জ্যোতির্ময় দত্তের সাক্ষাৎকার
সম্প্রতি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ইতিহাসে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেল। পর পর দু’দিন ঐতিহ্যশালী দ্য স্টেটসম্যান কাগজের মুদ্রিত সংস্করণ বেরোল না। স্টেটসম্যান কাগজের ইতিহাসে এমন ঘটনা সম্ভবত প্রথম। নিউ জার্সি প্রবাসী বিশিষ্ট সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দত্তকে শহরে পেয়ে চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের তরফে তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে কিছু আলাপ করা গেল। তবে আলাপ শুধুমাত্র স্টেটসম্যানেই থেমে থাকল না। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম, বর্তমান সমাজ – এ-সবকিছুই ছুঁয়ে গেলেন তিনি। দীর্ঘ (ও ফলপ্রসূ) সাংবাদিক জীবনের অভিজ্ঞতা ও তীব্র সমাজবীক্ষার আলোয় স্থিতধী, আবেগী জ্যোতির্ময় আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন তাঁর বিশ্লেষণ ও অনুভূতি।
আপনি নিশ্চয়ই জেনেছেন যে সম্প্রতি দ্য স্টেটসম্যান কাগজের মুদ্রিত সংস্করণ পর পর দু’দিন প্রকাশিত হয়নি। ১৮৭৫ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এই কাগজের ইতিহাসে এমন ঘটনা মনে হয় প্রথমবার ঘটল। যদিও আমরা জানি, যে এই কাগজ বিভিন্ন অসুবিধার মধ্য দিয়ে চলছে। তবু এই ঘটনা প্রসঙ্গে দুটো কথা আমাদের মনে হয়েছে। প্রথম কথা হল – স্টেটসম্যান, আর অবশ্যই আনন্দবাজার পত্রিকাও, এগুলো তো আমাদের কাছে শুধুমাত্র খবরের কাগজই নয়। আমাদের সংস্কৃতিরও একটা অংশ হয়ে গেছে। ছেলেবেলায় যেমন ইংরিজি শেখার জন্য স্টেটসম্যান পড়া বাধ্যতামূলক ছিল, যদিও শেষতক কতটা ইংরিজি শিখতে পেরেছি সেটা তর্কসাপেক্ষ। আর দ্বিতীয় যে দিকটা – এটা মনে হয় আরেকটু শঙ্কাজনক। সেটা হল, এখনকার সংবাদমাধ্যম বা খবরের কাগজের যে স্টাইলটা আমরা দেখছি, তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না-পারাটাও কি স্টেটসম্যান কাগজের দুর্দশার একটা কারণ?
আপনি স্টেটসম্যানে ছিলেন দীর্ঘ দিন। তাছাড়া আপনার দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে এই বিশাল পরিবর্তনটা আপনি প্রায় চোখের সামনে ঘটতে দেখেছেন। এই দুই অভিজ্ঞতার নিরিখে এই ব্যাপারটা কিভাবে আপনি দেখছেন জানতে চাইছি।
আমি প্রথমে বলি, যে বাইরে থেকে কিছুদিন পর পর কলকাতায় এলেই অনেকগুলো পরিবর্তন চোখে পড়ে। একসময় ছিল যখন আমি নিজেই বহিরাগত ছিলাম। আমার শৈশব কেটেছে দক্ষিণ ভারতের প্রধানত পার্বত্য বনাঞ্চলে। তখন যেহেতু এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা বাবা চাকরি নিয়ে ঘুরছেন, বাংলা আমাকে প্রায় শিখতে হয়েছে। ভাষা, এবং ভূগোল, এবং জাতি – এই সমস্ত ধারণাগুলো তখন ছিল না। ইংরেজ সাম্রাজ্যের শেষভাগে আমার শৈশব কেটেছে। তখন ‘দেশ’ – এটার চেয়েও বড় ছিল গান্ধি মহারাজ, নেতাজি। কী হবে না হবে আমরা কেউই বুঝতে পারিনি। আগামী দশ বছরে যা হবে, গত দশ বছরে তার কোনও ধারণা আমরা করতে পেরেছি?
কলকাতার বিষয়ে যেটা প্রথমেই চোখে পড়ে, সেটা হচ্ছে একটা সামগ্রিক অবনতি। কর্মের অভাব, পারিপাট্যের অভাব ছাড়াও… পৃথিবীতে যে জায়গায় কলকাতা ছিল… আমি ভীষণ গর্বিত ছিলাম। এখানে শিক্ষালাভের যে মান ছিল, ইংল্যান্ডের সঙ্গে যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল, পশ্চিমের সঙ্গে, চিনের সঙ্গে যে যোগাযোগ ছিল সব একে একে কেটে প্রায় বিচ্ছিন্ন, ওই হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচিউডের সেই গ্রামটা, যার ইতিহাস নেই, কোথাও একটা ভাসছে, ঠিক সেইরকম একটা জায়গা হয়ে উঠতে লাগল। যেখানে একসময় শুধু দ্বিতীয় নগরী নয়, কলকাতা ছিল অনেক বিষয়ে প্রথম নগরী। লেনিন মহারাজের কথায়, জগতের বিপ্লব কলকাতার পথ দিয়েই আসবে। কী হল?
প্রথম হল, স্বাভাবিক একটা এন্ট্রোপি– আস্তে আস্তে ভেঙে পড়া, যদি না তাকে জুড়বার কিছু থাকে। বাংলায় দীর্ঘকাল বামপন্থীরা রাজত্ব করলেন, কিন্তু তাঁরা কিছুই মিশ খাওয়াতে পারলেন না। কমিউনিস্ট রাজ্যেও পরিণত করতে পারলেন না, আবার ক্যাপিটালিস্ট রাজ্যেও পরিণত করতে পারলেন না। গুজরাতও হল না, পাঞ্জাবও হল না। তো এই সর্বনাশের কারণ কী, মূলে কারা এসব আলোচনা না করে আমি কী দেখছি – বিশেষ করে গত দু’তিন বছরে – সেটা বলতে চাই।
প্রথমত হচ্ছে, সমস্ত সংবাদপত্রের বিপর্যয়। খবরের কাগজ আমার কাছে ছিল একটা, প্রায়, কী বলব, ধর্মের মত। তার নিরপেক্ষতা নিয়ে স্টেটসম্যানে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। একসময় ইংরেজের কাগজ ছিল, দাসত্বের কাগজ ছিল বটেই। কিন্তু যখন আমরা কার্যভার নিয়েছি তখন, আমার মনে পড়ে, সম্পাদকীয় আর সংবাদ এ দুটোর মধ্যে একটা মহাসাগরীয় ব্যবধান ছিল। তোমার মতামতের সঙ্গে সংবাদকে গুলিয়ে ফেলবে না। এক রাত্রে আমার মনে আছে – তখন আমি চার্জে ছিলাম – গোয়ার অন্তর্ভুক্তির সময় – প্রথম পাতার প্রথম হেডিং-এ আমি একটা ইঙ্গিত করেছিলাম – জনগণের রায়টাই রায় – ঔপনিবেশিকতার শেষ চিহ্ন চলে গেল। পরেরদিন দুপুরে, মনে হয় নাইট ডিউটি শেষে এসে ঘুমোচ্ছি, তখনকার প্রধানের ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর– Look hear my chummy! The edit page is… may be for your own bloody opinions, but the news page is for news! You don’t make any comments on them! এটা যেমন একটা দিক, যে – আমি যেমন কাগজ পড়ছি তেমন সকলেই পড়ছেন। সাংবাদিকের কী দল, কী মতামত তা তাঁরা জানতে চাইছেন না। তাঁরা জানতে চাইছেন খবরের সূত্র, চাইছেন খবরের সত্যতা। আমরা যেমন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশ সূত্রে খবর বলে বলতাম। আজকাল শুনি, মীনাক্ষী যেমন বলছিল, কাগজে বলে ‘অধিকাংশ মহলে জল্পনা’! অর্থাৎ তথ্য যাচাই করার কোনও বালাই নেই। আর দুই, তার চেয়েও বড় হচ্ছে সংবাদপত্রগুলির মালিকানার পেছনে ক্রমশ রাজনীতির হাত। এসব আমরা ইন্দিরা গান্ধির আমলেও কল্পনা করতে পারিনি। পৃথিবীর বিষয়ে জানে না, ভ্রমণ করেনি, দিগন্তের ওপারে কী ঘটছে সে বিষয়ে ধারণা নেই – এইসব জানোয়ারেরা ধুতি পাঞ্জাবি পরে বেত ঘুরিয়ে নানান মন্তব্য দিচ্ছে। স্পষ্টতই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা কেউ পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না। কখনও পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করে দিয়ে, এমন কী অন্যদের বিজ্ঞাপনও বন্ধ করে দিয়ে কাগজের লাইনকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসতে চাইছে। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা সরকারি বিজ্ঞাপন। একটা কাগজের যদি দশ পাতার মধ্যে পাঁচ পাতাই সরকারি বিজ্ঞাপন থাকে, তবে সে কাগজ কী করে ঠিক থাকবে?
