঙ্ঘ, হিন্দু মহাসভা, আরএসএসের প্রভাব এদেশে তলানিতে এসে ঠেকেছিল।
কিন্তু একটা কথা মানতে হবে ক্যাডারভিত্তিক আরএসএস ও তার রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম জনসঙ্ঘ একবারের জন্যও হতোদ্যম না হয়ে, নীরবে সংগঠন বিস্তারে সক্রিয় থেকেছে। কিন্তু এটাও ঠিক ইন্দিরা গান্ধির জরুরি অবস্থা এদেশের গণতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা না বাজালে মৃতপ্রায় সঙ্ঘপরিবারের এভাবে ধ্বংসস্তূপ থেকে বেঁচে ওঠারই কোনও সম্ভাবনা ছিল না। তাই আপাত বিরোধিতার আড়ালে আজকের বিজেপির কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ইন্দিরা গান্ধির কাছে। নরেন্দ্র মোদি এখন জরুরি অবস্থার নিন্দে করছেন। ভাবটা এই, তিনি গণতন্ত্রের পূজারি। গত কয়েক বছর ধরে যে ধর্মীয় বিভাজন, যে মব লিঞ্চিং, জয় শ্রীরাম বলতে বাধ্য করা, যে হারে সংখ্যালঘু নির্যাতন ঘটেছে তা এ দেশ কখনও দেখেনি। শ্রীমতি গান্ধি বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিলেন নিশ্চিত কিন্তু এত এত বুদ্ধিজীবীদের খুন তখন দেখিনি। এত অসহিষ্ণু মনোভাব কখনও ভারত প্রত্যক্ষ করেনি। কখনও শোনেনি এমনধারা শ্লোগান— ভারত মেঁ রহনা হ্যায় তো মোদি মোদি কহনা হ্যায়। বিরোধী কণ্ঠস্বর এখন শুধু কেড়ে নেওয়াই হচ্ছে না তাকে দেশবিরোধী বলে চিহ্নিত করে হেনস্থা করা হচ্ছে।
আমার ভারতে আজ কী খাব কী খাব না তাও ঠিক করে দিচ্ছে এক অশুভ রাজনীতি।
শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধির তবু কিছু যুক্তি ছিল জরুরি অবস্থা জারির। অন্তত বামমুখী কিছু কর্মসূচি ছিল। কোনওভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ নীতি বদলে দেবার কোনও লক্ষণ তখন দেখিনি। আর আজ এদেশের অঘোষিত জরুরি অবস্থার দিনে ভারতের সংবিধানই এক গভীর বিপদের মধ্যে। বিপন্ন মানবাধিকার। মিথ্যে মামলা দিয়ে জেলে ঢোকানো হচ্ছে বিশিষ্টজনদের। বিরুদ্ধে কিছু বললেই শুনতে হচ্ছে মেরে ফেলার হুমকি। এ ভারতের সকাল নিঃসন্দেহে আলোর চেয়েও অন্ধকারের। জরুরি অবস্থা মনে রাখব শুধু গণতন্ত্রের পক্ষে সুখকর বিষয় নয় বলে নয়। মনে রাখব অত্যাচার বা স্বৈরতন্ত্র কখনও শেষ কথা বলে না ব’লেও। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি কিন্তু তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন।