সৌমিত্র দস্তিদার
কথায় কথায় মৃণাল সেন একবার বলেছিলেন যে মানুষ দু’ধরনের হয়। একদল বিশেষজ্ঞ। তারা সবসময় নানা ধরনের বিষয় নিয়ে কঠিন কঠিন ভাষায় সমালোচনা করে সহজ জিনিসকেও অযথা জটিল করে দেন। ধরুন, চমৎকার নীল আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির দল ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে। পণ্ডিতেরা সব ছেড়ে তখন লক্ষ রাখেন পাখিদের পায়ের নখ কেমন বা কী তাদের ঠোঁটের রং। আর একদল, আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যারা, তারা ওসব তাত্ত্বিক কচকচানির মধ্যে না গিয়ে মুগ্ধ হয়ে শুধু পাখির উড়ালের সৌন্দর্য দেখি। মৃণালদা বলেছিলেন, সিনেমা যখন দেখবে তখন তা শুধু পণ্ডিতদের দৃষ্টিতে নয়। আগে খেয়াল রাখবে ছবিটা প্রাথমিকভাবে তোমার কেমন লেগেছে, কতটা ভাবিয়েছে।
সত্যি কথা বলতে কি, ‘আর্টিকল-১৫’ সিনেমা নিয়ে এত বেশি পলিটিকাল কারেক্ট-ইনকারেক্ট কথাবার্তা হচ্ছে, তাই তা নিয়ে কিছু লেখার আগে মৃণালদার স্মরণ নিলাম। ঢাল হিসেবে। ভবিষ্যৎ আক্রমণের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে।
আমি কোনও অভিধান মেনে ছবির রিভিউ লিখতে বসিনি। প্রথমেই বলে রাখি যে, আর্টিকল-১৫ সিনেমাটি নিঃসন্দেহে আমার ভাল লেগেছে। অনুভব সিনহার ছবিটি কম বাজেটের। কম বাজেটেও এধরনের ছবি করার জন্য ধক লাগে। অনুভব তা করে দেখিয়েছেন। এমন একটা সময়ে ছবিটি নির্মিত যে সময় ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে এক ভয়ঙ্কর পর্যায় চলছে। রাজ্যে রাজ্যে দলিত ও সংখ্যালঘু নির্যাতন বাড়ছে। ‘জয় শ্রীরাম’ না বললে নিরীহ মানুষ খুন হচ্ছেন শাসক দুষ্কৃতীদের হাতে। এই ভুঁইফোড় জয় শ্রীরাম সংস্কৃতির বিরুদ্ধে মুখ খুলে অপমানিত হতে হচ্ছে দেশের নোবেলজয়ী চিন্তাবিদকে। ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ সবকা বিশ্বাস’ দিনকে দিন একটি ঝুটা স্লোগানে পর্যবসিত হচ্ছে। বিকাশ হচ্ছে শুধুমাত্র শাসক ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের। দেশের সম্পদের প্রায় পুরোটাই কেন্দ্রীভূত হয়ে যাচ্ছে কয়েকটি পরিবারের হাতে।
এই মনুবাদী, উচ্চবর্ণ, কর্পোরেট ভারতের মুখোশ খুলে দেওয়ার কৃতিত্ব এ ছবির। আশির দশকে শ্যাম বেনেগল, গোবিন্দ নিহালনি, শাজি কারুনেরা যে ধরনের ছবি বানাতেন, এ ছবি সেই ঘরানার। সাম্প্রতিক কালে পিপলি লাইভ, গাংস অব ওয়াসিপুর-এর পরে এই আর্টিকল-১৫ আমাদের সমাজ কাঠামোয় পরতে পরতে মিশে থাকা যে বিকট বৈষম্য, তাকে আবার নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে।
ছবির শুরুতেই আমরা দেখি, গাছে দুটি অল্প বয়সের মেয়ের লাশ ঝুলছে। এ ধরনের ঘটনা আমার দেশে প্রায় রোজকার বিষয়। হয় অনার কিলিং বা দলিত হওয়ার ‘অপরাধে’ খুন করা এখন ভারতের জাতীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছবির নায়ক এখানে এক তরুণ পুলিশ অফিসার। তার সততা, সাহসী তদন্ত পুরো সিস্টেমকেই অচিরে খুল্লামখুল্লা নগ্ন করে দেয়।
পুলিশ-রাজনীতিক-ব্যবসায়ী-প্রশাসনের প্রভাবশালী অংশ কীভাবে প্রভাব খাটিয়ে দলিতদের ওপর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শোষণ চালিয়ে যায় বছরের পর বছর, তা এই সময়ে আবার নতুন করে মানুষের সামনে আনাটা জরুরি ছিল। যেখানে আমাদের দেশে অধিকাংশ ইন্টেলেকচুয়াল, লেখক, শিল্পী, অভিনেতা, খেলোয়াড়দের প্রায় সবাই হাঁটু মুড়ে প্রতিষ্ঠান বা ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন, তখন এই আর্টিকল-১৫ নিশ্চিত এক দরকারি প্রতিবাদ।
