সুমনা রহমান চৌধুরী
ভাবুন একটা দেশ। যে দেশকে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের আখ্যা দেওয়া হয়। যেখানে একটা সংবিধান আছে। সেই সংবিধানে দেশের নাগরিকদের সমস্ত অধিকারের কথাও লেখা আছে। আইন আছে। পুলিশ, প্রশাসন মিলিটারি, প্যারামিলিটারি, সিবিআই, র- সব আছে। সর্বোপরি সুপ্রিম কোর্ট থেকে হাইকোর্ট, লোয়ার কোর্ট সব আছে। সেই জুডিশিয়াল সিস্টেমের কী দেখার কথা? নাগরিকদের অধিকার হরণ করা হচ্ছে কিনা, সেটা। অথচ সমস্ত আইন সংবিধান গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সেখানে প্রতিদিন নাগরিকদের অধিকার হরণ করা হয়, মব লিঞ্চিং হয়, ধর্ষণ, রাহাজানি, নেতাদের মিথ্যে ভাষণ প্রতিশ্রুতি, বাঙালি মানেই বিদেশি সাজানো, ডিটেনশন ক্যাম্প নামক জেলে সমস্ত মানবিক অধিকার হরণ – সব হয়। আইন চোখে কালো কাপড় বেঁধে রাখে। প্রশাসন নীরব থাকে। রাষ্ট্র মদত দেয়।
অথচ এই সমস্ত আইন আদালত পুলিশ মিলিটারি কাদের উপর চোখ গরম করে জানেন? কবিদের উপর। আজ্ঞে হ্যাঁ। সেই কবিরা যাঁরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নিজেদের উপর হওয়া অপমান, বিদ্রুপ, শোষণ, বঞ্চনা, প্রহার সবকিছুকে আগুনে পুড়িয়ে হাতে বন্দুক নয়, তুলে নিয়েছিলেন কলম। নিজেদের দৈনন্দিন যন্ত্রনা বয়ান করার হাতিয়ার করেছিলেন কবিতাকে। যাঁরা প্রভূত অভিমানে বলেছিলেন –
কিছুই চাই না তোমার
মাত্র আমার যা প্রাপ্য তাই দাও
আমার নাম আমি নিজেই বানাব একদিন
নিজের দমেই…
মিঞা কবি। মিঞা কবিতা। কলোনিয়াল অসমে পূর্ববাংলা থেকে আগত ভূমিহীন মুসলমান কৃষক, যাদের বৃটিশ পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক এবং সামাজিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করে নিজেদের ভাষা সাহিত্য সবকিছু ত্যাগ করে অন্যের ভাষাকে নিজেদের বলে আপন করে নিতে হয়েছিল, নিজের পরিচয়ের আগে বসাতে হয়েছিল অন্য জাতির পরিচয় এবং বিনিময়ে তকমা জুটেছিল ‘নব্য অসমীয়া’ হিসেবে। সেই নব্য অসমীয়াদের লোকগণনা শেষে তকমা জুটেছিল “চরুয়া” “মিঞা” “বাংলাদেশী” এসবের। তাদের প্রতিনিয়ত অপমান, ঘৃণা, শোষণ, বঞ্চনা এতকাল চুপচাপ মেনে নিয়েছিলেন তারা। কিন্তু আজকে যখন এন আর সি’র যাতাকলে তাদের একের পর এক ঠিকানা হচ্ছে ডিটেনশন ক্যাম্প নামক কন্সেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে, যখন বিদেশি নোটিশ হাতে অসহায় বাবা গলায় দড়ি দিচ্ছেন, তখন নিজেদের যন্ত্রণাগুলো, অসহায়ত্ব নিয়ে তাঁরা কথা বলছিলেন, নিজেদের ফেসবুকের পাতায় একের পর এক সেই ধারাভাষ্যগুলো লিখছিলেন নিজের ঘরের ভাষায়, মায়ের ভাষায়, নিজেদের দোয়ানে, তখন বৃহত্তর অসমীয়া উগ্র জাতীয়তাবাদ, অসম সাহিত্য সভার কর্ণধাররা হা রে রে রে বলে ছুটে আসলেন।
