Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চার বাঁক পরিবর্তন: একটি নতুন গ্রন্থ

দেওয়ান মিনহাজ গাজী

 

এক.

সম্প্রতি বেশ কয়টি রাজনৈতিক সাহিত্য বাংলাদেশের পাঠক মহলে এসেছে। এর প্রায় সবগুলো ’৭১ ও পূর্বাপর সময়ের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে লিখিত। বইগুলোর কোনওটা গবেষণাধর্মী, কোনওটা স্মৃতিচারণধর্মী, কোনওটা আত্মকথামূলক। সবগুলো আমাদের ইতিহাসকে স্পর্শ করে লিখিত। বইগুলো পাঠক মহলে সমাদৃত হয়েছে, আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে, নিন্দিতও হয়েছে কমবেশি।

লেখক-গবেষক আলতাফ পারভেজের সমকালীন গবেষণাগ্রন্থ ‘মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী: ইতিহাসের পুনর্পাঠ’ এরকমই এক রাজনৈতিক সাহিত্য। আমি জানি না এই বইটি কলকাতার বইবাজারে পৌঁছেছে কি না। কিন্তু পৌঁছানো দরকার ছিল। কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে কলকাতায় অনেক ভুল উপলব্ধি দেখেছি। যদিও কলকাতার বড় ধরনের সাহায্য নিয়েই সেই মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল।

একটি স্বাধীন দেশের জন্য বাঙালির চিন্তা, গড়ে ওঠা, বেড়ে ওঠা, তার জন্ম, তার আকাঙ্ক্ষা, তার যাত্রা, তার অনাকাঙ্ক্ষিত থমকে যাওয়া, ইত্যাদির চাপা পড়া প্রকৃত ইতিহাস যারা তালাশ করে বেড়ান, তাদের জন্য বাংলাদেশের ঐতিহ্য প্রকাশনীর এই বইটি এক সমৃদ্ধ ভাণ্ডার। নিশ্চয়ই কলকাতার অনেকেই এসব জানতে চান।

আমি লেখক গবেষক গোছের কেউ নই, এরকম যোগ্যতা আমার মোটেও নেই। থাকি মফস্বলের একটা জেলাশহরে। প্রাক্তন রাজনৈতিক কর্মী। এখন মূলত আইনজীবী। বর্তমান গ্রন্থের লেখকের সঙ্গেও আজও দেখা হয়নি আমার। মনের তাগিদ, যন্ত্রণা, দায়বোধ থেকে সাহস করে কিছু বলতে চেষ্টা করছি মাত্র। পাঠক, আমার ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন আশা করি।

লেখক আলতাফ পারভেজ তার বই মোট ৬০০ পৃষ্ঠায় গ্রন্থণা করেছেন। এর দামও বাংলাদেশের বিবেচনায় বেশ বেশি। ৯৯০ টাকা। প্রায় তিন বছর হয়ে গেল বইটি প্রকাশের।

বইটির প্রথমদিকের ৪১৮ পৃষ্ঠায় মূল বিষয়বস্তুর উপর লেখক বিভিন্ন তথ্যসূত্রের উপস্থাপনসহ তাঁর মতামত ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। বাদবাকি পৃষ্ঠাগুলোয় মূল বিষয়বস্তুর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বিভিন্ন লেখকের কিছু পুরানো লেখা, ঘটনাপঞ্জি, বিবৃতি, রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র, সাক্ষাৎকার ইত্যাদি সংযোজন করেছেন; কেন করেছেন, তার ব্যাখ্যা লেখক বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন। আমার কাছে মনে হয়েছে, প্রথম অধ্যায়টি, বইটির ভূমিকারই ব্যাখ্যাগত বিস্তৃতরূপ। লেখক এই অংশটিকে পাঠকের মর্জির উপর ছেড়ে দিয়েছেন, যাতে করে পাঠক বইয়ের এই অংশটিকে লেখকের পর্যবেক্ষণের প্রাথমিক স্তর বা ভূমিকার বিন্যাস হিসাবে ধরে নিয়ে দৃষ্টিনিবদ্ধ করতে পারেন বা মনোসংযোগ করতে পারেন। লেখক এই অধ্যায়টির নামকরণ করেছেন ‘অনুসন্ধানের প্রাসঙ্গিকতা, পরিধি, পদ্ধতি, কাঠামো ও সীমাবদ্ধতা।’

গোটা বইটিতে লেখক বাংলাদেশের চাপা পড়া রাজনৈতিক ইতিহাসের যেসব স্পর্শকাতর অধ্যায় উত্থাপন করেছেন, অনুসন্ধান করেছেন, তার জন্যে তিনি যদি পাঠকদের বিশেষত নির্মোহ ইতিহাসপিপাসুদের অভিনন্দন ও প্রশংসা পাওয়ার হকদার হন, তবে বইটির ৬ পৃষ্ঠার ভূমিকাটুকুর জন্যে আলাদা করে তিনি একটু সাবাস পেতেই পারেন। নিঃশঙ্ক উচ্চারণে তিনি ফরমায়েসি ইতিহাসবিদদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন! অবলীলায় বলছেন, তার লেখা প্রতিষ্ঠিত বা মান্য ইতিহাসের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হতে চায়! ভয়াবহ এই আহ্বান।

দেখার বিষয়, প্রথামুখী ‘মূলধারা’র ইতিহাসবিদরা যারা বছরের পর বছর আমাদের প্রকৃত ইতিহাসকে ইচ্ছাকৃতভাবে অবহেলা, অবজ্ঞা, ধামাচাপা দিয়ে আসছিলেন, বিকৃতি ঘটিয়েছিলেন, তারা এখন এই লেখকের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেন নাকি না দেখার ভান করে বাণিজ্য তালাশের পুরানো পথেই আকড়ে থাকবেন।

 

দুই.

