অরিন্দম মন্ডল
চিঠিটা খামে ভরার আগে আরেকবার ভালো করে পড়তে শুরু করলেন ধরণীমোহন সান্যাল। এটা মামুলি কোনও চিঠি না, এ হল তাঁর দীর্ঘ তিন মাস গবেষণার ফসল। এই তিন মাসে কী খাটুনিটাই না হয়েছে। দেশের এমন কোনও পাহাড়, জঙ্গল, চিড়িয়াখানা, অভয়ারণ্য, সংরক্ষিত অরণ্য বাকি নেই যা তিনি ঘুরে দেখেননি। কত দিন না খেয়ে কাটিয়েছেন, কত রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি— খালি দেখেছেন, ভেবেছেন আর লিখেছেন। এই অক্লান্ত পরিশ্রম বৃথা যায়নি। দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ আর ভাবনাচিন্তার মাধ্যমে যে সত্য খুঁজে পেয়েছেন তিনি, তা এক কথায় অভাবনীয়। এই গবেষণা প্রাণীবিজ্ঞান জগতে এক বিপ্লব এনে দেবে বলেই তাঁর বিশ্বাস। এর দৌলতে হয়তো নোবেলও পেয়ে যেতে পারেন। অবশ্য না পেলেও কিছু যায় আসে না। পুরস্কারের লোভে তিনি বিজ্ঞানচর্চা করেন না, করেন নিজের মানসিক শান্তি আর আনন্দের জন্য। কিন্তু আলোড়ন সৃষ্টির ক্ষমতাধারী এরকম একখানা গবেষণাপত্রকে তো আর নমোনমো করে সেরে দিলে হয় না। তাই বারচারেক খুঁটিয়ে পড়ার পরেও পুনরায় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলেন।
গবেষণাটা হাতির উপরে। হাতির প্রতি ধরণীবাবুর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অপরিসীম। এরকম অতিকায় চেহারার এক প্রাণী, অথচ কী নিরীহ। ঠিক যেন প্রাচীন ভারতের ব্রহ্মজ্ঞানী ঋষিদের মতো— এমন কিছু কাজ নেই যা তাঁদের অসাধ্য, এমন কোনও জ্ঞান নেই যা তাঁদের অজানা; অথচ সকলেই শান্ত, নিরহঙ্কার। ঠিক এই কারণেই ছোটবেলা থেকেই হাতি তাঁর প্রিয় প্রাণী।
তবে নিছক জ্ঞান আহরণ বা শৈশবের হাতিপ্রীতি এই গবেষণার মূল কারণ নয়। এর আসল কারণ লুকিয়ে রয়েছে ধরণীবাবুর ছোটবেলায় ঘটা এক ঘটনার মধ্যে।
তখন তিনি ক্লাস সেভেনে পড়েন। একদিন সন্ধ্যাবেলা বাবার সঙ্গে বাবার এক সহকর্মীও এলেন তাঁদের বাড়িতে। বেশ কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা চলছিল। সব কিছু ঠিকঠাকই ছিল, কিন্তু গোল বাঁধল চোরাশিকারিদের ক্রমবর্ধমান উপদ্রবের কথা উঠতেই। সেদিনের খবরের কাগজে বেরিয়েছিল, কোথায় যেন একটা হাতিকে মেরে তার দাঁতগুলো কেটে নিয়ে পালিয়ে গেছে চোরাশিকারিরা। কথায় কথায় সেই সহকর্মী বলে ফেললেন, হাতিদের নিয়ে বেশি চিন্তাভাবনা করার কোনও মানেই হয় না। কারণ হাতি আসলে আর কিছুই না, মশার পরিবর্তিত রূপ। ব্যস আর যায় কোথায়! সাঁই করে ছুটে এসে বালক ধরণীবাবু মাথা দিয়ে লোকটির পেটে মারলেন এক ঢুঁসো, আর তারপর আঁচড়ে-কামড়ে সেই দুঃসহ সহকর্মীকে বাড়ির বাইরে বের করে দিতে বেশি সময় লাগল না। এক সময় রাগ পড়ে গেল ঠিকই, কিন্তু ওই কথাটা মনের মধ্যে সারাক্ষণ খচখচ করে যেতেই লাগল। তবে কি গম্ভীর সম্রাটসম হস্তী আসলে এক তুচ্ছ মশার জাতভাই? না এ কিছুতেই হতে পারে না। তিনি শপথ করলেন, হাতি যে মহান, তা প্রমাণ করেই ছাড়বেন। আর বাল্যকালের সেই শপথই হল ধরণীবাবুর বর্তমান গবেষণার আসল উদ্দেশ্য।
এই মুহূর্তে তাঁর মন আনন্দে ভরপুর। দীর্ঘ ত্রিশ বছরের দুশ্চিন্তা, সন্দেহ সবকিছু মন থেকে উবে গেছে। এই তিন মাস যাবৎ যে সমস্ত তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন তার দ্বারা অনায়াসে বলা যায় হাতি আদৌ মশার বৃহৎ রূপ না, কখনও ছিলও না, আর কোনওভাবে হতেও পারে না। বরং গবেষণার ফল বলছে হাতি পক্ষীশ্রেণির থেকে উদ্ভূত হয়েছে, এবং খুব সম্ভবত ঈগলজাতীয় কোনও পাখির বিবর্তনের ফলেই ইদানিং কালের এই হাতির আবির্ভাব। এই যুক্তির সপক্ষে যে সমস্ত কারণগুলি তিনি চিঠিতে সাজিয়েছেন, সেগুলি এরকম—
প্রথমত, হাতি ও পাখির খাদ্যাভাসের মধ্যে অদ্ভুত মিল সকলেরই চোখে পড়ে। উভয়েই নিরামিষাশী— অধিকাংশ পাখিরাই দানাশস্য খেয়ে জীবনযাপন করে আর হাতির যে শস্য কীরূপ প্রিয়; তা তো তাদের ধানক্ষেতে হানা দেওয়া, গোলা, মরাই ভেঙে ধান খেয়ে যাওয়া দেখেই বোঝা যায়।
দ্বিতীয়ত, হাতির বৃহৎ কানের উপস্থিতি। জীবজগতে যত প্রাণী আছে তাদের মধ্যে হাতির কানদুটিই সর্ববৃহৎ আকৃতির। এগুলি আসলে কান নয়, এগুলি হল একপ্রকারের অভিযোজিত অঙ্গ— ডানার অভিযোজনের ফলেই এর উৎপত্তি। এবং হাতি যে আসলে পাখি এটাই তার সব থেকে বড় প্রমাণ। বিবর্তনের প্রাথমিক পর্যায়ে কান ঝাপটে হাতিরা উড়তে পারত (যদিও তখনও তারা ঠিক হাতি হয়ে ওঠেনি) কিন্তু দীর্ঘকালীন ব্যবহার না করার প্রভাবে সেগুলি কানে পরিণত হয়েছে, ঠিক মানুষের লেজ বা অ্যাপেন্ডিক্সের মতো। তাছাড়া পাখিরও গ্রীবার কাছেই ডানাদুটি অবস্থিত, হাতির ক্ষেত্রেও কান একইরকম জায়গায় থাকে। কানের আকৃতি দেখে মনে হয় হাতি নিশ্চয় বড়সড় কোনও পাখি (ঈগল, চিল) থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে, তবে খাদ্যাভাসের বৈপরীত্য দেখে মনে হয় অধুনালুপ্ত কোনও পাখির বিবর্তনের ফলেই হাতির জন্ম।
তৃতীয়ত, হাতি আর পাখি উভয়েরই লেজ আছে। তবে ওড়ার পরিবর্তে মাছি-মশা-কীটপতঙ্গ তাড়ানোর জন্যই হাতির লেজের পালক ঝরে গিয়ে তার পরিবর্তে লোমের উদ্ভব ঘটেছে।…
এছাড়া আরও কিছু কারণ তিনি লিখেছেন, তবে সেগুলি অতটা গুরুত্বপূর্ণ না।
