সুশোভন ধর
গত ৩০ এপ্রিল ভেনেজুয়েলায় মার্কিন মদতে অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়। এই অপচেষ্টা আপাতত ব্যর্থ হলেও বিপদ কেটে গেছে বলা যাবে না। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প ফেব্রুয়ারিতে খোলাখুলি ঘোষণা করেছিলেন যে মাদুরো সরকারকে উৎখাত করতে তিনি সমস্ত পথ ও উপায় খোলা রাখছেন। ফলে এই মুহূর্তে পিছিয়ে আসতে হলেও তিনি যে হাল ছাড়তে নারাজ তা খুব স্পষ্ট। কাজ হাসিল করতে তারা যেকোনও পন্থা অবলম্বন করতে পারেন— গৃহযুদ্ধ সংগঠিত করা, বাইরে থেকে ভাড়াটে সৈন্য পাঠিয়ে আক্রমণ, অর্থনৈতিক অবরোধ বা এমনকি সরাসরি মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ভাবনাচিন্তা অনুসারে, লাতিন আমেরিকা তাদের জমিদারি। অতএব সেখানে যেমন খুশি আধিপত্য বিস্তার করে যথেচ্ছ শোষণ-নিপীড়ন চালাতে তাদের বাধা দেয় কার সাধ্যি। ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন খোলাখুলিভাবেই বলেছেন যে এই আগ্রাসন ভেনেজুয়েলায় থামবে না। তাদের নিশানায় কিউবা এবং নিকারাগুয়াও আছে।
ভলুন্তাদ পপুলার (বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘জনগণের আকাঙ্খা’) দলের নেতা ও জাতীয় আইনসভার সদস্য খুয়ান গিয়াদোর সমস্ত পদক্ষেপ, এমনকি নিজেকে “ভেনেজুয়েলার অন্তর্বর্তী রাষ্ট্রপতি” ঘোষণা করা মার্কিন কেষ্ট-বিষ্টুদের নির্দেশেই। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে মার্কিন প্রশাসন মনে করছিল যে নিকোলাস মাদুরো সরকারকে উৎখাত করার জন্য “চূড়ান্ত ধাক্কা” দেওয়ার সময় এসে গেছে। সেই হিসাবেই তারা ৩০ এপ্রিলের অভ্যুথানের ছক কষে। তাদের অনুমান ছিল যে ভেনেজুয়েলার সামরিক বাহিনীর মধ্যে ফাটল ধরানোর চূড়ান্ত মুহূর্ত আসন্ন। সৌভাগ্যক্রমে তাদের অনুমান এক্ষেত্রে কাজ করেনি।
ব্যর্থ অভ্যুথান, অতঃপর?
সারা বিশ্বের প্রগতিশীল বা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ গিয়াদোর এই পরাজয়ে আনন্দিত। অন্যদিকে, এই আয়োজন ভেস্তে যাওয়ার ফলে ভেনেজুয়েলার দক্ষিণপন্থী শিবির একাধারে হতাশ এবং আরও মরিয়া হতে বাধ্য। বহুজাতিক পুঁজির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে লেওপোলদো লোপেজ, মারিয়া কোরিনা মাচাদো এবং ঐদেশের অন্যান্য বুর্জোয়া রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও তাদের গোষ্ঠীগুলি মুখিয়ে রয়েছে দেশের অভ্যন্তরে অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ মদতে যেনতেনপ্রকারেণ মাদুরো সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে মসনদ হাসিল করতে। কিন্তু এপ্রিল মাসের শেষে অত্যুৎসাহে ক্ষমতাদখল করতে গিয়ে তাঁরা হিসাবে কিছু কিছু ভুল করেছিলেন। তাঁরা আশা করেছিলেন যে জনগণ তাঁদের ডাকে সাড়া দিয়ে মাদুরো সরকারকে উৎখাত করতে জানপ্রাণ বাজি রেখে রাস্তায় নেমে পড়বেন। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের আর্থিক টানাটানির সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে বেঁচে থাকা ভেনেজুয়েলার এই সাধারণ মানুষগুলির আসল আকাঙ্খা ধর্তব্যের মধ্যে না এনে এই মানুষগুলিকে শুধুমাত্র ভেড়ার পাল হিসাবে কল্পনা করার কারণেই তাদের এই প্রচেষ্টা দানা বাঁধেনি। ভেনেজুয়েলীয় বুর্জোয়ারা আশায় বুক বাঁধছিলেন যে চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটের মাঝে কোনওরকমভাবে টিকে থাকা সেদেশের প্রলেতারীয় অংশ তাঁদের বাঁশির তালে নাচতে নাচতে মাদুরো সরকারকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে দলে দলে যোগ দেবেন। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে যেভাবে কারাকাস শহরের আশেপাশের বস্তির গরীব মানুষ রাস্তায় নেমে ২০০২ সালের ১৩ এপ্রিল আরেকজন স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি পেদ্রো কারমোনাকে দেশছাড়া করেছিল সেই ধরণের আরেকটি সামাজিক অভ্যুথান মঞ্চস্থ হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ওই সময় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ মদতে ভেনেজুয়েলার সামরিক বাহিনীর একাংশের মদতে ক্যু ঘটিয়ে পেদ্রো কারমোনা ৪৭ ঘণ্টা রাষ্ট্রপতি সেজে বসেছিলেন। কিম বার্টলি ও ডোনাচা ও ব্রায়ান পরিচালিত একটি তথ্যচিত্র “The Revolution Will Not Be Televised”, ঐ সময়কার ঘটনাগুলিকে অসাধারণ নৈপুণ্যে তুলে ধরেছে। সেদিনের ঐ অবিস্মরণীয় ঘটনাপঞ্জী ভেনেজুয়েলার শ্রমিক শ্রেণিকে এতটাই ঋদ্ধ করেছে যে তাঁরা দক্ষিণপন্থীদের তালে তাল মিলিয়ে চলতে প্রস্তুত নন। গিয়াদো ও অন্যান্যদের দেশটিকে বহুজাতিক পুঁজির হাতে সমর্পণ করার কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে ঐ দেশের যেটুকু সামাজিক সুরক্ষা বলবৎ আছে তা চুরমার হয়ে যাবে, শ্রমিক ও অন্যান্য শ্রমজীবীদের ওপর শোষণের মাত্রা বহুগুণ বাড়বে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ক্ষেত্রের সম্পূর্ণ বেসরকারিকরণ ঘটবে। সাধারণ মানুষ সম্ভবত এতটা বোকা নন। তাঁরা এই বিষয়গুলি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। তাঁরা জীবনের অভিজ্ঞতায় জানেন যে ভেনেজুয়েলার বুর্জোয়ারা তাঁদের কতটা বাঁকা চোখে দেখেন অথচ তাঁদের কাঁধের ওপর ভর করেই ক্ষমতার মসনদে বসতে চান। তাঁরা বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিয়ে প্রবল অসন্তুষ্ট হলেও উগ্র দক্ষিণপন্থীদের মদত দিতে প্রস্তুত নয়। ক্যু-পন্থীরা সফল হলে ভেনেজুয়েলা আন্তর্জাতিক পুঁজির মুক্ত মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত হবে কিন্তু তা কোনওভাবেই তাঁদের পক্ষে যাবে না।
গিয়াদো এবং লিওপোলদো লোপেজরা ব্যর্থ হলেও তারা তাঁদের শ্রেণি-কর্মসূচি বদলাবেন না। ভলুন্তাদ পপুলার দলের এই মানিকজোড় যখন আরেকটি অভ্যুত্থানের সলতে পাকাবেন তখন ভেনেজুয়েলার অন্যান্য বুর্জোয়া শক্তি, ক্ষমতা দখলের জন্য সরকারি বিভিন্ন অংশের সঙ্গে সমঝোতার খেলায়ও যেতে পারেন। তাঁদের সঙ্গে বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর কিছু অংশও যদি হাত মেলায় এবং যদি সত্যিই তাঁরা এপথে সফল হন তাহলে ভেনেজুয়েলার জনগণের জন্য এক বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। বলিভারীয় বিপ্লবের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা ও চেতনার এক বিরাট আদর্শগত পরাজয় ঘটবে। বিগত তিন দশকে ভেনেজুয়েলার শ্রেণিসংগ্রাম যেটুকু অগ্রসর হতে পেরেছিল তা শুধু থমকে যাবে নয়, ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।
সঙ্কট ও সাম্রাজ্যবাদী অপচেষ্টা
ভেনেজুয়েলার খেটে খাওয়া মানুষের বর্তমান অবস্থা খুবই শোচনীয় ও অসহনীয়। বিগত মে দিবসে সরকার ন্যূনতম মজুরি হিসাবে ৪০,০০০ বলিভার ঘোষণা করেছেন। এই ন্যূনতম মজুরির ক্রয়ক্ষমতা একটি উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট বোঝা যাবে। এই মুহূর্তে কারাকাস শহরে এক ডজন ডিমের দাম ২০,০০০ বলিভার। সরকার ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি একটি চারজনের পরিবারকে বড়জোর দুই থেকে তিন দিন খাইয়ে পরিয়ে রাখতে পারে। ২০১৮ সালে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ১৩০,০৬০%। ঠিক এই অবস্থার সুযোগ নিতে চাইছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি যাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা ভেনেজুয়েলার বুর্জোয়াদের। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাদের এই অভিযানের সপক্ষে জনমত গঠন করতে সেদেশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখাছে এবং আরও দেখাবে মার্কিন ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ এবং তাঁদের তাবেদার লিমা গোষ্ঠী। এই শেষোক্ত গোষ্ঠীর সদস্যরা হল আর্জেন্তিনা, ব্রাজিল, কানাডা, চিলি, কলম্বিয়া, কোস্তা রিকা, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, পানামা, প্যারাগুয়ে এবং পেরু। মেক্সিকো এর আগে এই গোষ্ঠীর সদস্য ছিল কিন্তু গিয়াদোকে রাষ্ট্রপতি হিসাবে মান্যতা দেওয়ার প্রতিবাদে তারা বেরিয়ে আসে।