প্রথমে অসমীয়া সংবাদপত্রগুলো প্রথম পাতায় বড় বড় হরফে ছাপল “মিঞা কবিতা অসমীয়া ভাষা ধ্বংসের ব্লুপ্রিন্ট”। অসমীয়া খবরের চ্যানেলে ঘন্টার পর ঘন্টা চললো একতরফা বিশ্লেষণ। মিঞা কবিদের সোস্যাল সাইট থেকে বাস্তব সমাজে মিলতে লাগলো হুমকি ধমকি সহ নানা কটুক্তি। তাতেও শেষ নয়, এবারে দশজন মিঞা কবিদের বিরুদ্ধে করা হল এফআইআর গুয়াহাটির পানবাজার থানায়। আইপিসির ধারা বসানো হল ১২০ (বি), ১৫৩ (এ), ২৯৫ (এ), ১৮৮ এবং শেষ ধারা আইটি এক্টের সেকশন ৬৬ (এ), সংবিধানের আর্টিকেল ১৯, ২১ এবং ১৫, ১৬কে প্রকাশ্যে লঙ্ঘন করে।
নিজের ঘরে যে ভাষায় কথা বলা হয়, নিজের মায়ের মুখের ভাষায় যে কবিতা লিখা হয় সেটা কি করে অপরাধ হতে পারে? প্রণবজিৎ দলুই এফ আই আর এর একটা পয়েন্টে কাজী নীল ওরফে কাজী শারওয়ার হুসেইনের একটা কবিতার উপর অভিযোগ এনে বলেছেন- “কাজী নীল তথা মিঞা কবিদের উদ্দেশ্য সমস্ত পৃথিবীর মানুষের সামনে অসমীয়া জনগণকে জাতিবিদ্বেষী হিসাবে তুলে ধরা, যা জাতীয় নিরাপত্তা ও ঐক্যবদ্ধ সামাজিক পরিবেশের জন্যে ক্ষতিকারক”। এবারে তবে দেখে নেওয়াই যাক কাজী নীল অসমীয়া ভাষা সংস্কৃতিকে ধ্বংসের চক্রান্তের ব্লুপ্রিন্টে ঠিক কী লিখেছিলেন-
যে দেশ আমার বাবাকে বিদেশি বানায়
যে দেশ আমার ভাইকে গুলি করে মারে
যে দেশে আমার বোন মরে গণধর্ষণে
যে দেশে আমার মা বুকে আগুন চেপে রাখে
সেই দেশ আমার, আমি সেই দেশের না।যে দেশে লুঙ্গি পরার অধিকার নাই
যে দেশে কান্না শুনার মানুষ নাই
যে দেশে সত্য বললে ভূত কিলায়
যে দেশ আমার আজীবন দাসত্ব চায়
সেই দেশ আমার, আমি সেই দেশের না।যে দেশে টুপী মানেই মৌলবাদী
যে দেশে মিঞা মানে নীচজাতি
যে দেশে ‘চরুয়ারা’ সব বাংলাদেশি
যে দেশ টাটা বিড়লা আম্বানীর হাতে বিক্রি হয়ে যায়
সেই দেশ আমার, আমি সেই দেশের না।যে দেশে আমাদের লাশের পর লাশ কুপিয়ে কেটে
নদীতে ভাসিয়ে দেয়
যে দেশে ৮৩ তে মানুষ মেরে শালার বেটারা জল্লাদের
মতো উল্লাস নৃত্য নাচে
সেই দেশ আমার, আমি সেই দেশের না।যে দেশে আমার ভিটা বাড়ি উচ্ছেদ করা হয়
যে দেশে আমার অস্তিত্বকে বাতিল করা হয়
যে দেশ আমাকে অন্ধকারে রাখার ষড়যন্ত্র চালায়
যে দেশ আমার থালাতে পান্তার বদলে পাথর ঢালতে চায়
সেই দেশ আমার, আমি সেই দেশের না।যে দেশে আমি গলা ছিঁড়ে চিৎকার করলেও কেউ শুনেনা
যে দেশে আমার খুনের জন্য কেউ দায়ী না
যে দেশে আমার ছেলের কফিন নিয়ে রাজনীতি চলে
যে দেশ আমার বোনের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলায়
যে দেশে আমি জানোয়ারের মতো বেঁচে থাকি
সেই দেশ আমার, আমি সেই দেশের না।”(মূল কবিতা থেকে বাংলায় অনুবাদিত)
