তৃষ্ণিকা ভৌমিক
ভারতবর্ষের মধ্যে অনেকগুলো পৃথক পৃথক ভারতবর্ষ আছে। একটা ভারতবর্ষ যখন রজঃচক্র নিয়ে সামাজিক কুসংস্কার, লোকলজ্জা আর মান্ধাতার আমলের মানসিকতার চিত্রটা বদলাতে চেয়ে লড়ছে, লড়াইয়ের জন্য খবরের শিরোনামে উঠে আসছে; আরেকটা ভারতবর্ষ তখন লাইমলাইটের দুনিয়া থেকে অনেক দূরে দুবেলা, দু মুঠো খাবারের জোগান বজায় রাখার তাগিদে বাধ্য হচ্ছে সমাজে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা রীতিনীতিকে আঁকড়ে কয়েক হাজার বছর পিছিয়ে যেতে। জীবনের তাগিদেই জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে। এই বছরেরই এপ্রিল মাস নাগাদ হিন্দু বিজনেস লাইনের রিপোর্টে এক ভয়ঙ্কর তথ্য উঠে আসে। মহারাষ্ট্রের বির জেলার আখ খেতের কর্মরত শ্রমিক মেয়েরা জীবিকা নির্বাহের জন্য নিজেদের জরায়ু কেটে বাদ দিয়ে দিচ্ছে। এই জেলার অধিকাংশ নারীই জরায়ু-হীন। অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যাওয়া এবং তারপর দুই বা তিন সন্তানের জন্ম দেবার পরই ২৪/২৫ বছরের মেয়েরা হিস্টেরেক্টমি এবং উফেরেক্টমির মাধ্যমে জরায়ু এবং ডিম্বাশয় উভয়ই বাদ দিয়ে দেয়। কারণ সেই রজঃচক্র। তবে রজঃচক্র নিয়ে এক্ষেত্রে ছুৎমার্গটা এখানে অন্য। এই সময় পেটে ব্যাথা, পেশিতে টান কিম্বা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে মেয়েরা অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়ে পরে, তাই অনান্যদিনের মত একই পরিমাণ শ্রম দিতে পারে না। তাই ক্ষতি হয় চিনি শিল্পের।
এবার একটু পরিসংখ্যানের দিকে দেখা যাক। প্রতি বছর অক্টোবর থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে ভারতবর্ষ ৩২.১১ মিলিয়ন টন চিনি উৎপাদন করে ব্রাজিলের পরেই চিনি উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় দেশ হিসেবে চিহ্নিত। এবং এই চিনি তৈরি হয় আখ থেকে। আখ উৎপাদনেও ভারতবর্ষ বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলির মধ্যে একটি। ইন্ডিয়ান সুগার মিল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী ২০১৭-১৮ বর্ষের তুলনায় ২০১৮-১৯ এ চিনি উৎপাদন ৩২ বিলিয়ন টন বৃদ্ধি পেয়েছে। এবং এই শিল্পের থেকে হাজার কোটি কোটি টাকা লাভ হলেও এই শিল্পের সাথে জড়িত কৃষক, শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনাটুকু পায় না। সরকারিভাবে নূন্যতম দাম বেঁধে দেবার ফলে কৃষকরা খানিক উপকৃত হলেওসংগঠিত না হবার দরুণ আখ কাটবার জন্য নিযুক্ত শ্রমিকরা বছরের পর বছর শোষিত হয়ে চলেছে।
বছরে মাত্র ছ’মাসের এই কাজের থেকে উপার্জিত অর্থেই তাদের সংসার চালাতে হয়, অন্য কোনও উপার্জনের রাস্তা না থাকার জন্য। মজার ব্যাপার হল সংখ্যায় প্রায় ৫০,০০০ (রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী) এই আখ-শ্রমিকরা স্বামী-স্ত্রী একটি একক হিসেবে মজুরি পান। অথচ প্রতিদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয় দুজনকেই। দুজনের একজন কোনও কারণে একদিন কাজ না করলে ৫০০ টাকা ফাইন হিসেবে কাটে ঠিকাদারেরা, যেখানে দৈনিক মজুরি ২৫০ টাকা মাত্র। এই জরায়ু এবং ডিম্বাশয় বাদ দেবার জন্য ঠিকাদারেরাই মেয়েদের বাধ্য করেন। দিন দিন খারাপ হতে থাকা ভারতবর্ষের এই গ্রামীণ অঞ্চলগুলোর অধিকাংশতেই স্বাভাবিকভাবে নূন্যতম খরচে এই অপারেশন করাবার ব্যবস্থা না থাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৩৫০০০টাকা দিয়ে এই অপারেশন করাতে হয়। ঠিকাদারেরাই অনেক সময় এই টাকা ধার হিসেবে দিয়ে মজুরির থেকে কেটে নেয়। শ্রমিকদের ভাগ্যে অবশিষ্ট যা পড়ে থাকে, তা বছরের খরচ চালানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
