Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

প্রদক্ষিণ

যুগান্তর মিত্র

 

এই ভাড়াবাড়িতে আসতে তৃণার খুবই আপত্তি ছিল। বাড়িটা সেই কোনকালে রং করেছিল কে জানে! বেশিরভাগ জায়গাতেই রং উঠে গেছে। রংটা গেরুয়ার কাছাকাছি ছিল বোঝা যায়। দু-এক জায়গায় পলেস্তারা খসে পড়েছে। কোথাও সিমেন্ট-বালির হাঁ-মুখ, কোথাও কালচে ছোপ। দোতলার ছাদের কার্নিশে সবুজ শ্যাওলাও দেখা যাচ্ছে নীচ থেকে।

এই মুহূর্তে একটা চলনসই ফ্ল্যাট কেনার অবস্থা নেই নীলাঞ্জনের। মায়ের ক্যানসার ধরা পড়ার পর তার হাত গলে বহু টাকা বেরিয়ে গেছে। অফিসের লোন এখনও শোধ হয়নি। আর মাত্র কয়েকমাস। সব শোধ না-হলে অফিস নতুন করে লোন দেবে না। এটাই ওদের অফিসের নিয়ম। তাছাড়া মায়ের গয়নার বাক্সটা তো আছেই। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে নীলাঞ্জনকে ডেকে তার মা বলেছিলেন, “এটা রাখ নীলু। নাতিনাতনি হলে তাদের কিছু দিস। বাকিটা বিক্রি করে একটা বাড়ি বানানো বা ফ্ল্যাট কেনার কথা ভাবিস। অনেক গয়না আছে তো। হয়ে যাবে ঠিক। কতদিন আর ভাড়াবাড়িতে থাকবি!” তৃণাকে এসব কথা মনে করানোয় সে অবশেষে রাজি হল এখানে আসতে।

মা বোধহয় নিজের চলে যাওয়াটা বুঝতে পারছিলেন। তাই হয়তো তাঁর নীলুকে ভাড়াবাড়িতে না-থেকে বাড়ি বানানোর কথা বলেছেন। আসলে সারাজীবন ভাড়াবাড়িতেই কাটিয়ে দিয়েছেন মা। তাই নিজস্ব বাড়ির ভাবনা সবসময় মাথায় ছিল। তেহট্টে ছিল বাবার পৈতৃক ভিটে। কলকাতায় বেসরকারি চাকরি পেয়ে বাবা চলে এলেন মাকে নিয়ে। জমিজমা যা ছিল, তা দিয়ে তেহট্টে সংসার চালানো খুব সহজ ছিল না। নীলাঞ্জনের দুই কাকাও জমির ভরসায় থাকেননি। চাকরি পেয়ে চলে গেছেন দূরে দূরে। বাবা তবু ভিটে আঁকড়ে পড়েছিলেন। চাষবাস করে কোনওমতে চলছিল। কিন্তু একবছর অতিবৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হল, অনেক ধারদেনা হয়ে গেল। তখনই চাকরি খুঁজতে খুঁজতে এক পরিচিত মানুষ কলকাতার চাকরিটার হদিশ দিয়েছিলেন; বলা যায় হাতে ধরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।

নীলাঞ্জনের ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর ঠাকুরদাও স্ত্রীর শোকে বেশিদিন বাঁচেননি। কলকাতা থেকে বাবা সপ্তাহে সপ্তাহে বাড়ি যেতেন। ঠাকুরদা মারা যাওয়ার পর তেহট্টের জমিবাড়ি বিক্রির বন্দোবস্ত করে নিলেন বাবা। দুই কাকাকে ভাগ দিয়ে যেটুকু টাকা হাতে থাকল, তাতে শহরের বুকে জমি কিনে বাড়ি করা সম্ভব ছিল না। ফলে ভাড়াবাড়িই সম্বল ছিল। নীলাঞ্জনের খারাপ লাগে, যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে মোটামুটি একটা ভদ্রস্থ চাকরি পেল সে, তখনই বাবা মারা গেলেন। বাবাকে সুখের মুখ দেখাতে পারেনি বলে নীলাঞ্জনের আফসোস হয় খুব। এর বছর খানেক পরে মায়ের শরীর খারাপ হতে শুরু করল। এর মধ্যে মায়ের জোরাজুরিতেই বিয়েটা তাড়াতাড়ি করে নিতে হল। তৃণার কথা জানার পর মা আর বেশি দেরি করতে চাননি। মনে হয়েছিল শেষ সময় বুঝি চলে আসছে কাছে।

আশ্চর্যজনক ঘটনা হল, নীলঞ্জনের বিয়ের কিছুদিন বাদেই মায়ের ক্যানসার ধরা পড়ল। আর ধরা পড়ার পর মাত্র ছ’মাস মা বেঁচেছিলেন। নীলাঞ্জনের মাঝে মাঝে মনে হয়, মায়ের শারীরিক কষ্ট অনেক আগে থেকেই ছিল। কিন্তু বুঝতে দেননি। তাই তার বিয়ের ব্যাপারে খুব জোরাজুরি করছিলেন।

চাকরি পাওয়ার আগে নীলাঞ্জন বেশ কিছু টিউশনি করত। বলা যায় টিউশনি না-করে উপায় ছিল না। এত খরচ চালানোর মতো টাকাপয়সা বাবার ছিল না। ফলে টিউশনিই ভরসা। শহরাঞ্চলের টিউশনিতে ভালই টাকা পাওয়া যায়। সেই টাকায় পড়ার খরচ চালানোর পাশাপাশি একটা এলআইসি করেছিল, আর ছিল রেকারিং ডিপোজিট। সেগুলো মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে ফিক্সড আর রি-ইনভেস্ট করে সে। এখন সবমিলিয়ে কম টাকা হবে না। সেসবের মেয়াদও ফুরিয়ে এল প্রায়। মাস ছয়-সাত পরে নীলাঞ্জনের হাতে মোটা টাকাই আসবে।

মায়ের ক্যানসার ধরা পড়ার পর নীলাঞ্জন ফিক্সড ডিপোজিটগুলো ম্যাচুউরিটির আগেই ভাঙাতে চেয়েছিল। তৃণাই তা করতে দেয়নি। “তার চেয়ে তুমি বরং অফিস থেকে লোন নাও। তোমাদের অফিস তো বিনা ইন্টারেস্টে লোন দেয়। সেই সুযোগটা নেবে না কেন?”

–আর যদি আরও বাড়াবাড়ি হয়, তখন তো ভাঙাতেই হবে। নীলাঞ্জন যুক্তি দিয়েছিল।
–সে তখন দেখা যাবে। উপায় না-থাকলে ভাঙাবে। কী আর করা যাবে !

নীলাঞ্জনের তৃণার কথাটা মনে ধরেছিল। সেইমতো অফিস থেকে বেশকিছু টাকা লোন করেছিল। তবে মাও ফিক্সড ডিপোজিটগুলো ভাঙানোর মতো পরিস্থিতিতে ফেলেননি নীলাঞ্জনকে।

বাড়িটা বাইরে থেকে দেখতে যেমনই হোক, সেই অর্থে খারাপ নয়। ভেতরের প্লাস্টার মোটামুটি ভালই আছে। মেঝেও চলনসই। দেয়াল খুব মোটা। অনেক পুরানো আমলের বাড়ি। এখনকার মালকিন যে তিন বোন, তাদের বাবা-মা মারা গেছেন অনেক আগেই। ভাড়া আর জমানো টাকায় চলে যায় কোনওমতে।

বাড়িটার কাঠের খড়খড়ি দেওয়া জানালা, জানালার ওপরে অর্ধ গোলাকার রঙিন কাচ বসানো ডিজাইন, লাল মেঝে, সবই এই বাড়িটার সঙ্গে বেশ মানানসই। জল, আলো, বাথরুম সবই ঠিক আছে। তবু কেন যে এবাড়িতে লোকজন বেশি টেকে না কে জানে! এ পাড়ার মুদি দোকানদার বলছিল, নতুন এসেছেন? গুহ বাড়িতে? তা ভালো। দেখুন কতদিন থাকতে পারেন।

কেন এসব বলেছে তার কোনও ব্যাখ্যা দেয়নি। নীলাঞ্জনের জিজ্ঞাসার জবাবে বলেছিল, সে একদিন বলা যাবে সময় সুযোগ করে। তবে থাকুন না। অসুবিধার কিছু নেই। তেমন বুঝলে আমাদের বলবেন।

একটা রহস্য জিইয়ে রেখে কথাগুলো বলেছিল লোকটা। নীলাঞ্জনের মনটা একটু ভেঙে পড়েছিল, কিন্তু তৃণাকে এ ব্যাপারে কিচ্ছু বলেনি। এমনিতেই তৃণা নিমরাজি হয়ে এসেছে, তার ওপর এইসব কথা শুনলে আর থাকতে চাইবে না। তার চেয়ে বরং নিজেই কিছুটা খেয়াল রাখবে ব্যাপারটা। তৃণার সঙ্গে তিন বোনের সারাদিনের গতিবিধি নিয়ে কথা বলে তেমন কিছু বুঝতেও পারেনি।

নীলাঞ্জনরা বরাবর ভাড়াবাড়িতে থাকলেও ওদের আসবাবপত্র বা অন্যান্য জিনিস কম নেই। ফলে বড় ঘরভাড়া ছাড়া উপায়ও ছিল না। কলকাতা শহরে এর চেয়ে কমে আর ঘর পাওয়া যাবে না সেকথা জানে নীলাঞ্জন আর তৃণা। আগের বাড়িওয়ালা প্রোমোটারকে বাড়িটা দিয়ে দিচ্ছে। তাই তড়িঘড়ি নতুন বাড়ি খুঁজে নিয়ে এখানে উঠে আসতেই হল।

বাড়িটা বাসরাস্তা থেকে খানিকটা দূরে। তবু মেনে নিতেই হচ্ছে। সব সুবিধা কি আর পাওয়া যায় ! সকালে আধঘণ্টা আগে বেরোতে হয়, আর সন্ধ্যায় প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে ফেরে। মোটামুটি এক ঘণ্টার বেশি সময় তৃণার থেকে বেরিয়ে যায় বলে প্রথমদিকে তৃণা মুখ ভার করে থাকত। ইদানিং সয়ে গেছে। সারা দিনে তিন বোনের সঙ্গে গল্পগুজব করে দিব্বি কাটিয়ে দেয় সে।

 

শীতের রাত। আজ খুব সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে নীলাঞ্জনের। সাধারণত রাতের খাওয়ার পরে সিগারেট টানে না সে। তৃণা খুব রাগারাগি করে। পাশে শুলেই বলবে, যাও তো। দাঁত মেজে এসো। আর সাবান দিয়ে হাত ধোবে। বদ্ধ ঘরে সিগারেটের গন্ধ অসহ্য লাগে।