ছবিটিকে আমার ব্যক্তিগতভাবে এত ভাল লাগার পিছনে আরও একটা কারণ থাকতে পারে। মহারাষ্ট্র, বস্তার, ছত্তিশগড়, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা ও উত্তর প্রদেশের গ্রামে গ্রামে মহান গণতান্ত্রিক ভারত তাঁর দলিতদের কোন চোখে দেখে তা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। মনে আছে, একবার দানহিবিহিটা বলে বিহারের এক নিম্নবর্গের গ্রামে প্রবল গরমে জলকষ্টে প্রায় মরতে বসেছিলাম। একটু এগিয়ে জনমানবহীন গ্রামের মাটির কুঁড়ের দাওয়ায় বসে থাকা অতিবৃদ্ধ একজনের কাছে জল চাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে সে জবাব দিয়েছিল— বাবুজি হাম চামার বা। অর্থাৎ চামার বলে উঁচু জাতের কাউকে জল দেবার অধিকার তাঁর নেই।
বাবাসাহেব আম্বেদকর ও তাঁর লড়াই আজও অনেক দলিত বহুজনের কাছে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। ছবির ডিটেলিং সুন্দর। সংবিধান হাতে বাবাসাহেবের এক অসহায় মূর্তি অনুচ্চারে ছবিতে ফিরে ফিরে এসেছে। মহারাষ্ট্রের গ্রামে দলিত মহল্লায় ঠিক এমনিভাবে বাজারে বা কোনও এক নদীর ধারে বাবাসাহেবের ছোট ছোট অসংখ্য মূর্তি দেখেছিলাম। আর্টিকল-১৫ আমাদের সংবিধানে লিখিতভাবে উল্লিখিত সমানাধিকারের কথা বলে, বাস্তবে যা স্বাধীনতার এত বছর পরেও নিছক অলীক কল্পনা তা আমরা কমবেশি সবাই জানি। কিন্তু আমরা সমাজের ‘ক্রিমি লেয়ার’, বাস্তবে যারা এই কাঠামোয় সুবিধেভোগী অংশ, তারা সব জেনেও না জানার ভান করে চুপ করে থাকি। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া দলিত আদিবাসী যখন রুখে দাঁড়ায় তখন শাসকদের ভুরু কুঁচকে যায়। থানায় থানায় ওয়ারলেস সক্রিয় হয়ে ওপরতলায় বার্তা পাঠাতে থাকে— ফৌজ পাঠান। আরও ফৌজ। নীচুজাতের বিদ্রোহ না হলে হাতের বাইরে চলে যাবে।
বাইলাডিলা থেকে গড়চিরৌলি হয়ে ওড়িশা বিহার ছত্তিশগড়ের জায়গায় জায়গায় নতুন নতুন আখ্যান জন্ম নেয়। সে আখ্যানে দলিত আদিবাসী জনতার মার খাওয়ার পাশাপাশি উঠে আসে পাল্টা প্রতিরোধের গল্প। এই ছবিতে সে ইঙ্গিতও আছে। আমার অন্তত মনে হয়েছে আর্টিকল-১৫-র সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক শাসকভজনার বিপরীতে এই পাল্টা লড়াইয়ের প্রস্তুতির সঙ্কেত।
জানি, এ ছবির শেষ দিকে আছে পুলিশ অফিসারের পাশে থাকা মন্ত্রীর ইতিবাচক ভূমিকা, যা বাস্তবে আশা করা কঠিন। অন্তত ফোনের কথোপকথন থেকে সেরকমই মনে হয়েছে। এই ধরনের আদর্শবাদী, সিস্টেমের সঙ্গে আপসহীন পুলিশ অফিসারও বাস্তবে কজন আছেন তা নিয়েও বিতর্ক থাকবে। তবু শিল্পের সত্য আর বাস্তব তো সবসময় এক হয় না। আমাদের অনেক সিনেমা সমালোচকদের দস্তুর যে ছবির শেষে বলা— ‘ক্যামেরা সুন্দর। সম্পাদনা যথাযথ।’ আমি তা বলব না। নন্দনতত্ত্বের থেকে বিষয় আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পের অন্যতম শর্ত সত্যকথন। সেদিক দিয়ে কোনও সন্দেহ নেই আর্টিকল-১৫ এই সময়ের এক দলিল, যা আপনাকে ভাবাবে। যারা এখনও দেখেননি, আজই দেখুন। অবশ্যই পয়সা খরচ করে সিনেমা হলে গিয়ে আমাদের সকলের দেখা উচিত এ ছবি।