ভেনেজুয়েলার দখল আন্তর্জাতিক পুঁজির কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কারণ ঐদেশে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। সেই কারণে সামরিক আগ্রাসনের স্বপক্ষে জমি তৈরি করতে ওয়াশিংটন ও তার সহযোগীরা এক মানবিক সঙ্কটের গল্প ফাঁদছেন। এই সস্তা ফাঁদ তৈরির কারিগর হিসেবে মূলধারার গণমাধ্যম তাদের দোসর। বিষয়টিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে যেন একটি স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্র ভুখা জনগণের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছোনো আটকাতে বদ্ধপরিকার। এবং সেদেশের স্বনিযুক্ত রাষ্ট্রপতি গিয়াদো তার জনগণের জন্য স্বাধীনতা চান এবং সীমান্তে আটকে পড়া ত্রাণসামগ্রী মানুষের হাতে তুলে দিতে আন্তর্জাতিক সাহায্য ভিক্ষা করছেন।
এই ভয়ঙ্কর চিত্রকল্প মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর সংলাপে নির্মিত। মাদুরো কোনমতেই একজন স্বৈরতান্ত্রিক শাসন নন। তিনি মানুষের ভোটে নির্বাচিত এবং সেদেশে বিরোধীরা তাঁদের ইচ্ছামত সভা-সমাবেশ-বিক্ষোভ ডেকে মাদুরোর মুণ্ডপাত করতে পারেন। হ্যাঁ, একই সঙ্গে একথা স্পষ্ট যে উগো চাভেজের আমলে ওদেশের মানুষ যে ধরনের গণতান্ত্রিক অধিকার পেতেন তার পরিসর এখন অনেক ছোট হয়ে গেছে। মাদুরো যখন একটি নতুন সাংবিধানিক সভা তৈরির জন্য নির্বাচনের ডাক দেন তখনই দেখা যায় তিনি আগের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন। অর্থাৎ, একটি নতুন সাংবিধানিক সভা তৈরির জন্য নির্বাচনের আদৌ কোনও প্রয়োজন আছে কিনা সে ব্যাপারে তিনি গণভোটের আয়োজন করে জনগণের মতামত নেওয়ার কোন প্রয়োজন বোধ করেননি। সাংবিধানিক সভার জন্য প্রার্থী বহুলাংশেই মাদুরো ও তার দলের চাপিয়ে দেওয়া।
একথাও ঠিক যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকার বিরোধীদের বিক্ষোভ-সমাবেশের ওপর দমননীতি প্রয়োগ করেছে যার খবর ও ছবি-ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছে। কিন্তু সেদেশের সরকার বিরোধীরা সুরক্ষিত নয় বলে যে প্রচার চালানো হচ্ছে তা ভ্রান্ত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
সঙ্কটের মূলে
অন্যদিকে মাদুরো সরকারের বিরুদ্ধে অতিরঞ্জিত প্রচার চললেও ভেনেজুয়েলা যে ধরণের সঙ্কটের সম্মুখীন তা সবই সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা সৃষ্ট একথা ভাবা মূর্খামি হবে। অবশ্যই মার্কিন রাষ্ট্রপতির ২০১৭ সালের অবরোধের পদক্ষেপের ফলে সরকারের দেশ ও অর্থনীতি পরিচালনা করতে নাভিশ্বাস উঠেছে। তীব্রতায় কম হলেও এর আগের ওবামা প্রশাসনও ভেনেজুয়েলার ব্যাপারে বৈরী অবস্থান গ্রহণ করেছিল। তবে ভেনেজুয়েলার বর্তমান সঙ্কটের পেছনে মাদুরো সরকার এবং নতুন বলিভারিয়ান বুর্জোয়াদেরও একটি বড় অবদান আছে। এই শেষোক্ত বুর্জোয়ারা বহুলাংশেই নতুন সরকার ও রাষ্ট্রপতি মাদুরোর পিএসইউভি পার্টির উত্থানের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থ গুছিয়ে নিতে সমর্থ হয়েছে। সমস্যার শেকড় অনেক গভীরে এবং তা বেশ অনেকদিনের।
“একুশ শতকের সমাজতন্ত্র” স্লোগানের বাইরে, ভেনেজুয়েলায় কোনদিনই সত্যিকারের পুঁজিবাদ-বিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। অর্থনীতির মূল ক্ষেত্রগুলির ওপর— শিল্প, অর্থ ও পরিবেশন— মূলত স্থানীয় পুঁজিপতি শ্রেণির নিয়ন্ত্রণ বজায় ছিল ও আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, রাশিয়া, চিন ও ব্রাজিল থেকে বড় বিদেশি পুঁজির জন্য বহু ক্ষেত্রে দরজা খোলা ছিল। দেশের অর্থনীতিকে বিভিন্ন দিকে ব্যাপ্ত ও বিকশিত করার পরিবর্তে তা খনিজ তেল ও কাঁচামাল রপ্তানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল রাখা হয়। নীতিনির্ধারণে জনসাধারণের অংশগ্রহণও ছিল অপর্যাপ্ত এবং এই