বিষাণ বসু
চলে গেলেন শিল্পী রবীন মণ্ডল। না, অকালে নয়। নব্বই পার করেছিলেন। তবু, আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। কেননা, আপাত প্রাণচাঞ্চল্যে কোনও ছেদ লক্ষ্য করা যায়নি। গতমাসেও ছবি এঁকেছেন। বয়সের কিছু অসুস্থতা সত্ত্বেও, শেষ দিনসাতেক হাসপাতালে থাকা বাদে, ছবি আঁকায় ফাঁক পড়েনি।
আর্ট কলেজের ডিগ্রী ছাড়াই দেশের প্রথমসারির শিল্পীদের মধ্যে জায়গা করে নেওয়া, অথবা ক্যালকাটা পেইন্টার্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে শিল্প-আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা, সেইসব নিয়ে পরবর্তীতে শিল্প-সমালোচক পণ্ডিতেরা বিস্তর আলোচনা নিশ্চয়ই করবেন।
আমাদের মতো আমজনতা শুধু এইটুকুই বলতে পারে, একদম নিজস্ব একটি শিল্পরীতি ও শিল্পভাষা তৈরী করতে পেরেছিলেন রবীনবাবু, যা খুব সহজ কাজ নয়। প্রথাগত শিল্পশিক্ষা ছাড়া এই অর্জন বিস্ময়কর।
নাকি, প্রথাগত শিল্পশিক্ষা ছিল না বলেই সম্ভব হয়েছিল এই অনুভব এবং তার প্রকাশ? আলবার্ট আইনস্টাইন যেমন বলেছিলেন, “Education is what remains after one has forgotten what one has learned in school.” শিল্পবিদ্যালয়ের শিক্ষার সুযোগ তেমনভাবে ঘটেনি বলেই তাঁর সেই শিক্ষা ভুলে গিয়ে, অথবা সেই শিক্ষা অতিক্রম করে সৃজনের প্রয়োজন ঘটেনি।
একদিন নিছক আড্ডার মুহূর্তে সমকালীন বিভিন্ন শিল্পী বিষয়ে হিরণদার, শিল্পী হিরণ মিত্রের মতামত শুনতে চাইছিলাম। রবীনবাবুর শিল্পকৃতি নিয়ে ওনার বক্তব্যটি খুব যথার্থ বলে মনে হয়েছিল। হিরণদা বলেছিলেন, দ্যাখো, রবীনদা আর্ট কলেজ থেকে আঁকা শিখলে এই ছবি আঁকতে পারতেন না। যে জায়গাটায় উনি reach করতে চাইছেন, তার জন্যে এই সমানে লেগে থাকা, continuous effort, এইটা সম্ভব হত না। হ্যাঁ, আর্ট কলেজে পড়লে কি রবীনদা ছবি আঁকতেন না? অবশ্যই আঁকতেন। কিন্তু, সে হয়ত অন্য ছবি।
সমকালীন শিল্পজগৎ, শিল্পের বাজার, শিল্পীর স্বীকৃতিতে বাজারের ভূমিকাটি মাথায় রাখলে রবীনবাবুর শিল্প বিষয়ে হিরণ মিত্রের মন্তব্যটির গুরুত্ব আরো বেশী করে অনুভব করা যায়। এই সময়ে, শিল্পীর ছবি বিক্রির, অথবা ছবির দামের সাথে শিল্পীর স্বীকৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। জীবনের বেশীর ভাগ সময় জুড়েই রবীন মণ্ডলের ছবির বাজার ছিল না তেমনভাবে। গ্যালারির সুনজর বা সর্বভারতীয় তথা সদবি-ক্রিস্টি-র নীলামে ছবি বিক্রি হওয়া – এসবই এসেছে শেষের দিকে।
সমসাময়িক শিল্পীবন্ধুদের ছবির চাহিদা-বিক্কিরি দেখে ঈর্ষা বা হতাশা কি গ্রাস করেনি তাঁকে? কখনোই? অন্তত, নিজের বেছে নেওয়া পথ, একান্ত নিজস্ব শিল্পদর্শনের যাথার্থ্য কি কখনোই প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়েনি? নিজের কাছেই?
