প্রশান্ত ভট্টাচার্য
পূর্ণাঙ্গ বাজেট, থুড়ি ‘বহিখাতা’, পেশ করলেন নির্মলা সীতারমন। এই প্রথম পূর্ণ সময়ের জন্য প্রথম মহিলা অর্থমন্ত্রী নির্মলা লাল শালুতে মোড়া যে বস্তুটি নিয়ে সংসদে ঢুকেছিলেন, তাকে তিনি বলেছেন ‘বহিখাতা’। সে না-হয় সই। ব্রিফকেস ট্র্যাডিশন ভেঙে নতুন মলাটে যা হাজির করেছেন, তা কিন্তু সেই নতুন বোতলে পুরনো মদ। নির্মলার বাজেট এমন ভারত সৃষ্টি করতে পারবে না, যা রীতিমতো প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে পারবে।
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে দ্বিতীয়বার সরকারে এসে নরেন্দ্র মোদি নতুন ভারতের কথা বলছেন সরবে। আর মোদি যত বলেন, তাঁর পারিষদবর্গ বলেন শতগুণ। অথচ এই বাজেটে নতুন কিছুই নেই। এমনকী, নতুন উদ্যোগ বা কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি নিয়েও কিছু বলা হয়নি। বাজেটে যুবক–যুবতীদের কর্মসংস্থানের কোনও উল্লেখ নেই। মধ্যবিত্তদের সঞ্চয়ে সুদ বাড়ার কোনও কথা নেই। এই বাজেটের ফলে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকা কঠিনতর হয়ে পড়বে। সেই বিচারে নির্মলার বাজেটে নির্মল হলাম বলা যাবে না। এটা একটি দিশাহীন বাজেট। আর এমনটা যে হতে চলেছে, তার ইঙ্গিত ছিল অর্থনৈতিক সমীক্ষায়। দেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষাটি যথার্থই বলেছে যে, কোনও রফতানি ছাড়া এবং ক্রমবর্ধমান রফতানি, জিডিপি, সঞ্চয় ও বিনিয়োগের একটি নিখুঁত সাইকেল তৈরি করতে না পারলে কোনও দেশের দ্রুত বৃদ্ধি হয় না। বাজেট এই কাজ করতে ব্যাপকভাবে ব্যর্থ।
দেশে ৮% বৃদ্ধি তো দূরে থাক তা ৬% নেমে যেতে পারে। নির্মলার প্রথম বাজেটে দাম বাড়ল পেট্রোল-ডিজেলের। তবে গৃহঋণের সুদে ছাড়ের সীমা বাড়ল। আয়কর কাঠামো অপরিবর্তিত কিন্তু পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়ল বাজেটে। লিটার পিছু উৎপাদন শুল্ক ও সেস উভয়ই ১ টাকা করে বাড়িয়ে পেট্রোল ও ডিজেলের আরও মূল্যবৃদ্ধি ঘটানো হয়েছে এই বাজেটে। ফলে করের বোঝা নতুন করে না চাপালেও পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ায় মধ্যবিত্তের পকেটে আরও বেশি চাপ পড়বে বলাই বাহুল্য। গাল কাত করে বলা হচ্ছে গৃহঋণে সুদ কমানো হয়েছে। ৪৫ লাখ টাকা পর্যন্ত মূল্যের গৃহ বা ফ্লাট কেনার জন্য গৃহঋণে কর ছাড়ের পরিমাণ ২ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করা হয়েছে। করা হয়েছে আসলে দারুণ মার খাওয়া রিয়াল এস্টেট ব্যবসাকে গতি দিতে। মনে রাখবেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মী নিয়োগ করার রিজার্ভ বেঞ্চ হচ্ছে রিয়াল এস্টেট ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকেরা। তাই মধ্যবিত্তকে গৃহঋণে সামান্য রিলিফ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সোনা বা অন্যান্য আমদানিকৃত ধাতুর ওপর আবগারি শুল্ক আড়াই শতাংশ বৃদ্ধি এবং আমদানিকৃত বই ও ছাপাখানার দ্রব্যাদির ওপর আবগারি শুল্ক ৫% বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যা বাস্তবে সব ক্ষেত্রেই মুদ্রাস্ফীতি ঘটাবে।
নির্মলা সীতারমনের বাজেটে সবচেয়ে বেশি প্রতারণা করা হয়েছে কৃষিজীবী মানুষের ওপর। কৃষকের জন্য বাজেটে কিছুই নেই। অথচ গত কয়েক বছরে দেশে কৃষক আত্মহত্যার হার দ্রুত গতিতে বেড়েছে। মূলত ঋণের জালে জড়িয়েই কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন। আর খরা পরিস্থিতির চক্করে পড়ে আর্তনাদ করছেন কৃষকেরা। কৃষির কর্পোরেটকরণ ও শস্যবীজের বাজারের ৮৫%-এরও বেশি অংশ বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কব্জায় থাকায় মোদি সরকার গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করেছেন ‘০% খরচে কৃষিকাজ’! দেশের কৃষকদের সঙ্গে এ এক নির্মম রসিকতা। বোধহয় বিজেপি সরকারই পারে এরকম রসিকতা করতে! তাই বাজেটে উৎপাদনশীল কৃষকদের ১০,০০০টি গোষ্ঠী গড়ার ঘোষণাও প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। মোদি-নির্মলা যুগলবন্দির এই