অবস্থায় ঢালাও স্বজনপোষণ চলার ফলে একটি পরজীবী বুর্জোয়া গোষ্ঠী আবির্ভূত হয় যা “বলি-বুর্জোয়া” নামে পরিচিত ও কুখ্যাত। মাদুরো সরকারের বিরুদ্ধে আরও কতগুলি অভিযোগের সারবত্তা আছে। এই সরকার ভেনেজুয়েলা থেকে পুঁজির নিষ্ক্রমণ আটকাতে শুধুমাত্র সম্পূর্ণ ব্যর্থ তাই নয়, সরকার ও প্রশাসনের অনেক হোমরাচোমরা এই পুঁজি পাচারের সঙ্গে যুক্ত। অর্থনীতি প্রায় সম্পূর্ণ নির্ভরশীল খনিজ পদার্থ উত্তোলন ও তা আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রির ওপর যা দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংসের পথ উন্মুক্ত করেছে। ট্রেড ইউনিয়ন ও অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মীদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে। একটি সাংবিধানিক সভার গঠন করা হয়েছে যার কার্যকারিতা মানুষের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ। উপরোক্ত পদক্ষেপগুলি বা যথেষ্ট পরিমাণে সদর্থক পদক্ষেপের অভাবই ভেনেজুয়েলার বর্তমান সঙ্কটের জন্য দায়ী।
আসলে এই সমস্যা নিয়ে ভেনেজুয়েলা সরকারের সমালোচক মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলি একটি কথাও বলবে না। এবং একই সঙ্গে, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, সরকার সমর্থক বিশ্বের বহু বামপন্থী আসল সমস্যা এড়িয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের সঙ্গে আলোচনার পূর্বশর্ত হল যে মাদুরো সরকারের কোনও সমালোচনা করা চলবে না। তাই ভেনেজুয়েলা নিয়ে চালু চর্চাগুলির একদিকে আছে “মানবিক সঙ্কট”, “স্বৈরতন্ত্র” অথবা “রাজনৈতিক বন্দি”, ইত্যাদি গল্প। অন্যদিকে মাদুরো সরকারের সমর্থকদের অস্ত্র “বিপ্লব” আর “সমাজতন্ত্র”, “অর্থনৈতিক যুদ্ধ” ও “সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ”। এই দুই আখ্যানের মাঝে এমন অনেক অদৃষ্ট ঘটনা, বিষয় ও প্রক্রিয়া আছে যার টানাপড়েনে আজকের এই জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি নির্মিত হয়েছে। ভেনেজুয়েলার বর্তমান সঙ্কটের মূলে আভ্যন্তরীণ কারণসমূহের বিশ্লেষণ ব্যতীত আজকের পরিস্থিতি বোঝা অসম্ভব। সরকারের “বন্ধু-শত্রু” শিবিরের ওপর ভিত্তি করে বিশ্লেষণ এবং তদুদ্ভূত রাজনৈতিক লাইন আর যাই হোক না কেন শ্রমিক শ্রেণির মৌলিক চাহিদা এবং অধিকার রক্ষায় কোন কাজে আসবে না। বরং এই শিবিরবাদী দৃষ্টিভঙ্গিগুলি আমাদের ঠেলে দেবে ভেনেজুলীয় সমাজের অভিজাতদের এক বা অন্যাংশের পক্ষ নিতে। সেদেশের স্বার্থান্বেষী মহল বিভিন্ন শিবির ও রাজনৈতিক দলে ছড়িয়ে আছে। এমনকি শাসক দলের ভেতরেও। সরকার ও বিরোধী দলের দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মাধ্যমে সব কিছু প্রতীয়মান নয়। সে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, সামাজিক গঠন ও বিভিন্ন অর্থনৈথিক প্রক্রিয়া কীভাবে বিকশিত হয়েছে তা মনোযোগ সহকারে দেখা দরকার। নব্য উদারবাদী জটিলতা সে দেশের সরকার ও শাসনব্যবস্থার ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে তা বোঝা একান্তই জরুরি।
সাম্রাজ্যবাদ ও তার বিরোধিতা
ভেনেজুয়েলার প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষত খনিজ তেল, তার ভূ-কৌশলগত অবস্থান; চাভেজ সরকারের প্রথমদিকে তার ওয়াশিংটন সমঝোতা নীতির সঙ্গে সংঘাত; মহাদেশীয় ঐক্য গড়ে তোলার ব্যপারে তার মুখ্য ভূমিকা; পাশাপাশি চিন, রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে ভেনেজুয়েলা বিশ্ব রাজনীতিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, কোনও কোনও বুদ্ধিজীবী ও বামপন্থী মহল এই সমস্ত জটিল কার্যকরণ সম্পর্কের ব্যাপারে নিতান্ত উদাসীন এবং শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধারাবাহিক হস্তক্ষেপের বিষয়টি নিয়েই সোচ্চর। তাঁদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা শুধুমাত্র মার্কিনিদের ক্ষেত্রেই সীমিত। এ কথা অনস্বীকার্য যে বলিভারীয় বিপ্লবের