প্রণবজিৎ দলুই, যিনি কিনা একজন রিপোর্টার, যিনি কিনা অসমের বাসিন্দা, তিনি কি নেলী হত্যাকান্ডের কথা জানেন না? তিনি কি জানেন না উত্তাল ষাটের দশকের আসামের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আসাম চুক্তি, বাঙালি মানেই বিদেশি দাবি, ‘ডি’ শনাক্তকরণ, উগ্র অসমীয়া জাতীয়তাবাদের দমনপীড়ন? তিনি কি জানেন না পূর্ববঙ্গীয় ভূমিহীন কৃষকদের ন-অসমীয়া করে তোলার ইতিহাস? তিনি কি জানেন না ন-অসমীয়াদের ‘মিঞা’ নামক স্ল্যাং-এ পরিণত হওয়ার ধারাভাষ্য? ডিটেনশন ক্যাম্প নামক নরকে এই চর অঞ্চলের মিঞাদের, বাঙালিদের, সর্বোপরি সমস্ত অনঅসমীয়া দের সমস্ত মানবিক অধিকার খুইয়ে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হওয়ার ঘটনাপ্রবাহ? অথচ রিপোর্টার হিসাবে এই সবকিছু তাঁর জানার কথা! এবং যে জাতি খোদ অন্য জাতি এবং ভাষার প্রতি চূড়ান্ত বিদ্বেষ বহন করে চলেছে, দমনপীড়ন করে চলেছে তারা কী করেই বা তাদের হাতেই যুগ যুগ ধরে শোষিত অন্য জাতিগোষ্ঠীগুলোকে জাতিবিদ্বেষী তকমায় ভূষিত করতে পারে? ভয় পেতে পারে? আমার জানা নেই।
মিঞা, মিঞা নামে চূড়ান্ত তাচ্ছিল্য করা হল এতদিন ধরে যাদের, নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতর হিসেবে যাদের দেখা হল, আজ যখন তারাই ফিরে বলছেন, হ্যাঁ, মেনে নিলাম আমরা মিঞা। মেনে নিলাম আমরা চরুয়া। কিন্তু চরুয়াদেরও যন্ত্রণা আছে হুজুর, দয়া করে শুনুন। আমরা বাংলাদেশি নই। ভারতীয়। আমরা অসমের নিবাসী সেই পূর্বপুরুষদের হাত ধরে। শস্য আবাদ করেছি। রক্ত ঘামে মোড়া শ্রম দিয়েছি। এই দেখুন পাট্টা। এই দেখুন দাদির সিন্দুকে তুলে রাখা কাগজ। জাতি হিসাবে আপনাদেরই কথামতো ‘অসমীয়া’ লিখেছিলাম ‘৫১ সালের লোকগণনায়। এবারে অন্তত স্বীকৃতিটুকু দিন। ইতিহাস স্মরণ করুন। আর তখনই ক্ষেপে উঠলেন হীরেন গোহাঁই, প্রণবজিৎরা।
ডিটেনশন ক্যাম্পে টেনে হিঁচড়ে যাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, একতরফা ভাবে বিদেশি ঘোষনা করা হচ্ছে, এন আর সি’র যাতাকলে পিষে মারা হচ্ছে যাদের, ১৩ দিনের শিশুও যে সন্ত্রাস থেকে রেহাই পায় না, তাদের নিজেদের কথাগুলো নিজেরা বললে, অসমীয়াদের দেওয়া মিঞা তকমা মেনে নিলে, সেটা নিয়ে হীরেন গোঁহাই-সহ অসম সাহিত্য সভা, অসমীয়া ভাষা কেন এত অস্তিত্ব সংকটে ভোগে- সেটাই এখন মুখ্য প্রশ্ন। কিছুদিন আগের এই ডামাডোল সৃষ্টি হওয়ার পরেই কাজী নীলের ফেসবুকের পাতায় পোষ্ট করা কয়েকটা লাইন দেখা যাক –
আৰে বাই সাপৱালা
যতই ঠুকুৰ দিক গুক্কুৰ সাপে
তোমাৰ কাছে আৰ তাবিজ বিচৰাইনা
এন্টিভেনম এহন বাইত্তেই আছে
তোমাৰ মন্ত্ৰই আৰ কাম কৰব না।
প্রমিত বাংলায় তর্জমা করলে দাঁড়ায় –
আরে ভাই সাপওয়ালা
যতই কামড় দিক গোখরো সাপ