ব্যস! এবার কাজ শেষ, সব মিলিয়ে দেখে নেওয়া হয়ে গেছে। পেনের ঢাকনাটা বন্ধ করে যখন সবে শুতে যাবার কথা ভাবছেন, তখনই মোবাইলের অ্যালার্ম বেজে উঠল। এখুনি আটটা বেজে গেল? এই হচ্ছে ধরণীবাবুর এক রোগ— একবার কাজ শুরু করলে আর সময়ের জ্ঞান থাকে না। লেখালেখি করে খেয়ে দেয়ে যখন ঠিকঠাক করতে বসেন তখন বাজছিল রাত বারোটা, তারপর কখন যে সকাল নেমেছে তা তিনি টেরই পাননি। আরও একটা রাত না ঘুমিয়ে কেটে গেল। কী আর করা যাবে, বৃহত্তর স্বার্থের জন্য এসব ছোটখাটো জিনিস নিয়ে মাথা ঘামালে চলে না। বার দুই হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন।
সামনে এখন একটাই কাজ, গবেষণাপত্রটাকে কোনও সায়েন্টিফিক জার্নালের দপ্তরে পাঠানোর বন্দোবস্ত করা। আটটা পাঁচ বাজছে, পোস্টঅফিস খোলে সাড়ে নটায়। মুখ ধুয়ে চা-টা খেতে খেতে নটা বেজেই যাবে। এদিকে দুদিন বাজার যাওয়া হয়নি, ঘরে আর কিচ্ছুটি পড়ে নেই, আজ না গেলে বনমালী চেঁচামেচি করবে। ভালোই হল, একেবারে বাজার যাবার পথেই চিঠিটা স্পিডপোস্ট করে দেবেন। মনে মনে সব পরিকল্পনা করে নিয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়ালেন ধরণীবাবু।
২
পৃথিবীতে যত বিজ্ঞানী জন্মেছেন তাঁদের মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম প্রকারের মধ্যে যাঁরা আছেন, তাঁরা খালি কাগজে-কলমে কাজ করেই খালাস। যেটা আবিষ্কার করলেন সেটার আদৌ কোনও বাস্তবিক ভিত্তি আছে কিনা, পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করা যায় কিনা, গেলে কীভাবে যায়— এসব নিয়ে তাঁদের কোনও মাথাব্যথা নেই। আর দ্বিতীয় দলের বিজ্ঞানীরা কর্মযোগী, আবিষ্কৃত তত্ত্ব চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ না করে দেওয়া অব্দি তাঁদের মনে শান্তি নেই।
আমাদের ধরণীবাবু এই দ্বিতীয় দলে পড়েন। হাতির ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান যাচাই করে তিনি একটা সিদ্ধান্ত পৌঁছেছেন ঠিকই, কিন্তু হাতি যে সত্যিই পাখি ছিল সেটা তাঁকে পরীক্ষা করে দেখতেই হবে। তার জন্য একটা হাতি জোগাড় করা দরকার। রমেন দোকানিকে বলে দেখলে হয়। লোকে বলে তার দোকানে নাকি হিরে থেকে জিরে সব পাওয়া যায়, কাজেই হাতি না পাওয়া যাওয়ার কোনও কারণ নেই।
চিঠিটা পোস্ট করার পর এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ধরণীবাবু সাইকেল নিয়ে বাজারে দিকে এগুচ্ছিলেন। পোস্টঅফিস থেকে বাজার আসার একটা শর্টকাট রাস্তা আছে। ওদিক দিয়ে বাজার পোঁছতে মিনিট পাঁচেক লাগে। তবে রাস্তাটা একটু নির্জন এই যা। তার মূল কারণ হল পদ্মদীঘি। পদ্ম ফুটত কিনা জানা নেই, তবে এটা এককালে বড়সড় ঝিল ছিল। মানবসভ্যতার কল্যাণে তা এখন মজে ডোবা হয়ে গেছে। লোকে বলে, পদ্মদীঘির আশেপাশে নাকি দিনেদুপুরেও নানা অশৈলী কাণ্ড ঘটে। এসব কথাকে ধরণীবাবু যে বিন্দুমাত্র পাত্তা দেন না সে কথা বলাই বাহুল্য। তিনি নিয়মিত এই রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করেন।
ধরণীবাবুর সাইকেল তখন ডোবা থেকে আন্দাজ বিশ হাত দূরে, এমন সময় তাঁর মনে হল কেউ যেন ‘ফেউ-ফেউ’ করে কাঁদছে। এদিক ওদিক তাকালেন তিনি; জনপ্রাণী নেই আশেপাশে। তবে কে কাঁদল? মনের ভুল হবে হয়তো। এইবার ডোবার পাশে এসে পৌঁছেছেন, আবার সেই ‘ফেউ-ফেউ’ রব। এবার সাইকেল থেকে নেমে পড়লেন ধরণীবাবু। সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে এপাশ-ওপাশ ঘুরে দেখলেন— কেউ কোত্থাও নেই। বুকটা ধড়াস করে উঠল তাঁর। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলেন। চোখ বুজে অনুভব করার চেষ্টা করলেন শব্দটা কোন দিক থেকে আসছে।
আন্দাজ মত কয়েক গজ এগুতেই শব্দের উৎসকে খুঁজে পাওয়া গেল। ডোবার যে পাশটায় ঝোপঝাড় একটু কম সেখানে বালিশের সাইজের কিছু একটা পড়ে আছে। যেহেতু কাঁদছে, তাই ওটি বালিশ নয়, অতএব সেটিকে বস্তু না বলে প্রাণী বলাই সমীচীন হবে। কিন্তু কাদা-পাঁকে মাখামাখি হয়ে যাওয়ায় প্রাণীটি কী সেটা বোঝা যাচ্ছে না। প্যান্টটাকে হাঁটু অব্দি গুটিয়ে ডোবায় নামলেন ধরণীবাবু। দেখতে বালিশের মতো হলে কী হবে, প্রাণীটি বেশ ওজনদার। শেষমেশ যখন তাকে টেনে পাড়ে তোলা হল, তখন ধরণীবাবু ঘেমেনেয়ে একশা।
প্রাণীটির বেশ বড়বড় দু’খানি কান আছে দেখা যাচ্ছে। সামনের দিকে কী যেন একটা ঝুলছে। ওমা! এ যে হাতিছানা! সামনের ওটা তো শুঁড়। কিন্তু হাতিটা এখানে এল কী করে? এই অঞ্চলে কস্মিনকালেও তো হাতির দল বেরোনোর খবর পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ দলছুট হয়ে এখানে আসেনি। তবে কি চোরাচালান? এইভাবে হস্তী আবির্ভাব রহস্য নিয়ে ভাবতে ভাবতে ধরণীবাবু চিন্তাসাগরে প্রায় ডুবেই যাচ্ছিলেন, এমন সময় খড়কুটোর মতো একখানি বুদ্ধি তাঁর মাথায় ভেসে এল। পরীক্ষা করার জন্য একটা হাতির প্রয়োজন, আর এই মুহূর্তে তাঁর সামনে একটা বেওয়ারিশ বাচ্চা হাতি বসে। মানুষের বাচ্চাকে ছোট থেকে আচার-ব্যবহার, নীতিবোধ শেখালে তবেই সে বড় হয়ে আদর্শ মানুষ হয়। হাতির বাচ্চার ক্ষেত্রেও তাঁর অন্যথা হবে বলে মনে হয় না। এখন থেকেই যদি ওড়ার ট্রেনিং দেওয়া হয় তবেই না বড় হয়ে পতাকার মতো পতপত করে উড়তে পারবে। সে এখন যতই ভুলে গিয়ে থাকুক না কেন, রক্তের গুণ অত সহজে যায় না। তাছাড়া বেচারা এতক্ষণ ধরে পাঁকে-কাদায় হাবুডুবু খেয়েছে, হাত-পা ছড়ে গিয়ে থাকতে পারে; খিদেও পেয়েছে নিশ্চয়। হাতিছানাটিকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে কয়েক দিন সেবা-শুশ্রূষা করা যাক, তারপর না হয় ভালো দিন দেখে শিক্ষা-দীক্ষার বন্দোবস্ত করা যাবে। বিনামূল্যে হাতি পেয়ে ধরণীবাবু মনে মনে ভগবানকে ধন্যবাদ দিতে যাচ্ছিলেন, শেষমেশ জিভ কেটে থেমে গেলেন। বিজ্ঞানী হয়ে কিনা ভগবানকে ধন্যবাদ! ছিঃ!