সেটা কেন্দ্র হোক বা রাজ্য…
সেটা কেন্দ্র হোক রাজ্য হোক। এই বিজ্ঞাপনের বিস্তার দেখে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়। এমন কোনও দেশে নেই। নিউ ইয়র্ক টাইমসে সরকারি বিজ্ঞাপন একশো আঠাশ পাতার মধ্যে ষাট পাতা থাকবে – ভাবতে পারে কেউ? প্রাভদার তো এককালে পুরোটাই ছিল সরকারি বিজ্ঞাপন!
আপনি বলতে চাইছেন সরকারি কাগজ ছিল, এই অর্থে…
হ্যাঁ। তাদের মত, সবকিছু। কিন্তু লিখিতভাবে। তাদের মালিকানাও তাই। তাদের কর্মচারীরাও কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার। কোনও রাখঢাকের ব্যাপার নেই। আমরা বুঝতে পারতাম যে এটা সরকারের মত যখন বলা হত যে প্রাভদা লিখেছে। Look at these papers! এরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার এমন কী ছদ্মবেশও এখন ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু যতদিন ছিল, সম্পূর্ণভাবে দালালি করত।
এখন, গণতন্ত্র মানেই কি এই? আমি বলব, না। লোকে যদি রাস্তায় নিয়মকানুন না মেনে এদিক-সেদিক চলে তবে যেমন ট্রাফিক চলে না, গণতন্ত্রেও তেমনি ভীষণ নিয়ম। সেটা কশাঘাতের নিয়ম নয়। বা বন্দি করে সাত বছর সাইবেরিয়ায় পাঠাব, সেরকম নয়। নিয়মটা হচ্ছে – সত্য কথা বলাই ঠিক। মিথ্যা প্রমাণিত হলে তা লজ্জার। এবং মিথ্যে কে কতবার বলেছে তার এমনকী তালিকা প্রস্তুত করা হবে। যেমন, ট্রাম্প। প্রত্যেকদিন নিউ ইয়র্ক টাইমসে বেরোয়, এইবারেরটা নিয়ে ওঁর দু’হাজার তেরোটা মিথ্যে কথা। আর এখানে এদের রেওয়াজই যা খুশি বানানো! যেমন- একদিন মুখ্যমন্ত্রী বলছেন আমার বিলিতি ডিগ্রি আছে! পরের দিন বলছেন, নেই, আমি গ্রামের মানুষ! মানে, সত্য-মিথ্যা মানুষের ব্যক্তিগত জীবনেও প্রায় নেই। ঠিক সময়ে তুমি যে এলে, আমি তো মুগ্ধ! লোকেরা – প্রথমত তো সময় দেয় না! তারপর বলে নাগাদ! চারটে নাগাদ! তারপর সেই নাগাদটা অগাধে পরিণত হয়! আমাদের সমাজ, ভারতীয় সমাজ, আবার আস্তে আস্তে ভেঙেচুরে কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের অভাবে – মানে যেসব প্রতিষ্ঠান বাঁচিয়ে রাখে – পরস্পর মতবিনিময় ইত্যাদি – সব আস্তে আস্তে নষ্ট হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার দলের লোক চাই! মেডিক্যাল কলেজে অমুক হবে! সে কেমন শল্যচিকিৎসক তা জেনে দরকার নেই। তিনি কার শালা, কার জামাই ইত্যাদি।
