Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সন্তোষদা: একজন অহিংস নকশাল

প্রশান্ত ভট্টাচার্য

 

সন্তোষ রানার নাম আমি প্রথম শুনি ১৯৭৭ সালে। তখন স্কুলে পড়ি। পরিবর্তনের ঋতু। আকাশেবাতাসে, ‘নকশাল-সহ সব রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি চাই’। কিছুটা বুঝে, অনেকটা না-বুঝে আমিও শামিল সেই স্লোগানে। তারপরই লোকসভা ভোট। সসঞ্জয় হার হয়েছে ইন্দিরা গান্ধীর। দেশে প্রথম অকংগ্রেসি সরকার। বাংলায় স্লোগান উঠল, ‘রায় মন্ত্রিসভা ভেঙে দাও/জনগণের রায় নাও।’ সেই আবহে পশ্চিমবঙ্গে জুন মাসে বিধানসভা ভোট হচ্ছে। শুনলাম জেলবন্দি এক নকশাল নেতা, সন্তোষ রানা, ভোটে দাঁড়িয়েছেন গোপীবল্লভপুর থেকে। তাঁর নির্বাচনী প্রতীক ‘মশাল’। সেই নাম জানলাম সন্তোষ রানার। কত কী শুনলাম! প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিদ্যার তুখোড় ছাত্র। একেবারে হদ্দ চাষা। গোপীবল্লভপুর কৃষকবিদ্রোহের মহানায়ক।  দু’হাতে বন্দুক চালাতে পারেন। তির-ধনুকেও সমান দড়। সব মিলিয়ে সে এক আশ্চর্য অতিকথা সন্তোষ রানাকে নিয়ে। আমি অন্তত তার আগে নকশাল নেতা বলে জানতাম চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, সরোজ দত্ত আর অসীম চট্টোপাধ্যায়কে। আর জানতাম পাড়ার উদয়কাকাকে, তিনিও তখন জেলে। ফলে ভোট রাজনীতির সৌজন্যেই সন্তোষ রানাকে চেনা এবং জানা। আমাদের চেয়ে বড় দাদাদের কয়েকজন শুনলাম সন্তোষ রানার হয়ে ভোটপ্রচার করতে গোপীবল্লভপুর গিয়েছেন। এঁদেরই একজন প্রদীপদা, প্রদীপ বসু। এখন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর। ভোটের ফল তখন একদিনেই বেরিয়ে যেত না। দু’ দিন, তিন দিন ধরে গোনা চলত। এরই মধ্যে রেডিও মারফত জানতে পারলাম, সন্তোষ রানা সিপিএমের প্রার্থীকে হারিয়ে জিতে গেছেন। হ্যাঁ, তিনিই প্রথম নকশাল বিধায়ক– গোপীবল্লভপুরের সশস্ত্র কৃষকবিদ্রোহ থেকে “শুয়োরের খোঁয়াড়’ বিধানসভায় পা রাখা প্রথম বিপ্লবী।

বিপ্লবী, কিন্তু আগুনখেকো নন। বরং, নকশালবাড়ির ‘আগুনখেকো’ রাজনৈতিক আন্দোলনের প্যরাডাইম শিফটের অন্যতম পথিকৃৎ তিনি – সন্তোষ রানা। একইসঙ্গে একটি বিতর্কের জন্ম হল। ১৯৬৭ সালের নকশালবাড়ি কৃষক-অভ্যুত্থান ভারতীয় রাজনীতিতে পার্লামেন্ট বয়কটের লাইন প্রতিষ্ঠা করেছিল। আমাদের মধ্যে একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল, নকশাল মানেই ভোট-রাজনীতির বাইরের লোক। সেই মানসিক বোঝাপড়ায় দাঁড়িয়ে সন্তোষ রানার ভোটে দাঁড়ানো ও জেতাটা আমার কাছে একটি দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতি বলে মনে হয়েছিল। ফলে দেদার তর্ক চলত বন্ধু বা কমরেডদের সঙ্গে। সব কিছু উড়িয়ে দেওয়ার বয়স সেটা, মানি না সংসদীয গণতন্ত্রের কোনও ইতিবাচক দিক। মজার কথা, তখনও সন্তোষ রানার সঙ্গে আমার কোনও আলাপ হয়নি, দু’-একবার দূর থেকে দেখেছি মাত্র। তবে ভোটে জেতার পর সন্তোষ রানার একটা কথা আমার খুব ভাল লেগেছিল। জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভা গঠনের কিছু পরে মুক্তি পেতে শুরু করলেন রাজনৈতিক বন্দিরা। মুক্তি পেলেন সন্তোষ রানাও। জেল থেকে বেরোতেই সংবাদমাধ্যম ঘিরে ধরল তাঁকে। সাংবাদিকের প্রথম প্রশ্নের উত্তরে সন্তোষ রানা বলতে পেরেছিলেন, “জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় হলে আপত্তি নেই, কিন্তু জেলার প্রতি গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় তৈরি অনেক গুরুত্বপূর্ণ।” বুঝলাম মেধাবী ছাত্র, কলকাতায় চলে এলেও সুবর্ণরেখার পাড়ের গ্রামের কথা ভোলেননি! আর আমরা তখন মন্ত্রের মতো আউড়ে যাই, ‘শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা ঘটায় বিপ্লব।’