দাঁত মেজে, হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে এলেও তৃণার রাগ পড়ে না। “তোমার সারা গায়েই সিগারেটের গন্ধ ভরে আছে।” সেই থেকে রাতের খাওয়ার পর সিগারেট বাদ দিয়েছে নীলাঞ্জন। আজ প্রোমোশনের খবর পেয়ে বিরিয়ানি আর চিকেন চাপ নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। দুটোই তৃণার ফেভারিট। মাইক্রোওভেনে গরম করে একটু আগেই রাতের খাওয়া শেষ করল ওরা।

সিগারেট টানতে ছাদে পাঠিয়ে দিল তৃণা। এখন ওর পিরিয়ডের সময়। এই কদিন ও কাছেই ঘেঁষতে দেবে না। ফলে সিগারেট টেনে হাত-মুখ ধুয়ে পাশাবালিশ জাপটে ওপাশ ফিরে শুলেই ল্যাঠা চুকে গেল। তাছাড়া তৃণা ঘুমিয়ে পড়লেই কাদা। কিচ্ছু টের পায় না।

পা টিপে টিপে দোতলায় ওঠে নীলাঞ্জন। চিলেকোঠায় দরজার পাশে পেরেকে ঝোলানো থাকে ছাদের চাবি। যে ছাদে যায়, ওখান থেকেই চাবি নিয়ে খোলে আর বন্ধ করে ওখানেই ঝুলিয়ে রাখে। নীলাঞ্জন সতর্ক হয়ে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে ওঠে। সেজ বোনটা খুব রাগী। টের পেলে দু-কথা শুনিয়ে দেবে। বড় আর মেজ বোনের ওপর তার খবরদারির শেষ নেই। প্রথম যেদিন এ বাড়িতে এল নীলাঞ্জনরা, তখন এই সেজই একটা আমুলের টিনের কৌটো দিয়ে গেল।

–শুনুন ভাই, সিগারেট খান ঠিক আছে। কিন্তু দরজা জানালা দিয়ে টুসকি মেরে পোড়া সিগারেট ফেলবেন না প্লিজ। অ্যাসট্রে না-থাকলে এই কৌটোর মধ্যে সিগারেট নিভিয়ে ফেলবেন। পরে জমে গেলে রাস্তার ধারে ড্রেনে ফেলে দিলেই হল। এইরকম যেখানে-সেখানে সিগারেটের টুকরো পড়ে থাকতে দেখলে আমার মাথা ধরে যায়।

একনাগাড়ে কথাগুলো বলেই দোতলায় ফিরে গেল সে। নীলাঞ্জনের ইচ্ছে ছিল বলার, এতই যদি পরিষ্কারের বাতিক, তাহলে উঠোনে এদিক-সেদিক ঘাসের পাহাড় জমে আছে দেখতে পান না? কিংবা শ্যাওলা জমে আছে দেয়ালে, পাঁচিলে! এসব চোখে পড়ে না? কিন্তু সেসব শোনার মতো লোকটিই তো নাগালের বাইরে! তাছাড়া এসব বলা মানে পায়ের ওপর পা দিয়ে ঝগড়া করা। নীলাঞ্জন তাই চুপ করে যায়। কৌটোটাও পরে ফেরত দিয়ে এসেছে তৃণা।

সিগারেট টেনে একইভাবে পা টিপে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় তীব্র সবুজ আলো চোখে পড়ল নীলাঞ্জনের। জানালার নীচ দিয়ে আলোটা বেরিয়ে এসে উল্টোদিকের দেয়ালে পড়েছে। ওঠার সময় আলোটা কি দেখেছিল? ভাবে নীলাঞ্জন। নাহ্‍, তখন টিউবের আলো এসে পড়েছিল এই দেয়ালে। এখন সবুজ আলো পড়েছে। হয়তো স্লিপিং লাইটের আলো। কিন্তু আলোটা এত তীব্র বলেই কেমন যেন খটকা লাগে তার।

আলোর শরীরে ছায়ারা নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। তার মানে ঘরে কেউ চলাফেরা করছে। তা করুক। যাদের ঘর তারা ঘরে তীব্র আলো জ্বালাক, চলাফেরা করুক বা অন্যকিছু, তাতে নীলাঞ্জনের কী যায় আসে? কথাগুলো ভেবে এগোতে থাকে নীচতলার দিকে। আচমকা তার কানে ভেসে আসে গুনগুন শব্দ। একটানা সুরের মতো। হঠাৎই কৌতূহল হয় তার। কেউ কি গান গাইছে? একটু কান পেতে শোনে, একা কারও গলা নয় যেন। তার মানে কি সবাই মিলে গান গাইছে? কৌতূহল এত তীব্র হয়ে উঠল যে নীলাঞ্জন নিজের অজান্তেই নীচু হয়ে পর্দার ফাঁক দিয়ে চোখ রাখে ঘরের ভেতরে। আর তার পরেই তার চোখ স্থির হয়ে যায়। হৃদপিণ্ডের ওঠানামা থেমে যায় যেন।

সবুজ আলোয় নীলাঞ্জন চোখ বড় বড় করে দেখে তিন বোনই একটা ছোট্ট টেবিলকে ঘিরে ঘুরে চলেছে। তিনজনের শরীরেই কোনো পোশাক নেই। এদের সবার চেহারাতে একটা বনেদিয়ানা আছে। গায়ের রঙও ফরসা। চামড়ায় ঔজ্জ্বল্য আছে। ফলে ঘরের সবুজ আলো যেন চলকে পড়ছে সবার শরীর থেকে।