কলকাতারই একটি গ্যালারিতে, গতবছরে, আয়োজিত একটি একক প্রদর্শনীতে দাঁড়িয়ে রবীনবাবু বলছিলেন, রবি ঠাকুরের ওই গানখানা আছেনা, যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়ব না,ওইটা, ওইটাই আমার মূলমন্ত্র। নতুন শিল্পীদের উদ্দেশ্যেও ওইটাই বলার। ছাড়বে না। ধরে থাকবে। একদিন না একদিন হবে, হবেই।
এই একাগ্রতা, নিষ্ঠা, পারিপার্শ্বিক রণ-রক্ত-সফলতার বিপ্রতীপে হেঁটে একান্ত নিজস্ব চলন নিয়েই শিল্পী রবীন মণ্ডলের জার্নি। না, পুরোটা ঠিক বলা হল না হয়ত। কেননা, দেশভাগ, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ যাঁকে গভীরভাবে বিচলিত করেছিল, যিনি শুধু শিল্পী হয়ে নয়, সমাজসচেতন মানুষ হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যও ছিলেন, শেষ কয়েক দশক জুড়ে যিনি কেবলই এঁকে গিয়েছেন মানুষের মুখ, ভেঙেচুরে যাওয়া মানুষের মুখ, যাঁর কিং সিরিজের রাজা ক্ষমতার আশ্রয়ে বসে থাকা একজন জীর্ণ মানুষ – তিনি তো সমাজবিমুখ নন। তবে, আর্থিক সাফল্যের সরল পথ তিনি আঁকড়ে ধরতে চাননি, এইটুকু সত্যি অনস্বীকার্য।
শিল্পী হিসেবে তাঁর মূল্যায়ন ভাবীকাল করবে নিশ্চয়ই।
সমকালীন শিল্পীদের একাংশ তো বটেই, জুনিয়রদের একাংশও আড়ালে-আবডালে তাঁকে নিয়ে উপহাস করেছেন। শিল্পের জগতে একটা এলিটিজম রয়েছে। আর্ট কলেজের বাইরে থেকে আসায় তিনি অনিবার্য আউটসাইডার। এর সাথে, তাঁর ছবিতে কারিগরি দক্ষতা দেখানোর প্রচেষ্টা ছিল, হয়ত সচেতনভাবেই, অনুপস্থিত। কিন্তু, সম্পূর্ণ নিজস্ব এক শিল্পরীতির যে উত্তরাধিকার রবীন মণ্ডল রেখে গেলেন, তা নিয়ে বিস্তারিত চর্চা অনিবার্য।
পাশাপাশি, মানুষ রবীন মণ্ডলের সংস্পর্শে যাঁরা এতটুকুও এসেছেন, তাঁরা জানেন, এমন মানুষ বিরল। নিজের একক প্রদর্শনীতে এককোণে কুণ্ঠিত দাঁড়িয়ে থাকা রোগা মানুষটি, ক্যাটালগের উপরে সই করে দিতে বললে সবসময়েই বাড়তি পাওনা হত অনবদ্য কিছু ড্রয়িং, সামান্য আমন্ত্রণেই যেকোনো প্রদর্শনীতেই হাজির হয়ে যাওয়া, গিয়ে আবারও হইচই থেকে দূরে থাকা – এমন নিরহঙ্কার ও প্রচারবিমুখ শিল্পী খুব কমই দেখা যায়। বিশেষত, শিল্পজগতের সাথে যাঁরা একটুও পরিচিত, তাঁরা বুঝবেন, এমন আচরণ ঠিক কতখানি ব্যতিক্রমী।
সবমিলিয়ে, মানুষ এবং শিল্পী, দুই হিসেবেই (নাকি এই দুইয়ের মধ্যে নিবিড় বন্ধন অনিবার্য?) রবীন মণ্ডল ব্যতিক্রমী। এক হারিয়ে যাওয়া সময়ের শেষ প্রতিনিধিদের মধ্যে একজন। সমাজসচেতন কিন্তু নিভৃতচারী, চর্যা ও চর্চায় একনিষ্ঠ, নির্লোভ ও নির্মোহ।
আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ও প্রচার এখন সাফল্যের অনিবার্য মাপকাঠি। পুরোনো আদর্শের সেই দিন হারিয়ে গিয়েছে। বাতিলও হয়েছে, সম্ভবত। রবীন মণ্ডলও হারিয়ে গেলেন। তাঁর আঁকা ছবিগুলো রইল। নিরন্তর দৌড়ের শেষে, একটু ভাবার অবকাশ পেলে, আমরা, হয়ত, দাঁড়াব সেই ছবির সামনেই।