পাকিস্তানি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে থেকে যাঁরা বাঙালিদের জন্য প্রথম একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের ধারণা পোষণ সহ ওই রাষ্ট্রের চরিত্র নিয়ে ভাবতেন, গোপন চিন্তার বিনিময় করতেন, উদ্বুদ্ধ করতেন নবীনদের, সংগঠিত করতেন এবং অনিবার্য ১৯৭১-এর যুদ্ধটিকে রাজনৈতিকভাবে আলিঙ্গন করেছিলেন পরম মমতায়, শ্রদ্ধায়, বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন তাঁরা অপাংক্তেয়। তাঁদের আকাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ লুন্ঠিত হয়েছে অনেক আগে, একেবারে প্রথম প্রহরে! অনেকে হয়তো মানবেন না! ঐ অগ্রসরমান চিন্তার মূলধারক ছিলেন সিরাজুল আলম খান। চৈতন্য বৈকল্যের বাংলাদেশে ইতিহাসের ফেরিওয়ালাদের কাছে যাঁর নাম যথাযথ অনুসন্ধানের দাবি রাখেনি। কিন্তু এখন আর অনেকের কাছেই তিনি উচ্চারিত নন এবং তিনি নিজেও বিস্ময়করভাবে নীরব। আমার মনে হয় কলকাতার অনেক বাংলাদেশ-বিশেষজ্ঞ তাঁর নামও হয়তো শোনেননি। আলতাফ পারভেজ তাঁকেই অনুসন্ধান করেছেন, তালাশ করেছেন অগণিত সূত্রে, কারণ, তাঁকে কেন্দ্র করেই ‘মুজিব বাহিনী’, পরবর্তীকালে তাঁকে কেন্দ্র করে ‘গণবাহিনী’। সে এক উত্তাল সময় এসেছিল বাংলাদেশে! কিন্তু মুজিব বাহিনী ও গণবাহিনী ছাড়াই টনে টনে বাংলাদেশের ইতিহাস লিখিত হয়ে চলেছে!!

লেখক তাঁর গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে সিরাজুল আলম খান গঠিত ‘নিউক্লিয়াস’, যা পরবর্তীকালে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা মুজিব বাহিনী নাম পায়, তা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। খুবই বিশদ সেই আলোচনা। এই আলোচনা পশ্চিমবঙ্গের পাঠকের জানা উচিত। কারণ ভারতের মাটিতেই গঠিত হয়েছিল ‘মুজিব বাহিনী’।

আলোচ্য গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিব বাহিনী নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক এবং বাহিনীটিকে নিয়ে ভারতীয় ভূমিকাসহ আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের স্বার্থ-দ্বন্দ্ব ও ষড়যান্ত্রিক আচরণগত বহুবিদ প্রেক্ষিত নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক অনুসন্ধান তুলে ধরা হয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এমন সব অগণিত তথ্যসূত্র লেখক পর্যবেক্ষণে এনেছেন, যার অনেকগুলোই নতুন। প্রথামুখী ইতিহাস বিশারদরা বিগত সময়ে এই তথ্যসূত্রসমূহকে হয়তো তালাশই করেননি বা আমলে নেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেননি অথবা না দেখার ভান করে ঘটনা আড়াল করে খণ্ডিত ইতিহাসচর্চার ক্ষমাহীন অসততা প্রদর্শন করে গেছেন।

কোনও দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসচর্চার দায় নিশ্চয়ই বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদের আড়াল করা বা তুলে ধরা নয়, কোনও ঘটনাসমূহকে গুরুত্ব না দেয়া বা অনর্থক গুরুত্ব দেয়া নয়। একটি জাতির গড়ে উঠার সময়টিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উপলব্ধি করা। সময়ের দ্বন্দ্ব-সংঘাতসমূহের বিবিধ প্রেক্ষিতগুলোকে নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ না করলে, জাতির প্রকৃত ইতিহাসটি কখনওই আলোর মুখ দেখার কথা নয়।

বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন ‘মুজিব বাহিনী’র ভূমিকা নিয়ে, তাদের কর্মপদ্ধতি কর্মপরিধি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হতেই পারে, বিতর্ক থাকতেই পারে। তাঁরা জেনে বুঝে হোক, না জেনেবুঝে হোক, কিছু বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন বা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন বা পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছিলেন। এগুলোই ইতিহাসের অনুসন্ধানের বিষয়। কিন্তু তা না করে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টির বীজরোপনকারী এই মূলধারাটি, যাঁরা তাঁদের সাহসিকতা ও আপসহীন লড়াইয়ের ব্যাপকতা দিয়ে বাংলাদেশ নামক মহাকাব্যিক শব্দটিকে অনিবার্য পরিণতির দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের অবজ্ঞা করা, অবহেলা করা, অবমূল্যায়ন করা, প্রচলিত ইতিহাসের ক্ষুদ্রতা এবং নষ্টামিও বটে। এক্ষেত্রে বর্তমান লেখকের নির্মোহতা প্রচলিত ইতিহাসচর্চার গণ্ডিকে অতিক্রম করেছে অসাধারণভাবে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনও প্রাপ্তি নয়। ১৯৬২ সালে গঠিত ‘নিউক্লিয়াস’ তৎকালীন ছাত্র যুব-সমাজের মধ্যে ক্রমে ক্রমে যে লড়াকু মেজাজ তৈরি করেছিলেন, যে আপোষহীন দৃঢ়তা প্রদর্শন করেছিলেন, তা-ই স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রামকে অনিবার্য করেছিল। ভুলে গেলে চলবে না, তৎকালীন জাতীয় নেতৃত্বের পুরোধা অংশই আপস ও সংগ্রামের দোলায় দুলছিলেন। প্রয়াত অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক মেঘনার সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লিগ হাইকমান্ড স্বাধীনতার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুকে ইয়াহিয়ার সাথে আপোস করতে বলেছিল।’ কোনও কোনও ইতিহাস গ্রন্থে এটাও পাওয়া যায়, ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের ভয়াল রাতেও আওয়ামী লিগের সর্বোচ্চ স্তর থেকে ২৭ মার্চ হরতাল কর্মসূচির ঘোষণা এসেছিল। অন্য বিষয়গুলো নাই বা বললাম। মূলত স্বাধীনতার প্রশ্নে সিরাজুল আলম খানের ‘নিউক্লিয়াস’ যা পরবর্তীকালে বিএলএফ বা মুজিববাহিনী, সেটাই স্বাধীনতার মূল ধারা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেদিন। সেখানে আলো ফেলা তাই ইতিহাসবিদদের কাছে একটি বড় রকমের দায়।

মুজিববাহিনীকে নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক ও অস্পষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থান বা আচরণগুলো তুলে ধরতে এই লেখক মোটেও কাপর্ণ্য করেননি। আমি মনে করি কলকাতার ভবানীপুরস্থ ২১ রাজেন্দ্র রোডের বিলাসবহুল ‘সানি ভিলা’য় (এখন আছে কি সেই বাড়ি?) অবস্থান করেই তাঁরা চিত্তরঞ্জন সুতারের হাতে নিজেদের সঁপে দেন এবং ‘র’-এর পাতা ফাঁদে অনিচ্ছাকৃতভাবে জড়িয়ে পরেন। বিতর্কের সূত্রপাত সেখান থেকেই। প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাকের ভাষ্যমতে এই চিত্ত সুতারই কলকাতায় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিনিধি ছিলেন। এই সুতারই ভারত সরকারের যোগসূত্র। এই সুতারের মাধ্যমেই ভারতীয় জেনারেল উবানের আবির্ভাব।

’৭১-এর পূর্বাপর সময়ে এই চিত্তরঞ্জন সুতারের ভুমিকা খুবই রহস্যঘেরা। লেখক-গবেষক মঈদুল হাসানের মতে, তাজউদ্দিনের মন্ত্রিসভা গঠন ও বেতার ভাষণ দেয়ার ব্যাপারে সুতার খুব তৎপর ছিলেন। লেখক রইসউদ্দিন আরিফের তথ্য অনুযায়ী, এই সুতার ৭৫-এর ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে হঠাৎ বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। এই সুতারকেই আবার ৯০ দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের কিছু জেলার সমন্বয়ে একটি ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ গঠন বা স্বাধীন বঙ্গভূমির দাবি উত্থাপন করতে দেখা যায়। যদিও একাত্তর সালের গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারকরা এবং জেনারেল উবানও তাঁর বিখ্যাত বইতে চিত্তরঞ্জন সুতার সম্বন্ধে বিস্ময়করভাবে নীরব।

মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ অনুসন্ধানকর্মে চিত্তরঞ্জন সুতার নামটি বিশেষ গুরুত্বের দাবী রাখে। বর্তমান লেখকও তাঁর গ্রন্থে সুতারের জন্ম-মৃত্যু-কর্মনিবাস নিয়ে মৃদু আলোকপাত করেছেন। মুজিব বাহিনী বিষয়ক আলোচনা তাঁকে ছাড়া সম্ভব নয়।

এইরূপ আলোচনা থেকে মোটা দাগে যে প্রশ্নটি মুজিববাহিনীকে কেন্দ্র করে জোরালোভাবে উঠে আসে তা হলো, বাহিনীটি সম্মুখযুদ্ধে কেন গেল না এবং কিছু পরিমাণে দেশের ভেতরে ঢুকলেও তাদের কোনও যুদ্ধের ইতিহাস নেই কেন? সশস্ত্র প্রশিক্ষিত, আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত এবং শিক্ষিত তরুণ যুবকের সম্মিলন হয়েও তারা কেন সংঘবদ্ধভাবে সম্মুখ সমরে নামল না। এটি এক বিরাট প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আলতাফ পারভেজের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ছিল, হতাশাও আছে, ভবিষ্যৎ অনুসন্ধান জারির অঙ্গীকারও আছে ।