লাইট ব্র্যাকেটে সবুজ আলোটা জ্বলছে। ঘরের ঠিক মাঝবরাবর, খাটের সামনে একটা টেবিল বসানো। তার ওপর কোনো বাঁধানো ছবি দাঁড় করানো আছে। তাকে ঘিরেই ওরা ঘুরে চলেছে। খুব যত্ন করে দেখার চেষ্টা করে নীলাঞ্জন। একটা সাদাকালো ছবি মনে হচ্ছে। আড়াআড়ি রাখা বলে ভাল করে দেখতে পাচ্ছে না সে। এরা তিনজন ছবিটার চারপাশে ঘুরছে আর মন্ত্রের মতো একটানা সুর করে কিছু-একটা বলে চলেছে। অবাক হয় সে।

বড় আর মেজ বোনের মধ্যে বয়সের পার্থক্য খুব বেশি নয়। বড়জোর দু-তিন বছর, কিন্তু সেজ বোন প্রায় বছর দশেকের ছোট। যদিও তার দাপটই বেশি। আর ছোট বোন নাকি সেজ বোনের থেকে সাড়ে তিন বছরের ছোট। যদিও তার সঙ্গে এদের কারও যোগাযোগ নেই এখন আর। দু-পক্ষই যোগাযোগ রাখে না। অসম বয়সের তিন বোন এইরকম উলঙ্গ হয়ে চক্রাকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে? এদের মাথার ঠিক আছে তো? লোকটি কে? কার ছবিকে মাঝে রেখে এরা প্রদক্ষিণ করছে?

এক সময় নীলাঞ্জন লক্ষ করে তিনজনেই পরস্পরের কাঁধে হাত রেখে ঘুরছিল, এখন সেই হাতগুলো কোমরে নেমে এসেছে। তৃণা আর তুয়াবৌদি ছাড়া কারও খোলা শরীর নীলাঞ্জন কোনওদিন দেখেনি। যদিও এদের দুজন মাঝবয়সি, আর সেজো বোনের বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশের কাছাকাছিই হবে। সবারই শরীর বেশ মজবুত। একটুও নুয়ে পড়েনি। অথচ এদের খোলা শরীর দেখে তার মধ্যে কোনও উত্তেজনা হচ্ছে না। কেমন যেন একটা ভয় আর রোমাঞ্চ মিলেমিশে জড়িয়ে ধরছে তাকে। মনে হচ্ছে উঠে চলে যায় ঘরে। আবার কেন যেন যেতেই পারছে না। জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ছে বুঝতে পেরে নিজেকে সংযত করে সে। বাঁধানো ফটোটা এবার এক-এক করে বুকে চেপে ধরছে তারা। তারপর ফটোটাকে ছোট্ট টেবিলটায় রেখে পরস্পর জড়িয়ে ধরল। এরপর? আরও পরে কী ঘটে দেখার জন্য চোখ আটকে রাখে পর্দার নীচের আলোকিত গহ্বরে। কিছুক্ষণ ঐভাবে থাকার পর ছবিটা যেমন ছিল সেখানেই রেখে বড় আর মেজ বিছানায় উঠে পড়ে খোলা শরীরেই। সেজ শুধু আলোটা বন্ধ করার জন্য এগিয়ে যায় সুইচবোর্ডের দিকে। নীলাঞ্জন এবার উঠে পড়ে। আর তখনই আলো নিভে যায়। অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়ে দোতলার বারান্দায়। নীলাঞ্জন দ্রুত নেমে আসে নীচে।

 

নীলাঞ্জন সন্তর্পণে ঘরে এসে দেখে তৃণা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। দরজা খোলা। টিউব লাইট জ্বলছে। বারান্দার গ্রিলে তালা দেওয়া থাকলে আর কোনও সংশয় থাকে না। তাই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাইরের গেটেও দশটার পরেই বড় তালা ঝুলিয়ে দেয় সেজ বোন। তৃণা এদের তিন বোনকে বড়দি, মেজদি, সেজদি বলে ডাকে। নীলাঞ্জন কিছুই ডাকত না আগে। “আমি এইসব দিদি-ফিদি বলতে পারব না। কথাই তো বলি না, তার আবার দিদি!” তৃণাকে বলেছিল নীলাঞ্জন।

ভেবেছিল তৃণাকে ঘটনাটা বলবে। কিন্তু সে তো ঘুমিয়েই কাদা। পরক্ষণেই মনে হয় পর্দার আড়াল থেকে এই দৃশ্য দেখার কথা কিছুতেই বলা ঠিক হবে না তৃণাকে। হয়তো বলেই বসবে, তুমি এত নীচ! মহিলাদের ঘরে উঁকি মারো?

নীলাঞ্জনের কিছুতেই ঘুম আসছে না। বারবার সেই দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছে। ওরা কী করছিল ওভাবে? ছবিটাই-বা কার? যতবার অন্যকিছু ভাবতে চেয়েছে, ততবারই মেরুন রঙের পর্দাটা চোখের সামনে দুলে দুলে ওঠে। ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম নিয়ে রাত কাটে নীলাঞ্জনের।

ভোরেই খবরের কাগজ দিয়ে যায়। বাইরের গ্রিলের গায়ে কাগজটা আটকে রেখে যায় ছেলেটা। প্রথমদিকে তৃণা নিয়ে আসত পেপারটা। এখন সেজ বোন নিয়ে এসে ওদের দরজার সামনে রেখে দেয়। খুব ভোরে উঠে নানা কাজ সেরে সেজ বাজারে যায়। এটা তার প্রতিদিনের কাজ।

খবরের কাগজে চোখ রেখে নীলাঞ্জন বুঝতে পারে সেজ বোন বাজারে যাচ্ছে। আড়চোখে একবার দেখে নেয় নীলাঞ্জন। পেছনটা দেখেই গত রাতের কথা মনে পড়ে তার। শাড়ি ভেদ করে গোটা শরীরই যেন বেআব্রু হয়ে পড়ে তার সামনে। কেমন একটা অস্বস্তি নিয়ে নীলাঞ্জন স্নান করতে ঢোকে বাথরুমে।