৩
এতক্ষণে একটু শান্তিতে বসার সুযোগ পাওয়া গেল। হাত-পা ছড়িয়ে আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিলেন ধরণীবাবু। সকাল থেকে যা হুড়যুদ্ধ গেল! একে তো রাতে ঘুম নেই, তার উপর ওই হাতিকাণ্ড। যতই অনাহূত হোক না কেন, বেচারার স্বাস্থ্য নিয়ে একটু চিন্তা হচ্ছিল বৈকি। তাই বাড়ি ফিরে হাতিকে স্নান করিয়েই বটকেষ্ট ডাক্তারকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। হলই বা মানুষের ডাক্তার, তার মানে তো এই নয় যে সে হাতির চিকিৎসা করতে পারবে না। হাতি বলে কী মানুষ নয়? বট এসে পাক্কা চার মিনিট ধরে হাতিটার শুঁড় টিপে পালস রেট চেক করে, ল্যাজের প্রেসার মেপে, স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে বুকে কফ জমেছে কিনা সেসব দেখে বলে গেল চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু ধরণীবাবু তাতে খুশি না হওয়ায় সে একটা মলম, একটা অ্যান্টিবায়োটিক আর একটা কাফসিরাপ লিখে দিয়ে গেছে।
দেখতে দেখতে দুটো সপ্তাহ কেটে গেল। হাতিছানা এখন পুরোপুরি সুস্থ, রীতিমত হেসে-খেলে বেড়াচ্ছে বলা যায়। প্রথমত বাচ্চা তার উপর নতুন পরিবেশ, তাই শুরুর দিকে খাবার হজম করতে পারছিল না। তবে এখন আর কোনও সমস্যা নেই। এখন অবনীবাবুর সঙ্গেই খাবার খায় হাতিছানাটি। ভাত-মুড়ি কিছুতেই আপত্তি নেই, আলুভাজা তো তার বিশেষ প্রিয়। এমনকি কাঁটা ছাড়িয়ে দিলে মাছও খেয়ে নেয় এখন।
এসব দেখে ধরণীবাবু তো দারুণ খুশি। এত দিন যে প্রাণীটা নিরীহ নিরামিষভোজী ছিল আজ সে যদি মাছ খেতে পারে, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পেলে তার পক্ষে ওড়াটাও এমন কিছু অসম্ভব না।
মনে মনে স্থির করলেন, আরেকটা সপ্তাহ কাটুক, তারপর ট্রেনিং শুরু করা যাবে। এই কটা দিনে সমস্ত জোগাড়যন্ত্র সেরে ফেলতে হবে। বিশেষ কিছুর প্রয়োজন নেই— গোটা কয়েক গ্যাস বেলুন, একটা এয়ার গান, একটা প্রমাণ মাপের ফ্যান আর একটা রিমোট কন্ট্রোল হেলিকপ্টার।
প্ল্যানটা মোটামুটি এরকম। ফ্যানের ব্লেড আর মোটরটার সামান্য রদবদল করে এমন একটা ফ্যান বানানো হবে যা ছোটখাটো মাপের ঝড় তলার ক্ষমতা রাখবে। এরপর ফ্যানটাকে মাটিতে রেখে ফ্যানের উপরের তারজালির উপর হাতিছানাকে বসিয়ে ফ্যানটা চালিয়ে দেওয়া হবে। ধীরে ধীরে ফ্যানের স্পিড ততক্ষণ অব্দি বাড়ানো হবে, যতক্ষণ না হাতিটি মাটি থেকে বেশ কয়েক হাত উপরে ভেসে উঠছে। এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে পড়ে হাতিছানা হাত-পা-লেজ ছুঁড়তে এবং কান ঝাপটাতে শুরু করবে। যদি দেখা যায় খালি হাত-পা ছুঁড়ছে, কান নাড়ছে না, সেক্ষেত্রে পাগুলো বেঁধে রাখার চেষ্টা করা যেতে পারে। এতে হাতি এবং ধরণীবাবু দুজনেরই কষ্ট হবে ঠিকই কিন্তু আসল উদ্দেশ্য সফল করার জন্য সামান্য আত্মত্যাগ তো করতেই হবে। যতদিন না হাতিটি কানে ভর দিয়ে হাওয়ায় ভাসতে শিখছে ততদিন পর্যন্ত চলবে এই পদ্ধতিতে অনুশীলন।
এই পদ্ধতি বিশেষ ফলপ্রসূ না হলে দ্বিতীয় উপায়ের কথাও ভাবা আছে। রিমোট কন্ট্রোল হেলিকপ্টারটির নীচে এক জামবাটি আলুভাজা ঝুলিয়ে দেওয়া দেওয়া হবে। তার আগে কয়েকদিন ধরে হাতিকে আলুভাজা দেওয়া হবে না। এরপর জামবাটিসুদ্ধ হেলিকপ্টারটিকে ওড়ানো হবে হাতিছানার মুখের সামনে দিয়ে। প্রিয় খাদ্যকে ধরার চেষ্টায় সে প্রথমে শুঁড় বাড়াবে, অসফল হয়ে দৌড়াদৌড়ি করে ধরার চেষ্টা করবে। শেষ অব্দি তাতেও নাগাল পাবে না, কারণ জামবাটি মাটি থেকে সাত হাত উপরে। তখন ক্ষিপ্ত হয়ে হাতিছানা কান ঝাপটে উড়ে আলুভাজা খাবার চেষ্টা করবে এবং ধরণীবাবুর অভীষ্ট ফল লাভ হবে।
দুটোর একটাও যদি সফল না হয় সেক্ষত্রে কঠিন পথ বেছে নিতেই হবে। এতে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা আছে বেশ। তবে তার তুলনায় সাফল্যের সম্ভাবনা দশগুণ। পদ্ধতিটি খানিকটা এরকম। গোটা দশেক গ্যাস বেলুন বেঁধে হাতিটিকে শূন্যে তুলে দিয়ে এয়ার গানে করে গুলি করে এক একটি বেলুন ফাটানো হবে। প্রাণ রক্ষার তাগিদে হাতি কান ঝাপটাবে এবং শেষমেশ উড়তে শিখে যাবে। ঠিক যেভাবে বাচ্চা পাখি উড়তে শেখে সেভাবে। জোরে হাওয়া দিলে বেলুনসুদ্ধু হাতি যাতে ভেসে দূরে না পালায় তার জন্যে হাতির কোমরে একটা দড়িও বেঁধে দেওয়া হবে। এক্ষণে সবাই ভাবতে পারে সবকটা বেলুন যদি ফেটে যায় আর হাতি যদি তখনও উড়তে না পারে তাহলে কী হবে। এর প্রতিকারও ভাবা আছে। সেই প্রমাণ মাপের ফ্যানটা নীচে লাগানোই থাকবে, বিপত্তির বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা দেখা গেলেই ওটার স্পিড বাড়া-কমা করেই হাতিকে নীচে নামানো হবে।
সমস্ত পরিকল্পনা করে ধরণীবাবু গেলেন খেতে। আজ গভীর ঘুমের প্রয়োজন। সকাল সকাল উঠে জিনিসপত্র জোগাড়ে নেমে পড়তে হবে।
৪
এদিকে এক অদ্ভুত সমস্যা দেখা দিল পাড়ায়। সেদিন সকালবেলায় বাজার যাওয়ার সময় পাশের বাড়িতে দারুণ হইচই শুনে ধরণীবাবু সেদিকে উঁকি দিয়ে দেখতে পেলেন গৃহকর্তা সহদেব মাথায় হাত দিয়ে বসে গভীরভাবে কিছু চিন্তা করছে, তার স্ত্রী পাড়ারই কয়েকজনকে উত্তেজিতভাবে কী যেন বলে চলেছে। আশঙ্কা মিশ্রিত কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গেলেন সেদিকে।