সূচনাকাল থেকেই ভেনেজুয়েলাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ঘটে চলেছে। ২০১৩ সালে উগো চাভেজের জীবনাবসান এবং সমসাময়িক কালে লাতিন আমেরিকার প্রগতিশীল যুগের অবসান ও দক্ষিণপন্থার উত্থানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এর তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ২০১৫ সালের মার্চে বারাক ওবামা স্বাক্ষরিত এক্সেকিউটিভ আদেশে বলা হয় যে ভেনেজুয়েলা “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা এবং বিদেশনীতির জন্য অসীম বিপজ্জনক”। আমরা জানি যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি কোন রাষ্ট্র সম্বন্ধে এই ধরণের মন্তব্য করলে তার পরিণাম কী হতে পারে। রক্ষণশীল শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া দক্ষিণপন্থী বুদ্ধিজীবী ও গণমাধ্যমগুলি ভেনেজুয়েলার মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু তাঁরা একবারের জন্যও কলম্বিয়া বা মেক্সিকোয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কোনও আঞ্চলিক উদ্যোগের কথা মুখেও আনেন না।
কিন্তু আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে যা বাদ দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কিত আলোচনা সম্পূর্ণ হয় না। আমরা যদি হস্তক্ষেপের কথা বলি, তাহলে কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলে থামলে চলবে না। ভেনেজুয়েলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতিসমূহে ক্রমবর্ধমান চৈনিক হস্তক্ষেপও সেদেশের সার্বভৌমত্বের ওপর থাবা বসিয়েছে, তাঁকে এশিয়ার এই উদীয়মান সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ওপর নির্ভরশীল করেছে এবং নয়া-উদারীকরণ প্রক্রিয়ায় বাড়তি গতি এনেছে। বামেদের এক বড় অংশ এ ব্যাপারগুলি দেখেও না দেখার ভান করছেন। তাঁরা মনে করেন মার্কিনিরা ছাড়া আর কেউ হস্তক্ষেপ করতেই পারে না। বস্তুত ভেনেজুয়েলা সহ তামাম তৃতীয় বিশ্বে এই উভয় শক্তিই বহুজাতিক পুঁজির স্বার্থরক্ষা করছে, বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর থাবা বসাচ্ছে যার সঙ্গে ভেনেজুয়েলার সাধারণ মানুষের স্বার্থের কোনও সম্পর্ক নেই।
বর্তমান পরিস্থিতি ও কিছু প্রশ্ন
ভেনেজুয়েলার সামগ্রিক পরিস্থিতি অত্যন্ত ক্ষতবিক্ষত, গভীর দূর্নীতিতে নিমজ্জিত ও বিশৃঙ্খলায় আবর্ত। আইনি, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি নড়বড় করছে। বিশ্ববাজারে তেলের দামের ওঠানামা, তেল বিক্রির ক্ষেত্রে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, ইত্যাদির কারণে খনিজ তেলভিত্তিক ‘রঁতিয়ে’ বা উপস্বত্বজীবী অর্থনীতি এক ঐতিহাসিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলছে। খবরে প্রকাশ যে গত মে মাসে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি ১৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত, সামাজিক অবক্ষয় (যা ২০১৩ সালের পর ত্বরান্বিত হয়), রাজনৈতিক বিবাদ ও হিংসা, ইত্যাদি। ফলত বহু সামাজিক লেনদেন বা মীমাংসা আর প্রতিষ্ঠানিক কায়দায় হচ্ছে না। গোপনে ও বেআইনি পথে হচ্ছে। সংগঠিত অর্থনীতি ভেঙে পড়ার ফলে অসংগঠিত ক্ষেত্রই এই মুহূর্তে অর্থনীতির চলিকাশক্তি। খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য পণ্য যেমন ওষুধপত্র, পেট্রোল, ইত্যাদির কালোবাজারি রমরমিয়ে চলছে। এই মুহুর্তে সমান্তরাল বাজারই হল উচ্চহারে মুনাফা অর্জন বা সামাজিক প্রতিপত্তি হাসিলের চাবিকাঠি।