বাজেট কৃষক সমাজের প্রত্যাশার প্রতি এক জবরদস্ত ধাক্কা। যদিও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বাজেট ভাষণে বলেছেন, কৃষির পরিকাঠামো উন্নতিতে ব্যাপক হারে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে বলেও বাজেটে ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। কিন্তু বাস্তবে তার সংস্থান কোথায়? আমাদের অন্নদাতা কৃষকরা আশা করেছিলেন যে ঋণমুক্তির লক্ষ্যে এবং স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশগুলি চালু করতে সরকার সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ করবে। কিন্তু তাহার দেখা নাই! এমনকী, ১৫৯২টি উন্নয়ন অঞ্চলে ‘জল শক্তি অভিযান’ ঘোষণা এবং ‘জল জীবন’ প্রকল্পে ২০২২ সালের মধ্যে প্রত্যেকটি ঘরে পানীয় জল সরবরাহের প্রতিশ্রুতি রূপায়ণের কোনও রূপরেখা এই বাজেটে নেই। যাকে বিরোধীরা বলছেন, মোদি সরকারের আরেক মিথ্যাচার।
কৃষকদের মতোই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মালিকদেরও হতাশ করা হয়েছে বাজেটে। বাড়তি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে কর্পোরেট ও বিদেশি পুঁজিকে। একদিকে ২ থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত আয়ের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ৩% ও ৫ কোটির ঊর্ধ্বে হলে অতিরিক্ত ৭% আয়কর ধার্য করা হয়েছে সারচার্জের মাধ্যমে। ফলে কর্পোরেট নয় এরকম মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পে করের বোঝা বাড়বে, অন্যদিকে, মোদি সরকার কর্পোরেট ট্যাক্স কমিয়ে ২৫%-এ নিয়ে এসেছে। এইভাবে কর্পোরেট পুঁজির কব্জা শক্ত করা হয়েছে। সেই কর্পোরেট পুঁজির সেবাদাস হিসাবে বেঙ্গল কেমিক্যালের মতো লাভজনক সংস্থা থেকে এয়ার ইন্ডিয়া-সহ সব রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বিলগ্নিকরণের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে মোদি সরকার। এগুলো সবই তুলে দেওয়া হবে আদানি, আম্বানিদের মতো পুঁজিপতিদের হাতে। ভারতীয় রেলওয়েতে বিলগ্নিকরণ পাকা। ঘোষণা করা হয়েছে রেলের ৫০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিলগ্নিকরণের। বিমা ক্ষেত্র খুলে দেওয়া হচ্ছে বিদেশিদের জন্য। এই ক্ষেত্রে ১০০% প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের মাত্রা ঘোষিত হয়েছে এবারের বাজেটে। এই নিরিখে মনমোহন সিং সরকার যা শুরু করেছিল তা দ্রুত রূপায়ণ করবে। মোদি-নির্মলার এই বাজেট সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের কোম্পানিগুলির বেসরকারিকরণ আরও ত্বরান্বিত করবে। ‘ওয়ান নেশন ওয়ান পাওয়ার গ্রিড’ ঘোষণা এবং জল ও গ্যাসের জন্য আলাদা আলাদা গ্রিড স্থাপনের ঘোষণার একটাই উদ্দেশ্য, এই দুই জাতীয় সম্পদের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে কর্পোরেট পুঁজির হাতে তুলে দেওয়া। অন্যদিকে, সরকার দাবি করছে যে ব্যাঙ্কগুলোর অনুৎপাদক সম্পদ (এনপিএ) বড় মাত্রায় কমেছে এবং ব্যাঙ্কগুলো ঋণগ্রস্ততা কাটিয়ে উঠেছে। তাই যদি হয় তবে বাজেটে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোকে ৭০,০০০ কোটি টাকা দেওয়ার বন্দোবস্ত কেন? এটা কি দেখিয়ে দিচ্ছে না সরকারের দাবির মধ্যে কতটা জল আছে? এছাড়াও এই বাজেটে ব্যাঙ্কের লেনদেন কর আরও বাড়ানো হয়েছে। কার্যত ব্যাঙ্কগুলো থেকে বিজয় মালিয়া, নীরব মোদি, মেহুল চোকসিদের হাতিয়ে নেওয়া টাকা নরেন্দ্র মোদিরা নীরবে পূরণ করে দিচ্ছে আপনার-আমার দেওয়া করের টাকা থেকে। আর এভাবেই গৈরিক উত্তরীয়ের আড়াল কর্পোরেট ও ব্যাঙ্ক মিলে এনপিএ’কে নতুন ঋণে বদলে দেওয়ার কারবারটি চালিয়ে যাচ্ছে।