“আমরা তো জন্মে কারও ক্ষতি করিনি”, “হায় হায় গো”, “কোন মিনসে এমন করল গো” ইত্যাদি কথার ভিড়ের মধ্য থেকে যেটুকু সারবস্তু উদ্ধার করা গেল সেটা মোটামুটি এরকম— সহদেবদের পাঁচ-পাঁচটা আমগাছ, যেগুলোতে কাল অব্দি পাতার থেকে নাকি আমের সংখ্যা বেশি ছিল, সেগুলো রাতারাতি ফাঁকা হয়ে গেছে। সহদেবের মেয়ের গতবছর বিয়ে হয়েছে, মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে আম পাঠাবার যে পরিকল্পনাটা ছিল সেটা তো নষ্ট হলই, নিজেদের জন্যও কিচ্ছুটি পড়ে নেই।
এসব শুনে ধরণীবাবুর মনটা একটু খারাপ হল। তবে সেটা যতটা না প্রতিবেশীদের প্রতি সহানুভূতিজনিত কারণে, তার থেকেও বেশি নিজে আম না খেতে পাওয়ার কারণে। প্রতিবারেই খান দশেক আম দেয় সহদেব। যেমন স্বাদ তেমনি গন্ধ। এবার আর পাওয়া যাবে না ভাবলে বুকটা হুহু করছে। হাতিছানাকেও এক-দুটো খাওয়াবেন ভেবেছিলেন; সেটাও আর হল না।
সহদেব যে একা এই ঘটনার শিকার নয় সেটা জানা গেল বাজারে যাওয়ার পর। পাড়ার আরও দু-তিন জনের বাগানের গাছ থেকে নাকি কলা, নারকেল গায়েব হয়ে গেছে। অদ্ভুত কাণ্ড তো! এত ফলমূল এক রাতে কে চুরি করে নিল? সবাই সবাইকে সজাগ থাকার পরামর্শ দিয়েই শান্ত হয়ে গেল।
তবে এত ফল সাবাড় করেও চোরের লোভ যে মেটেনি সেটা প্রকাশ পেয়ে গেল পরের দিন সকালেই। খবর এল আজও তিন-চার ঘরের গাছ ফাঁকা হয়েছে।
এইবার নিজের কাঁঠালগাছগুলো নিয়ে চিন্তায় পড়লেন ধরণীবাবু। অমন সাধের গাছগুলোও কি ফাঁকা করে যাবে চোরে? এ অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না। দরকার হলে লোক লাগিয়ে পাহারা দেওয়াতে হবে, পয়সা-কড়ি নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই। কিন্তু লোক ঠিক করতে হলেও তো দিন দুয়েক সময় লাগবে। এরই মধ্যে যদি সব ঝেড়ে সাফ করে দেয়? অগত্যা ঠিক করে হল যতদিন না লোক পাওয়া যাচ্ছে ততদিন তিনি আর বনমালী পালা করে রাত জেগে গাছ পাহারা দেবেন।
আজ ধরণীবাবুর পালা। প্ল্যান করেই ধরণীবাবু আজকের রাতটা বেছেছেন। পূর্ণিমার রাত। রাত জেগে চাঁদ দেখবেন। কবি না হলে যে চাঁদের সৌন্দর্য দেখে ‘আহা-উহু’ করতে নেই এরকম তো কোন দিব্যি দেওয়া নেই!
কিন্তু কপাল মন্দ। বিকেল থেকেই ঈশান কোণে মেঘ জমতে শুরু করল। খাওয়া-দাওয়া সেরে ধরণীবাবু যখন পাহার দেওয়ার জন্য বাইরের আরামকেদারায় এসে বসলেন, তখন ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করে দিয়েছে। মিনিট দশেকের মধ্যে ঝুপ করে কারেন্টটাও চলে গেল। অবশ্য কাছে টর্চ আছে। তাছাড়া বাড়িতে ইনভার্টারও রয়েছে। কিন্তু লাইট না জ্বালিয়ে অন্ধকারেই বসে থাকা বেশি সুখকর মনে হল তাঁর কাছে।
এই বার ঝড় শুরু হল। সোঁ সোঁ আওয়াজ। মাঝে মাঝে বাজ পড়ছে প্রচণ্ড শব্দে। বিদ্যুতের আলোয় ভরে উঠছে চারপাশটা। আজ আর চোরেদের আশার সম্ভাবনা নেই বোধহয়। এত সুন্দর ঠান্ডা-ঠান্ডা পরিবেশ পেয়ে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল ধরণীবাবুর। কিন্তু তন্দ্রাচ্ছন্নভাবটা মুহূর্তের মধ্যে কেটে গেল।
কাছেই কোথাও একটা বাজ পড়ল আর তার আলোতে তিনি দেখতে পেলেন তাঁর পরম প্রিয় হাতিছানা থুপ-থুপ করে বেরিয়ে আসছে ঘর থেকে। তার শুঁড়ে দরজার চাবি। ‘খুট’ শব্দ শুনে বুঝলেন বাইরের দরজার তালা খুলে ফেলেছে। এসব দেখে-শুনে ধরণীবাবু এত অবাক হয়ে গেলেন যে টর্চ জ্বালার কথা মাথাতেই এল না তাঁর। দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে বোঝা গেল এইবার বাইরে বেরোল হাতিছানা।
এরপর যা দেখলেন তিনি তাতে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হল। বিদ্যুতের আলোয় দেখা গেল হাতিছানা বার দুই কান ঝাপটে মুহূর্তের মধ্যেই মাটি ছেড়ে শূন্যে ভেসে উঠল। তারপর বাতাসে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে গেল কাঁঠাল গাছের দিকে। পট করে গোটা একটা কাঁঠাল তুলে উদরস্থ করতে বেশি সময় লাগল না তার। এরপর কাঁঠাল খেতে সে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল আশেপাশে কেউ আছে কিনা সে নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামানোর প্রয়োজন বোধ করল না।
রাতারাতি পাড়ার সবার গাছ ফাঁকা হয়ে যাওয়ার রহস্যটা এবার পরিষ্কার হল ধরণীবাবুর কাছে।
সবথেকে বড় মাপের কাঁঠালটার কাছে পৌঁছে খাওয়া থামিয়ে দিল হাতিছানা। একটু থেমে কিছু যেন ভাবল, তারপর অতি যত্নে কাঁঠালটা ছিঁড়ে নিয়ে আবার উড়ে উড়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে এল। কাঁঠালটা দরজার সামনে নামিয়ে রেখে দিয়ে বাড়ির দিকে চেয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। ফোঁস করে যেন একটা দীর্ঘনিঃশ্বাসও ফেলল। এখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সে কি বিষণ্ণ? তবে কি ধরণীবাবু যা ভাবছেন সেটাই ঘটতে চলেছে? হাতিছানা কি বিদায় নিতে চাইছে?