এটা অনেকটা পরিষ্কার, ইতিহাসের কিছু জট খুলবে না। কারণ সময়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছেন। যারা এখনও বেঁচে আছেন নিজেকে বিকিয়ে না দিয়ে, আত্মমর্যাদা নিয়ে, তাঁরা অবশেষে নীরবতা ভাঙবেন, মুখ খুলবেন, এমন আশাও সহজ নয়; কারণ ইতিহাসের দায় যে অনেক ভারী। আর বাংলাদেশ সত্য প্রকাশের পরিসরও অনেক ছোট হয়ে গেছে।

লেখক তাঁর বইয়ের চতুর্থ অধ্যায় থেকে সপ্তম অধ্যায় পর্যন্ত সদ্য স্বাধীন দেশে মুজিববাহিনীর আনুষ্ঠানিক বিভাজক রেখাগুলোর উপর আলোকপাত করেছেন। এ পর্যায়ের বিভিন্ন রূপ বিশ্লেষণে লেখকের অনুসন্ধান কর্মের গভীরতা অনুধাবন করা যায়। সংশ্লিষ্ট কোনও সূত্রকে তিনি খাটো করেননি, অবহেলা করেননি, তা নিকটবর্তী হোক বা দূরবর্তী, সবই যাচাই করেছেন নিষ্ঠার সাথে।

 

তিন.

ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ তত্ত্বাবধানে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত মুজিববাহিনীর প্রকৃত সংখ্যা কত, এটা এক জটিল প্রশ্ন। বোধ করি এর কোনও উত্তর আর নেই। ৮-১০ হাজার, ১০-১২ হাজার, মতান্তরে সর্বোচ্চ ২০ হাজার। অদ্ভুত ঘটনা হল, এই বাহিনীটি যখন স্বাধীন দেশে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ অস্ত্রসমর্পণ করে তখন বাহিনীটির অফিসিয়াল সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০ হাজার! যাদের প্রায় সবার মুক্তিযোদ্ধা সনদ প্রাপ্তির সৌভাগ্য হয় এবং সনদে সাক্ষর প্রদান করেন শেখ ফজলুল হক মনি এবং স্বরাস্ট্র সচিব তসলিম আহমদ। বিস্ময়কর হল এই আমলা তসলিম আহমদ যুদ্ধের নয়টি মাস ঢাকায় অবস্থান করে পাকবাহিনীর বিশ্বস্ততা অর্জনে সফল ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের এই উদার সনদ বিতরণ দেশটাকে আজও খোঁচাচ্ছে।

এখানে একটি ছোট প্রশ্ন উঁকি মারবেই। যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি থাকাবস্থায়, সম্মুখ সমরের সেক্টর কমান্ডাররা থাকাবস্থায়, শেখ মনিকে কেন মুজিববাহিনীর পক্ষে আলাদা করে সনদ প্রদান করতে হবে? তারা একটি ভিন্ন বাহিনী, এই কথা প্রকৃতই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। কারণ আরও অনেক বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে ক্রিয়াশীল ছিলেন, তাদের এমনটা করতে হয়নি। অনেকে সনদ নেয়া বা প্রাপ্তির প্রয়োজন অনুভব করেননি, করেন না আজো। এই লেখক, তাঁর বইয়ের প্রথমাংশে এ সংক্রান্ত তাবৎ বিষয়ের ময়নাতদন্ত করেছেন দক্ষতার সাথে। তবুও অনুসন্ধান জারি থাকুক। কারণ এই লেখকের অনুসন্ধানও চূড়ান্ত নয়। তিনি সেটা দাবীও করেননি।

মুজিব বাহিনীর অভ্যন্তরের যুদ্ধকালীন মতবিরোধ কেমন তীব্রতর আকার ধারণ করেছিল, লেখক বইটিতে তার আদ্যোপান্থ তুলে ধরেছেন। আদর্শিক মতবিরোধের মাঝে প্রধান দুই নেতার ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব একাকার হয়েছিল, ফলে ভাঙ্গনটি অনিবার্য ছিল। মুজিব বাহিনীর মূল ও মেধাবী আদর্শিক অংশটিকে সিরাজুল আলম খান তাঁর প্রজ্ঞাময় নেতৃত্ব দিয়ে নিরংকুশভাবে ধরে রাখতে পারলেও অপর অংশের নেতা শেখ মনির ক্ষমতার মূল ভিত্তি ছিলেন তাঁর মামা মুজিব, এটা যুদ্ধকালীন সময়েও, যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশেও। এই অংশটিতেও মতবিরোধটাও লক্ষণীয়। ১৯৮৯-এর সাক্ষাতকারে প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল সাহেবকে বলেছেন ‘অপরিপক্ক’, নূরে আলম সিদ্দিকীকে বলেছেন ‘লস্ট কেইস’। অথচ নূরে আলম সিদ্দিকী মুজিবের ‘চার খলিফা’-র একজন বলে খ্যাত। স্বাধীনতার পর এই এভাবেই মুজিব বাহিনীর নেতাদের দ্বন্দ্ব-বিরোধ সরকার প্রধানের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