অফিসে গিয়ে একবার ভাবে দত্তদার সঙ্গে কথা বলা যাক। দত্তদা গ্রুপ থিয়েটার করে। এদের ছোট বোনটাও গ্রুপ থিয়েটার করে। ভাড়ায় আসার দিন কয়েকের মধ্যেই তৃণা ওদের অনেক খবর পেয়ে যায় গল্পে গল্পে। সেজ বোন সুনেত্রা বলেছে ছোট বোন সুছন্দার কথা। বিয়ের পর সুছন্দা গুহ থেকে রায় হয়েছে সেকথাও জানিয়েছে। নীলাঞ্জন যখন জিজ্ঞাসা করেছিল দত্তদা সুছন্দাকে ভালই চেনে বলেছিল। আর অনেক প্রশংসা করেছিল তার।

–বুঝলি, খুব ভালো অভিনয় করে সুছন্দা। আমাদের দল ছেড়ে দিল। আমরা এখনও ওর অভাবটা বুঝি। ঐরকম একজন অভিনেত্রী আজও পেলাম না।

দত্তদার আফসোস শুনে নীলাঞ্জন জিজ্ঞাসা করেছিল, এখনও যোগাযোগ আছে?

–অবশ্যই। ওদের শো দেখতে যাই। আমাদের শো দেখতে আসে ও।

নীলাঞ্জন ভাবছে একবার দত্তদার মাধ্যমে যোগাযোগ করা যায় না সুছন্দা রায়ের সঙ্গে? তাহলে হয়তো জানা যাবে এদের কাণ্ডকারখানা সম্পর্কে। কিন্তু লুকিয়ে দেখা দৃশ্যটা জানাবে কী করে দত্তদাকে? এইসব ভেবে আর বলা হয়ে ওঠে না। মনের মধ্যে খচখচানি থেকেই যায়। কিন্তু বেশিদিন এই খচখচানি থাকে না। দিন তিনেকের মাথায় এই প্রসঙ্গেই পাড়ার দোকানদারের সঙ্গে কথা হয় নীলাঞ্জনের।

শ্রাবণ মাস। সকাল থেকেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে। দোকানে কোনও খরিদ্দার নেই। নীলাঞ্জন অফিস থেকে ফেরার পথে এখান থেকে টুকিটাকি জিনিস কেনে। সেইসময় একটা সিগারেটও টানে। তৃণা ফোন করে বলল, পারলে আসার সময় হাঁসের ডিম এনো তো মিন্টাদার দোকান থেকে। এই দোকানদারকে সবাই মিন্টাদা বলে। বয়স মোটামুটি ষাটের ওপরেই হবে। এমনকি ছোটদেরও মিন্টাদা বলতে শুনেছে নীলাঞ্জন। এটাই এখন নাম হয়ে গেছে দোকানদারের। নীলাঞ্জন ডিম কিনতে ঢোকে দোকানে। ফাঁকা দোকান বলে কথাটা পাড়ে সে।

–আপনি একদিন বলছিলেন, গুহবাড়িতে কেউ টেকে না। কেন বলুন তো? একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে প্রশ্নটা ভাসিয়ে দেয় নীলাঞ্জন।

–কেন জানি না ভায়া। তবে কেউই বেশিদিন থাকে না।

নীলাঞ্জন কোনও আন্দাজ পায় না। তবু চেষ্টা করে সে। ওরা কিন্তু কেউ মুখরা নয় সেভাবে। মানে মুখটুখ করলে অনেক সময় ঝামেলা হয় না? তাই বলছিলাম।

–সেজটা তো খুব চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে। আমার দোকানে আসে তো, তাই জানি।

–তা একটু আছে। তবে আমাদের সঙ্গে কোনও খারাপ ব্যবহার করেনি এখনও। নীলাঞ্জন সতর্ক হয়ে যায়।

–করেনি। কিন্তু করতে কতক্ষণ ভাই? তিন বোনই এক-একটা চিজ।

–একথা বলছেন কেন?

চোখেমুখে কৌতুক রেখে মিন্টাদা বলে, জানেন না ওদের কাণ্ড? তিন বোনের তো একটাই নাঙ ছিল।

–মানে? রহস্যের গন্ধ পায় নীলাঞ্জন।

–আশনাই বোঝেন, আশনাই? বড় বোন সুমিত্রার বিয়ে হয়েছিল এক নেভি অফিসারের সঙ্গে। সেই লোকটা ছ-মাসে ন-মাসে বাড়িতে আসত আর এসেই যখন-তখন বৌকে বগলদাবা করে এখানে নিয়ে এসে দিন কয়েক থাকত। সেইসময়ই মেজটার সঙ্গে লটরপটর হয়ে গেল। সে কী কেলো মাইরি! ঝগড়াঝাঁটি, চেঁচামেচি সব হল। বাড়ির সামনে ভিড় জমে গেল একদম বুঝলেন! তারপর বৌ নিয়ে সেই সন্ধ্যাতেই চলে গেল সে। ও বাবা! এক সপ্তাহ কাটেনি। আবার বৌকে নিয়ে হাজির। তারপর সব মিটেও গেল।

–এটা কতদিন আগের ঘটনা? কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞাসা করে নীলাঞ্জন।

–তা ধরুন গে বছর দশেকের বেশি তো হবেই।

–আচ্ছা। তারপর আর ঝামেলা হয়নি কোনওদিন?

