প্রবুদ্ধ ঘোষ
সোনভদ্র। উত্তরপ্রদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা। কাকতাড়ুয়া দেখে। জমির লড়াই। জমির জন্যে লড়াই। আর, সে লড়াইতে জড়িয়ে থাকে আইন-রাষ্ট্রব্যবস্থা-বাহুবলী এবং অতি অবশ্যই নিম্নবর্গ। এ আখ্যান তো নতুন কিছু নয়, শুধু সোনভদ্র জেলা বা উবহা গ্রামের নয়। এই আখ্যান ভারতজুড়ে, এই আখ্যান স্থানকালিকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে।
সোনভদ্র উত্তরপ্রদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা। চার চারটি রাজ্য ছুঁয়ে রয়েছে সীমানা। এই বিশাল জেলায় জমির ঝগড়াও বহু পুরনো। কোনও এক ‘আদর্শ সমাজ’ কিনে নিয়েছিল উবহা গ্রামের ৩৬ একর জমি, ১৯৫৫ সালে। সমবায় থেকে ব্যক্তি মালিকানায় হাতবদল হতে হতে ’৮০-র দশকের শেষদিকে জনৈক জোতদার কিনে নেয় সেই জমি, ২০১৭ সালে এক সরকারি উচ্চপদস্থ আধিকারিকের থেকে সেই ৯০ বিঘা জমি কেনে যজ্ঞদত্ত গুর্জর। বহুফসলী কৃষিজমি— গঙ্গার পলিতে উর্বর মাটি উবহা গ্রামের গোন্দ জাতির জীবিকা ও সংস্থানের ভিত্তি। তাঁদের দাবি, এই জমিবিক্রির পদ্ধতিই বেআইনি। তাঁরা রাজি হন না জমি ছাড়তে, ফলে জমির দখল নিতে যজ্ঞদত্ত গুর্জর ১০ ট্রাক লোক নিয়ে আসে তাদের উচ্ছেদ করতে। আগেও বহুবার হুমকি-ধমকি-আইনি সংলাপ চলেছে যজ্ঞদত্ত ও কৃষকদের মধ্যে, কিন্তু জমির মালিকানা আঁকড়েই ছিলেন কৃষকরা। ১৭ই জুলাই বাহুবলীদের এলোপাথাড়ি গুলিতে মারা যান ১০ জন গোন্দ আদিবাসী, আহত প্রায় ৩০। গণহত্যার মধ্যে দিয়ে শোষকশ্রেণির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সামন্ততান্ত্রিক পদ্ধতি প্রচলিত, শাসকের সমর্থন পেয়ে এসেছে যুগ যুগ ধরে। দলিতদের জমির অধিকার কেড়ে নিতে রণবীর সেনা সূর্য সেনা, প্রান্তিকদের জমি অধিগ্রহণে জোতদারের প্রাইভেট আর্মি— যজ্ঞদত্তের ব্যক্তিগত সেনাদলের ভূমিকাও তেমনই।
গণহত্যার পরেই গল্পের শেষ হল না। কারণ, বিক্ষুব্ধ গোন্দ আদিবাসীরা দাবি করলেন যে, ওই মাটিতেই দাফন হবে মৃত স্বজনদের। যথারীতি প্রশাসনিক কর্তারা সেই অনুমতি দিতে চাইলেন না। গ্রামবাসীদের বিক্ষোভ প্রশমিত করতে পুলিশকর্তারা এল। অবশেষে নির্দিষ্ট স্থানেই শেষকৃত্য হল মৃতদের। গণতন্ত্রের নিয়মমাফিক সরকার ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করল প্রত্যেক মৃত পরিবারের জন্য। ভোট-রাজনীতির স্বার্থে ক্ষতিপূরণের অঙ্ক নিয়ে দলগুলোর নিলাম হাঁকা। বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রথামাফিক রাজনৈতিক দলগুলোর তরজা ও কাদাছোঁড়া শুরু হল। বর্তমান ক্ষমতাসীন বিজেপি দোষারোপ করল কংগ্রেসের জমিনীতিকে, কংগ্রেসের নেত্রী ক্ষোভ উগরে দিল বিজেপির বিরুদ্ধে এবং মায়াবতী দোষ দিল দু’টো দলকেই। বিরোধী দলগুলোর চাপে এবং গোন্দদের প্রবল ক্ষোভের মুখে পড়ে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ গ্রেফতার করে যজ্ঞদত্ত ও তার ২৯ বাহুবলীকে। হামলা করতে নিয়ে যাওয়া ৬টি ট্রাক্টর আটক করা হয়। যোগী আদিত্যনাথ থেকে শুরু ক’রে পুলিশকর্তারা প্রত্যেকেই সহমত যে, ওই জমি বিতর্কিত এবং আইনি জটিলতা প্রচুর। কিন্তু, সেই জটিলতার উৎস খুঁজে সমাধানের পথ কী হবে, যে কৃষকেরা চাষ করে জমি তাদের হবে নাকি কোনও এক জোতদারের ব্যক্তিমালিকানা ও শোষণ বলবৎ থেকে যাবে— সে বিষয়ে নিশ্চুপ এরা সকলেই। শুধু বসেছে দায়বদ্ধতার তদন্ত কমিটি।
১৯৫৫ সালে ‘আদর্শ সমাজ’ ও তার সমবায় সংস্থার জন্যে প্রায় ৬০০ বিঘা জমি সোসাইটিজ অ্যাক্ট অনুযায়ী রেজিস্টার্ড হয়। ১৯৫০-এর জমিদারি উচ্ছেদ আইনের পরে এই হস্তান্তর হয়। স্থানীয়দের মতে, উবহা ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাসিন্দাদের এবং আদিবাসী কৃষকদের অন্ধকারে রেখেই জমির মালিকানা হস্তান্তরের কাজ বহুবার হয়েছে। ফলে, যে কৃষকরা তাঁদের শ্রমে জমিতে ফসল ফলিয়েছেন, সেখানে দশকের পর দশক বাস করেছেন, জমি তাঁদের নামে ‘স্বীকৃত’ হয়নি। প্রাপ্ত জমিটি পরে যখন ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হয়ে যায়, ১৯৮৯ সালে, তখনও যথারীতি সেই গঙ্গাপার্শ্ববর্তী উর্বর জমিতে চাষ করছিলেন সেই মানুষগুলোই। ২০১৭ সালে তৎকালীন মালিকের থেকে জমি কিনে নেয় নব্য-জোতদার যজ্ঞদত্ত। ১৭ই জুলাই গুর্জর নিজের কেনা সেই ১০০ বিঘা জমির দখল নিতে যায়। প্রত্যেকবার জমির মালিকানা হাতবদলের পদ্ধতিতেও বহু আইনি ফাঁকফোকর। কংগ্রেস বা সমাজবাদী বা বিজেপি— কোনও জমানাতেই সুরাহা হয়নি এই সমস্যার। হয়ও না। বরং, এই জমির সমস্যা জিইয়ে রেখে ভোট হয়, নেতা উঠে আসে, টাকাপয়সার অন্ধকার লেনদেন চলে আর দালাল ও শোষকশ্রেণি ফুলেফেঁপে ওঠে। গঙ্গার সোনভদ্র জেলায় আদিবাসীদের ওপর অত্যাচার নতুন কিছু নয় বরং সরকারি জবরজুলুম এবার বেসরকারি পথে এগোল। ২০১৮-র মে মাসে লিলাসি গ্রামে সকাল সকাল ঢুকে পড়ে ৩ গাড়ি পুলিশ, লাঠি-বন্দুক নিয়ে। বন দপ্তরের কর্তা ও পুলিশ প্রত্যেকটি কুঁড়েঘরে ঢুকে হুমকি দেয় বনে ঢোকার বা বন পরিষ্কার করার কোনও অধিকার নেই লিলাসি গ্রামের বাসিন্দাদের, যাঁরা বনজ সম্পদের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। গুরুতর আহত হলেন ফরেস্ট রাইটস কমিটির সেক্রেটারি কিসমতিয়া গোন্দ। তুলে নিয়ে যাওয়া হয় প্রায় ১৪ জন মহিলাকে। পুলিশি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ও বনের অধিকার রক্ষার আন্দোলনের তীব্রতা বাড়লে গ্রেফতার করা হল আন্দোলনের আদিবাসী নেতা সুকালোকে। ২০১৫ সালে সোনভদ্র জেলার ছত্তিশগড়-ঝাড়খণ্ড সীমানায় কনহর সেচ প্রকল্প ও কনহর বাঁধ ঘিরে উচ্ছেদপ্রকল্প শুরু হয়। ‘সময়-অসময়ের বৃত্তান্ত’-র পুনাসি বাঁধ ঘিরে যেমন, নর্মদা নদীর ওপরে বাঁধকে কেন্দ্র করে