সন্তোষ রানার সঙ্গে প্রথম কথা হয় ১০২ এসএন ব্যানার্জি রোডের পার্টি অফিসে। প্রথম দিন কথা বলেই আমার যেটা ভাল লেগেছিল, অন্যদের মতো ইনি শুধুই বক্তা নন, বরং শ্রোতা। নিষ্ঠাবান শ্রোতা। কাকা, মানে অসীম চট্টোপাধ্যায়ের ঠিক উল্টো। আসলে সন্তোষ রানা ইংরেজিতে যাকে বলে ফায়ারব্র্যান্ড লিডার, তেমনটা কোনওদিনই ছিলেন না। তখন আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি শূন্য, বাক্যের ঝুলি উপছে পড়ছে, অথচ উনি প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন কথা না-বলে। এই একই অভিজ্ঞতা হযেছে, গত বছর অগস্ট মাসেও। আমি ‘সুখবর’ পত্রিকার উৎসব সংখ্যার জন্য সন্তোষ রানার একটা সাক্ষাৎকার নিতে পূর্বাচলের বাড়িতে গিয়েছি। বলতে ভুলে গিয়েছি, এর মধ্যে কবে থেকে যেন সন্তোষ রানা আমার সন্তোষদা হয়ে গিয়েছেন। তারপর আপনিটিও খসে পড়ে তুমি হয়ে গিয়েছে। তা যে কথা বলছিলাম, সন্তোষদার তখন কেমোথেরাপি চলছে, তবু আমার আবদার রক্ষা করে সাক্ষাৎকারে রাজি হলেন। প্রায় তিন ঘণ্টার লম্বা সাক্ষাৎকার। যার ভিত্তিতে আমি সন্তোষদার নামেই একটি প্রবন্ধ দাঁড় করিয়ে দিলাম। তা দেখেছি, সেই সাক্ষাৎকারের সময়ও আমি সন্তোষদার তুলনায় বেশি কথা বলেছি। তর্কও করেছি।