–সে আর বলতে! বৌ বাড়িতে আর উনি দুপুরবেলা এখানে এসে ওঠেন। পরে জানাজানি হল মেজ আর সেজ দুজনের সঙ্গে তার ফস্টিনস্টি চলছে। পাড়ার ছেলেছোকরাদের কারবার। ঠিক বের করে ফেলেছে।

–আর ছোট বোন?

–সে তো তখন কলেজে পড়ে। যেদিন বাড়িতে থাকত সেদিন আসত না। আর সে যেদিন কলেজে যেত সেদিনই আসত ব্যাটা।

–তারপর? নীলাঞ্জনের কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে ব্যাপারটা। তাই অজান্তেই মুখ থেকে ‘তারপর’ বেরিয়ে এল।

–এইসব নিয়ে আবার ক্যাচাল। একদিন ছোটটা কলেজ যেতে গিয়ে মাঝপথ থেকে ফিরে আসে। বাসে উঠতে গিয়ে নাকি কী কারণে পা মচকে গেছে। বাড়িতে এসে দেখে জামাইবাবু আছে। তার সন্দেহ হয়। সে বড়দিকে ফোন করে সব জানায়। তারপর সে কী ঝামেলি! হা হা হা… বড়টার শ্বশুরবাড়ি ছিল দু-তিনটে স্টেশন পরে। সেও এসে হাজির। অফিসের কাজ বলে নাকি মাঝেমাঝেই বের হয়। ব্যাটা যে তারই বোনেদের সঙ্গে লটঘট করতে আসে তা তো আর জানত না!

–আচ্ছা। এরপরই আর বড় বোন ফিরে যায়নি। তাই না? নীলাঞ্জন নিশ্চিত হয়ে বলে।

–না না। সেদিনই তো কান্নাকাটি করে ফিরে গেল। এরপর যেখানেই যায় লোকটা, বৌয়ের সন্দেহ হয় এখানেই আসছে। এই নিয়ে অশান্তি। তারপর মাস কয়েক পরে বৌকে এবাড়িতে তুলে দিয়ে গেল। সেই যে নেভির কাজে গেল, আর আসেনি। যোগাযোগও রাখে না। ব্যাটা নাকি আর ফেরেইনি। কোথাও হয়তো সংসার পেতে বসে আছে। হা হা হা…

নীলাঞ্জনের কাছে খানিকটা স্পষ্ট হয় ছবিটা। তার মানে কি ছবির লোকটা বড় জনের বর আর বাকি দুই বোনের জামাইবাবু!

–ছোটটার সঙ্গে কিছু হয়নি লোকটার? গোয়েন্দার মতো প্রশ্ন করে সে।

–আরে নাহ্‍। সুছন্দা এদের মতো না। দারুণ গান গাইত জানেন! আর অল্প বয়স থেকেই নাটক করত। নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছে। বিয়ের পর একবার-দুবার এসেছিল। তারপর আর এমুখো হয়নি।

নীলাঞ্জনের কাছে কিছুটা ধোঁয়াশা কাটলেও, পুরোটা কাটেনি এখনও। তবু যেটুকু হল তাও কম নয়। এই ভেবে সে ডিমের ঠোঙা হাতে নিয়ে বেরোতে যায় দোকান থেকে।

–শুনুন ভাই, এসব কথা আমি বলেছি সেটা কাউকে বলবেন না যেন। সবাই জানে যদিও। তবু আমার কথাটা ঘুণাক্ষরেও বলবেন না কাউকে।

–আরে না না মিন্টাদা। কাকে আর বলব? আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

নীলাঞ্জন বেরিয়ে যায় দোকান থেকে।

–ও ভাই, আর একটা কথাও শুনে যান। হেব্বি ইন্টারেস্টিং!

নীলাঞ্জন ফিরে আসে দোকানের কাছে।

–কথা দিন কাউকে বলবেন না? আপনাকে বলেই বলছি। আপনি তো ও বাড়িতে থাকেন। তাই বলছি আর কি। আমি নিজের চোখে দেখিনি যদিও। তবে একজন দেখেছে। তার থেকেই শোনা। তার নাম আমি বলব না।

–কী দেখেছে একজন?

–মেয়েছেলেগুলো ন্যাংটো হয়ে সেই লোকটার ছবির চারপাশে ঘোরে নাকি রাতদুপুরে।

মুখটা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে নীলাঞ্জন। যেন এই প্রথম এমন একটা ঘটনার কথা শুনল সেভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়।

–বলেন কী? এ তো তাজ্জব ব্যাপার !

–কথাটা কিন্তু সত্যি।

–যাহ্‍। আমার বিশ্বাস হয় না। যে দেখেছে সে কীভাবে দেখল? উঁচু পাঁচিল দেওয়া বাড়ি। বারান্দা আর বাইরের গ্রিলে তালা দেওয়া থাকে।

নীলাঞ্জনের মনে উঁকি মারে নিজের নিরাপত্তার কথা। দোতলার ঘরের খবর মিন্টাদা জানে। আর সে থাকে নীচতলায়। তার ঘরেও তো উঁকি মারতে পারে কেউ!