তোমার কাছে আর তাবিজ খুঁজি না
এন্টিভেনম এখন বাড়িতেই আছে
তোমার মন্ত্র আর কাজ করবে না।
সে প্রশ্নের উত্তর হয়তো কাজী নীলের মতো আমরা অসমে বসবাসকারী ভাষিক সংখ্যালঘুরা অনুমান করতে পারি। ইতিহাস এবং বর্তমান সময়ের নিরিখে। ২০২১-এর সেনসাসে কিছু অদল বদল ঘটতে চলেছে সেটাও অনুমান করে আমরা অসমীয়াদের এই মিঞা বা ন-অসমীয়াদের প্রতি ভয়, আক্রমণকে অনুমান করতে পারি। এবং এটুকু বলতে পারি নিশ্চিত হয়ে, সবে শুরু হল। প্রথমে ‘নিয়মিয়া বার্তা’। তারপর হীরেন গোঁহাই সহ আসাম সাহিত্য সভার ক্ষোভ, তারপর এই এফ আই আর। পরেও আরও অনেক কিছু হবে। নঅসমীয়ারা আর সুরক্ষিত নয় অসমে। বাঙালিরাও নয়। কোনও ভাষিক সংখ্যালঘুই নয়। আশির দশক, ষাটের দশক থেকেও আরও তীব্র হারে উগ্র ভাষিক নির্যাতন শুরু হতে চলেছে অসমে।
আরেকটা বিষয় ও বোধহয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। আজকাল দখলদারিতে ব্যস্ত মিঞা ভাষা নিয়ে সবাই। মিঞা যে বাংলার উপভাষা বা অসমীয়া এবং বাংলার ক্রিওল নয় তা আসামের বাইরের বাঙালি লোকজন কিছুতেই বুঝছেন না!! এবং হঠাৎ করে মিঞা কবিতার উপর দমনপীড়ন শুরু হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মিঞা ভাষাকে বাংলার উপভাষা হিসেবে ক্রেডিট দেওয়ার দরদ উথলিয়া উঠছে। মিঞা একটি স্বতন্ত্র ভাষা। সিলেটি, ময়মনসিংহি, অসমীয়া, কামতাপুরী ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণে এই ভাষার গড়ে উঠা। এবং বঞ্চনার ইতিহাস এই ভাষার ভিত। মিঞা নাম দেওয়ার ভিত। মিঞা শব্দ দিয়ে অসমে যে তীব্র শ্লেষ, বিদ্রুপ, অপমান, স্ল্যাং জাহির করা হয়, তা থেকেই এই মিঞা নামের উৎপত্তি। ‘মিঞা’ দীর্ঘদিনের বঞ্চনার প্রতি এক বিপ্লব গড়ে উঠার নাম। আমি জানি না আর কোন ভাষায় বা কীভাবে একথা বুঝাতে হয়!! জানি না অসমীয়া জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বাংলা জাতীয়তাবাদকে লেলিয়ে দেওয়া আসলেই ফ্যাসিবাদ কি না!! সেটা পশ্চিমবঙ্গের ‘বাঙালি’ বুদ্ধিজীবীরা বলতে পারবেন হয়তো!!
তবে অসমের একজন ভাষিক সংখ্যালঘু হিসেবে এইটুকু বলতে পারি আপাতত এই দশজন কবি সহ সমগ্র মিঞা কবিদের, মিঞা ভাষার প্রতিবাদকে আমাদের সবার ঐক্যবদ্ধভাবে বুঝতে হবে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। অসমীয়া উগ্র জাতীয়বাদ তথা এনআরসি নামের এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে প্রতিহত করতে হবে। ডিটেনশন ক্যাম্পগুলো নির্মূল করার স্বার্থে সর্বোপরি মানুষের অধিকারকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে সমস্ত ভাষাভাষির মানুষকে জাত ধর্মের উর্ধ্বে উঠে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।