সব আশঙ্কা সত্যি করে হাতিছানা বাড়ির দিকে পেছন ঘুরে আবার কান ঝাপটে মাটি ছেড়ে উপরে ভেসে উঠল। ধরণীবাবুর কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেল এইবার। হাতিটার প্রতি বড্ড মায়া পড়ে গেছে, তাকে ছাড়া কোনওভাবেই থাকতে পারবেন না তিনি। এতকাল অব্দি সমস্ত বন্ধনের প্রতি নির্লিপ্ত থাকা মানুষটা হঠাৎ করে কারও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে উঠল।
তিনি দৌড় লাগালেন বাইরের দিকে। হাতিছানা ততক্ষণে মাটি ছাড়িয়ে কয়েক হাত উপরে। ছুটে গিয়ে জাপটে ধরলেন হাতির কোমরটা। অতর্কিত আক্রমণে চমকে হাতিছানা শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল, তবে টাল সামলে নিতে বিশেষ সময় লাগল না। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল কোন আপদ এসে জুটল তার কোমরে। ধরণীবাবুকে দেখে বোধহয় সে খুশিই হল। তার ঠোঁটের কোনায় যেন এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল।
ধরণীবাবুকে সঙ্গে নিয়েই সে পাড়ি দিল কোনও অজানা ঠিকানার উদ্দেশ্যে। কয়েক মুহূর্তের জন্য আমাদের বিজ্ঞানীর মনে ভেসে উঠল তাঁর মা-বাবার কথা, ঘরবাড়ির কথা, বনমালীর কথা, পাড়া-প্রতিবেশীর কথা। তবে সেসব তিনি মুছে ফেললেন মাথা থেকে। ওসবের চেয়ে এখন হাতিছানার সঙ্গে লেপটে থাকার কথা চিন্তা করাটাই বিশেষ জরুরি বলে মনে হল তাঁর। কারণ এই মুহূর্তে তাঁরা মেঘের মধ্য দিয়ে চলেছেন। অন্যমনস্ক হয়ে একবার হাত ছেড়ে ফেললে তিনি নিজেও যে মেঘ হয়ে যাবেন সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে কোনওরকমে কোমর ছাড়িয়ে হাতিছানার পিঠে উঠে এসে গলা জাপটে বসে পড়লেন তিনি। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হল কই। হঠাৎ করে কানের পাশে একটা বিদ্যুৎ চমকে উঠল, তীব্র আলোর ঝলকানি আর প্রচণ্ড শব্দে জ্ঞান হারালেন ধরণীবাবু। গলার থেকে হাত আলগা হয়ে তাঁর চেতনাহীন দেহটা প্রবল বেগে মাটির দিকে পড়তে লাগল।
৫
গোটা শরীরে তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে চোখ খুলে আবিস্কার করলাম আমি বিছানায় শুয়ে। কোথায় আমি? উফ কী ব্যথা! মাথাটা আদৌ আছে নাকি উবে গেছে বুঝতে পাচ্ছিনে। ডান হাত দিয়ে ছুঁয়ে বুঝলাম কপালে ব্যান্ডেজ বাঁধা। বাম হাতটা নড়াতে গিয়ে দেখি তাতে চ্যানেল করে স্যালাইন লাগানো। ওহ! তাহলে আমি হাসপাতালে আছি নিশ্চয়। কিন্তু হাসপাতালে কেন? ধুর কিছুই তো মনে পড়ছে না।
কষ্টেসৃষ্টে উঠে বসার চেষ্টা করতেই দেখি দারুণ ব্যস্ত হয়ে হাঁইমাই করে কে যেন চিৎকার করে উঠল, “মশাই করেন কী! করেন কী!”
নাহ মাথাটা সত্যিই গেছে দেখছি। কারণ এই কথাটা বলে যিনি আমার দিকে এগিয়ে এলেন তিনি আসলে একটি উট। এসে আমাকে বিছানায় যত্ন করে শুইয়ে দিলেন তিনি। চোখগুলো বার দুয়েক কচলে নিয়ে আবার তাকালাম। কোনও ভুল নেই। এই মুহূর্তে নার্সের পোশাক পরে আমার বেডের পাশে যিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি সত্যি সত্যিই উট।
নেশা করার অভ্যেস কোনও কালেই আমার ছিল না। বিড়ি-সিগারেট তো বহু দূরের জিনিস মায় চায়ের প্রতিও টান অনুভব করিনি। এ নিয়ে লোকজনের কাছে কত গর্ব করে বেড়িয়েছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে নিজের অজান্তেই আমি নেশা করা শুরু করেছি, তাও আবার রীতিমত সস্তার নেশা।
চোখ বুজে থাকাই বাঞ্ছনীয় মনে হচ্ছে। চোখ খুললে আবার কী দেখব কে জানে!
“কী ধরণীবাবু কেমন আছেন?”
ওকি! অঙ্ক স্যারের গলা মনে হল। কিন্তু তিনি তো বহুকাল আগেই…
অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকালুম। সব দেখে পেটে একটা চিমটি কেটে পাশ ফিরে আবার চোখ বুজিয়ে দিলাম। পেটটা জ্বলছে। তার মানে আমি স্বপ্ন দেখছি না। তাহলে কী দেখছি? হলিউডের সিনেমা? সিনেমা ছাড়া এ যে একেবারে অসম্ভব। প্রথমে দেখলাম নার্সরূপী উট আর এখন অ্যাপ্রন পরা, গলায় স্টেথোস্কোপ ঝোলানো একটা শেয়াল!
“এহেহে মশাই বোধহয় আমাদের দেখে বড্ড ঘাবড়ে গেছেন”, উটের গলা পাই।
“সে আর এমন কী কথা। নতুন মানুষ কিনা”, আশ্বাস দেন শেয়াল ডাক্তার, “এবার এপাশে একটু ঘুরুন। সব বুঝিয়ে বলছি আপনাকে।”
ভদ্রতাবশত পাশ ফিরতে হয়। কিন্তু চোখ এখনও বন্ধই আছে। জিজ্ঞাসা করি, “এটা কোন হাসপাতাল?”
“হাঁসপাতাল? আ মোলো যা। এটা হাঁসপাতাল হবে কেন? আপনি কি হাঁস? এটা নরপাতাল”, আবাক হয়ে শেয়ালবাবু বলে ওঠেন।
নরপাতাল! এ আবার কেমন নাম! এটাই কি সেই যায়গা যাকে লোকে নরক বলে? এরা যমদূত নাকি? নাহয় আমি নাস্তিক তাই বলে আমাকে নরকে পাঠানো হবে! এ কেমন অন্যায়! মাথা গরম হয়ে যায় আমার।
“শুনুন মশাই যার অস্তিত্বের কোনও প্রমাণ নেই তাকে আমি বিশ্বাস করিনি, আর কোনও কালেই করব না। আপনাদের ভগবান যদি ভেবে থাকেন নরকে পাঠালে আমি নিজের কর্মের জন্য অনুতপ্ত হব তাহলে তিনি খুব বড় ভুল করেছেন। অন্ধ বিশ্বাসের চেয়ে অবিশ্বাস ঢের গুণে ভালো”, এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে দম নিই আমি।
“আরে ধুর”, একরাশ বিরক্তি ফুটে ওঠে ডাক্তারের গলায়, “এটা সেবাকেন্দ্র। মানুষের জন্য বলেই আমরা একে নরপাতাল বলি। সংস্কৃতে বলা যায় হিউম্যান হসপিটাল। বুঝলেন কিনা?”
সামান্যই বুঝি। বাদবাকি মাথার ব্যান্ডেজেই আটকে থেকে যায়। চোখ খুলে জিজ্ঞাসা করি “কিন্তু আমি এখানে কেন? আর আপনি আমার নামই বা জানলেন কীভাবে?”