গত বছর বাজেটে অরুণ জেটলি ৪০টিরও বেশি পণ্য আমদানি করার জন্য নিরপেক্ষ প্রবণতা শুরু করেন। সীতারমন এই বছরের আরও অনেক কিছু তালিকা প্রকাশ করেছেন, তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে তিনি আমদানি নির্ভরতা কমানো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে রক্ষা এবং অপরিহার্য আমদানি নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে কাজ করছেন। এটি পরিষ্কার লাইসেন্স-পারমিট রাজের ভাষা। এমনিতে রফতানির হাল গত পাঁচ বছর ধরে বাড়েনি, চলতি লবজে বললে, বলতে হয়, মায়েরভোগে। কেন রফতানি নেই? বলা যায়, এর কারণ ভারতের বাজার একটি উচ্চ মূল্যের অর্থনীতির, যা তার এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে না। ভারতে জমি, শ্রম, পুঁজি, বিদ্যুৎ, রেলওয়ে মালবহনের খরচ, বিমানে মালবাহনের খরচ এবং উচ্চ হারে কর্পোরেট ও আয়করের জন্য রফতানি যোগ্য পণ্যের দাম বেশি হয়ে যায়, ফলে পাত্তা পায় না। ৮% বৃদ্ধির জন্য বাজারের তেজি ভাবের তীব্রতা যে হারে থাকার কথা তা নেই। আর বাজেটও বিপরীত দিকেই হাঁটছে।
এই বাজেট একবিংশ শতাব্দীর ভারতে ফের দাসত্বকে প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র দেবে। বাড়বে বৈষম্য, বাড়বে বেকারত্ব। দেশের ১% লোকের হাতে মোট সম্পদের ২১.৭%। অথচ গণতন্ত্রের স্বাভাবিক ধারণা এই যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর ধনী-দরিদ্রের ফারাক কমতে থাকে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, রাজা-মহারাজাদের আমলের চেয়েও বর্তমান ভারতে বৈষম্য অনেকটাই বেশি। কেন? ধনবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, মোদির নয়া ভারতে ধনী-গরিবে ফারাক বাড়তে বাড়তে তা ছাপিয়ে গিয়েছে সামন্ততন্ত্রকেও। এই আর্থসামাজিক চেহারায় শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়া ও সমষ্টিবদ্ধ দরকষাকষি করার অধিকার খর্ব করার লক্ষ্যে শ্রম আইনে পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে বাজেট। ২০১৪ সালে মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বছরে ২ কোটি লোকের চাকরি হবে, সেসব প্রতিশ্রুতি তো দূরে থাক এবারের বাজেটে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা প্রসঙ্গে একটি শব্দও খরচ করেননি নির্মলা সীতারমন। ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি বা এনআরইজি (১০০ দিনের কাজ)-র মজুরি বৃদ্ধির মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষা শক্তিশালী করা প্রসঙ্গেও নিয়েও টুঁ শব্দটি নেই। এককথায় বললে বলতে হয়, নির্মলার প্রথম বাজেট শ্রমিক বিরোধী। বাজেটে উচ্চবাচ্য নেই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে খরচের কথাও। বাজেট যদি হয় কেন্দ্রীয় সরকারের সংসার খরচের খতিয়ান তবে সেই সংসারে যেন শিক্ষা বা স্বাস্থ্য বলে কিছু নেই। অথচ ৫ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনীতির দেশ হবে বলে গালভরা কথা বারবারই আমরা শুনে এসেছি মোদির গলায়। এবার মোদির অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় কার্যত সেই কথাই অনুরণিত হয়েছে। ১.৮ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনীতিতে পৌঁছতে ভারতের যে ৫০ বছরেরও বেশি সময় লেগেছে, সেকথা বাজেট বক্তৃতায় তুলে ধরে কংগ্রেসকেও খোঁচা দেন নির্মলা। কিন্তু কথা সেটা নয়, কোনও মহামারী, বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা বড় ধরনের যুদ্ধু যুদ্ধু খেলা না হলে, মনমোহন থাকুন বা রাহুল গান্ধি কিম্বা নরেন্দ্র মোদি, এমনিতেই ভারত ২০২৪-২৫ সাল নাগাদ ৫ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনীতিতে পৌঁছে যাবে। যাবে তো বুঝলাম, তাতে হবেটা কী? প্রশ্ন তুললে যতই ‘পেশাদার নৈরাশ্যবাদী’ বলে দেগে দেওয়া হোক না কেন, আসলে কী হল সেটা তো বলতে হবে। ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানীদের একাংশ যথার্থই বলছেন, আগ্রাসী হিন্দুত্বের স্লোগানের আড়ালে আসলে মহা-ধনীদের খুশি করারই নিরন্তর প্রয়াস চলছে মোদি সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপে। শুধু তাই নয়, মহা-ধনী পরিবারগুলোর পাশাপাশি উগ্র হিন্দুত্বের সমর্থকদের খুশি রাখাও মোদি সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। নির্মলা সীতারমনের বাজেটেও তা প্রতিফলিত হয়েছে।