বিশ্বের ১৯৫টা দেশের মধ্যে স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ১৪৫তম দেশ। সদ্য প্রকাশিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে খরচ কমেছে আরও খানিক। ফলে, ভারতীয়দের স্বাস্থ্যের গড়পড়তা অবস্থা সম্পর্কে অনুমান করতে অসুবিধা হবার কথা নয়। ২০১৪ সালে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ভারতবর্ষের ৭৮% নারী শ্রমিক পিঠে ব্যথা, ওবেসিটি, অবসাদ, ডায়েবেটিস, হাইপার টেনশন, হৃদরোগসহ বিভিন্ন সমস্যায় ভোগেন। এর সাথে যদি হিস্টেরেক্টমি এবং উফেরেক্টমির মত অপারেশন (এবং সেটাও যথেষ্ট পরিমাণ বিশ্রাম এবং যত্ন ছাড়া) যোগ করা যায়, একটা ভয়ঙ্কর চিত্র উঠে আসে। এই গণ হারে হিস্টেরেক্টমির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া? তার একটা সুদীর্ঘ তালিকা আছে। প্রথমত, এই সার্জারি সঠিক চিকিৎসক এবং প্রতিষ্ঠানে না করানোর ফলে জরায়ু সংলগ্ন অনান্য অঙ্গের ক্ষতি হতে পারে। মূত্রনালী সংক্রমণ, পেশিতে টান, অনিদ্রা, গাঁটে ব্যথা, অবসাদ, উদ্বেগ জনিত মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। অল্প বয়সেই যারা এই সার্জারি করতে বাধ্য হচ্ছে, তারা এই সমস্ত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াজনিত শারীরিক ও মানসিক সমস্যা সারাজীবন ধরে বয়ে নিয়ে বেড়ায়। এর সামাজিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াটি ভুলে গেলে চলে না। যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ সন্তান উৎপাদন ক্ষমতার মাপকাঠিতে নারীদের মাপে সেখানে জরায়ু এবং ডিম্বাশয় বাদ দেবার পর মেয়েদেরকে যে সামাজিক প্রতিকূলতা সহ্য করতে হয় ঘরে, বাইরে তা যথেষ্ট যন্ত্রণাদায়ক। যদি সবক্ষেত্রে সামাজিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয় না ধরে নিই তারপরে ব্যক্তিমানুষটি থেকে যায়। যে নিজেকে এই সমাজের চোখ দিয়েই দেখতে শিখেছে। জীবন ও জীবিকা নির্বাহের তাগিদে এই পদক্ষেপ নেবার সান্তনা থাকলেও তীব্র মানসিক অবসাদ সঙ্গী হয়ে যায়।সাথে ডিম্বাশয় বাদ দেবার ফলে মেয়েদের অস্টিওপরেসিস অর্থাৎ হাড় ক্ষয়ে যাবার হার তীব্র হারে বৃদ্ধি পায়। যা আদতে তাদের কর্মজীবনকে সঙ্কুচিত করে।
আখ ক্ষেতের নারী শ্রমিকদের মধ্যে হিস্টেরেক্টমির পরিসংখ্যান দেখলে তামিলনাড়ু কিংবা অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের থেকে কিছু পিছিয়ে নেই। আমেরিকার ন্যাশানাল লাইব্রেরি অফ মেডিসিনের সমীক্ষা অনুযায়ী ৪০ বছরের নীচে অন্ধ্রপ্রদেশের ৪২ শতাংশ এবং তামিলনাড়ুর ৪৭ শতাংশ নারী এই সার্জারি করিয়েছে। রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী তামিলনাড়ুর বস্ত্র শিল্পের কারাখানাগুলিতে যেখানে শ্রমিকদের অধিকাংশই নারী, রজঃচক্র চলাকালীন মেয়েদের পেট ব্যথা কিংবা অনান্য শারীরিক সমস্যা এড়ানোর জন্য নাম না জানা এক ধরণের ওষুধ সেবন করতে বাধ্য করা হয়। তার ফলে তাদের মধ্যে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা দেখা যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক থেকে জাতীয় স্তরে রজঃচক্র নিয়ে প্রচলিত মানসিকতার বিরুদ্ধে যেখানে আওয়াজ উঠছে, আন্দোলন হচ্ছে রজ:চক্র চলাকালীন নারীকে অপবিত্র বলে অছ্যুৎ করে রাখার প্রাচীন এবং সংকীর্ণ প্রবণতাকে গুঁড়িয়ে ফেলতে, সেখানে মুনাফা বাড়াবার জন্য মালিক শ্রেণি তার নিত্য নতুন শোষণের পদ্ধতিতে নতুন পালক জুড়েছে অলিখিতভাবে এই হিস্টেরেক্টমি বাধ্য করে। মালিক শ্রেণীর শোষণের এই নতুন পদ্ধতির রমরমার কারণ যেমন বাঁচার জন্য কাজের খোঁজে বেরোনো মানুষগুলোর অসহয়তা, তেমনি তাদের অশিক্ষা। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হবার কারণ এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক পরিচয় এক সর্বনাশা ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এক অংশের ভারতীয় নারীদের। হিস্টেরেক্টমি কিম্বা অজানা ওষুধের অপব্যবহার সম্পর্কে তাদেরকে সচেতন করা এবং একে বন্ধ করা না গেলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নিরীখে ভারত পিছনের সারির শেষ দেশটি হতে আর বেশি দেরী নেই। এই শ্রমিকদের অমানুষিক কাজের চাপ, শারীরিক-মানসিক শোষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত করে আন্দোলনই একমাত্র বর্তমান অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।