“ধীরে, ধীরে। এই অসুস্থ শরীরে এত উত্তেজনা ভালো না”, একটা টুল টেনে শেয়ালবাবু আমার বেডের পাশে বসলেন। “দেখুন আপনি কীভাবে এখানে এলেন সেটা আমার কাছেও অতটা স্পষ্ট না। গত পরশু রাতের বেলা আপনি নাকি আকাশ থেকে পড়েছেন। তবে ভাগ্য ভালো খরগোশদের ডাঁই করে রাখা পুরানো তোষকের গাদায় পড়েছিলেন, নইলে বাঁচানো মুশকিল হত। খরগোশরাই শব্দ পেয়ে আপনাকে উদ্ধার করে এখানে দিয়ে যায়। আর নাম? ওটা আপনার বুক পকেটে রাখা ডাইরি থেকে জানা গেছে।”
এখন আমার আকাশ থেকে পড়ার মতোই অবস্থা। বুক পকেটের ডাইরির ব্যাপারটা বোঝা গেল। এ আমার পুরানো অভ্যেস। ওটা সবসময় কাছে থাকত, যাতে হঠাৎ করে কিছু মনে পড়লে লিখে রাখতে পারি। কিন্তু আমি পড়লাম কোত্থেকে? আর পড়লামই বা কেন? মাথায় চোট পেয়ে সব গুলিয়ে ফেলেছি বোধহয়।
“কিন্তু মশাই আপনি আকাশে করছিলেনটা কী? যন্ত্রপাতির সাহায্য ছাড়া তো মানুষ উড়তে পারে না বলেই তো জানতাম। আশেপাশে তো অন্যকিছুর ধ্বংসাবশেষও পাওয়া যায়নি।”
“কী জানি। আমার নিজেরই তো কিছুই মনে পড়ছে না। শুধু এটুকু খেয়াল আছে যে আমি আরামকেদারায় বসেছিলুম, ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল। তারপর যে কী হল কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।”
“মাথায় যেরকম চোট লেগেছে তাতে সাময়িক স্মৃতি বিভ্রাট অসম্ভব না। তবে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। একটু সুস্থ হলেই আপনাকে এখান থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তারপর আমাদের দেশটা ঘুরে ফিরে দেখুন। পরে যদি স্মৃতি ফিরে আসে তখন মন চাইলে না হয় নিজের জায়গায় ফিরে যাবেন। অবশ্যি আমাদের এখানে যারা একবার আসে তারা আর ফিরে যায় না।”
ইতিমধ্যে উট আমাকে এক গ্লাস কমলালেবুর রস এনে দিল। ডাক্তারবাবু আমাকে বিশ্রাম নিতে বলে বিদায় নিলেন। তাঁর এখনও অনেক রোগী দেখা বাকি আছে। আমিও জুসটা শেষ করে বিছানায় শুয়ে পড়লুম। বেশি চিন্তা করতে গেলে মাথা যন্ত্রণা করছে। সুস্থ হই, তারপর কিছু একটা করা যাবে।
৬
আজ ছাড়া পেলুম হসপিটাল থেকে। শরীর পুরো ঝরঝরে। দারুণ সার্ভিসিং করে দিয়েছে বলতে হবে, এত সুস্থ কখনও অনুভব করিনি। এরা খুবই ভালো মানুষ(?)। সঙ্গে একজন গাইডও দিয়েছে, সব জায়গা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখানোর জন্যে। যদ্দিন না আমার কিছু একটা হিল্লে হচ্ছে ততদিন সে আমার কাছেই থাকবে।
গাইডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে বেশ অসুবিধেয় পড়েছিলাম। এইরকম দামড়া চেহারার মানুষ আমি আর তিনি একটি পুঁচকে কাঠবেড়ালি— অসুবিধা হওয়া স্বাভাবিক। আমি দুই পা ফেলে যতটা এগুচ্ছি সেই দূরত্ব অতিক্রম করতে তাঁকে ভালো রকমের দৌড়োদৌড়ি করতে হচ্ছে। অবশ্য এতে ওনার কষ্ট হওয়ার কথা নয়, কাঠবেড়ালি দৌড়বাজ প্রাণী। কিন্তু ব্যাপারটা কীরকম খারাপ দেখাচ্ছিল। তাছাড়াও আশেপাশের জিনিসের বিবরণ দেওয়ার সময় তাঁকে বেশ জোরে বলতে হচ্ছিল, নইলে আমার কান অব্দি আওয়াজ পৌঁছচ্ছিল না। তাই শেষমেশ ঠিক করলাম কাঠবেড়ালিমশাইকে কাঁধে তুলে নি। এতে করে ওনার পায়ের পরিশ্রমও কম হবে আর কানের কাছে থাকায় স্বাভাবিক স্বরে কথা বললেই চলবে।
‘আপনি’ দিয়েই কথাবার্তা চলছিল। তারপর যেই জানা গেল তিনি আমার থেকে বয়সে ছোট অমনি আপত্তি করে বসলেন। তাই এখন আমি ‘তুমি’ দিয়ে সম্বোধন করছি।
রাস্তাঘাট কী দারুণ! পরিষ্কার ঝকঝকে তকতকে। এর পুরো কৃতিত্ব খরগোশ আর জিরাফদের। আমাদের ওদিকে যে কেন এরকম হয় না! চারিদিকে গাছপালাও প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। রাস্তাঘাটে গাড়িঘোড়ার ভিড় আমাদের মতোই। কলকারখানাও দেখতে পেলাম বেশ কয়েকটা। অথচ না আছে বাতাসে ধোঁয়া-ধুলো-বালি, না আছে অযথা চিৎকার চেঁচামেচি। এত সতেজ হাওয়া কোনওদিন খাইনি। যাওয়ার আগে জেনে যেতে হবে কীভাবে সবকিছু ভালভাবে রেখেছে, আমাদের ওখানেও এদের কিছু টেকনোলজি ব্যবহার করা যাবে তাহলে। অবশ্য চারিদিক এত সুন্দর সাজানো গোছানো, একবার দেখলে আর যেতে ইচ্ছে করবে না। ডাক্তারবাবু ঠিক কথাই বলেছিলেন দেখছি।
সব থেকে খুশি হতে হয় এদের প্রতিবাদ জানানোর পদ্ধতি দেখে। ‘চোরের মায়ের বড় গলা’— এই প্রবাদবাক্যটি তাদের জন্য অপমানজনক, তাই এটির ব্যবহার বন্ধ করা দরকার এই মর্মে জিরাফেরা প্রতিবাদ জানাচ্ছে। সকলের গলায় প্ল্যাকার্ড ঝোলানো, কারও কারও গায়ে লেখা স্লোগান। কিন্তু কারও মুখে কোনও শব্দ নেই। কেউ কাজেও ফাঁকি দিচ্ছে না।
এদিকে ওদিকে ঘুরতে ঘুরতে আরেক জায়গায় দেখতে পেলাম এক দল হুলোবেড়াল সৎসঙ্গের আয়োজন করেছে। এসব আমার মোটেও পছন্দের নয়। এই সৎসঙ্গের আয়োজনকারীরা যে কতটা সৎ সে বিষয়ে আমার বরাবরের সন্দেহ। যাইহোক, হুলোদের মধ্যে থেকে পাগড়ি পরা কোনও এক হোমরাচোমরা লোক বক্তৃতা দিতে উঠল।
“ভাইসব, জীবজগতে আমরাই প্রথম যারা সেই পরম পুরুষের সঙ্গে নিজেদের অখণ্ডতা উপলব্ধি করেছি। কীভাবে? এই যে আমাদের প্রিয় ডাক ‘ম্যাওঁ’— এর আসল অর্থ কী? এর আসল অর্থ হল ‘ম্যায় ওঁ’ অর্থাৎ ‘আমিই ওঙ্কার’।”
চতুর্দিকে হাততালির ঝড় বয়ে গেল।
সত্যিই এ কথাটা একবারের জন্যেও মাথায় আসেনি। এতকাল ধরে বেড়ালকে দুধ আর মাছচোর ভেবে আসাটা ভুল বলে মনে হচ্ছে।
বক্তৃতা শেষ হতে দুপুর হয়ে গেল। খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছে। গেলাম একটা হোটেলে। বেশ ছিমছাম। টিভিতে চলছে আমার প্রিয় কার্টুন ‘টম অ্যান্ড জেরি’। সবকটা এপিসোডই দেখা, তবুও বারবার দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এই মুহূর্তে যে এপিসোডটা চলছে সেটা কেমন যেন অপিরিচিত লাগছে। সব চরিত্র একই আছে কিন্তু কোথাও যেন আলাদা। কিছু একটা পাল্টে গেছে। কাঠবেড়ালিমশাই দারুণ উপভোগ করছে দেখছি, হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে প্রায়। এদিকে আমার মন থেকে কিছুতেই খটকা যাচ্ছে না।