যুদ্ধ কেবল মানচিত্র বদলায় না, জনগোষ্ঠির মাঝে নতুন চিন্তা চেতনা স্বপ্ন আকাঙ্খার জন্ম দেয়। যে দেশ এগুলো ধারণ করতে পারে সে দেশ অগ্রগতির পথে হোঁচট খায় না। যুদ্ধ আমাদের মানচিত্র বদলে দিয়েছিল। কিন্তু স্বপ্নের দ্বার খুলতে পারেনি। পুরানো ধাঁচের বিধি ব্যবস্থাপনাকে নতুন দেশে পুনরায় আঁকড়ে ধরায় সমাজে দ্বন্দ্ব বেড়েছে। অনৈক্য বেড়েছে, সংঘাত বেড়েছে, লুন্ঠন বেড়েছে, নৈরাজ্য বেড়েছে। সেই সঙ্গে দ্রুত লয়ে বেড়ে উঠছিল মানুষের হতাশা। এখানেই বোধ করি লেখক খোঁজ করেছেন ‘জাসদ’ ও ‘গণবাহিনী’ সৃষ্টির পটভূমিটি। কলকাতার আজকের তরুণ প্রজন্ম কতটা জানেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সেই ইতিহাস?

লেখক রাজনীতিক সাঈদ তারেকের ভাষ্য অনুযায়ী, যুদ্ধ পূর্ববর্তীকালে ‘মুজিবের কানের কাছে স্বাধীনতা নিয়ে সর্বক্ষণ ঘ্যানর ঘ্যানর করতে থাকা’ সিরাজুল আলম খানের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পর্কটি ছিল পারস্পরিক ভালোবাসা বিশ্বাস ও নিভর্রতার। এই সম্পর্কটি স্বাধীন দেশে দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। শুধু সিরাজ নন, প্রবাসী সরকারের মুখ্য চরিত্র তাজউদ্দিনও যুদ্ধপরবর্তীকালের ‘ভিকটিম’। এই দুই বিশ্বস্ত রাজনৈতিক চরিত্রের সঙ্গে মুজিবের দূরত্ব তৈরির ভূমিকাটি পালন করে যাচ্ছিলেন মুজিব বাহিনীর অপর নেতা শেখ ফজলুল হক মনি। এক্ষেত্রে তিনি সফল। মনি ক্ষমতার কেন্দ্রে কারও অংশীদারিত্ব চাননি। সদ্য স্বাধীন যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে যেখানে প্রয়োজন ছিল ঐক্য এবং নিবিড় ঐক্যের। সেখানে সৃষ্টি হল দ্বন্দ্বের এবং নেতা মুজিব স্নেহশীল মামা মুজিবের কাছে হারলেন নাকি নিজেকে সমর্পিত করলেন! লেখকের অনুসন্ধানে খুব সূক্ষ্ম ও তীক্ষ্ণভাবে বিষয়গুলো উঠে এসেছে অনেক সময়ই প্রশ্ন আকারে!

অনেক একচোখা ইতিহাসবিদরা বাংলাদেশের তৎকালীন অস্থির সময়ের যাবতীয় দায়ভার সিরাজুল আলম খান, জাসদ ও অপরাপর প্রতিবাদী শক্তিসমূহের উপর চাপিয়ে দিয়ে তৃপ্তিবোধ করে থাকেন। তারা দেশটির জন্ম প্রক্রিয়ার গভীরে ঢুকতে নারাজ। জন্মযাত্রার মুহূর্তে দেশটা কীভাবে গণিমতের মাল হয়ে গিয়েছিল, নতুন রাষ্ট্রের চৈতন্যের জায়গাগুলো কীভাবে লুন্ঠন হয়েছিল, অরাজক অব্যবস্থাপনা কীভাবে আচারে পরিণত হয়েছিল, আইনের শাসনসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে ভেঙে পড়ছিল, ক্ষমতার চতুষ্পার্শে কীভাবে বিশেষ শ্রেণি গড়ে উঠেছিল। কেনই বা জাসদ অস্ত্রবাজী প্রতিযোগিতার রাজনীতিতে ঝাঁপ দিল। এসব ঐতিহাসিক প্রশ্নগুলো তারা আমলে নিতে চান না। সমাজ বদলের ধারণায় পুষ্ট অগণিত মুক্তিপাগল তরুণ যুবকের আত্মদান তাদের কোনও চিন্তার খোরাক যোগায় না। যুদ্ধের ময়দানে জন্ম নেওয়া অগণিত মুক্তিযোদ্ধার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পরিবর্তনে নতুন আকাঙ্খার জন্ম হতে পারে। এমন বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা এষ্টাবলিশমেন্টকে আঁকড়ে ধরা একচোখা ইতিহাসবিদদের থাকার কথা নয়। নেই বলেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুধাবনে ব্যর্থ ঐ বিজ্ঞজনরা আজও বাংলাদেশের মাঝে পাকিস্তানের ভূত দেখতে পান এবং ভূত তাড়াতে বুদ্ধির যোগালি হয়ে শান-শওকত আস্বাদন করেন। একইভাবে বাংলাদেশের অনেকে পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনের তাৎপর্য বুঝতে পারেন না।

তবে এটা সত্য, বাংলাদেশে জাসদ গঠন প্রক্রিয়াকালে একঝাঁক নৈরাজ্যবাদী দলটির কাঁধে ভর করে এবং একপর্যায়ে তারা দলটিকে তাদের কাঙ্খিত পথে নিয়ে যায়। তারা কেবল দলটিকে ধ্বংস করে, প্রশ্নবিদ্ধ করেই কাজ শেষ করেনি, বাংলাদেশের বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির সমস্ত সম্ভাবনাকে আঁতুড় ঘরে হত্যা করে। ওরা এখন বিলীয়মান। বিভিন্নভাবেই নষ্ট সমাজে শোভাবর্ধন করে যাচ্ছেন তারা। আর দলটির প্রতিষ্ঠাতারা, অগণিত আন্তরিক কর্মী যাবতীয় পাপ-তাপ ধারণ করে রক্তক্ষরিত। এটা ইতিহাসের নিষ্ঠুরতাও বটে।

 

চার.

যুদ্ধের মাধ্যমে গঠিত সদ্য স্বাধীন কোন দেশ কল্যাণকামী ধারায় অগ্রগতির পথে যাবে নাকি পুনরায় গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে যাবে সেটা নির্ভর করে দেশটিতে নিপাট আইনের শাসন বলবৎ হওয়া না হওয়ার ওপর। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রথম থেকে এই বিষয়টির অনুশীলন ছিল খুব হতাশাজনক। মুজিববাহিনীর ক্ষমতাকেন্দ্রীক ধারাটির মূল চালক শেখ ফজলুল হক মনি বলেছিলেন, ‘মুজিবের শাসন চাই, আইনের শাসন নয়’ (বাংলার বাণী, ২৬ সেপ্টেম্বর ৭২)। রাষ্ট্রীয় সংস্কারমূলক বিভিন্ন কর্মসূচি উত্থাপন করতে থাকা মনির প্রতিপক্ষ অংশ তখনও সংগঠিত আকারে মাঠে নেই, অপরাপর বিদ্রোহী শক্তিসমূহ তখনও সক্রিয় নয়। প্রখ্যাত সাংবাদিক প্রয়াত ফয়েজ আহমেদ লিখেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধের পর যাদের কাছে এদেশটা ব্যক্তিগত সম্পত্তি রূপে প্রতিয়মান হয়ে উঠে, তারা অবাধ লুন্ঠন ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা যেন ন্যায়সঙ্গত করেই তুলেছিল; নিরাপত্তাহীন মানুষের জীবনটা অনেক ক্ষেত্রে সবচেয়ে সস্তা হয়ে দাঁড়ায়। বাহাত্তরের গোড়ার দিক থেকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র সন্ধ্যার সাথে সাথে যেন গভীর রাত্রি নেমে আসত।’

প্রকৃত অর্থেই মানুষ, এ জাতীয় ‘মুক্তিলাভ’ থেকে মুক্তি চেয়েছিল। শেখ মনির ওইরকম বিস্ময়কর তত্ত্ব উত্থাপন সদ্য জন্ম নেওয়া দেশে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে আইনহীনতায় কীরূপ নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল তা নিবিড় অনুসন্ধানের বিষয়। তবে এটা নিশ্চিত, অনুসন্ধানের গভীরতায় শেখ মনি প্রসঙ্গ শুধু ওখানেই থেমে থাকবে না। বর্তমান গ্রন্থে তার প্রবল আঁচ পাওয়া যায়।

সিরাজুল আলম খানের অনুসারীরা কেবল ‘মুজিব বাহিনী’তেই ছিলেন না বিভিন্ন সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রণাঙ্গনেও তাঁরা ছিলেন। এই অগণিত দেশপ্রেমিক যোদ্ধারা নতুন দেশ গড়ে তোলার ব্যাপারে কোনও অবদানই রাখতে পারছিলেন না। অথচ এদের প্রায় সবাই ছিলেন মেধা-প্রজ্ঞায় অনন্য এবং রাজনৈতিক ধ্যানধারণায় পুষ্ট। ফলে এঁদের মধ্যে ক্রমে ক্ষোভ দানা বাঁধছিল। তবুও সিরাজুল আলম খানরা দেশ পুনর্গঠনের জন্য নেতা মুজিবের কাছে চাপ রাখছিলেন, নতুন নতুন কর্মসূচি উত্থাপন করছিলেন। কিন্তু সবকিছু বিফলে যায় প্রত্যাখ্যাত হয়। ক্ষমতার মদমত্ততায় খুন রাহাজানি লুন্ঠন নৈরাজ্য বিরুদ্ধমত দমন লাগামহীনভাবে বেড়েই চলছিল। অন্যদিকে, আন্দোলন সংগ্রাম আর যুদ্ধের ময়দানে জন্ম নেয়া আকাঙ্খারও মহামিলন ঘটছিল সংগঠিত আকারে, দ্রুতগতিতে।

অনেক আন্দোলন সংগ্রামের ও সিদ্ধান্তের সাক্ষ্য বহনকারী ‘ছাত্রলিগ’ কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সংগঠনটির মূল ধারাটিকে সিরাজুল আলম ধরে রেখেছিলেন নিপুনতার সাথে। ছাত্রলিগের মধ্যে বিভাজকরেখা স্পষ্টতই ছিল। সেই বিভাজনকে ভাঙ্গনে রূপ দিলেন খোদ মুজিব নিজেই। এ ছিল ভাঙ্গনকে আমন্ত্রণ জানানো। একই দিনে ডাকা উভয় অংশের সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন তিনি নিজে। অভিভাবক মুজিব, জাতির প্রাণপুরুষ মুজিব ক্ষমতাকেন্দ্রীক অংশটিকে আলিঙ্গন করলেন। অন্য অংশটিকে অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করলেন। কিন্তু কেন? কোন অংশের ডাকে না গিয়ে যদি তিনি প্রকৃতই অভিভাবকত্ব করতেন, পরবর্তী ইতিহাস ভিন্ন ধাঁচের হত, এটা নিশ্চিত। ‘বিশ্বে এল নতুন বাদ- মুজিববাদ’ নামক ব্যক্তিতোষণমূলক শ্লোগানটাই যে তাঁকে একটি অংশের প্রধান অতিথির আসন গ্রহণে অনুপ্রাণিত করেছিল, এমনটা ধারণা করা অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু এরপর সিরাজুল আলম খান বা ছাত্রলীগের মূল অংশটির সামনে বিকল্প কোনও পথের সন্ধান করা ছাড়া উপায় ছিল না। বাংলাদেশের ইতিহাসের নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছিল এভাবেই।

নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির অঙ্গীকারসহ নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ, মুজিববাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের আনুষ্ঠানিক বিভক্তি, রক্ষীবাহিনী গঠন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের লাগামহীনতা, রাষ্ট্রীয় অনাচার, অব্যবস্থাপনা, বিরোধী মত দমন, অস্ত্রবাজী, চোরাচালান, ভারতীয় আগ্রাসন ও লুন্ঠন ইত্যাদি সর্বনাশা প্রেক্ষিত সামনে নিয়ে ছাত্র যুব সমাজের শক্তিকে পুঁজি করে জাসদের যাত্রা এবং ক্ষেত্রবিশেষে তড়িৎ প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন, দলটির নিয়মতান্ত্রিক যাত্রাপথকে ক্রমে অস্থির করে তোলে। তারাও প্রতিপক্ষ মোকাবেলায় নৈরাজ্যবাদী পদ্ধতিকে আলিঙ্গন করতে থাকে। ঘোষিত রাজনীতির ভুল বিশ্লেষণ দলটির গোপন রাজনীতির অনুশীলনকে প্রশস্ত করে। এখানেই গণবাহিনী গড়ে ওঠার শিকড় নিহিত। ক্ষমতার রাজনীতির বিভিন্নমুখী অসহিঞ্চু আচরণ সদ্য জন্ম নেয়া দলটিকে ঠেলে ধাক্কিয়ে গোপন সশস্ত্র রাজনীতির পথে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে। লেখক বিভিন্ন তথ্যসূত্রের বিশ্লেষণসহ ঐ সময়ের বিধ্বংসী রাজনীতিটাকে বা রাজনীতি নামক আত্মঘাতী সময়টিকে এতো যত্ন ও নিষ্ঠার সাথে বইতে তুলে ধরেছেন, যা অসাধারণ। ভবিষ্যৎ নির্মোহ ইতিহাসচর্চাকারীদের জন্যে বইটি অনেক দিন আলোর যোগান দেবে। যদি আদৌ দেশ-বিদেশের কেউ সেটা জানতে চায়।

 

পাঁচ.

লেখক তাঁর গ্রন্থে দেখিয়েছেন ‘মুজিব বাহিনী’র মূল কাঠামো পরবর্তীকালে পাঁচটি ধারায় বিভক্ত হয়েছে: রক্ষীবাহিনী হিসেবে, বেসামরিক আমলাতন্ত্রে, সিরাজুল আলমের জাসদে, শেখ মনির প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে যুবলীগে এবং আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবক লীগে। আমি মনে করি আরও দুটি ক্ষুদ্র ধারার অস্তিত্ব লেখকের নজর এড়িয়ে গেছে। একটি ক্ষুদ্র অংশ ৭২-৭৩ এর দিকেই স্বপ্নভঙ্গের হতাশা নিয়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে দেশত্যাগ করে। এই ধারার একটি উপ-অংশ ৮০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। অপর একটি ক্ষুদ্র অংশ পুরোপুরিভাবে অপরাধ জগতে প্রবেশ করে।

মুজিব বাহিনীর গোটা কাঠামোর কোনও অংশেরই ’৭১-এ শত্রুনিধনের কোনও গৌরবজনক ইতিহাস না থাকলেও স্বাধীনদেশে একে অন্যের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ ও নিধনযজ্ঞের ইতিহাসের অভাব নেই। এই ইতিহাসপর্বের বড় অংশটির নাম রক্ষীবাহিনী।

লেখক রক্ষীবাহিনীর গঠন, কাঠামো, বিধিবিধান, দায়মুক্তি, সশস্ত্রতা ও অসহায় আত্মসমর্পন ইত্যাদি ও তৎপরবর্তী ঘটনাবলী নিয়ে অনুসন্ধানের অনেক গভীরে বিচরণ করেছেন। আর্শ্চযের বিষয়, যুদ্ধকালীন মুজিববাহিনীর নিয়ন্ত্রণ অস্থায়ী সরকারের হাতে ছিল না, ছিল জেনারেল উবানের নেতৃত্বে ‘র’ এর হাতে, স্বাধীন দেশে সেই মুজিববাহিনী থেকে যখন আরেকটি বাহিনী গঠনের প্রয়োজন হলো, তখন আবার প্রয়োজন পড়ল সেই উবানের। আবার প্রয়োজন পড়ল বিশেষ প্রশিক্ষণের। আবার প্রয়োজন পড়ল দেরাদুনের। আবার প্রয়োজন পড়ল ভারতীয় প্রশিক্ষকদের। ‘বিশেষ প্রশিক্ষণে’ প্রশিক্ষিত এই রক্ষীবাহিনী কর্মক্ষেত্রে অনেক কঠোরতা দেখাতে পারলেও, অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়ে সরকার প্রধানের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারলেও যখন মুজিবকে ‘রক্ষা করা’র প্রয়োজন এল, তখন তারা বিস্ময়করভাবে অকার্যকর হয়ে গেল।

শেখ মুজিবুর রহমান ও সিরাজুল আলম খান যখন পরস্পরবিরোধী চূড়ান্ত বৈরি রাজনৈতিক ধারায় বিভক্ত, তখনও তাদের উভয়ের মধ্যে একটি গোপন সমঝোতা ছিল বলে অভিমত প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন লেখক তাঁর গ্রন্থে। আমি তাঁর সাথে একমত নই। এই অভিমত প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে লেখক মুজিববাহিনীর দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির এক সংগঠক ও পরবর্তীকালে জাসদ ও গণবাহিনীর এক নেতার সমকালীন একটি বইকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন। মূলত বইটি তার নামকরণের কারণেই নির্মোহ ইতিহাসের সূত্র হতে পারে না। কুচক্রীরা সবসময় কুচিন্তার ধারক হয়। এস্টাবলিশমেন্টকে আঁকড়ে ধরার নোংরা প্রতিযোগিতায় কুচক্রীরা অনেককে তাদের মতো করে ফরমায়েসি ইতিহাসের চরিত্র বানিয়ে ফেলে। লেখক এইরূপ জ্ঞানপাপীদের বই নির্মোহ ইতিহাসের উপাদান হিসাবে গ্রহণ করে ঠিক করেননি।

বইটির একটা ঘাটতি দিক সম্পর্কে বলব এবার। যে বিষয় ও সময়কাল নিয়ে লেখক তাঁর চমৎকার রাজনৈতিক সাহিত্যটি সাজালেন, সেই কাল ও বিষয়ের প্রাণপুরুষ মুজিব, সেই সময়কালের অনিবার্য চরিত্র তিনি। সেক্ষেত্রে মুজিবচরিত নিয়ে বইটিতে একটি অধ্যায় রচিত হওয়া বোধ করি বিধেয় ছিল। এই জনপদের এযাবৎ কালের জনপ্রিয় মানুষটি যাঁর যাদুস্পর্শ ডাকে মানুষ সংগ্রামী হল, যাঁর নামে যুদ্ধ করল, জীবন বিলাল অকাতরে, সেই মানুষটি নতুন রাষ্ট্রের নাগরিক প্রাপ্যতা উপলব্ধিতে ঋজুতা হারিয়ে ফেলবেন কেন? কেন রাষ্ট্রটি অসহিষ্ণু হয়ে ধংসের কিনারায় দাঁড়িয়ে যাবে, কেন তিনি পারিপার্শ্বিকতার কাছে আত্মসমর্পিত হয়ে যাবেন, কেন এই বিশাল ব্যক্তিত্বের মানুষটি দেশের নাজুক পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রের দিশা হারালেন? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য ঐ সময়ের মুজিবচরিত বিশ্লেষণ প্রাসঙ্গিক ছিল।

এটা আসলেই কঠিন সত্য যে, আমাদের নির্মোহ ইতিহাস রচনার অনেক উপাদান হারিয়ে গেছে। ইতিহাসের অনেক সূত্র আমাদের ভূ-সীমানার বাইরে, অনেক অনিবার্য সত্য আর তালাশ করেও পাওয়া যাবে না, অনেক বিষয়ই ঝুঁকিপূর্ণও, যা অনেকে বলতে চান না; যারা বলেন তাদের কেউ কেউ আঁকড়ে ধরা অসৎ রাজনীতির বৃত্ত থেকে বলেন, কোনও অপরাধবোধ থেকে তাড়িত হয়ে হয়তো বা কেউ কেউ আবার কিছুই বলেন না, একরাশ বেদনা নিয়ে নির্বাক থেকেই পৃথিবী থেকেই বিদায় নিয়েছেন অনেকে। ইতিহাসের অনেক অনিবার্য চরিত্র কিছুই বলে যাননি, অনেকেই আবার প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের গোপন হিংসার নিষ্ঠুর বলি হয়েছেন। সীমাবব্ধতা সত্ত্বেও লেখক তাঁর গবেষণাকর্মে বিষয়বস্তুর স্বরূপ সন্ধানে ও বিশ্লেষণে যে নির্মোহ গভীরতা দেখিয়েছেন, তা ভবিষ্যতের অনুসন্ধানকারীদের জন্য অনুকরণীয়। এখানেই বইটির অসাধারণত্ব!

 

লেখক পেশায় আইনজীবী; বসবাস করছেন বাংলাদেশের হবিগঞ্জে। প্রকাশিত মতামত তাঁর ব্যক্তিগত। আলোচ্য গ্রন্থের লেখক বা বর্তমান পর্যালোচনার প্রকাশকের মতামতের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই।