Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

গৃহিণীর প্রসাধন এবং আরও দুইটি অণুগল্প

যশোধরা রায়চৌধুরী

 

গৃহিণীর প্রসাধন

গৃহিণী প্রসাধনে বসিয়াছেন।

দর্পণের সম্মুখে বসিয়া দীর্ঘ কালো কেশের ভিতর চিরুণী চালাইতেছেন। অঙ্গে গামছা ও সায়া…  ব্লাউজটি ইস্তিরি করা পার্শ্বে স্থিত, কাঁচুলি পরিহিত হইয়াছে। শাটী রক্ষিত রইয়াছে। সর্বশেষে পরিধেয়।

এ এক চিরন্তন চিত্র। এ এক বিরক্তিকর চিত্র। দীর্ঘসূত্রিতায় এই দৃশ্যের সহিত পাল্লা দিতে পারে সামান্যই এ পৃথিবীতে। হয়ত বালকের অঙ্ক কষিবার গতি, অধমর্ণের উত্তমর্ণকে ধারকর্জ করা ধন ফিরাইবার গতি, বা সাহেবের আপিশের দেওয়াল ঘড়ির গতি… সেইরূপ এই কার্যটি বড়ই শ্লথতাসম্পন্ন, ধীর, ধৈর্যের পরীক্ষাবৎ হইয়া থাকে।

আত্মীয়সকাশে যাইবেন কর্তা, সগৃহিণী ও সকাচ্চাবাচ্চা। সকলের তৈয়ারি হইয়া গিয়াছে কিন্তু গৃহিণীর প্রসাধন এখনও হয় নাই। সারা সকাল কাটিয়া গিয়াছে। এখন বেলা গড়াইতে চলে।

তৈয়ারি হইয়া কর্তা ক্রমাগত ঘড়ির দিকে তাকাইতেছেন, ছড়ি দুলাইয়া এবং স্কন্ধের শুভ্র চাদরখান একবার পাক খুলিয়া আর একবার পাকাইয়া তুলিয়া মনের অস্থিরতা ও অধীরতা প্রকটিত করিতেছেন।

বাচ্চাকাচ্চাগুলি সংখ্যায় অল্প নহে। দ্বিবর্ষীয় বালক হইতে নবমবর্ষীয় জ্যেষ্ঠপুত্র। যাহাকে বলে কাঁখের কোলের মিলাইয়া চারিটি শিশু। সকলেই প্রস্তুত, সকলেই ঘোড়াগাড়ি চাপিয়া আত্মীয়সকাশে যাইতে উৎসুক। উহাদের পাউডার বিনিন্দিত মুখচ্ছবিগুলি ঘর্মাক্ত হইয়া পড়িতেছে। কেহই স্থির বসিতে অভ্যস্ত নহে।

ফিটফাট দর্শন লাল জামা লাল জুতুয়া পরা নবম বর্ষীয় বালক পুত্রটি কাদায় পা ঠুকিয়া ইতোমধ্যেই জুতাটি ময়লা করিয়া ফেলিয়াছে। ষষ্ঠবর্ষীয়া যমজ মেনি আর খেঁদি পরস্পরের চুল টানাটানি করিয়া, তাহাদের দুইটি বেগুনি ও গোলাপি রিবন বাঁধা বিনুনির দফারফা করিতেছে। অতিক্ষুদ্র দীপু তাহার মায়ের কোল ঘেঁষিয়া থাকিতে চাহিতেছে আর ক্রমাগত মায়ের তাড়না খাইয়া ঘরের বাহির হইতেছে।

এইরূপ, ঘড়িতে অর্ধঘটিকা অতিক্রান্ত হইলে বাবু হুঙ্কার ছাড়িলেন, কই তোমার হল? এ ত দেখছি বেলা পেরিয়ে যায় তোমার সাজগোজের ঠেলায়।