শেষমেশ বাধ্য হয়ে জিজ্ঞাসা করেই বসলাম “ভায়া মনে হচ্ছে তুমি তো টম-জেরির বড়সড় ভক্ত।”
“হ্যাঁ তা বলতে পারেন। এতবার দেখেছি, তবুও পুরানো হয় না।”
“আচ্ছা একটা কথা বলতে পারো? এই এপিসোডটা দেখে কি তোমার মনে কোনও খটকা লাগছে? সেই টম আছে, জেরি আছে, সেই কাঠঠোকরাও আছে অথচ কেন জানি না কিছু একটা যেন বদলে গেছে মনে হচ্ছে।”
“খটকা লাগাটা স্বাভাবিক। বছরখানেক আগে আমারও লেগেছিল। আসলে চরিত্রগুলো একই থাকলেও গল্পের কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। মূল শোয়ে কাঠঠোকরাদের নিষ্ঠুর দেখানো হয়েছিল। অথচ বাস্তবে তারা খুবই সহজ-সরল প্রকৃতির। এদিকে এসব দেখে কেউ আর তদের বিশ্বাস করতে চায় না। বিনা কারণে নিজেদের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত হওয়ার কারণেই তারা অভিযোগ জানিয়ে হলিউডে চিঠি পাঠায়। হলিউড ভুল স্বীকার করে, ক্ষমা চেয়ে গল্পটা পাল্টে দিয়েছে।”
“অভূতপূর্ব!”, আমার চোখেমুখে বিস্ময়ের ছাপ।
“তবে একটা খারাপ খবর পেলাম। এই কার্টুনটাতে ইঁদুর-বেড়াল-কুকুরদের মধ্যে যেরকম সম্পর্ক দেখানো হচ্ছে সেটা একেবারেই সত্যি না। এরা সকলেই শান্তিতে থাকে, সামান্য তর্কতর্কিও হয়নি আজ আব্দি। জনমানসে ভুল বার্তা ছড়ানোর অপরাধে ‘টম অ্যান্ড জেরি’ ব্যান হতে পারে।”
শুনে মন বিষণ্ণ হয়ে যায়। তবে এদের সামজিক মূল্যবোধ দেখে অবাক হই।
সব দেখে-শুনে ভাবছিলাম এদের সব কিছুই ভালো। এখানকার সমাজে খারাপের কোনও অস্তিত্বই নেই। ভুল ভাঙল কিছুক্ষণের মধ্যেই।
খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে রাস্তায় হাঁটছি। কিছু দূর গিয়ে দেখি এক ব্যাঙ্কের সামনে বেশ জটলা। তিনটে পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে। পুলিশের পোশাক পরা কয়েকজন কুকুর ভিড় সামলাচ্ছে। একজন অফিসার গোছের কুকুর এটাওটা শুঁকে দেখছেন।
ঘটনাস্থলে গিয়ে জানা গেল চুরি হয়েছে। পুলিশরা নিঃসন্দেহে জানাচ্ছেন এটি কোনও এক সজারুর কম্ম। কাঁটা দিয়ে দেওয়ালে সিঁধ কেটে সব টাকা-পয়সা হাতিয়ে কেটে পড়েছে।
কৌতূহলবশত খুদে সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করলাম “এখানে কী কী ধরনের সাজা দেওয়া হয়ে থাকে?”
“এখানে সাজা দেওয়ার পদ্ধতি খুবই ভয়ানক। দোষীর জেল তো হয়ই, যদ্দিন জেলে থাকে তিন বেলা পটল খাওয়ানো হয়। পটলের দোরমা, পটল চচ্চড়ি, পটলের সুপ এসব খেয়ে দিন কাটাতে হয়। জেল থেকে বেরোনোর পর প্রায় সবাই খাওয়া-দাওয়া ত্যাগ করে।”
আতঙ্কে শিউরে উঠি আমি। এই শান্তিপূর্ণ রামরাজ্যে এরকম নিষ্ঠুর সাজা! সেই জন্যেই বোধহয় এদেশে কেউ ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট করে না।
অনেকদিন পর এত হাঁটাহাঁটি করলাম, পা-গুলো গাছ হয়ে গেছে। এবার বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। অবশ্য আমি কিছু বলার আগেই কাঠবেড়ালি আজকের মতো ভ্রমণ বন্ধ রাখার প্রস্তাব দিল। ভালোই হল।
হোটেলের সব বন্দোবস্ত করে কাঠবেড়ালি করে রেখেছে। এবার ফিরে একটু লম্বা হওয়া যাবে। কাল সক্কাল সক্কাল বেরোতে হবে, এক দারুণ জায়গায় যাওয়ার কথা আছে।
৭
এসেছি এক আর্ট মিউজিয়ামে। ঢোকার মুখেই একটি করে বুকলেট হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাতে সমস্ত শিল্পকর্মের বিবরণ, শিল্পীদের সংক্ষিপ্ত জীবনী ছাড়াও মিউজ্যিয়ম ঘুরে দেখার জন্য দিক নির্দেশ করা আছে। সেখান থেকেই জানতে পারলাম মিউজিয়ামের তিনটে ভাগ— সবার আগে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন ভাস্কর্যের নিদর্শন, পরের অংশে ক্যামেরায় তোলা ছবি আর সর্বশেষ অংশে হাতে আঁকা ছবি।
ভেতরে ঢুকে মোহিত হয়ে গেলাম। কী অপূর্ব সব শিল্পকলা! কী অসাধারণ সব হাতের কাজ! অবশ্য হাতের কাজ বলাটা ভুল হবে। কারণ এখানে পাখি, সাপ প্রভৃতি প্রাণীদের বানানো অজস্র মূর্তিও রয়েছে। আর এদের তো হাত নেই। তাই বলা যায় অসাধারণ হাত-পা-লেজ এবং চঞ্চুর কাজ। ভাস্কর্যের মধ্যে বাঁদর থেকে মানুষের বিবর্তনের মূর্তিগুলি উল্লেখযোগ্য। মানুষটা খানিকটা আমার মতো দেখতে— টাকে চুল লাগিয়ে দিলে আর চোখগুলো একটু বড় করে দিলে আমার যমজ ভাই মনে হতে পারে।
এছাড়াও জনৈক ওরাংওটাঙের বানানো মোমের ডাইনোসর মূর্তিটি আমার দারুণ লেগেছে। ডাইনোর মাথা সহ সমস্ত দেহ গলে যাচ্ছে দেখানো হয়েছে। মূর্তির মাথার উপরে রয়েছে একটি প্রমাণ মাপের মোমের গোলা, যেটি আসলে উল্কার প্রতিমূর্তি। ডাইনোদের বিলুপ্তিকে এত সুন্দরভাবে দেখানো যেতে পারে সেটা এই মূর্তি না দেখলে বোঝা যায় না।
ছবি তোলায় আমার একটু সুনাম ছিল। কিন্তু এদের তোলা ছবি দেখে লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছি। যা কিছু বিশেষণ জানা ছিল, সেসব ভাস্কর্যের পেছনেই খরচ হয়ে গিয়েছে, তাই এখন চুপ করে দেখা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। তবে একজন শিল্পীর জীবনী পড়ে আমি দারুণ উদ্বুদ্ধ হয়ে গেছি। শিল্পী একজন কাঠঠোকরা। ছবি তুলতে গিয়ে কত ক্যামেরা তিনি নষ্ট করে ফেলেছেন তাঁর শক্তিশালী চঞ্চুর কারণে। ক্যামেরা কিনতে গিয়ে সমস্ত সঞ্চয় শেষ হয়ে গিয়েছে, ঘর-বাড়ি বন্ধক রেখে পথে নামতে হয়েছে। খাবার জোটেনি ঠিক করে— কখনও আধপেটা হয়ে আবার কখনও খালি পেটে দিন কাটিয়েছেন। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। এই অদম্য মনোভাবই তাঁকে এনে দিয়েছে শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পীর খেতাব সহ বিভিন্ন পুরস্কার।
এরপর ঢুকলাম আসল এলাকায়। এতক্ষণ নিজে লজ্জা পেয়েছি, এখন মনে হচ্ছে আঁকা ছবিগুলো দেখলে দ্য ভিঞ্চি, পিকাসো সবার মাথা হেঁট হয়ে যাবে। কিন্তু আমার কপাল খারাপ। সবকটা ছবি দেখার আগেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল।