–বিশ্বাস করা না-করা আপনার ব্যাপার। আরে বাবা বুঝছেন না কেন, পাঁচিল তো হালে দেওয়া। আগে তো ছিল না। বারান্দায় গ্রিলও ছিল না।

নীলাঞ্জন পায়ে পায়ে বেরিয়ে আসে দোকান থেকে। পাঁচিল নতুন এটা ঠিক। গ্রিলটাও নতুনই হবে। তবু তিন মহিলা থাকে একটা বাড়িতে। তাদের ঘরে উঁকি মেরে দেখল কেউ? এ আবার কেমন কথা? সেই লোকটাই বা কেমন? ছিঃ ছিঃ। মনে মনে কথাগুলো বলেই নিজের কথা ভাবে সে। নীলাঞ্জনও তো উঁকি দিয়েই দেখেছে সেই দৃশ্য! তার মানে তার মানসিকতাও ভালো নয়! কেমন যেন গা ঘিনঘিন করে ওঠে তার।

 

সেই ঘটনা নীলাঞ্জন তৃণাকে বলতে পারেনি তখনই। একজনের সঙ্গে তিন বোনের শারীরিক সম্পর্ক ছিল সেকথা বলতে ইচ্ছে করেনি। নিজের মনেও মেঘলা আকাশের ছায়া ঘনিয়ে ওঠে। মাসতুতো দাদা তুষারের সঙ্গে নীলাঞ্জনের বয়সের পার্থক্য ছয়-সাত বছরের। তবু ছোটবেলা থেকেই বন্ধুর মতো সম্পর্ক। সেই দাদার বৌকে তুয়াবৌদি বলত নীলাঞ্জন। তুয়ার সঙ্গে তিন-চারবার নীলাঞ্জনের শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল। কীভাবে যেন তুষারদা জেনে গিয়েছিল। এই নিয়ে অশান্তি এমন জায়গায় পৌঁছল যে তুষারদার সঙ্গে সম্পর্কটাই নষ্ট হয়ে গেল শেষপর্যন্ত। তৃণাকে সেকথাও বলেনি নীলাঞ্জন। বলা যায়ও না। নিজের এইরকম অন্ধকারের কথা বৌকে বলা মানে একটা সন্দেহের আবরণ তৈরি করা। সেই আঁশটে দিনগুলো নিজের বুকেই জমা করে রেখেছে নীলাঞ্জন। তবে বিতস্তার কথা বলেছে, যার সঙ্গে তার প্রেম-প্রেম সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল কলেজে। বিতস্তা তো হাতটাও ধরতে দিত না ঠিকমতো।

ইদানিং এদের তিন বোনের সঙ্গেই সখ্যতা গড়ে উঠেছে নীলাঞ্জনের। নিজেই টুকিটাকি কথা বলা শুরু করেছে। কী সেজদি বাজারে যাচ্ছেন? দেখবেন তো ভাল কই উঠেছে কিনা। অনেকদিন তেল-কই খাওয়া হয় না।

–হ্যাঁ হ্যাঁ দেখব। আমাদের অবশ্য কইমাছ কারও ভালো লাগে না। মাথাসর্বস্ব মাছ। শাঁস নেই…

এভাবেই প্রথমে সেজর সঙ্গে, পরে মেজ আর বড়র সঙ্গেও কথাবার্তা হয় মাঝে মাঝে। মেজদির সঙ্গে কথা হয় ছুটির দিনে, ছাদে জামাকাপড় মেলার সময়। নীলাঞ্জনই কাচা জামাকাপড় মেলে দেয় ছুটির দিন। বড়দির সঙ্গেও সেভাবেই আলাপ। তবে কথা হয়েছে খুবই কম।

নীলাঞ্জন এখন সুনেত্রাকে সেজদি বলে ডাকে। যদিও খুব আপত্তি করেছিল, ছি ছি, দিদি বলবেন না। আমাকে নাম ধরেই ডাকবেন।

–তুমি ছাড়ো তো সেজদি। দিদি বলে ডাকছে যখন আপত্তি কোরো না। চোখ টিপে বলেছিল তৃণা। সেজ বাজারে চলে যেতেই তৃণা হিসহিস করে বলেছে, এর আবার বড্ড খুকি সাজার ইচ্ছে। ন্যাকা…

এরপর আর কথা হয়নি। নীলাঞ্জনও তারপর থেকে সেজদিই ডাকে।

দু-একসময় বাজার থেকে এটা-সেটা এনেও দেয় সেজদি। অল্প আলাপেই বড়দি-মেজদিরও প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছে নীলাঞ্জন।

এক রবিবারের সকালে তৃণা একাই তার বোনের বাড়ি গিয়েছিল। একটা মাত্র ছুটির দিন একটু শুয়েবসে কাটাতে ভালো লাগে। এতটা পথ যাতায়াত করতে ইচ্ছে করছিল না। তাছাড়া নীলাঞ্জনের সেদিন সকাল থেকেই ঘাড়ে বড্ড ব্যথা। তাই আর যায়নি। বোনের ননদের সাধভক্ষণ অনুষ্ঠান, সেখানে না-গেলেই নয় বলে তৃণা গিয়েছিল। ভোরে উঠে রান্নাবান্না করে রাখবে ভেবেছিল তৃণা। কিন্তু সেজদিই বারণ করে দিল।

–ওসব নিয়ে ভেবো না তৃণা। আমাদের ঘরেই খেয়ে নেবে’খন। তুমি নিশ্চিন্তে যাও।

খুব জোরে জোরে কথা বলে সেজদি। তার গলার আওয়াজ ওপরেও পৌঁছে গেছে কিংবা নিজেই হয়তো পৌঁছতে চেয়েছে। ফলে ওপর থেকেও মেজদির সমর্থনের শব্দ ভেসে আসে নীচে। তৃণা সত্যিকারের নিশ্চিন্ত হয়ে চলে যায়। সেদিন খুব যত্ন করে খাইয়েছিল ওরা। সর্বাঙ্গ সযত্নে ঢাকা তিন বোনের শরীর তবু নীলাঞ্জনের চোখে উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছিল বারবার। বড়দি আর মেজদি খুব কাছ ঘেঁষে বসেছিল নীলাঞ্জনের। সেজদি সুন্দর করে পরিবেশন করে খাইয়েছে। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে নীলাঞ্জনের ভাবী পরিকল্পনাও জানতে চেয়েছিল খুব উৎসাহ নিয়ে সবাই। নীলাঞ্জন এড়িয়ে গেছে।

 

এক রাতে বিছানায় শুয়ে তৃণাকে জড়িয়ে ধরে নীলাঞ্জন বলে, জানো তো, এদের তিন বোনের একজনের সঙ্গেই শারীরিক সম্পর্ক ছিল।

ছিটকে ওঠে তৃণা। তুমি জানলে কীকরে?