রাজনৈতিক ও আইনি ব্যবস্থা নড়বড়ে হওয়ার ফলে শাসক বা বিরোধীরা বহু ক্ষেত্রেই দ্বন্দ্ব নিরসনের পথ হিসাবে এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে একে অপরকে দেখে নেওয়ার জন্য বেআইনি পন্থা অবলম্বন করছেন। রেষারেষি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে মনে হচ্ছে তাঁরা অন্যকে শেষ করার জন্য যে কোনও উপায় অবলম্বন করতে পারেন। সরকার বিরোধীদের বেশিরভাগ অংশকেই “শত্রু শিবির” হিসাবে চিহ্নিত করে এদের মোকাবিলায় একগুচ্ছ কালা কানুন সহ জরুরি পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে বিরোধীরা সরকারের মোকাবিলার নামে বিভিন্ন হিংসাত্মক ঘটনা, যেমন ভাঙচুর, মারামারি এবং অন্যান্য নৈরাজ্যমূলক গণ্ডগোলের মাধ্যমে গোটা সামাজিক পরিস্থিতি বিষিয়ে তুলেছে। এমন অবস্থায় আইনের শাসন শিকেয় ওঠার ফলে সাধারণ জনগণের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। আইন ও বিচারব্যবস্থার হাত এতটাই দুর্বল যে অনেক সময় বড় ধরনের অপরাধ ঘটিয়েও লোকজন সহজে ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। এই দণ্ডমুক্ততা সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ার ফলে একদিকে অপরাধমূলক কাজকর্মের প্রভূত বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। সেদেশের সাধারণ মানুষ আজ আইনি বিচারের ওপর আস্থা হারানোর ফলে আরও বেশি বেশি করে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন। স্বাভাবিক অবস্থা টলমলে হওয়ার কারণে সমাজে ব্যক্তিস্বার্থের সংঘাত তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
তেল অর্থনীতির সীমাবদ্ধতা
আন্তর্জাতিক বাজরে তেলের মূল্য হ্রাস পাওয়ার কারণে ভেনেজুয়েলার সঙ্কট ত্বরান্বিত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু বর্তমান সময়ের শুধুমাত্র তেলের দামের ওঠানামার মাধ্যমে এই সঙ্কট ব্যখ্যা করা মুশকিল। ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মূলত খনিজ তেলভিত্তিক পুঁজির পুঞ্জীভবন এবং সেই মুনাফার একটি অংশ সামাজিক প্রকল্পে বিতরণের মাধ্যমে টিকে আছে। কিন্তু আটের দশক থেকেই এই মডেলের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা নজরে আসতে শুরু করে। সমসাময়িক কালের (২০১৩ থেকে আজ অবধি) জাতীয় অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলা গত ৩০ বছরের বিভিন্ন প্রবণতার ফসল। পাঠকের অবশ্যই এই বিষয়ে ব্যখ্যা চাওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আছে।
বিভিন্ন কারণগুলির অন্যতম হল সেদেশের জমির নীচে পাওয়া খনিজ তেল তুলনামূলকভাবে ভারী বা অতিরিক্ত ভারী। এর পরিশোধন শুধুমাত্র অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি ব্যয়বহুল নয়, একে ব্যবহার্য করে তুলতে হরেক রকমের প্রক্রিয়াকরণের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। বিশ্ববাজারে তেলের দামের সূচক যে কোনও নির্দিষ্ট সময়ে একটাই হয়। কিন্তু বাস্তবে এর কেনাবচার দাম নির্ধারিত হয় এর গ্রেড অনুযায়ী এবং পরিবহন খরচের ওপর। বিগত দুই-তিন দশক ধরেই তেলের দাম অর্থনীতির চাহিদা-যোগানের ওপর নির্ভরশীল নয়। বরং এই দামের নিয়ন্ত্রণ বড় বড় ফাটকাবাজদের হাতে। তেল নিয়ে হাজার হাজার কোটি কোটি ডলার-পাউন্ড-ইউরোর ফাটকা লেনদেন চলছে যার পুরোধা তাবড় তাবড় অর্থনৈতিক সংস্থাগুলি। যাই হোক বিশ্ববাজারে তেলের দামের রাজনীতি নিয়ে আলোচনার সুযোগ এই লেখায় অত্যন্ত সীমিত। খনিজ তেল প্রক্রিয়াকরণের বাড়তি খরচের ফলে ভেনেজুয়েলার তেল থেকে পাওয়া মুনাফার ওপর ক্রমাগত টান পড়ছে। এমন মুনাফা হ্রাসের ফলে রাজস্বে টান পড়ছে ঠিক এমনই এক সময়ে যখন ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে আরও বেশি করে সামাজিক বিনিয়োগের প্রয়োজন।
ভেনেজুয়েলার জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ শহরকেন্দ্রিক। বহু বছর ধরেই খনিজ তেলভিত্তিক সামাজিক-অর্থনৈতিক বন্দোবস্ত ওদেশে চাষবাসে ইতি ঘটিয়েছে। ফলত খাদ্যদ্রব্য আমদানির ওপরেই তাঁরা সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। তেল রপ্তানি করে পাওয়া মুনফার বেশিরভাগ খরচা হয় খাদ্যদ্রব্য আমদানি করতে। ফলত অন্যান্য ক্ষেত্রে নিবেশ করার মতো পুঁজি বিশেষ অবশিষ্ট থাকে না। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম যখন ওপরে ছিল, খনিজ তেল থেকে উৎপন্ন বাড়তি মুনাফা অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে খনিজ তেল ভিত্তিক এই উত্তোলন (extractive) শিল্পটিকেই আরও শক্তিশালী করে গোটা সমাজকে এর মুখাপেক্ষী করেছে। একই সঙ্গে অন্যান্য উৎপাদনশীল ক্ষেত্রগুলির প্রতি চরম অবহেলা ও উদাসীনতার কারণে সেগুলি দুর্বলতর হয়েছে। খনিজ তেলের বাজার দ্রুত পড়ে যাওয়ার ফলে— যেমন সাতের দশকে এবং ২০১৪ থেকে অদ্যবধি— অর্থনীতি আরও বেশি তেলের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে এবং নতুন নতুন সঙ্কটে আবর্তিত হয়েছে। ঠিক এই সময় সামাজিক-রাজনৈতিক দুর্নীতির ফলে মুনাফা বহুভাবে ও বহু পথে বেআইনিভাবে কুক্ষিগত হচ্ছে। এর ফলে সঙ্কট নিরসনে সম্পদ বিতরণের যে ধরনের সুসঙ্গত নীতির প্রয়োজন তা প্রবলভাবে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। অপরিশোধিত তেলের আন্তর্জাতিক মূল্যের ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতার পাশাপাশি তেল-কেন্দ্রিক বিশ্বব্যাপী শক্তির ভারসাম্যের পরিবর্তন (যেমন ওপেকের ক্রমবর্ধমান অপ্রাসঙ্গিকতা) জাতীয় অর্থনীতির উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। একদিকে এই সব অর্থনৈতিক ঝড়ঝঞ্জা ভেনেজুয়েলায় বিস্তর প্রভাব ফেলেছে। অন্যদিকে এই উত্তোলন শিল্পের বাড়বাড়ন্তের কারণে সেদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপরেও বিপর্যয় নেমে আসছে যা বর্তমান ও ভবিষ্যতে লক্ষ লক্ষ ভেনেজুয়েলীয়র জীবিকা বিপন্ন করে তুলবে। সমস্যা হল যে এই সঙ্কট নিরসনে সরকার আরও বেশি বেশি বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে। উত্তোলন শিল্পের আরও প্রসারণ ঘটিয়েছে। আন্তর্জাতিক পুঁজির জন্য দরজা হাট করে খুলে দিয়ে তার অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করেছে। মোটের ওপর আগামী দিনগুলিতে অভিজাতদের যে অংশই ক্ষমতায় আসুক না কেন প্রান্তসীমায় পৌঁছে যাওয়া তেলভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার এই নিঃস্বতার সঙ্গে তাঁদের প্রত্যেককেই মুখোমুখি হতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ার আশায় ভাগ্যের ভরসায় বসে না থেকে সুষম অর্থনৈতিক পরিকল্পনার পথে না হাঁটলে সঙ্কট আরও ঘনীভূত হয়ে মহামারির সম্ভাবনাও ডেকে আনতে পারে।
ভেনেজুয়েলা কি সমাজতন্ত্রের পথে হাঁটছে?
ভেনেজুয়েলা আসলে ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উদারীকরণের পথে হেঁটে চলেছে। অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রের ক্রমাগত নয়া-উদারবাদী সংস্কারের ফলে পুঁজির ওপর আগের সমস্ত প্রবিধান ও বিধিনিষেধ লোপ পাচ্ছে। এমনকি বলিভারীয় বিপ্লবের ফলে অর্জিত মানুষের সাধারাণ অধিকারসমূহের নিয়মিত সঙ্কোচনের ফলে পূর্ববর্তী সামাজিক অগ্রগতির চাকা উলটোদিকে ঘুরতে শুরু করেছে। এই পদক্ষেপগুলিকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, সমাজতন্ত্র ও বিপ্লবের মোড়কে নামে চালানোর চেষ্টা হলেও জনগণ উত্তরোত্তর তার বিরোধিতায় রাস্তায় নামছেন। এই পদক্ষেপগুলির মধ্যে রয়েছে অনেকটা আমাদের এখানকার নন্দীগ্রামের ধাঁচে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল সৃষ্টি। অবশ্য মাদুরো সরকারকে এর হোতা বলা ঠিক হবে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডারের পরামর্শে ৯০-এর দশকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রাফায়েল কালদেরা “অ্যাজেন্ডা ভেনেজুয়েলা” নামে যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তারই অঙ্গ। বর্তমান সঙ্কট নিরসনে উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে মাদুরো ও তার দলবল এই পুরনো প্রেসক্রিপশন মিলিয়ে দাওয়াই কিনছেন। অন্যান্য উদারীকরণ প্রক্রিয়ার কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসবে ওরনিকো উপত্যকায় খনিজ তেল উত্তোলনে বিদেশি সংস্থাগুলির ছাড়ের পরিমাণ বাড়ানো। বহু আবশ্যিক পণ্যের দামের বিনিয়ন্ত্রণ। আরও বেশি বেশি সভরেন বন্ড বাজারে ছাড়া। মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও একটি ভাসমান বিনিময় হার প্রবর্তন। সরাসরি ডলারের মাধ্যমে কিছু কিছু বাণিজ্যিক লেনদেন, উদাহরণস্বরূপ, পর্যটন খাতে। বিশ্বস্ততার সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ পরিষেবা যার এক বড় অংশ অবৈধ। এর ফলে আমদানিতে ঘাটতি পড়ছে এবং মৌলিক ভোগ্যপণ্যের বাজারে অমিল হচ্ছে।
ওরনিকো উপত্যকায় খনিজ তেল উত্তোলনের জন্য ১,১১,৮০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে এক সুবৃহৎ প্রকল্প গড়ার পরিকল্পনা রচিত হচ্ছে যার ফলে আদিবাসী অধ্যুষিত ঐ অঞ্চলে শুধুমাত্র নির্বিচারে উচ্ছেদ হবে তাই নয়, প্রকল্প ক্ষেত্রের বাইরেও বহু এলাকা জুড়ে বহু মানুষ জীবন-জীবিকা হারাবেন। এছাড়াও এই প্রকল্প যে দীর্ঘমেয়াদিরূপে অর্থনীতিকে খনিজ তেলের ওপর নির্ভরশীল করে তুলবে তা বলাই বাহুল্য।
অবশ্য একই সঙ্গে একথাও উল্লেখ করা উচিত যে এই সংস্কার প্রক্রিয়ার মাঝেই কিছু কিছু সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প এখনও টিকিয়ে রাখা হয়েছে। মজুরি নামমাত্র বাড়ানো হলেও তা নিয়মিত বৃদ্ধি পাচ্ছে যদিও মূল্যবৃদ্ধির অনুপাতে তা সিন্ধুতে বিন্দুর সমান। একদিকে গণসংগঠনগুলির কিছু কিছু দাবি মেনে নেওয়া আর অন্যদিকে বিপ্লবী এবং সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী বুলি ব্যবহার করে তাঁদের নিয়ন্ত্রণে রাখা। অবশ্য এই সব পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য হল নির্বাচনী সমর্থন অক্ষুণ্ণ রাখা এবং জনগণের প্রলেতারীয় অংশকে যাতে বিরোধীরা ব্যবহার করতে না পারে তা সুনিশ্চিত করা।
ভেনেজুয়েলা সংহতি কোন পথে
রাজায় রাজায় এই সব যুদ্ধে— তার তীব্রতা যত কমই হোক না কেন— সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের ওপর সঙ্কটের ঝাপটা সবচেয়ে বেশি আছড়ে পড়ে। বলিভারীয় বিপ্লবের প্রথম দিকে প্রতিষ্ঠিত শক্তিশালী সামাজিক-রাজনৈতিক সংহতি কেবলমাত্র ক্ষয়প্রাপ্ত হয়নি, ক্রমাগত অবলুপ্তির পথে। সাধারণ মানুষ তাঁদের দৈন্যন্দিন জীবনের ওঠাপড়া নিয়ে এতটাই ব্যতিব্যস্ত এবং বহুবিধ পশ্চাদমুখী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার জোয়ার-ভাটা তাঁদের এমন ধরনের অনিশ্চয়তার কূলে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে যা চলমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সমষ্টিগত প্রতিরোধ গড়ে তোলার মাঝে শুধুমাত্র অন্তরায় নয়, প্রতিকুল বটে। যদিও দেশজুড়ে বহু সামাজিক আন্দোলন ও বিভিন্ন তৃণমূল সংগঠন বিকল্প সামাজিক আন্দোলন তৈরির চেষ্টা ছাড়তে নারাজ। সময় বলবে এ লক্ষ্যে তাঁরা কতটা অগ্রসর ও সফল হতে পারবেন। ভেনেজুয়েলাকে কেন্দ্র করে যদি কোনও আন্তর্জাতিক সংহতি গড়ে তুলতে হয় তাহলে এটি অবশ্যই এই সংগ্রামরত মানুষের স্বার্থে হওয়া উচিত যারা ঐতিহাসিকভাবে শোষণ ও সঙ্কটের বোঝা বহন করে চলেছেন। যারা নিয়মিত রাস্তায় নেমেছেন ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের দাবিগুলি নিয়ে। বর্তমান সময়ের পশ্চাদগামী ও প্রতিক্রিয়াশীল জটিল দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হয়েও যারা লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে যাচ্ছেন না বামপন্থী হিসাবে তাঁরাই সকল সম্মানের যোগ্য। দলাদলির পাল্লায় পড়ে “প্রগতিশীল সরকার” টিকিয়ে রাখার ঠেকা নিয়ে এই মানুষগুলির থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলে শুধুমাত্র এক বিশাল বড় ভুল হবে না বড়সড় খেসারত দিতে হতে হবে। দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিপ্রতীপে অন্য কোন হেজেমনি গড়ে তুলতে গেলে সেদেশের সামাজিক আন্দোলন, কতিপয় বামপন্থী শক্তি এবং লড়াইয়ের ময়দানে থাকা মানুষগুলির প্রতি সমর্থন, সহমর্মিতা ও সংহতি গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন।