Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মৃত পাখিদের গান — ৬ষ্ঠ পর্ব

অবিন সেন

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

দশ

একটা গলি রাস্তায় একটু ফাঁকা জায়গা দেখে গাড়ি পার্ক করতে বলে তন্ময় সামন্ত। আজ আকাশে মেঘ নেই। চড়া রোদে দুপুরটা তেতে আগুন হয়ে আছে। গাড়ির এসি থেকে বাইরে বের হতেই ইচ্ছা করে না। কিন্তু এর পরে তাদের সরু গলিতে ঢুকতে হবে, গাড়ি সেই রাস্তায় ঢুকবে না। প্রবাল, তন্ময় সামন্ত আর প্রবীর পাল গাড়ি থেকে নামল। রেখা দাশের ভাড়া বাড়িতে তাদের আরও মিনিট দশেক সরু অলিগলি দিয়ে হাঁটতে হবে। দু পাশে গায়ে গা ঠেকিয়ে ফ্ল্যাট বাড়ি, তার মাঝখান দিয়ে সরু রাস্তা। দুপুরের রোদ এই রাস্তায় তেমন করে পড়ে না। সরাসরি রোদের তাপ না থাকায়, প্রবালের হাঁটতে খুব একটা কষ্ট হচ্ছিল না।

একটা তিনতলা ফ্ল্যাট বাড়ির একতলার একটা সিঙ্গেল-বেডরুম ছোট্ট ফ্ল্যাট। আধো অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে। তাদের সঙ্গে কোনও কনস্টেবল ছিল না, প্রবীর নিজেই তালা খুলল। ঘরের ভিতরটা অন্ধকার। ভ্যাপসা, একটা ভিজে ভিজে গন্ধ। ঘরের ভিতরে যেন একটা অসুস্থ বাতাস বন্দি হয়ে আছে।

ঘরে ঢুকেই একটু ছোট করে বসার জায়গা। একটা দশ বাই দশ শোবার ঘর। এক চিলতে কিচেন।

সামন্ত গিয়ে বাসার ঘরের একমাত্র জানলাটা খুলে দিল। আলোটাও জ্বেলে দিল। স্বল্প ওয়াটের একটা সিএফএল। ঘরে জিনিসপত্র রাখার একটা মাঝারি আলমারি। কাঠের। চারটে প্লাস্টিকের চেয়ার। একটা প্লাস্টিকের টেবিল।

প্রবাল ঘরের চারপাশটা ভালো করে লক্ষ করে। সামন্ত শোবার ঘরটা খুলে আলো জ্বেলে দেয়। শোবার ঘারে একটা পাঁচ-সাত তক্তপোশ। একপাশে কাপড় জামা রাখার একটা আয়না লাগানো ওয়ার্ডরোব।

সামন্ত বলল,

–স্যার, আজ বিশ দিন হয়ে গেল বিশাখা দত্তর কোনও খোঁজ নেই। সামান্য ক্লুও নেই আমাদের হাতে। এমনকি সে বেঁচে আছে কিনা সেটাই এখনও বোঝা যাচ্ছে না। আপনার কী মনে হয় স্যার?

প্রবাল কিছু ভাবছিল। তাই সে যেন সামন্তর কথাটা ভালো করে অনুধাবন করতে পারেনি। অন্যমনস্কভাবে সে বলল,

–কী বিষয়ে সামন্তবাবু? ক্লু নেই? না সে বেঁচে আছে কি না?

সামন্ত তার স্বভাবসুলভ হাসতে হাসতে বলল,

–দুটোই স্যার।

প্রবাল প্রথমেই তার কথার উত্তর দিল না। সে কাঠের আলমারিটা হাট করে খুলে দিল। আলমারির নিচের তাকে কিছু বই, ম্যাগাজিন, পুরানো খবরের কাগজ, দু একটা খাতা ইত্যাদি। উপরের তাকে দু-চারটে অর্ডিনারি পুতুল। খেলনা। ইত্যাদি।

সে সামন্তর দিকে ফিরে বলল,

–আপনার কি মনে হয় বিশাখা দত্ত এখনও বেঁচে আছে?

–আপনার কি তেমনটা মনে হয় না স্যার?

–প্রবীর আপনার কি মনে হয়?

সামন্ত কিছু বলল না। সে হাসি মুখে প্রবীরের দিকে তাকায়।

প্রবীর একটা ছোট পকেট ডাইরিতে কিছু নোট লিখছিল। বলল,

–হয়ত কোথাও সে গা ঢাকা দিয়ে আছে। রাহুলের সঙ্গে তার সম্পর্ক শেষের দিকে ভালো যাচ্ছিল না। আমাদের কাছে খবর আছে।

প্রবাল গোটা দুই খাতা আর ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসল। খাতাগুলোর উপরেই চোখ রেখে বলল,

–বিশাখা আর বেঁচে নেই।

কথাটা সে যেন সবাইকে চমকে দেবার মতো করে বলল।

সামন্ত বলল,

–কেন স্যার?

–কেন? তা ঠিক এখনই বলার সাময় আসেনি। তবে, আই অ্যাম নট রং।

প্রবাল একটা খাতার পাতা ওলটাতে ওলটাতে তার ভিতরে ডুবে গেল।

প্রবীর বলল,

–তবে কি রাহুলের মৃত্যু আর বিশাখার অন্তর্ধান দুটো বিচ্ছিন্ন ঘটনা?

প্রবাল বোধহয় তার কথাটা ভালো শুনতে পায়নি, সে সেই রুলটানা খাতাটায় মগ্ন হয়ে গিয়েছিল।

প্রবীর বলল,

–যাই আশেপাশের লোকদের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলে আসি।

সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

খাতা থেকে মুখ তুলে প্রবাল বলল,

–সামন্তবাবু, আপনি বলছেন রেখা দাশ আউটডোরে গিয়েছিল। সে পুরো সময় তাদের সঙ্গে ছিল?

–হ্যাঁ, স্যার। কিন্তু পরদিন দুপুরের পরে তাদের ফেরার কথা ছিল। কিন্তু রেখা দাশ একটু আগেই মানে দুপুর বারোটার দিকে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে।তার আর কাজ ছিল না। বামুনগাছি স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে ফিরবে এমনটা এক টেকনিশিয়ানকে সে বলেছিল।

প্রবাল নিজের মনেই বলল,

–ফিরেছিল নিশ্চয়ই, না হলে আর তার ফোন বাবুঘাটের কাছে ট্রেস হবে কী করে। কটার সময় তার ফোন সুইচ অফ হয়?

–তিনটে বেয়াল্লিশ।

–সামন্তবাবু সাড়ে তিনটেকে কি বলবেন? দুপুর না বিকেল?

সামন্ত হাসে। হাসতে হাসতে বলে,

–আমি স্যার, বিকেলই বলব। তিনটের পর হয়ে গেলেই আমি বিকেল বলি।

–তা হলে বিকেলে রেখা দাশের কারও সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল?

–কে সেটা?

–সেটাই তো আপনাদের খুঁজে বার করতে হবে সামন্তবাবু!

প্রবাল মৃদু হাসল। যেন সে সেই রুলটানা খাতাগুলোর ভিতর থেকে কিছু খুঁজে বার করেছে। সে হাসি মুখেই বলল,

–রেখা দাশের লাভার ছিল?

–তা তো জানি না স্যার!

–কী যে করছেন আপনারা! চোখ কান খোলা রাখুন সামন্তবাবু। রেখা দাশের শোবার ঘরটা তো ঘুরে দেখলেন, কিছু পেলেন না?

–কই তেমন তো কিছু পেলাম না!

–কাপড়জামা রাখার আলমারিতে একপাশে কয়েকটা খালি ওষুধের স্ট্রিপ। খালি কন্ডোমের প্যাকেট দেখলেন না!

সামন্ত জিব কাটল!

–এই রে! কিন্তু স্যার, আপনি তো ঘরে ঢোকেননি।

–আমি বইরের আলমারিতে একটা এমন ফাঁকা প্যাকেট পেলাম। তাই অনুমান করলাম আরও কিছু পাওয়া যাবে একইভাবে শোবার ঘরে। জানেন তো মহিলারা তাদের গোপন জিনিস অনেক সময় লুকিয়ে রাখে কাপড়-জামার আড়ালে? আপনার গিন্নি রাখেন না?

সামন্ত যেন অনেকটা ম্যাড়ম্যাড়ে ভাবে হাসল। দু হাতের চেটোটা উল্টে বলল,

–কী জানি স্যার। আমার তো আলমারিতে হাত দেওয়াই বারণ। আমি নাকি সব সাজানো জিনিস এলোমেলো করে ফেলি। বলুন তো স্যার এর কোনও উত্তর হয়? আমি সেই কারণে আলমারিই খুলি না।

প্রবাল তার কথার ভঙ্গিতে শব্দ করে হেসে উঠল। কিছুক্ষণ যেন সে হাসিটা উপভোগ করল। হাসি থামলে বলল,

–কিন্তু, কথা হচ্ছে, লাভার কি তার একজন? না একাধিক?

–কেন স্যার, কিছু বুঝতে পারছেন?

–পারছি, আবার পারছিও না।

সে আবার খাতার মধ্যে ডুবে গেল।

–আপনি স্যার এমন হেঁয়ালি করেন না!

প্রবীর তখন ঘরে ঢুকছিল। সামন্তবাবুর হেঁয়ালি শব্দটা বোধহয় সে শুনতে পেয়েছে। সে বলল,

–কিসের হেঁয়ালি সামন্তদা?

সামন্তবাবু কিছু বলার আগেই প্রবাল বলল,

–নতুন কিছু খবর পেলেন?

–রেখা দাশের ঘরে বেশ কয়েকজন পুরুষ মানুষের আনাগোনা ছিল।

–সে আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কারা কারা? তাদের সবাইকেই কিন্তু জেরা কারা দরকার। সামন্তবাবু চর লাগিয়ে দিন। আর রেখা দাশের লাস্ট দু-মাসের ফোন কলের লিস্ট আনানোর ব্যবস্থা করুন।

–ওকে স্যার। আর কিছু?

সে সামন্তর কথার উত্তর দেয় না। চেয়ার থেকে উঠে একটা সিগারেট ধরায়। জানালার কাছে গিয়ে বলে,

–প্রবীরবাবু আপনি স্টুডিওপাড়ায় রেখার পরিচিত সবাইকে একবার ফর্মালি জেরা করুন। এবং সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। এবং কে কী বলল, সেটা দরকারি হোক, অদরকারি হোক, সবকিছু ডিটেলে লিখে তার সঙ্গে আপনার নিজের ওপিনিয়ন লিখে আমার কাছে পাঠাবেন।

তার পরে যেন অনেকটা যেন আপন মনে বলে,

–রেখা দাশের হত্যার বীজ বেশ কিছুদিন আগেই পোঁতা হয়েছে।

প্রবীর তার কথাটা শুনতে পেয়েছে। যেন অবাক হয়েছে এমনভাবে বলল,

–হত্যা?

প্রবাল একটানে অনেকটা ধোঁয়া টেনে নিয়ে বলল,

–হ্যাঁ। রেখা দাশের আর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই।

ঘরে কেউ কোনও কথা বলছিল না। প্রবাল শান্তভাবে আরও দু-তিনটে টান দিয়ে নেয়। তার পরে সহসা যেন সে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এমন ভঙ্গিমায় বলে,

–এখনই একবার রাহুল বৈদ্যর বাড়ি চলুন। বিশাখা দত্তর ঘরটা আমাকে একবার দেখতে হবে। এখানে আমার আর দেখার কিছু নেই। সে কয়েকটা খবরের কাগজ আর সেই রুলটানা খাতা দুটো বগলদাবা করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।

রাহুল বৈদ্যর বাড়ি দূরে নয়। তারা যখন পৌঁছল তখন বিকেল প্রায় ঢলে পড়েছে। তবু বাতাস ভীষণ তেতে আছে। আর দারুণ হিউমিড। রাত্রে হয়ত বৃষ্টি হবে। প্রবাল ভাবল। প্রবাল একটা জিনিস মিলিয়ে দেখে অবাক হচ্ছে, রাহুল বৈদ্য যেদিন খুন হয় সেদিন বৃষ্টি, আবার রেখা দাশ যেদিন নিখোঁজ হয় সেদিনও বৃষ্টি। এ সব কি কাকতালীয়! তার ঠিক মালুম হচ্ছে না।

প্রবাল জিজ্ঞাসা করল,

–আচ্ছা. সামন্তবাবু, কাকতালীয় মানে জানেন?

–তা আর জানি না, গাছে কাক বসল আর ধপাস করে তাল পড়ল।

তিনজনেই হো হো করে হেসে উঠল।

বাড়িতে বলাইবাবু ছিল না। কাজের মাসি ছিল। প্রবাল বলল,

–আপনারা উপরে যান।

কথাটা বলে সে কাজের মাসির সঙ্গে ভিতরে গিয়ে কিছু কথা বলে এল।

বিশাখার ঘরের আলোর ডিজাইন দারুণ। সারা ঘরে দারুণ এক অ্যাম্বিয়েন্স রচিত হয়। প্রবাল গিয়ে প্রথমেই কাপড়-জামা রাখার ওয়ার্ডরোব খুলে সেটার সামানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। তাকিয়ে থাকল তো তাকিয়েই থাকল। কী যে খুঁজতে চাইছে তা তার মনে পড়ছে না। অথচ মনে পড়ার কথা ছিল। সেদিন যখন সে এসেছিল তখন সে সেটা দেখেছে, কিন্তু ঠিক খেয়াল করেনি। তার পরে একটা একটা করে কাপড় জামা সে সরিয়ে খুঁজতে থাকল। খুব পরিপাটি তার খোঁজা। ধীর স্থির। কোথাও যেন তার কোনও ত্বরা নেই। কাপড়চোপড় সরাতে সরাতে একটা চোরাকুঠুরি সে দেখতে পায়। সেটাতে কোনও চাবি ছিল না। কিন্তু এমনভাবে কাঠের দেওয়ালের সঙ্গে সেটা ক্যামোফ্লাজ করে রাখা, যে সহজে কারও চোখে পড়বে না। তার পরে সেটার সামনে সে কয়েক মুহূর্ত চুপ কারে দাঁড়িয়ে থাকল। হাতের আন্দাজে সেটার উপরে চাপ দিল সে।

–বাহঃ।

মুখ দিয়ে সে স্বস্তির আওয়াজ করে।

সেই কুঠুরিটা খুলে গিয়েছে। সেটা বেশি বড় না। বেশ কিছু সোনার গহনার সঙ্গে একটা ছবির অ্যালবাম সে দেখতে পায়। অ্যালবামটা বার করে সে উল্টেপাল্টে দেখে। গোটা চল্লিশেক ছবি তাতে। বিশাখার নিজের ছবি। ফ্যামিলির ছবি। বন্ধুবান্ধবদের ছবি। না সেটাতে সে রাহুল বৈদ্যর কোনও ছবি দেখতে পায় না। ছবির অ্যালবামটা হাতে নিয়ে সে সামন্তর দিকে ঘুরে বলে,

–সামন্তবাবু এটা আমি রাখছি। পরে ফেরত পাবেন। চলুন। আর কিছু দেখার নেই।

সে ঘর থেকে বেরিয়ে হন হন করে নিচে নেমে যায়।

সামন্ত আর প্রবীর যেন হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে থাকে।

 

এগারো

কয়েকদিন বেশ ভালো ঘুম হল অর্কর। ভালো ঘুমের ফলে অফিসেও কাজ করে বিন্দাস শান্তি পেয়েছে সে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে বই নিয়ে বসে পড়ার চেষ্টা করেছে। একটু যেন মন বসাতে পেরেছে বইয়ের পাতায়। এর মধ্যে দু দিন তার আর রুচিরার কথা হয়েছে। রুচিরাকে সে শুকনো আশার কথা ছাড়া আর কিছুই শোনাতে পারেনি। রেখা দাশের বিষয়ে কথা শেষ হয়ে যেতেই অর্কর যেন কথা ফুরিয়ে যায়। সে আর কী বলবে সেই বিষয়ে যেন ভেবে ভেবে কুলকিনারা পায় না। ফলে তাদের কথা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। ফোন রাখার পরে তার মাথার ভিতরটা এক শান্ত খুশিতে ভরে থাকে। সে বইটা হাতে নিয়ে কয়েক পাতা এমনি পড়ে যায়। কী যে সে পড়ে তা তার মনে থাকে না।

দুপুরে কোনও রোদ নেই আকাশে। আকাশ ঘন মেঘে ছেয়ে আছে। যে কোনও সময় বৃষ্টি নামতে পারে। অধীর গাঙ্গুলি আর অর্ককে চেনা যাচ্ছে না। দু জনেই ছদ্মবেশে আছে। সঙ্গে অ্যাকশন স্কোয়াডের দুজন সাব ইনস্পেক্টর। সিভিল ড্রেসে।

নিমতলা গঙ্গার ঘাট থেকে কিছুটা তফাতে একটা ডিঙি নৌকার ছইয়ের ভিতরে নিজেদের প্রায় আড়াল করে বসে আছে অর্ক আর অধীর। দুজনের পরনেই জেলে মাঝিদের পোশাক। অর্ক একবার তার গ্লক ১৭ পিস্তলটা বার করে দেখে নিয়ে আবার কোমরের কাছে গুঁজে রাখল। অধীরের মুখের রেখা দৃঢ় আর কঠিন। আজ একটা এসপার ওসপার হয়ে যাবে। সাব ইনস্পেক্টর দুজন গঙ্গার পাড়ে বায়ুসেবনকারীদের মতো বসে আছে।

অর্ক মনে মনে প্রার্থনা করছিল, বৃষ্টি যেন না আসে। বৃষ্টি এসে গেলেই সমস্ত প্ল্যান হয়ত ব্যর্থ হয়ে যাবে।

বেশ অনেকক্ষণ তারা বসে আছে। আকাশে মেঘ আরও ঘন হয়েছে। থম থম করছে যেন চারপাশ। অর্কর অধৈর্য লাগছিল। তবে কি আসবে না? খবর কি তবে ভুল ছিল!

অধীর যেন অর্কর মনের ভাব বুঝতে পারে। ফিস ফিস করে বলে,

–খবর একেবারে পাকা স্যার।

সহসা মাঝগঙ্গায় একটা কালো মতন বিন্দু ক্রমশ তাদের চোখের দৃষ্টির সামনে বড় হতে হতে একটা ডিঙি নৌকার চেহারা নিয়েছে।

অধীর ফিস ফিস করে বলে,

–ওই দেখুন স্যার।

নৌকাটা ক্রমশ পাড়ের দিকে এগিয়ে আসছে। সবার কানেই ব্ল-টুথ হেডসেট। অর্ক সতর্ক করে দেয় পাড়ে বসে থাকা দু-জনকে।

দূরের নৌকাটির কিন্তু আসার কোনও ত্বরা নেই। সে তার নিজের খেয়ালে আসছে।

আরও কিছুটা কাছে চলে এসেছে সেটি। হঠাৎ জলে ঝুপ করে কিছু একটা যেন পড়ার শব্দ। অর্কর মনে হল কেউ যেন জলে লাফিয়ে পড়ল। এমনটা তারা আশা করেনি। তবে কি তাদের এই অপেক্ষা করে থাকার খবর লিক হয়ে গিয়েছে! অর্ক বুঝতে পারছে জলে যে লাফিয়ে পড়েছে তাকে আর ধরা যাবে না। সে হাতের বাইরে বেরিয়ে গেল।

অর্ককে কিছু বালার সুযোগ না দিয়ে, সতর্কভাবে যাতে শব্দ না হয় তেমন নিশ্চুপভাবে জলে নেমে পড়েছে অধীর গাঙ্গুলি। নেমেই ডুব সাঁতার।

ওদিকে অর্ক দেখল নৌকাটা এবার একটু দ্রুত এগিয়ে আসছে। এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, নৌকাতে মাত্র একজনই আছে।

তখনি বৃষ্টি নামল তোড়ে। চারপাশ যেন বৃষ্টিতে অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। সামনের জিনিসও ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। অধীর কি এখনও ডুব সাঁতার দিচ্ছে? অর্ক বুঝতে পারল না। গঙ্গার বুকে এখন কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।

কিন্তু আসল লোক কি হাতছাড়া হয়ে গেল! অর্ক ঠিক বুঝতে পারছে না। নৌকা বেয়ে আসছিল বছর ত্রিশের এক যুবক। অর্ক যেন ঝাপসা ঝাপসা বুঝতে পারছে।

নৌকাটা ঘাটের কাছে আসতে আরও এক যুবক ঘাটের কাছে এসে দাঁড়ায়। তাকে নৌকা বাঁধতে সাহায্য করার জন্য সে যেন এগিয়ে যাচ্ছে।

অর্ক তার নিজের পিস্তল হাতে নিয়ে নিয়েছে। ঘাটের দু-জনও নিজের নিজের পজিশনে। অর্ক এক মুহূর্ত অপেক্ষা করতে বলল ইশারায়। চারপাশে ঘনায়মান বৃষ্টির অন্ধকার। বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই যেন।

নৌকার ছেলেটি লাফিয়ে নামল। গঙ্গার পারের কাদায় তার পা দেবে যাচ্ছে। পাড়ের যুবকটি তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা কেউই বৃষ্টি থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে না। বৃষ্টিতে ভেজার একটা বিলাসিতা তাদের যেন ত্বরাহীন করে রেখেছে। পাশের দুজন সাব ইনস্পেক্টর তাদের ছাউনি থেকে বেরিয়ে পাড়ের দিকে নামল। তাদের দুজনের হাতেই উদ্যত রিভলভার। এদিকে অর্কও নৌকার ছইয়ের ভিতর থেকে বেরিয়ে লাফ দিয়ে পাড়ে নামল।

চোখের নিমেষে নৌকার আরোহী যুবকটি বৃষ্টির মধ্যে কাদায় শুয়ে পড়ে জলের দিকে গড়িয়ে যাবার চেষ্টা করল। দ্রুত একটা ফায়ার করে অর্ক। সেটা মনে হয় মিস হয়েছে। যুবকটি প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্যোগ করেছে অর্কর পিস্তলের গুলি তাকে পেড়ে ফেলেছে। পাড়ে দাঁড়ানো ছেলেটি নিমেষে তার পিস্তল তুলে ফায়ার করেই দৌড় দিয়েছে। অর্ক বসে পড়েছিল। ছেলেটি ভালো দৌড়াতে পারছিল না, কাদায় তার পা দেবে যাচ্ছিল।  তার পিছনে পুলিশ দুজন দৌড়ায়। বৃষ্টিতে কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না ভালো। হঠাৎ দৌড়-রত ছেলেটি গঙ্গার পাড়ে লুটিয়ে পড়ল। পুলিশ দুজন তো ফায়ার করেনি। তারা যেন ঠিক বুঝতে পারল না। তারা তার দিকে দৌড়ে গেল।

অর্ক কাদায় পাঁকে পড়ে থাকা ছেলেটির কাছে গিয়ে দেখল, ছেলেটি নিস্পন্দ। বৃষ্টিতে তার গা থাকে কাদা ধুয়ে যাচ্ছে। তার পিঠের কাদার সঙ্গে ধুয়ে যাচ্ছে রক্ত।

বৃষ্টির বেগ একটু যেন কমেছে। সেই সঙ্গে আকাশ একটু পরিষ্কার হয়ে চারপাশের ঝাপসা ভাবটাকে সরিয়ে আলো একটু ফর্সা হয়েছে। সেই আলোয় অর্ক দেখল ছেলেটির পিঠে একটা বুলেটের ক্ষত। অর্ক অবাক হয়ে যায়। তার একটা গুলি তো ছেলেটির পায়ে লাগার কথা, আর একটা গুলি মিস হয়েছে, সে নিশ্চিত। অর্ক ভালো করে দেখল, হ্যাঁ ঠিক ছেলেটির পায়ে একটা গুলি লেগেছে। তার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত যেন নামতে থাকে। সে স্বাভাবিক প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় পাড়ের দিকে তাকায়। শক্ত হাতে পিস্তলটা ধরে। সে নিশ্চিত ছেলেটির পিঠে লাগা গুলিটা পাড়ের দিক থেকে চলেছে। নিঃশব্দে। অর্ক সতর্ক হয়ে যায়। তার দু-চোখ পাড়ের দিকটা তন্ন তন্ন করে অন্বেষণ করে। একটা ঠান্ডা ভয়ের অনুভব তার ভিতরে খেলে যায়। সে বুঝতে পারে আর একটা বুলেট যে কোনও মুহূর্তে ছুটে এসে সম্পূর্ণ অরক্ষিত তাকে পেড়ে ফেলতে পারে।

ওদিকে পুলিশ দুজন নিস্পন্দ পড়ে থাকা ছেলেটির কাছে গিয়ে দেখে তার পিঠে গুলি লেগেছে। একজন তার নাকের কাছের আঙুল নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করে। না, ছেলেটির নিশ্বাস পড়ছে না। সে মৃত। সে খবর ফোনে অর্ককে জানিয়ে দেয় সে।

অধীর গাঙ্গুলি সেই সাঁতারুর কোনও নাগাল পায়নি। বৃষ্টির মধ্যে দুহাত সামনের জিনিসও দেখা যাচ্ছিল না। ফলে তাকে ব্যর্থ হয়েই ফিরে আসতে হয়েছে। সে পাড়ে এসে অর্কর পাশে দাঁড়াল। সে কন্ট্রোল রুমে ফোন করে গাড়ি আর কনস্টেবল পাঠাতে বলল।

অধীর লাফিয়ে ছেলেটির সেই নৌকায় গিয়ে উঠল।

মৃত ছেলেটির পিস্তলটা একটু দূরে কাদায় পড়ে ছিল। অর্ক পিস্তলটা কুড়িয়ে নেয়। এতক্ষণ পরে তার ঠোটের কোনে একটু হাসি দেখা দেয়। এ সেই চোরাচালানের পিস্তল।

নৌকার ছইয়ের ভিতর থেকে অধীর ডাকে,

–স্যার।

অর্ক তার দিকে তাকায়।

ছইয়ের ভিতর থেকে অধীর একটা প্যাকেট উঁচু করে তুলে দেখায়। তার পরে সেটা হাতে নিয়ে নৌকা থেকে নেমে এসে অর্কর কাছে আসে।

–এতে স্যার আরও দুটো পিস্তল আছে। আর তো কিছুই পেলাম না নৌকায়।

অর্ক বলল,

–অধীর বুঝতে পারছেন তো, কেন এবারে এই সামান্য ফোর্স নিয়ে রেড করতে চাইলাম।

–হ্যাঁ স্যার। আমাদের আজকের রেডের খবর আগে থেকে লিক করেনি। তা যদি হত তা হলে আজকে এরা আমাদের ফাঁদে পা দিত না।

–কিন্তু এদের সাবধানী ব্যবস্থাটা দেখলেন তো! দুটো লাশ আর চারটে পিস্তল ছাড়া কিছুই পাওয়া গেল না।

বডিগুলোর যথাযথ ব্যবস্থা করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে অর্কর রাত হল। ছেলে দুটির কাছ থেকে কয়েকটি কাগজপত্র, তিনটি মোবাইল ফোন পাওয়া গিয়েছে। সেগুলো নিয়ে অর্ক পরদিন ভাববে। অর্কর বেশ হালকা লাগছিল। একটা ফাঁড়া কি কেটে গেল তার! যেভাবে সে অরক্ষিত হয়ে পড়েছিল তাতে যে কোনও সময়ে বধ হয়ে যেতে পারত। তবে এই সব ক্ষেত্রে এরা পুলিশের উপর সহজে গুলি চালায় না। এটুকুই নিশ্চিন্ত করে তাকে।

অর্ক যেন বুঝতে পারছে, তারা ঠিক ডিরেকশানেই এগোচ্ছে। সেই ভাবনাটা তাকে শান্তি দিচ্ছিল।

 

(ক্রমশ)