গৃহিণী বলিলেন এই হয়ে এসেচে। দর্পণে মুখ দেখিয়া চক্ষে তখন তিনি কাজল লেপন করিতেছিলেন। এমন সময়ে চোখে যেন কী পড়িল।

বাবু আরও পাঁচ মিনিট ছটফট করিয়া বলিলেন, এইবার ত গাড়ি ডাকা দরকার। বাবুর ভৃত্যটি ছটফটাইয়া গাড়ি ডাকিতে গেল। আরও কয় মিনিট অতিক্রান্ত হইল।

গাড়ি জোতা হইয়া গেল… দরোজায় ঘোড়াগাড়ির সহিস কোচোয়ান বচসা করিতে লাগিল। পথ আটকাইয়া গাড়ি দাঁড়াইয়া আছে তাই প্রতিবেশী রাগ করিতে লাগিল। সকলকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া গৃহিণী তখন শাড়িটির শেষ পাক গায়ে জড়াইয়া তাহার উপরে এক রেশমের চাদর জড়াইয়া বাহির হইলেন।

হইয়াই, চীল চীৎকার দিলেন। একিইইইইইই! বাবুয়া, তোর লাল জুতুয়ার একী দশা! মেনি খেঁদি, এই চুল নিয়ে তোরা লোকের বাড়ি যাবি?

চপেটাঘাত, শিশুর কান্না, সর্বমোট ফল, কর্তার ধৈর্যচ্যুতি ও গাড়ি ছাড়িয়া দিবার হুমকি। আত্মীয়সন্দর্শন নাই বা হইল কিন্তু এই সংসারের জ্বালায় চুলা গুঁজিয়া, থুড়ি চুলায় সংসার গুঁজিয়া গৃহত্যাগ করিতে অদ্যই কর্তব্য জ্ঞান করিতেছিলেন কর্তা।

এক পাল অ্যান্ডাগন্ডা পয়দা করিবার ও সংসার করিবার জন্য কপালে করাঘাত করিয়া ক্রন্দন করিবার মত মেয়েপনা ত আর করিতে পারেন না তাই হুঙ্কার ছাড়িলেন। পুরুষোচিত মন্যু প্রকাশ করিলেন গৃহিণীকে সরোষ তাড়নায়। কহিলেন এমন কোথাও কেউ দেখেছে? একটা শাড়ি ত বাপু পরবে? পরতে হত আমাদের মত চোগা চাপকান, বুঝতে!

ইতোমধ্যে বাচ্চাকাচ্চারা লাইন দিয়া গাড়িতে চড়িয়া বসিয়াছিল এই রক্ষা। সংসার চুলায় গুঁজিতে হয়, তো পতিদেবতা কেন, তিনিই গুঁজিবেন না হয়, বিড়বিড় করিয়া বলিতে বলিতে গৃহিণী চলিলেন গাড়ির দিকে, সজোরে কিছু বলিলেই ব্রহ্মাণ্ড তছনছ হইবে। বাড়ির চারি দেওয়াল হইতে বাহির হইবার এমন একটা মওকা হাতছাড়া হইবে। তাই কথা না বাড়াইয়া গৃহিণী চাকরানিকে হারাইয়া যাওয়া কানের প্যাঁচটা খুঁজিয়া রাখিবার হুকুম দিয়া দ্রুত গৃহ হইতে অপসৃত হইলেন।

গাড়ি মৃদুবেগে চলিতে শুরু করিল। পাড়ার ক্রুদ্ধ কুকুরগুলা চীৎকার করিয়া জানান দিল তাহাদের মহল্লায় ঘোড়াগাড়ি তাহারা কোনমতে স্বীকার করিবে না। আকাশে সূর্য সবেগে উত্থান করতঃ জানান দিলেন, মেঘ ঝঞ্ঝা নামক দুর্গ্রহ অদ্য রবিবার তাঁহার মোটে পছন্দ নয়।

ক্রোধের দিন ক্রোধের দ্বিপ্রহর ক্রমশ শান্ত হইয়া আসিতেছিল। বাবু বাহির পানে চাহিয়া সংসারকে মায়াজ্ঞান করিয়া গোটানো সংবাদপত্রটি ভেতর পকেট হইতে বাহির করিলেন। ক্রমওয়েল সায়েবের বক্তৃতার ওজস্বিতা কল্পনা করিতে ব্যস্ত হইলেন। শিশুরা পরস্পরকে খোঁচাইয়া আমোদ পাইল। কর্তা গলা খাঁকরাইয়া বলিলেন, বাচ্চাগুলোকে সামলাও না একটু। উফ, একটু কাগজটাও পড়তে দেয় না।

কুপিত গ্রহের মত সকালটা দূরীভূত হইয়াছে। গৃহিণী হাঁপ ছাড়িলেন। একবার স্বপ্নের ন্যায়, দুঃস্বপ্নের ন্যায় ভাসিয়া গেল সারা সকাল গৃহিণীর যা যা করিয়া কাটিয়াছিল তাহার স্মৃতি।

সকালের উনুন ধরাইবার ব্রাহ্মমুহূর্তে কয়লা ফুরাইয়াছে টের পাইয়া কপালে করাঘাত করিয়া কিছু কাঠকুটা, পুরানো টুলের ভাঙা পাওয়া ও গন্ডাদুই কিলো খবরের কাগজ পোড়াইয়া প্রাতরাশে গন্ডা কয় লুচি ও আলুর তরকারি বানাইয়া কর্তাকে খাওয়াইয়া, দুধ জ্বাল দিয়া শিশুদের মুখে তাহা ঠুশিয়া, কর্তার চা ও পান দিয়া, বিছানার উপর কর্তার পেন্টুলুন চাপকান অন্তর্বাস রুমাল মোজা জুতা (পালিশ করিয়া) এবং ছড়ি সাজাইয়া, স্নানঘরে গরম জল দিয়া, সবকটি বাচ্চাকে স্নান করাইয়া চুল আঁচড়াইয়া জামা পরাইয়া তৈয়ারি করাইয়া তিনি অবশেষে সাজিতে গিয়াছিলেন। মধ্য হইতে কানের ফুলের প্যাঁচ কোথায় যেন পরিয়া যাওয়াতে খুঁজিতে বিলম্ব আর দীপু আসিয়া পাউডারের কৌটা উলটাইয়া দিতে কিঞ্চিত বেগ পাইয়াছিলেন।

সবই এ ক্ষেত্রে উহ্য, উহার মধ্যে কহিবার মত কী আর আছে।

আপাতত জানালার ধারে বসিয়া গৃহিণী স্বামীর গজগজানি এক কান দিয়া শুনিয়া অন্য কান হইতে বাহির করিয়া দিতেছিলেন। আহা আজ কী সুন্দর রৌদ্র, কত সুন্দর বাতাস দিতেছে। আজিকার মত রান্নাঘরের পালা চুকিয়াছে। এই কী কম মুক্তি!


জয় শিব শম্ভু

বাবু বাগাড়ম্বর সেন ইদানীং বাটীর সম্মুখে পায়চারি করিতেছিলেন। জুড়িগাড়ি দেরি করিতেছে বলিয়া কল্পচক্ষে কোচোয়ান ও যে চাকরটা গাড়ি ডাকিতে গিয়াছে তাহাদের উত্তমমধ্যম দিতেছিলেন।

ইস্টুপিড, গর্দভ, কুত্তা বলিয়া সম্বোধন করিতে করিতে অধুনা বাবু সেনের মুখের আগল নাই। তিনি উহাদের মনুষ্য জ্ঞান করেন না, ইহা অবশ্য দুর্জনেও বলিবে না। এক পাড়ার কুকুরগুলি বলিতে পারে বটে।

আসলে চাকর বাড়িতে চাকরের মত থাকিবে, স্ত্রী বাড়িতে স্ত্রীর ন্যায় আচরণ করিবে, মনু ত তাহাই বলিয়াছিলেন। চোর বা ভিখারি অনাহুতভাবে আসিলে দারোয়ান বুরবক সিং খেদাইয়া দিবে, কোচোয়ান প্রয়োজন হইলে মিসির আলি নিমেষের মধ্যে গাড়ি জুতিয়া হাজির হইবে, তামাকু সেবনের ইচ্ছা হইলে ভৃত্য রামশরণ মুখের সামনে হুঁকা হাজির করিবে, ক্ষুধা পাইলে গরম গরম লুচি আসিবে পত্নী ও দাসীর মধ্যস্থতায়। ইহাই সেনবাবুর ওয়ার্ল্ড অর্ডার।

এই অর্ডারের ব্যত্যয় হইলেই মাথা গরম। সদ্য পড়া কোঁত-এর হিউমানিজম হজম হইবে না। সকল বিস্বাদ, বিরস। এমনিতেই কলিকাতায় আজিকালি বাতাস বহে না, মেঘ করিলেও বৃষ্টি হয় না।

পশ্চিমে যাইলে কেমন হয়? কিন্তু সে অনেক দেরি। শারদীয়া ছুটির পর যাইবেন। পোঁটলা বাঁধিয়া বিশ্বজয়ে বাহিরিবার আকাঙ্ক্ষা সেনবাবুর মনে।

আজ ফেসবুকে ভাল দেখিয়া একটা পোস্ট লিখিতে হইবে। Friends and Companions of England.  সংক্ষেপে ফেস। তাঁহাদের বুক। বৃটিশ গভরমেন্টের প্রতি দায়বদ্ধ অথচ স্বাধীন, মানবদরদী ইংরাজবন্ধু, মোস্ট ওবিডিয়েন্ট সার্ভেন্ট যাঁহারা তাঁহারাই এই ফেসবুকে আছেন। সকলেই তক্তা তক্তা লেখেন।

কিন্তু ইদানীং ব্যাটা বেম্মোগুলার বড় বাড় বাড়িয়াছে, ধরাকে সরাজ্ঞান করে। বলে কিনা হিন্দু ধর্ম ব্রাহ্মণ্যধর্মের এই খুঁত সেই খুঁত। ইহাদের কাজ নাই। রামমোহন ত ব্রিটিশের পা চাটা ছিলই, বাকিরাও বেদ উপনিষদের উচ্ছিষ্ট খাইয়াছে। বাগাড়ম্বর সেনের ইহাতে আপত্তি নাই। মডার্ন বেঙ্গল বলিয়া ফেসবুকে যে গ্রুপটি আছে তাহাতে তিনিও বড়বড় বাতেলা ঝাড়েন। কিন্তু আপত্তি এক জায়গায়, নিচু জাতকে বেম্মোগণ উচ্চাসনে বসাইতেছে।

সেনবাবুর চাকর রাধামাধব গলায় কন্ঠি দিয়া ঘোরে। নিচু জাত আগে বৈষ্ণব ছিল। এখন বেম্মোদের কাছাকাছি ঘেঁষিতেছে। ইহার পর চেয়ারে বসিবে, ডিনার খাইবে কাঁটাচামচ দিয়া। আর কত দেখিতে হইবে। বাগাড়ম্বর সেনের পিতাঠাকুর দেশের বাড়িতে আম জাম কাঁঠালের গাছের তলায় খাটিয়া পাতিয়া শুদ্ধ বস্ত্রে বসিয়া সমাজের সকল অবিচারের বিরুদ্ধে নিদান দেন, পল্লীর সকলে তাঁহাকে মানে, অসতী ও কুলটাদের ঘাড় ধরিয়া তাড়ানো বা কাশীবাসী করানোর বিখ্যাত সব ঘটনা পিতাঠাকুরের আছে। বাগাড়ম্বর কালেজে পড়িয়া সামান্য ব্যবহারজীবী হইয়া কিছুদিন ডালে ডালে পাতায় পাতায় ছিল, তখন ইয়ং বেঙ্গলের ভূত মাথায় চড়িয়াছিল, বিধবা বিবাহ করিবার স্বপ্ন দেখিত।

শেষে পিতামাতার চক্ষু রাঙানি, মাতার অসুস্থতার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলিং, অথবা ইয়ার বান্ধবদের মুখে, নিজ স্বধর্মে স্থিত থাকার সনির্বন্ধ উপরোধ ফেলিতে তাও সে পারিল কই। শেষাবধি শোভাবাজারের বড় পরিবারের মেয়েকে বিবাহ করিয়াছে, দু থলি স্বর্ণমুদ্রা আর প্রচুর স্বর্ণালংকার সহ। এখন তাহার ট্যাঁ ফুঁ বেশি নাই। শুধু ওই ফেসবুকেই যা লম্ফঝম্প।

আজ যাইবেন একটি সভায়। বাবু শতহস্ত চাটুজ্জের বাটিকায় সভা বসিবে। বিষয়, কী করিয়া সমস্ত জাতির স্ব স্ব স্থান বজায় রাখিয়া তাহাদের একসূত্রে বাঁধা যায়। মোস্ট ওবিডিয়েন্ট সার্ভেন্ট তৈয়ারি করিতে হইলে, ইংরাজ প্রণীত ডেমোক্রাসির আইডিয়ার সহিত আমাদের চির পুরাতন চতুর্বর্ণকে মিলাইতে হইবে। কীভাবে তাহা সম্ভব হইতে পারে, ভাবিতে হইবে।

শেষ পর্যন্ত আসিল গাড়ি। এক প্রস্থ চীৎকার বকাবকি করিলেন বাগাড়ম্বর। ভর্ৎসনা শুনিতে ইহারা অভ্যস্ত তাই এক কান দিয়া শুনিয়া অন্য কানে বাহির করিয়া দিল মনে হইতেছে যেন। বাগারম্বর রাত্রিকালে ফেসবুকে যাহা যাহা লিখিবেন মনে মনে ভাবিতে ভাবিতে গেলেন। চোখা বাক্যবাণে বিধ্বস্ত করিয়া দিতে হইবে ওই কেশববাবুর চেলাদিগকে।

শতহস্তের গৃহে আগমন করিয়া সভায় উপনীত হইলেন। সকলেই ফেসবুকের সদস্য। পান তামুক সহযোগে দিব্য কাটিল সময়, শতহস্ত এক অসামান্য দক্ষ চিন্তাবিদ। বলিলেন, আজ হইতে তাঁহাদের নতুন স্লোগান চালু হইবে। একে অপরকে দেখা হইলেই বলিবেন, জয় শিব শম্ভু!

শিব হইলেন ত্রি জগতের ধ্বংসকর্তা। সাক্ষাৎ বৃটিশ সরকারের প্রতিভূ। শিব যেরূপে সৃষ্টিকে প্রথমে ধ্বংস করিলে তবেই নব সৃষ্টি, সেইরূপ বৃটিশ সকল ধ্বংস করিয়া দিতেছে, যাহাতে নব ভারত উত্থিত হইতে পারে। আইনকানুন নতুন করিয়া ঢালিয়া সাজাইতেছে কে? ইংরাজ! দেশটাকে নব আত্মপরিচয়ে বাঁধিল কে? ইংরাজ।

ইংরাজি শিক্ষিত বাবুদিগকে নব উদ্যমে সমাজকে গড়িয়া তুলিতে হইবে। ইহা সম্ভব করিল কে? ইংরাজ!

তাহার পর হইতে জয় শিব শম্ভু! বলিয়া সকলেই সকলকে অভিভাষণ করিতে লাগিলেন। প্রভাতে উঠিয়া যাহাদের মুখ দেখিলে দিন খারাপ যায় সেই মুচি মেথরের উপস্থিতি শোধন হইতে লাগিল জয় শিব শম্ভু বাচন দ্বারা।

কেবল একজন ইহাতে যার পর নাই খুশি হইল।

বাগাড়ম্বর বাবুর কনিষ্ঠ ভ্রাতা মেঘডম্বর।

উহার পোষা ছাগলটির নাম রাখিয়াছিল শিব শম্ভু। সেটি দাড়ি নাড়িয়া কাঁঠাল পাতা খাইলেই মেঘডম্বর হুঙ্কার দিয়া বলিতে লাগিল জয় শিব শম্ভু!

উত্তরে ছাগল কেবল বলিল, ম্যা।


জমানো

এখানে এসে ও দেখল সবাই কিছু না কিছু জমায়। সিঁড়ির নিচে জটলা হয়। মেলা বসে, মেলা ভাঙে। নোটিসবোর্ডে টাঙানো থাকে চিলতে রোদ, কাঁচা কবিতা। পোস্টারে পোস্টারে ছয়লাপ পোর্টিকো। এলা রঙের দেওয়াল কখনও এলিয়ে পড়ে না। কোথাও ফাঁকা না, দেওয়াল। চাদ্দিকে বড় বড় লেটারিং।

একটা ছেলে বড় বড় লেটারিং জমায়, এখানে এসে ও দেখল। একটা ছেলে পুরনো চশমার ফ্রেম। কতগুলো ভাঙা চশমা, ব্যাগভর্তি। নিজেরই, বিবিধ সময়ের।

আর ধান্ধাবাজ ছেলেমেদের খাতা ভরে যায় জমানো নোটে। ওরা নোট জমায়। এ ওর থেকে নোট টোকে। কপি করে। জেরক্স করে। বই থেকে জেরক্স করে। জেরক্সের দোকানে গিয়ে লাইন দিয়ে বসে থাকে, পাতায় পাতায় চিরকুট দিয়ে রেখে পর পর বই চোথা করে। তারপর ব্রাউন পেপারের মলাট মারে সেগুলোয়। তারপর সেগুলো কিন্তু পড়ে না, শুধু মাগ্‌গা মারে, মেরে পরীক্ষার খাতায় গিয়ে উগরে দিয়ে চলে আসে।

সিঁড়ির কাছেটা অনেককিছু দেখানোর স্থান মনে হয়। পোস্টারে পোস্টারে ছয়লাপ পোর্টিকো। কোথাও নিশ্চিত কিচ্ছু নেই। ছাত্রসংসদ, প্রতিবাদী ছাত্র আন্দোলনরা পোস্টারে কেরামতি দেখাচ্ছে। কত ভালো লেটারিং, কত ভালো আঁকা, সূর্য, ওঁচানো হাত, মুঠো করা হাত। লেটারিং পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে, রং পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। পোস্টারের বক্তব্যে জুড়ে যাচ্ছে একটা দুটো ভঙ্গি যা এক এক পার্টির নিজস্ব। কেউ বলবে …। তো কেউ বলবে…। কেউ বলবে…

ভীষণ নতুন, সবসময়, সবকিছু। কোথাও নিশ্চিত কিচ্ছু নেই। সবাই দেখাতে চাইছে, বলতে চাইছে কিছু না কিছু। কেউ ফোটো দেখাচ্ছে। পোর্টিকোর এক কোণে ফোটো একজিবিশন বসে গেল। কেউ কবিতা দেখাচ্ছে, দেওয়াল পত্রিকা। পলিটিকস, সাহিত্য, পড়াশুনো, ফোটো, ফিল্ম ক্লাব, সবকিছু সবাই জমায়, সবাই দেখায়। সবাই কিছু না কিছু রাংতার কাগজের মত লুকিয়ে রেখে রেখে শেষ একদিন চমকায়, আর অন্যেরা তার দিকে দৌড় মারে। ঘিরে ধরে। হাঁ করে তাকায়।

কতগুলো মেয়ে আছে ওদের দিকে সব ছেলেরা, এমনকি মেয়েরাও, হাঁ করে তাকায়। ওরা জামাকাপড় শুধু জমায় না, ডিসপ্লেও করে। রোজ নতুন লাগে ওদের জামাগুলোকে। অদ্ভুত সব জামাকাপড়। কখনও কাপড় কম, কখনও কাপড় বেশি। কোনদিনই ঠিক ঠিক না, মাপে মাপে না। কখনও ঝুলঝুল করে ঝুলছে স্কার্টের কোণ, উড়নি লুটিয়ে পড়ছে। অথবা নাভির নিচে পরা শাড়ির তলা গোড়ালির নিচে লুটিয়ে ঝাঁট দিচ্ছে মেঝে, সিঁড়ি, আঁচল উড়ে উড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞাপনের ঢং-এ।

একদিন সুভদ্রা, প্রোফেসর আঙুর বরণ সমাদ্দারের মেয়ে, টেপ ফ্রক পরে চলে এল। ওপরে কিছু পরতে ভুলে গেছে বোধ হয়। কিন্তু কী ডাঁট। টেপফ্রক পরে আছে, তাতে কী? র‍্যালার মাথায় ঘুরে বেড়াল সারা কলেজ। আর একদিন এক বিশাল বেঢপ সোয়েটার, বোধহয় বাবারই হবে। ওর বাবা মাঝে মাঝে আমেরিকার কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়াতে যায়। কলকতায় শীতকাল কাটায়, পেরুতে বসন্ত।

টুপি, গোল গোল ফুলছাপ দেওয়া টুপি পরে চলে এসেছে পিঙ্কি শরণ। ওর বাবা এম এল এ। সেকেলে মেমদের মত বড় ঘেরের রোদটুপি।

আশ্চর্যের ব্যাপার হল এরা সবাই পোর্টিকোয়। ঠিক স্টেজের মত। অবিরত নাটক হয়ে চলেছে। কোনও উইংস নেই। এই স্টেজে। শুধু দর্শক আছে গ্যালারিতে। সিঁড়িটাও অবশ্য স্টেজ। তাহলে গ্যালারিটা ঠিক কোথায়? দর্শক কি আদৌ আছে? নাকি সবাই অ্যাক্টর?

সোমনাথ অনিন্দিতাকে তাড়া করল সিঁড়ির ওপর, দৌড়ল অনিন্দিতা। সোমনাথ তিড়িং করে এক লাফ দিয়ে গিয়ে ধরে ফেলল ওকে, বা ওর চুলের বিনুনি ধরে নাড়া দিল। হাততালি, হাততালি। সমস্ত বাকি অ্যাক্টররা এখন দর্শক বনে গিয়ে হাততালি দিয়ে উঠল। অনিন্দিতার চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টেনে আনল সোমনাথ। অনিন্দিতার চীল চীৎকার। মিশে গিয়ে হো হো হি হি হাসি, হুল্লোড়ের মধ্যে লুপ্ত।

ওখানে এসে ও বুঝতে পারল ও নাটক পারে না। তালি কুড়োতে পারে না। ছন্দ পারে না কবিতায়। কবিতাই লিখতে পারে না। বড় বড় লেটারিং পারে না, তুলি ধরেনি কোনওদিন। বড় বড় বাবামাও ওর নেই।

বিহান যেমন গার্ল ফ্রেন্ড জমায়। দু বাহুতে খুব জোর। মাঝে মধ্যেই নতুন মেয়ে তোলে। তুলতে গেলে বাহুর জোর তো লাগবেই। আবার দেখতে বাহুবলী হলে হবে না। হালক না হাংক কী যেন বলে। দেখতে হতে হবে মায়াবী ও মেট্রোসেক্সুয়াল। চুল থাকবে উশকোখুশকো, নরম মিষ্টি দাড়িও থাকবে, চোখময় সফটনেস, কিন্তু কথায় তাজ্জব রুখুপনা।

ও দেখল ও মেয়ে তুলতে পারে না। ওর জমানোর মত কোন নরম দুরন্ত সুন্দর, আশ্চর্য ছোট্ট ছোট্ট করে কাটা চুলের তন্বী টিংটিঙে রোগা ফুচকাখাওয়া মেয়ে নেই।

ও দেখল ও কিছু দেখাতেও পারে না। দেখাতে, বোঝাতে, কথা বলে কাত করতে পারে দাদাদিদিরা। স্টুডেন্ট ইউনিয়ানের। ওরা ক্যাডার জমায়, নতুন ক্লাসের ছেলেমেয়েদের পাকড়াও করে নতুন রিক্রুট বানায়। মগজ ধোলাই দেয়। বলে চাপ নিও না বস, কিন্তু এটা তোমার আমার সবার ইস্যু। আনডেমোক্রেটিক, আনকালচারড বলে গাল পাড়ে অন্য পার্টিগুলোকে। প্রত্যেকে।

নানা শেডের লাল ও সবুজ, নানা বাম-দক্ষিণ। ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছদ্মবেশে নকু, নকুর ভেতর ফ্যাসিবাদী। কতরকম জামা। পরলে সবাই ঘুরে ঘুরে তাকায়। খুব ভাল্লাগে জামাগুলো পরলে।

কিন্তু ও পরে উঠতে পারে না। ডিসাইড করে উঠতে পারে না।

এমন একটা সময় ওর সঙ্গে রুচির আলাপ হল। রুচি ওকে প্রথম আলাপেই হাত বারিয়ে দিয়ে হ্যান্ডশেক করল। তারপর বলল, এ্যাই, আমি মুহূর্ত জমাই। তুই? তুই কী জমাস?

কলেজ ফেস্টের ঠিক আগে আগে আলাপটা হল। গোটা ফেস্ট ওরা একসঙ্গেই ছিল, কিন্তু ও বুঝতে পারেনি যে এটা একসঙ্গে থাকা। ও কোনও গানে, ডিবেটে, জ্যামে বা কুইজে নাম দেয়নি। ও নাচেওনি দুলে দুলে, অর্ধচন্দ্র ব্যান্ডের গানের সঙ্গে, শেষ দিনে। রুচিও ছবি আঁকা, কত্থক বা ওয়েস্টার্ন ভোকাল বা ইনস্ট্রুমেন্টাল কিছুই পারে না। ও শুধু উঁচু একটা দাঁত হঠাত হঠাত দেখিয়ে ফিক করে হাসে আর ছোট্ট, এইটুকুন একটা ডায়েরিতে কুটিকুটি কী সব লেখে। ওটার মধ্যেই নাকি ও মুহূর্ত জমায়।

কী কী জমল? শেষ দিন, কলেজফেস্টের প্রাইজের দিন, ফাঁকতালে সাহস করে জিগ্যেসই করে ফেলল।

পরশু ভেলপুরির কাগজটা খুলতেই একটা লেখা বেরিয়েছিল না, অশুভ চিন্তা দূরে রাখুন, সেটা দেখে তোর মুখটা খুব কমিকাল হয়েছিল। এটা মুহূর্ত নং এক। আর সেদিন ফেরার সময় সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ-এর দিকে একটা গলিতে ঢুকতেই, দুটো ইঁটের মাঝখানে রাখা একটা মোমবাতিকে একলা একলা জ্বলে যেতে দেখলাম না? তুই বললি কে বা কারা জ্বেলেছে, আমি তাকিয়ে রইলাম অনেক সময় ধরে? সেইটা।