পাঁচটি কবিতা
হংসধ্বনি
দেখো, তাকে জুম করে দেখো। মরিচা রঙের চাঁদ, দমকুঠুরির মাঝে, বিহানকালে। তুমি নাকি রঙের ব্যাপারী ছিলে চিঁড়ে কুটবার দিনে, জল তোলা, জল ফেলা রাতের আড়ালে! ডুবুরিও ছিলে, ছিলে নাকি গো, হাওয়ার ঘরের মাঝে ফাঁদ পেতে তুলেছ স্বপ্নফুল, ব্রহ্মকমল? তাকে আমি শমন বলেছি, বলেছি ডাকপিওন। সেই চিঠি ধুলো হয়ে মিশে আছে এই ঘরে, তাই তো এঘরে আজও ঝাঁটও পড়েনি। ব্যাধ ফিরে এসে দেখে পড়ে আছে এক দুটো মৃত হাড়গোড়, এখনও তাদের গায়ে মাংসের দাগ। এই পথে তিলে তিলে হয় গো সাঁতার। জল আসে, নদী আসে, আঠালো বসতে ডোবে মৃদু প্রজাপতি।
একটা বারান্দা দিও, ঘর নয়, ঘর তো চাইনি আমি, চেয়েছি কি কোনওদিন, বলো? আর দিও সেই লালচাঁদ, খুলিগুহা, সুবর্ণ বালুকা ভরা জমি। বেল, জুঁই, চামেলি বা চাঁপার ফুলের রেণু, সব সব বেদম হাউশ ফেলে চলে যাব লালিগুরাশের দিকে, চরম শ্রাবণ হয়ে ঝরে যায় দিন ও সময়। এসো আজ গুহাশিল্পের কথা বলি, বলি সেই সিঁড়ি ও সুড়ঙ্গকথা। অন্তিম ঝাউবনে ঢুকে যাক আলবাট্রস পাখিটি আমার। সেইদিন রাস্তাও পথ হবে, কালো ও পিছল সেই পথে ফোঁটা ফোঁটা রবারগাছের ঘু্ম। লেখো মোম, লেখো রাত্রি, লেখো বোলতার ধুন, প্রতিটি ব্যথার পর হংসধ্বনিতে ছড় টানো, ব্যাকুল এস্রাজ থেকে আদিতম স্বর
বৃষ্টিক্ষত
সে আসে। ধুলো জমা হয়। বৃষ্টিক্ষত। কেউ যেন এক টুকরো বেদনা সেলাই করে দিচ্ছে রৌদ্রবেসিনে। এসো তুলে ধরো এই রোদ্দুর, অন্তর্বাস খুলে চিনে নাও তাকে। রোগা ও খয়েরি এই ছোটগল্প আমার। শুরু নেই, শেষ নেই। যেন কত রাত জেগে জেগে কাটিয়েছে এই ঝরনা কলম। আর নীরবতা, আর সান্নাটা— পোয়াতি হয়ে উঠছে ভাতঘুম। জল পড়েই চলেছে, কে যে বারবার খুলে দেয় কৌতুকনির্ঝর! জল পড়ে জল পড়ে। আতশকাচের বাড়ি, সূর্য ছানতে গিয়ে নিজেই আগুন।
বৃষ্টির পেছনপানে যে তারা ঘাপটি মেরে বসে আছে, তার কাছে বসন্ত এক রোদন-পরব। আর ফাল্গুন বিনিময় করে করে শুধু কাদা লেগে গেল সাঁই, এই হাতে শুধুই বারুদ। মেঘের এপ্রনের তলে একা সেই রুগ্ন তারাটি। সে তারাই তো ছোটগল্প আমার, আমার বাতিল গলার স্বর। যখন একটা একটা করে শব্দ মুছে ফেলি, ইরেজার হে, তোমারই ইবাদত করি, যখন একটা একটা করে কান্না মুছে ফেলি, জলের বিজ্ঞাপন হয়ে তুমি বেজে ওঠো, আর খালি গেলাসের কথা, আর কাচের ভঙ্গুরতা নিয়ে কত ছল কত ছল, কত না হলুদ বর্ণমালা, পাতার খোয়াইশ নিয়ে, ফলের বাসনা নিয়ে ঝরে গেল আম্রমুকুল।
পরাজাগতিক
মৃত সেই ঘোড়াটিকে দেখো। এখনও ছুটছে সে, এখনও এখনও
অথচ বুকের থেকে গাঢ় এক রক্তের ধারা, যেন কিছুই হয়নি তার, যেন শুধুমাত্র লাগামখানি হাওয়ার বেমক্কা টানে ছিঁড়ে ঝুলছে এখানে। রক্ত নয়, ঘাম নয়, এ শুধু লাগাম ছিল, এখনও এ ঘোড়ার বুকের ভাঁজেএইটুকু স্মৃতি লেগে আছে। প্রভু এসে থামাবেন তাকে, আদরে আশ্লেষে দেবেন নতুন লাগাম। তাঁর হাতে গম ও যবের দানা, ভিজে ছোলা, আস্তিনে লুকোনো বাঘনখ।
আমার সময় পড়ে আসে। আনদিনে বেভুল শাপলার বনে ব্যাধ এসেছিল। অলীক তরঙ্গজালে তার মুখ ছিল ঢাকা।
যবনিকা টেনে দিতে গিয়ে দেখি আমার শরীরজোড়া আঁশ, আঁশ নয় সে তোএক লৌহঝিনুক যেন কফিনের মতো করে জড়িয়ে রেখেছে।
আনো তবে তোমার সে হিরণ্যকুঠার। ভেঙে দাও লোহার এ খোলস আমার।
চলে যাই বালির প্রদেশে। দেখো দেখো আজও এ হৃদয়পিণ্ডের মাঝে রক্তনির্ঝর সেই জেগে বসে আছে। তাকে দাও হুহু মরীচিকা, দাও এক তাজা শবদেহ, খুলিভরা কারণবারির ধারা ধুয়ে দিক সবটা অরণ্যধ্বনি, পাখিডাক। বহুদিন বাদে সেই গূঢ় কাপালিক আজ বসেছে বিদ্যুতে, আর তার করোটির থেকে পরাজাগতিক এক সাপ নেমে আসে
সিংহিনী
সে ছিল দুঃখের যমজ বোন, সে ছিল দলছুট একক সিংহিনী। তাকে দিলাম ভাঙা তালপাতার পাখা, দিলাম এ ঘুণেধরা মগজ আমার।
আমার খুলি ফাটিয়ে দিচ্ছে ডোম। আমি দেখতে পাচ্ছি আগুনের ভেতর আমার খুলি ফাটিয়ে দিচ্ছে ডোম।
তাহলে কি তাহলে কি
আমিও শবদেহ এক
চিতার ভেতরে শুয়ে নিজেই নিজের এই পুড়ে যাওয়া দেখতে দেখতে আমি ঘুমিয়ে পড়ছি, আর ঘুমিয়ে পড়ছি, আর জেগে উঠছে সেই বাতিল কবরখানার নিভন্ত শকুন! শকুন কম পড়লে জানিও, আমার হৃদয়ের কাছে তারা বসে আছে, ঠুকরে খাচ্ছে আমারই অলিন্দ নিলয়। শকুন কম পড়লে মাত্র একটা চিঠি ছেড়ে দিও, তাকে দিও চিতাভস্মের ডানা। হাওয়ারূপ এসএমএস পাঠিয়ে দিও আমার এ কলিজায়। সেইখানে ভাঙা সানকিতে করে রক্ত ও কান্না চটকে নিয়ে পান্তা আমানি খাই আমি আর আমার সিংহিনী
কাঁঠালপাতার বাঁশি
চাষাবাদ সামান্যই, তবু আমি ফসল তুলতে ভুলে গেছি।
এখন দিনের শেষে মত্ত মাতঙ্গের দল তারা সব কর্কটরাশিতে জাত, খুবলে খুবলে খায় আমার এ তুচ্ছ আবাদ।
রবিফসলের দিন শেষ হলে দেখো ঐ মাঠে মাঠে জ্বলছে আগুন, তার পাশে পড়ে আছে কুমোরের চাক, ভাঙা হাঁড়িকুঁড়ি।
চৈ চৈ চৈ চৈ হাঁসটিকে ডাকি তবু অরণ্যপ্রমাদে।
এসো হে আকাশ, এসো ক্ষিতি ও মরুৎ, আমি কলমে লিখব সেই বিনিময়।
আকাশ কোথায় থাকে! সরু ও লম্বাটে এক পেজমার্কার, যেন ময়ূরের পাখনা, যেন শান্তির পারাবত এক নেমে আসছে দিন ও রাত্রির এই সন্ধিকালে, হননের ছলে তার নাম দিই মহাকাশ, আর ফুটন্ত সেই ঘিলুর কড়ায় রান্না হোক আমাদের ঘরবাড়ি,
আমাদের মুঠো মুঠো ছাই ও অঙ্গার-কথা তার গায়ে লিখে দিয়ে মৃদুবাতাসের দিকে চলে যাব, চলে যাব অতিজাগতিক সেই ঘোড়ার কেশর থেকে যেইখানে স্বেদ জমা হয়।
স্বপ্নডিমের থেকে চিঠি উড়ে আসে। চিঠি নয়, সে তো ছিল আরজনমের সখী, সে আমার কাঁঠালপাতার বাঁশি। তাকে তুমি নিয়তি বলেছ