–একজন বলছিল এ পাড়ার। এইসব নিয়ে নানা ঝামেলা হয়েছিল কয়েক বছর আগে।
–মানে?
–বড় বোনের স্বামীর সঙ্গে বাকি দু-বোনের ফিজিক্যাল রিলেশন ছিল। তাই নিয়ে অনেক ঝঞ্ঝাট হয়েছিল।
–এ পাড়ার একজন মানে কে গো? আমি চিনি তাকে?
–মিন্টাদা। সেদিন ডিম কিনতে গিয়ে দেখি ফাঁকা দোকান। তখনই বলল এসব।
–তোমাকে ডেকে বলল নাকি তুমি নিজেই জানতে চাইলে?
–একদিন মিন্টাদা বলছিল এবাড়িতে কেউ নাকি বেশিদিন টেকে না। তাই জিজ্ঞাসা করলাম কারণটা। তখনই মিন্টাদা কথায় কথায় বলল।
–ধ্যাত, তা হয় নাকি? একজনের সঙ্গে তিন বোনের ফিজিক্যাল রিলেশন। এসব বাজে কথা মনে হয়।
–মিন্টাদা বলল কে নাকি উঁকি মেরে দেখেছে মধ্যরাতে।
–মধ্যরাতে? সে কি চোর নাকি যে চুরি করতে এসে দেখে ফেলেছে? যতসব আজগুবি খবর বুঝলে। আমার বিশ্বাস হয় না।
–যাক গে, ছাড়ো লোকের কথা। আমাদের কী যায় আসে! আমাদের সঙ্গে তো খারাপ ব্যবহার করছে না! নীলাঞ্জন সতর্ক হয়ে যায়। যদি নিজের চোখে দেখাটাও মুখ ফসকে বেরিয়ে যায় এই আশঙ্কায় চুপ করে যায়। তারপর গভীরভাবে তৃণাকে জড়িয়ে ধরে বলে, কাউকে আর বোলো না এসব।

এরপর আর নীলাঞ্জনের শরীরে সেভাবে আলো জ্বলে উঠল না। নিভন্ত চুল্লিতে কোনওরকমে জল ঢেলে শুয়ে থাকল সে। শ্রান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে তৃণা। সেদিকে তাকিয়ে দেখে চোখ বুঝে ঘুমানোর চেষ্টা করে নীলাঞ্জন। একসময় ঘুম চলেও আসে চোখে। কিন্তু ঘুমটা ঠিক জমে না। শুকনো পাতার মতো উড়ে যেতে থাকে নানা দৃশ্য। তিন বোনের নিরাবরণ প্রদক্ষিণের ছবি ধরা পড়ে তার তন্দ্রাচ্ছন্ন স্বপ্নে।

আচমকা ঘুম ভেঙে যায় নীলাঞ্জনের। পাশ ফিরে দেখে তৃণা বিছানায় নেই। লাফ দিয়ে ওঠে। লাগোয়া বাথরুমের আলো নেভানো। বাইরে থেকে আটকানো। চোখ পড়ে খোলা দরজার দিকে। নীলাঞ্জনের পা কেউ যেন টেনে টেনে নিয়ে যায় দোতলায়। আজও সবুজ আলোর রেখা দেয়ালের গায়ে। দ্রুত পরদার ফাঁক দিয়ে চোখ রাখে। বিস্ময়ে নীলাঞ্জন তাকিয়ে দেখে তিন বোনের সঙ্গেই তৃণাও প্রদক্ষিণ করে চলেছে একটা রঙিন ছবিকে। কী আশ্চর্য, তুয়াবৌদিও ওদের দলে! নীলাঞ্জন আরও আশ্চর্য হয়ে দেখে সেই ছবিটা তারই। আজ জানালার দিকে মুখ করে রাখা।

চরম হতাশা আর ঘৃণায় নীলাঞ্জনের বমি উঠে আসে। দ্রুত নীচে নেমে আসে সে। ঘরে ঢুকে অ্যাটাচ বাথরুমে গিয়ে হড়হড় করে বমি করে স্বস্তি পায়। তারপর বাথরুম থেকে বেরিয়ে ঘরের মাঝখানে এসে চোখ বন্ধ করে শ্বাস নেয় কিছুক্ষণ। বৃষ্টিভেজা রাতের বাতাসে শিরশিরে হাওয়া। তবু শরীরের অস্বস্তি কাটাতে সে সিলিং ফ্যান ফুল স্পিডে চালিয়ে দেয়।

কিছুক্ষণ পরে নীলাঞ্জনের মনে হয় তৃণা তাকে কেন্দ্র করে ঘুরে চলেছে গুনগুন গুঞ্জন তুলে। সেই সঙ্গে তুয়াবৌদি। আর আছে ওরা তিন বোনও। নীলাঞ্জন জোর করে চোখ বন্ধ করে রাখে। চোখ খুলতে ভয় পায় সে।