এখন সেই ক্ষেত্রে শুধু কি অশ্রুপাত আমরা করব? প্রথমত, কাগজগুলোর চেহারা দেখলেই বোঝা যায় যে এগুলো আর খবরের কাগজ নেই! সংবাদ লোকেরা এখন অন্যত্র পাচ্ছে। এবারে, সংবাদের ক্ষেত্রে নেট এমন একটা জিনিস – আমি এ ব্যাপারে বিশেষভাবে আলোচনা করতে চাই – নেট হচ্ছে জীবন। কারণ, সম্পাদিত নয়। যতখুশি, যা খুশি লিখে দাও। কোনও নিরিখ নেই। তথ্যের পরিচিতি নেই, ভিত্তি নেই। আমি বললাম অমুক, তাও যেমন, জগদীশচন্দ্র বসু এক বিষয়ে কিছু বলেছেন তাও তেমন! এই নিরিখহীন, অনন্ত, রাশি-রাশি আবর্জনার মধ্যে কিছু খুঁজে বার করা দুঃসাধ্য। কাগজ মানে, নিউ ইয়র্ক টাইমসে যেমন থাকে – All the news that’s fit to print!
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এর থেকে মুক্তি পাবার উপায় কী। এটুকু বলতে পারি যে আবার দল গঠন করে লাভ নেই। আবার একটা হাওয়া উঠবে, আর সবকিছু মিথ্যার গুজবের তলায় পড়বে। কিন্তু basic institutionsগুলো, universities, schools, colleges – education, আর এসবের মধ্যে খুব বড় অংশ হচ্ছে খবরের কাগজ। বড় সংবাদমাধ্যমের পক্ষে যা সম্ভব হচ্ছে না, সেটা ছোট ছোট কাগজগুলোতে এখনও মনে হয় করা যায়। এবং কোনও কোনও নির্ভীক সাংবাদিক তা করছেন। তাঁরা প্রণম্য, তাঁরা নমস্য। এঁদের কীভাবে শক্তি দেওয়া যায়। কোনও ফাউন্ডেশন মানেই তো আবার একই কথা। প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া এককালে সরকারি সাহায্যেই অপেক্ষাকৃত সঠিক সংবাদ পেশ করত। টেলিভিশন ছাড়া একটা মাধ্যমের খুব প্রয়োজন। নেট অনেক কিছু করতে পারত। কিন্তু ওই মহাবিশ্বটা এত বৃহৎ, যে এখনও ঠিক আমরা উপায় বার করতে পারিনি। অথবা নেটের মধ্যেও কী করে একটা বিশ্বাস্য, প্রামাণ্য, সম্পাদিত চ্যানেল করা যায়। অথবা রেটিং-এর ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু সেরকম ব্যবস্থা কে করবে, কেই বা স্বীকৃতি দেবে – এসব অত্যন্ত জটিল প্রশ্ন। তার ওপর সার্ভিলেন্সের প্রশ্ন। সরকার একের পর এক হরণ করে যাচ্ছে এইসব অধিকার, আর আমরা নীরবে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি। হতাশা এবং নেতৃত্বহীনতার অভাবে আমরা ক্লান্ত, বিষণ্ণ বোধ করি। এখন কে কী করবে? যদি আপনাদের মত ছেলেরা… কারণ যন্ত্র সবই আছে। বাম সরকারের বিরুদ্ধে যখন শঙ্খ ঘোষ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, ওয়ারশ মুভমেন্টের মত, হয়ত তেমন কিছু গড়ে উঠবে। একেবারে নৈরাশ্যে ডুবে যাবার কারণ নেই। কিন্তু আমি বলব, যদি গবেষণা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এ-বিষয়ে সচেতন হয়, এ-বিষয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন করা হয়, শিক্ষিত সাংবাদিক তৈরি করা হয় তবে আশা রাখা যেতে পারে।
এখন, এই স্টেটসম্যান কাগজ এক সময় ইংরেজ ঔপনিবেশিকতার বাহন ছিল, যন্ত্র ছিল। কিন্তু আমি যখন দেখেছি, যতদূর বাহ্যত দেখেছি…
ষাটের দশকের কথা বলছেন…
আমি ষাটের দশকের কথা বলছি। স্বাধীন, এবং আর্থিকভাবে এটা একটা নিরপেক্ষ ব্যবসায়। সেবাপ্রতিষ্ঠানও নয়, বিচারের যন্ত্রও নয়। সেটা ব্যবসা। তবুও, যখন ইন্দিরা গান্ধি হস্তক্ষেপের চেষ্টা করলেন, অনেক কাগজ হুড়হুড় করে ওদিকে চলে গেলেও স্টেটসম্যান যায়নি। তখনও চক্ষুলজ্জা ছিল সরকারের। তাই বিশেষ কিছু করতে পারেনি। কিছু সাহসী সাংবাদিকও ছিল। যেমন আমার বন্ধু সচ্চিদানন্দ সহায়, তখন স্টেটসম্যান দিল্লির সম্পাদক, বেশ সাহস নিয়ে লিখতেন। ওরা ভয় দেখাত এরকম, যে যেখানেই তুমি যাও না কেন পেছন-পেছন একটা পুলিশের গাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু এই যে অবস্থা, অনেক দূরে চলে এসেছি।
তখনও কি কিছু করার ছিল? ওই ছোট ছোট ছাপাখানার, লেটারপ্রেসের যুগে কলকাতায় পত্রিকা বার করে যা করেছি – এটা আমার দাবী, অনেকে বলেনও – যে এক লক্ষ ব্যবসায়িক কাগজও তা করতে পারেনি! কারণ খুব যখন অন্ধকার, অন্য কোনও আলো নেই, তখন দেশলাইকাঠি জ্বালালেও নির্জন রাস্তায় চোখে পড়ে। আজকাল শুনি প্রেসগুলোতে যা ছাপা হবে তাকে আগে অনুমোদন করিয়ে আনতে হবে। গলা টিপে টিপে টিপে আমাদের এমন জায়গায় নিয়ে গেছে। আবার এদেরই আমরা ভোট দিতে বাধ্য হই। অবশ্য আজকালকার যুগে কারা পক্ষে ভোট দেয় আর কারা বিপক্ষে, সে তালিকা হয়তো প্রস্তুত করাও হয়ে গেছে।
এই দেখুন, আপনার কথায় এত কথা বলে ফেললাম, অথচ সঠিক প্রশ্নের উত্তরটা বোধ হয় দিলাম না।
হয়তো একটু অন্যভাবে দিলেন। স্টেটসম্যান কাগজের দুরবস্থা– এক কথায় যদি এইটা বলি, তবে যুগের রুচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না-পারাটাই কি সেই দুর্দশার মূলে? ছাপা বড় খবরের কাগজ বা টিভির সংবাদমাধ্যমের দিকে তাকালে দেখছি, এর একটা বড় অংশ বেশ ট্যাবলয়েডধর্মী হয়ে উঠেছে, যেটা শত অসুবিধা সত্ত্বেও স্টেটসম্যান হয়ে উঠতে পারেনি। এই সম্বন্ধে আপনি কী বলবেন?
দেখো আমি একটা প্রাদেশিক কথা বলি। আসলে যেদিন থেকে বাংলার বাঙালির কাগজ না হয়ে পশ্চিম আর উত্তর ভারতের লোকেদের দখলে চলে গেল, স্টেটসম্যান তার চরিত্র হারাল। এই কাগজকে নিয়ে অহঙ্কার করতেন আমার পিতামহ, আমার বাবা। লিখতেন তাঁরা। বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত – এঁরা স্টেটসম্যানে লিখতেন। আমি নিজে কাজ করেছি। সমর সেন ওখানে চাকরি করেছেন। আমি আর মীনাক্ষী একদিন ব্রড স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। উল্টোদিক থেকে সমর সেন আসছেন। দেখে হেসে বললেন – ‘আপনি আসছেন আমাদের আপিসে? কী আনন্দ! কিন্তু আমি তো চলে যাচ্ছি।’ উনি তখন রাশিয়ায় চলে যাচ্ছেন। আমার তখন প্রায় স্বপ্নভঙ্গ, যে স্টেটসম্যানকে কেউ ‘আপিস’ বলতে পারে? কিন্তু যেটা বলতে চাইছি, কে না ওখানে কাজ করেছেন? সুধীন্দ্রনাথের এডিটোরিয়াল বড় শক্ত ইংরিজিতে ভরা থাকত। ইংরেজ সম্পাদকের মত। বলতাম, তুমি একটু সহজ বাংলা করে লেখো তো! উনি বলতেন, ওইটেই বাংলা ইংরিজি! বুদ্ধদেবের যখন অন্য কোনও কাজ প্রায় নেই, স্টেটসম্যানের চেকটি ঠিক সময়ে পৌঁছে যেত। লেখা পছন্দ হলে এডিটর আবার ছোটখাটো উপহারও পাঠাতেন। So, it was intermixed with Bengali lives! কিন্তু এমন একদিন এল, যখন পাঞ্জাবি… আমি তখন বিদেশে। আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে আছি। আমি গর্বের সঙ্গে বলব যে আমি থাকলে হয়তো কিছুটা বিরোধিতা করতাম। যে কোনও উপায়ে পারি। আমার এডিটর লিখছেন – Jyoti you better come back. There will be some changes soon, and I want you to be here. আমি আসিনি। তখন প্রাণ চোপড়া নামক একটি চরিত্র এডিটর হল। সেই প্রাণ চোপড়া অল ইন্ডিয়া রেডিওর নিউজ এডিটর ছিল। তারপর থেকে যারাই এসেছে, সব অতি নিম্নমানের, দিল্লি-ট্রেইনড, পাঞ্জাবি। তারা কলকাতার কিছু বুঝবে কী করে? তারা এখানকার থিয়েটার, গান, নাচ কিছুই… তারা থাকতও যে পাড়ায়, সেখানে বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের কোনও ছাপ নেই। স্টেটসম্যানের আসল সর্বনাশ হয়েছে, যখন বাঙালিদের হাত থেকে চলে গিয়ে, বাঙালিত্ব হারিয়ে একটি টাইমস অফ ইন্ডিয়া ধরনের কাগজ… It is not tabloid. It is not that. বাংলার ইন্টেলেকচুয়াল, যে গর্ববোধ করে ভাল লেখায়, ভাল সাহিত্যে যার ভীষণ উৎসাহ, যে সিনেমার থেকে সাহিত্যকে বেশি মূল্য দেয় – সিনেমাকেও দেয়, কিন্তু সত্যজিৎ রায়, তরুণ মজুমদারের দিকটাকে দেয়। বলিউড নয়। এসব নিয়ে কাগজে অনেক লিখেছি, ইন্ডাস্ট্রির গালাগালিও প্রচুর খেয়েছি। একদিন একতাড়া চিঠি চার্লটন পাঠিয়ে দিল – What do you think of these? আমি বললাম – What am I to say? I expressed my opinion in a refined way. It is now for you to decide. চার্লটন আমার সমর্থনে ছিল। এই ছিল স্টেটসম্যানের স্বাধীনতা।
এটা কোন সময়ের কথা বলছেন?
এটা… যখন আমি ছাড়লাম তার আগে। ১৯৬১। মুশকিল হচ্ছে, আমি যখন ছাড়লাম সেই সময় আমি সবচেয়ে বেশি কার্যকর হতে পারতাম। আমার অ্যামেরিকায় একটা নিমন্ত্রণ এল। আর হল টিউবারকিউলসিস। So, I was out of the picture for six years when I could be at my prime. একদিকে আমায় ধরে ধরে ওঁরা এক-একটা ঘরে বসাচ্ছেন, to be literary editor, etc etc… ওদিকে পনেরো দিন যায় আর আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। যাই হোক, স্টেটসম্যানে… বুদ্ধদেব কত লিখেছেন। নিয়মিত থার্ড এডিটিং করেছেন। সুধীন্দ্রনাথ চাকরি করতেন। জীবনানন্দের ঘরে সঞ্চয়ের মধ্যে ছিল এক কোণায় জমিয়ে রাখা স্টেটসম্যান। সেই কাগজ যখন বানিয়াদের হাতে চলে গেল। কে বলে স্টেটসম্যান ট্যাবলয়েড হতে পারেনি বলে এই অবস্থা? বরং উলটো! The Statesman was handed over to the Tatas as a first-class property by Calcutta Properties! Then they failed! কিন্তু স্টেটসম্যান তো গেল! বাকি কাগজগুলো কোথায়? পাতার পর পাতা বিজ্ঞাপন! আর লেখার মান? You call it writing?! রাস্তার লোক ওর চেয়ে ভাল লিখতে পারে! একটা কাগজে লেখার মানই যদি ভাল না থাকে তবে সেটা কী কাগজ? নিউ ইয়র্ক টাইমস – ট্রাম্পও পড়ে, আবার হার্ভার্ডের প্রফেসরও পড়ে। এই কাগজগুলো কোনও বুদ্ধিমান লোক পড়বে?
একবার নীরদ চৌধুরির প্রবন্ধ আমি – অন্যায়ভাবেই হয়তো – ছেঁটেছিলাম। তা আমাকে চার্লটন বলছে – You see he is an old man ইত্যাদি ইত্যাদি। তুমি ওঁর পিসগুলো অন্তত এডিট করার আগে আমাকে দেখিও। আমি বললাম – ডিপার্টমেন্টাল এডিটরের কবে থেকে এমন করা প্রয়োজন হয়ে পড়ল? নীরদবাবু প্রচণ্ড রেগেমেগে চিঠি লিখতেন। চার্লটন আমাকে দেখাত। কিন্তু আমি আমার কাজ করতাম। কিন্তু নীরদবাবু লিখতেন। ওঁর সম্বন্ধে আর যা-ই বলা হোক – একটু বেঢপ রকমের বঙ্কিমি, উনিশ শতকী ইংরিজি শিক্ষায় শিক্ষিত – কিন্তু শিক্ষিত লোক! প্রচুর পড়েছেন। আর এরা কারা, যারা লিখছে? আমাদের করেস্পন্ডেন্ট ফ্রম চণ্ডীগড়? ভাষা জানে না, লেখা জানে না, জানার চেষ্টাও নেই! উদ্ধত! আবার খুব গর্বিত হয় যখন হার্ভার্ডে কী কোথাও একটা সেমিনারে যোগ দেবার জন্য বৃত্তি পায়। কী একটা সামান্য ফেলোশিপ পায়।
আসল কথা হল, India is no longer fit for a good English language newspaper. Tragic. The Statesman, the last English newspaper-এর এই অবস্থা সত্যিই পীড়াদায়ক।
শেষ ইংরিজি কাগজ কথাটা কোন জায়গা থেকে বলছেন বুঝতে পারছি।
আমার ক্রুদ্ধ, মাঝে মাঝে হয়তো যুক্তিহারা বক্তব্য আপনাদের কাছে প্রকাশ করতে পারলাম এটাও আমার সৌভাগ্য।
স্টেটসম্যানের পরে কলকাতায় আমি আরও তিনটে কাগজে কাজ করেছি। বিদেশেও করেছি। কিন্তু জীবিকা আমার ইংরিজি কাগজ থেকেই। কী অবস্থা! আমি বললাম last English language newspaper – আপনি হাসলেন একটু, কৌতুকের হাসি। কী গর্ব ছিল আমাদের এই কাগজ! আর গর্ব ছিল এই ভাষার চর্চা নিয়ে। উনিশ শতকের বাংলা গদ্য কি ইংরিজি ছাড়া হত? যে ভাষা নবজাগরণের সূচনা করল…
তবে আমি ভীষণভাবে বিশ্বাস করি, এই কলকাতায় যে বীজ বপণ করা হয়েছে সেটা লুপ্ত হবার নয়।
আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আপনার অল্প সময়ের কলকাতাবাসের মধ্যে যোগাযোগ করতে পেরে, এবং আপনার মূল্যবান মতামত জানতে পেরে আমরা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করছি।