আসলে বরাবরই দেখেছি, সন্তোষদা অসম্ভব ভালো শ্রোতা। চুপচাপ অন্যের কথা শুনতেন। নিজের কথা কিছু বলার থাকলে হামলে পড়ে বলতেন না। যুক্তির ইট দিয়ে নিজের বক্তব্যকে সাজাতেন। আর একটা জিনিস দেখেছি, সন্তোষদা কখনওই অন্যের বক্তব্যকে খণ্ডন করতেন না। এর পিছনে তাঁর যুক্তি ছিল, যেকোনও সমস্যায় যতটা সম্ভব সহমত গড়ে তুলে এগনোটাই শ্রেয়। সন্তোষদা একবার কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, এই শিক্ষা তিনি আদিবাসী-সমাজ থেকে পেয়েছেন। আসলে, খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন গরিব আদিবাসী মানুষের কষ্ট।বিশেষ করে শিক্ষা নিয়েছিলেন আদিবাসীদের যাপন থেকে। একবার কথাপ্রসঙ্গে সন্তোষদা শুনিয়েছিলেন আদিবাসী সমাজের বিচারধারা। বলেছিলেন, “জানো, মাঝি বা মোড়ল সব সময় চেষ্টা করেন গোষ্ঠীর সব লোককে সহমত করতে। দিনের পর দিন তারজন্য ওঁরা বসেন মণ্ডলে। কীভাবে যতটা সম্ভব সহমতে আসা যায়। ওঁরা ঠিক সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে সিদ্ধান্তে আসে না।” তখনই বুঝেছিলাম সন্তোষদার এই শিক্ষা আমাদের এই মেকলীয় সমাজ থেকে আসেনি, এসেছে সুবর্ণরেখার পাড় থেকে। আর এই জীবন থেকে যে রাজনৈতিক বিশ্বাস অর্জন করলেন, তানিয়েই নিয়োজিত হলেন মানুষের কাজে। গ্রামীণ শোষকদের সঙ্গে লড়াই কম কথা নয়, এত নিবিড়ভাবে গ্রামজীবনকে তাঁর মতো ক’জন আর  বুঝতে পারলেন। আমায় একবার বলেছিলেন, “আমরা মার্কস-লেনিন জানতাম, মাও জানতাম, হো চি মিন জানতাম, এমনকী, চে, লিঙ পিয়াংকেও জানতাম, কিন্তু আম্বেদকরের নাম শুনিনি, ফুলের নাম শুনিনি,  পেরিয়ারকে জানতাম না। ওঁদের নাম আমি প্রথম শুনেছিলাম ১০২ নম্বর এসএন ব্যানার্জি রোডের অফিসে। পলতার জগদীশ হালদার, বারাসতের সতীশদা আমাকে আম্বেদকরের কথা বলেন। পরে দলিত আন্দোলনের ব্যাপারে জানতে পারি।”

সাধারণভাবে কমিউনিস্টরা অর্থনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে শ্রেণিসংগ্রামের রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন। অন্যান্য সামাজিক সমস্যাগুলি কমিউনিস্টরা শ্রেণি সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সমাধান হবে বলে মনে করেন। সন্তোষ রানার নেতৃত্বাধীন পিসিসি সিপিআই(এমএল) সেই অর্থে প্রথম জাত, জাতিগত ও ধর্মীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলতে শুরু করে। সন্তোষদা যখন এই মতাদর্শ একটু একটু করে ছাড়ছেন, আমার কাছেও প্রথমে তা হাস্যকর মনে হয়েছিল। মুখে লাগাম না-থাকা আমি অক্লেশে সন্তোষদাকে বলতাম, এসব হল শ্রেণি রাজনীতি থেকে পালাবার রাস্তা। আপনার তো আর বিপ্লব করার মুরোদ নেই, তাই এইসব লাইন নামাচ্ছেন। সন্তোষদার সেই দুষ্টু হাসিটা শুধু মুখে লেগে থাকত। একসময় আমার মতো যাঁরা অনেকেই সন্তোষদাদের এই লাইনের বিরোধিতা করতেন, পরে তাঁদের অনেকেই লড়াইয়ের ময়দানের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছিলেন সন্তোষ রানাদের অনুশীলনের মধ্যে এ-দেশের মাটির কথা আছে, যা কোনওমতেই মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও জে দংয়ের চিন্তাধারার পরিপন্থী নয়। বাস্তবিক মাত্র দুটি কমিউনিস্ট সংগঠন জাত, জাতিগত ও ধর্মীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলে। একটি সন্তোষ রানার নেতৃত্বাধীন পিসিসি সিপিআই(এমএল), অপরটি কোন্ডাপল্লি সীতারামাইয়ার নেতৃত্বাধীন পূর্বতন সিপিআইএমএল (জনযুদ্ধ)।

রাজনীতির মূল স্রোতে না-থাকলেও, নয়ের দশকের পর থেকে তাঁর আগের রাজনৈতিক চিন্তার বদল ঘটতে থাকে। নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী) সশস্ত্র পথ ত্যাগ করে সংসদীয় পথ নেওয়ার পর একাধিক নিবন্ধ লিখেছিলেন চারু মজুমদারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এই নেতা। নেপালের মাও নেতা বাবুরাম ভট্টরাইয়ের লেখা দলিল ‘সন্ত্রাসের জনযুদ্ধ বনাম গণতন্ত্রের লংমার্চ’-এর পক্ষে কলম ধরেছিলেন সন্তোষদা।

যাই হোক, সন্তোষদার বিরোধিতা করতে আমাকে কখনও আড়াল নিতে হয়নি বা মুখোশ পরতে হয়নি। তাই তিনি যখন বৃহত্তর বাম আন্দোলনের স্বার্থে সিপিএমকে ভোট দেওয়ার আবেদন করলেন, তখন ফোনে প্রচুর চেঁচামেচি করলাম। তখনও সন্তোষদা শান্তভাবে নিজের যুক্তি উচ্চারণ করে গেলেন। নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর আন্দোলনের সময়ও সন্তোষদা ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। সামনাসামনি এ নিয়ে তর্ক হয়েছে, বা বলা ভাল আমি একতরফা বুদ্ধদেব সরকারের বিরোধিতা করে গেছি, আর সন্তোষদা বরাবরই থেকে গিয়েছেন নিজের অবস্থানে। আবার এই সন্তোষদাই বিজেপির ফ্যাসিবাদের মোকাবিলায় বাম ও কংগ্রেসকে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে চলার কথা বলেছেন। তিনি মনে করতেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনে গণতান্ত্রিক পরিসর সংকীর্ণ হচ্ছে বটে, কিন্তু ফ্যাসিবাদের পত্তন হচ্ছে না। এই কারণেই বিজেপির চেয়ে ঢের ভাল মমতার তৃণমূল।

রাজনৈতিক সাহিত্যে তাঁর ক্ষুরধার কলম একাধিক কালজয়ী লেখার জন্ম দিয়েছে। জাত-পাত নিয়ে বই লিখেছিলেন। এই নিয়ে সন্তোষদার যে ভাবনা, গবেষণা, তার কাছে একদিন বাম রাজনীতিকদের আসতে হবে বলে মৃদু স্বরে বলতেন তিনি। ‘রাজনীতির এক জীবন’ নামক আত্মজীবনীমূলক বইটির জন্য সন্তোষদা আনন্দ পুরস্কার পাচ্ছেন বলে খবর হল, সেই সকালেই সন্তোষদাকে ফোন করে বললাম, একই সঙ্গে অভিনন্দন ও ধিক্কার। তোমার মতো লোক কর্পোরেট হাউসের পুরস্কার নেবে! সন্তোষদার কোনও হেলদোল নেই, রাগ দেখানো নেই। নিজে অসুস্থ, শরীরে কর্কট রোগ বাসা বেঁধেছে, তবু আমার শরীর কেমন আছে জানতে চাইলেন। এটাই সন্তোষদা। এরকম ভদ্রলোক রাজনীতিতে দূরে থাক, সমাজেও মিলবে কম। ‘রাজনীতির এক জীবন’ বইটা অতি কৌতূহল নিয়ে পড়া শেষ করেও সন্তোষদাকে ফোনে অনেক অভিযোগ করেছিলাম। বইটা আমার ভাল লেগেও ভাল লাগেনি। আমার বক্তব্য ছিল, অন্তত লেখায় উনি অকপট হতে পারতেন। তিনি জানেন যা, তা খোলাখুলি লিখতে পারতেন। কাউকেই যেন চটাতে চাইছেন না, এমন একটা মানসিকতা থেকে অনেক কথা বলতে গিয়েও যেন বললেন না। আমি অভিযোগ করেছিলাম, “তুমি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করনি। সেই সময়কার ঘটনা নিয়ে অনেক গালগল্প আছে, তুমি তার মুখোস খুলে দিতে পারতে। এই দিক থেকে ভবিষ্যৎ সমাজ তোমাকেও একজন প্রতারক বলবে।” সন্তোষদা আস্তে-আস্তে বললেন, “অত রাগ করছ কেন, আরও অনেকেই লিখবেন, তখন সব প্রকাশ পাবে।” খুব রাগ হলেও রাগতে পারলাম না প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাত থেকে আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত হওয়া ওঁর ছবিটা দেখেও। বুঝলাম, এটাই সন্তোষদা। নকশালবাড়ি আন্দোলন থেকে জেগে ওঠা সহিংস লড়াইয়ের সন্তোষ রানা আসলে একজন অ্যাক্সিডেন্টাল পলিটিশিয়ান। ছয়-সাতের দশকের ওই অতিবাম রাজনীতির জন্য নয়, সন্তোষ রানা বেঁচে থাকবেন তাঁর মানুষ-কেন্দ্রিক লেখা, বিশ্লেষণের জন্য। বেঁচে থাকবেন একজন অহিংস নকশাল হিসাবে।