যেমন, তেমনই এখানেও এক অনিবার্য সরকার-নির্দেশিত উচ্ছেদ। বিস্থাপনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান সেখানকার মানুষ, মূলত কৃষিজীবী আদিবাসীরা বিস্থাপন বিরোধী সভা-মিছিল করলে তাঁদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। কিছু জায়গায় নামমাত্র ক্ষতিপূরণে জমি নিয়ে এবং কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দীর্ঘসূত্রিতায় আটকে রইল প্রকল্প। চন্দ্রাণী খারওয়ার, আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “We are not protesting out of fear but we are not accepting either. We are tribals and so should be given forest land rather than a 150 sq m plot with drainage and streetlights.” আরওয়াল জেলা ও গ্রাম, বিহারে। ১৯৮৬ সালের ১৯শে এপ্রিল ‘মজদুর কিষাণ সংঘর্ষ সমিতি’-র সভায় উচ্চবর্ণের জোতদারদের প্রাইভেট সেনাবাহিনী গুলি চালায়। পুলিশ ও তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিন্দেশ্বরী দুবের প্রত্যক্ষ মদতে। চারদিক থেকে সভা ঘিরে ফেলে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি। শহীদ হন ২৩ জন। এই MKSS-এর স্লোগান ছিল, “জোতে বোয়ে কাটে ধান/ ক্ষেত কা মালিক ওহি কিসান”। বিন্দেশ্বরী দুবে পুলিশ ও রণবীর সেনার গণহত্যাকে শাবাসি দেয়। আরওয়াল গণহত্যার বিচার হয়ে অপরাধীরা শাস্তি পেয়েছে— এমন দাবি আইনব্যবস্থার পরম সমর্থকও করেন না। এমনকি ভারতের কোনও গণহত্যাতেই যে ‘সুবিচার’ হয়েছে বা সামন্ততান্ত্রিক, বর্ণবাদী জুলুম শেষ করা গেছে এমন দাবি কোনও আইনপ্রেমিকও নিশ্চয় করেন না।
কিন্তু, মূল প্রশ্নটা রইল গণহত্যা নিয়ে। প্রশ্ন জেগে রইল যে, যজ্ঞদত্ত গুর্জরের ব্যক্তিগত ভাড়াটে গুণ্ডারা কোন রাজনৈতিক মদতে জমিদখলে মরিয়া হয়ে উঠল? তারা আইন-প্রশাসনকে কাঁচকলা দেখিয়ে এত বাহুবলী সংগঠিত করল কীভাবে? আর, এই বাহুবলী রাজনীতির সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতি, জমি অধিগ্রহণে জবরদস্তির রীতি কতদিন চলতে থাকবে?
আর যে জেগে থাকে, সে কাকতাড়ুয়া। নবারুণ যেমন লিখতে চেয়েছিলেন যে, কাকতাড়ুয়ার গায়ে চাপিয়ে দেওয়া হয় মৃত গোন্দ কৃষকের রক্তভেজা ছেঁড়াফুটো শার্ট। কিছু সময়ের মধ্যে ফের ভোট আসবে, পুলিসের ট্রাক আর জিপে ১৪৪ ধারায় আপাতত থমথম করবে বা মুখর থাকবে উবহা গ্রাম। হয়তো ভোটে নামবে বা ভোটে নামা নেতার ডানহাত হয়ে উঠবে যজ্ঞদত্ত গুর্জর। সোনভদ্র জেলার কোনও গ্রামের কোনও এক বুড়ো দাওয়ায় বসে বাহুবলী-প্রাইভেট আর্মির প্রত্যেকটা গণহত্যা এবং কৃষকদের প্রতিটা প্রতিরোধের গল্প বিড়বিড় করবে। আর, রক্তের ছোপ, বুলেটের ছ্যাঁদা হওয়া শার্ট পড়ে একচোখা কাকতাড়ুয়া দাঁত বার ক’রে হিহি হাসবে। কারণ, সেই অব্যর্থ অমোঘ সত্যি, ‘কাকতাড়ুয়ার ভোট নেই’।