ছবি দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে এগিয়ে চলেছি এমন সময় মাথার পেছনে ভারি কিছু একটা ‘খটাং’ করে এসে লাগল। মুহূর্তের মধ্যেই চারপাশ অন্ধকার হয়ে এল, আমি জ্ঞান হারালুম।
জ্ঞান ফেরার পর দেখলাম আমি দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে, কাঠবেড়ালি উদ্বিগ্নভাবে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমাদের আশেপাশে ছোটখাটো ভিড় জমে গেছে। চোখ খোলা মাত্রই মিউজিয়ামের কর্মচারীরা আমার হাতে-পায়ে পড়তে শুরু করলেন। কয়েকজন তো দেওয়ালে মাথা ঠুকে কাঁদতেও শুরু করে দিলেন। সব দেখে আমি তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি। এরা হঠাৎ এমন করে কেন।
তারপর মিউজিয়ামের মালিকের মুখে ঘটনাটা সবিস্তারে জানতে পারলাম। আমি যখন ছবির নিচ দিয়ে হাঁটছিলাম তখন কোনও কারণে একটা ছবির এক দিকের পেরেক খুলে পড়ে। যার ফলে ভারসাম্য হারিয়ে ছবিটা হেলে পড়ে আর ফ্রেমের কোণা এসে আমার মাথায় ধাক্কা মারে এবং আমি জ্ঞান হারাই। এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্যেই মালিক সহ সমস্ত কর্মচারীরা ক্ষমা চাইতে এসেছেন আমার কাছে। তাঁরা যে কোনও রকমের ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি আছেন।
ক্ষতিপূরণের যে কোনও প্রয়োজন নেই সে কথা তাঁদের জানালাম। কিন্তু তাঁরা মানতে নারাজ। শেষ অব্দি তাঁরা আমাকে একটা পাস দিলেন যেটার দৌলতে আমি যখন খুশি বিনে পয়সায় মিউজিয়ামে প্রবেশের অধিকার লাভ করলাম।
মাথাটা ব্যথা করছিল ঠিকই, কিন্তু যে ছবি আমাকে কুপোকাত করল সেটাকে না দেখে ফিরে যাওয়া অনুচিত হবে বলে মনে হল। আমার মনোবাঞ্ছা জানালাম মালিক বাজপাখিকে। তিনি জানালেন ছবিটা খুলে সারাই করার রুমে রাখা আছে। সেখানে গেলেই দেখতে পাওয়া যাবে। কাঠবেড়ালিকে কাঁধে নিয়ে আমি রওনা দিলাম সেদিকে। একজন কর্মচারীকে আমাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন বাজবাবু।
বেশ বড়সড় রুম, কর্মচারীরা সবাই কাজে ব্যস্ত। রুমের শেষ প্রান্তে একটা স্ট্যান্ডে সাড়ে ছয় ফুট বাই সাড়ে পাঁচ ফুট মাপের অয়েল পেন্টিংটা আটকানো রয়েছে। সামনে গেলাম।
একটা হাতির ছবি। বড় বড় কান। আকাশে উড়ছে সে অথচ ডানা নেই। বোধহয় কান ঝাপটেই উড়ছে, ঠিক যেরকমটি আমি গবেষণা করে বের করেছিলুম। গবেষণার কথা ভাবতেই মাথাটা ঘুরে গেল। আবার ছবিটার দিকে তাকালুম।
“হাতি হাতি হাতি”, উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠলাম আমি।
“আস্তে মশাই আস্তে। হাতাহাতির কথা বলছেন শুনলে পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে। আর তারপর কী শাস্তি হতে পারে সে তো আপনার অজানা নয়”, খুদে সঙ্গী আশঙ্কাগ্রস্ত হয়ে ওঠে।
“আরে আমি হাতাহাতি না হাতির কথা বলছি। হাতি উড়ছে।”
“এতে অবাক হওয়ার কী আছে? হাতি তো ওড়েই। বিশ্বাস না হলে দেখিয়েও আনতে পারি আপনাকে।”
“আরে সে তো আমিও জানি। এই নিয়েই গবেষণাপত্র লিখে এলুম তো। কিন্তু ছবি দেখে মনে পড়েছে আমি কীভাবে এদেশে এলাম”, জানাই আমি।
এরপর কাঠবেড়ালিকে সব খুলে বলি— আমার গবেষণায় কথা, হাতিছানাকে উদ্ধারের কথা, তাকে ওড়ার ট্রেনিং দেওয়ার কথা, ফলচুরির ঘটনা এবং শেষমেশ এক ঝড়জলের রাতে তার পিঠে চেপে ভ্রমণ করতে গিয়ে বিদ্যুতের ঝটকায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলা।
বলা যখন শেষ হয় দেখি কাঠবেড়ালির চোখে জল।
“আমার মনে হয়েছিল আপনি খুব ভালোমানুষ। একটা অসহায় হাতিকে আপনি যেভাবে সেবাযত্ন করেছেন, তাকে খাদ্য-বাসস্থান দিয়েছেন তা শুনে বুঝলাম আমার ধারণা মোটেও ভুল নয়। আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ”, মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে সে।
“ভায়া তুমি যে বললে আমাকে হাতি দেখাতে পারো তা আমাকে নিয়ে যাবে সেখানে?” হাতিছানার বিরহে ব্যাকুল হই আমি।
“নিশ্চয়। কালই নাহয় সেখানে নিয়ে যাবো আপনাকে।”
“কাল নয়, কাল নয়। আমি এক্ষুনি যেতে চাই।”
“বেশ এত করে বলছেন যখন তখন আজই বেরোই। কিন্তু এখন বেরোলে পোঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে যাবে।”
আমার মুখের ডোন্টকেয়ার মনোভাব দেখে হেসে ফেলে কাঠবেড়ালি। তারপর বলে ওঠে, “চলুন রওনা দেওয়া যাক।”
৮
হাতিদের বাসস্থানটা শহরের দক্ষিণ দিকে। ট্রেনে ঘণ্টা তিনেক লাগল। এদিকটা গাছপালায় ঘেরা। হাতিদের শহরের মেয়র কাঠবেড়ালির নিকট আত্মীয়। ট্রেনে আসার সময় তাঁকে ফোন করে দেওয়া হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন আমাদের নিতে স্টেশনে গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। শহর বললাম বটে, তবে গাছপালা-মাঠঘাটের পরিমাণ দেখে গ্রামই বোধ হয়।
স্টেশন মাস্টার হাতি, কর্মচারীরা হাতি, এমনকি আমাদের নিতে এসেছে যে গাড়িটা তার চালকও হাতি। পথে এক জায়গায় কয়েকটা বাচ্চা হাতিকে বল নিয়ে আকাশে খেলতে দেখে আশান্বিত হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু দেখলাম তাদের মধ্যে আমার হাতিছানা নেই।
বাড়িতে পৌঁছতেই মেয়রবাবু আমাদের খাতির যত্ন করে ভেতরে নিয়ে গেলেন। সবার খবরটবর নিলেন, আমার পরিচয় দিলুম। তারপর জানতে চাইলেন কী কারণে এত তাড়াহুড়ো করে এখানে আসা। কাঠবেড়ালি আমার কাহিনী পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করে দিল।
মেয়র হাতি তো দারুণ খুশি। তিনি বললেন, “হ্যাঁ আমার কাছে একটি বাচ্চা হারিয়ে যাওয়ার খবর এসেছিল। আমরা বহুদিন ধরে খোঁজাখুঁজি করেছিলাম কিন্তু তার শুঁড়ের চিহ্নমাত্র পাইনি। তারপর সেদিন খবর পেলাম বাচ্চাটি ফেরত এসেছে। সব ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে এই বাচ্চাটিই আপনার কাছে গিয়েছিল।”
“বাচ্চাটির সঙ্গে একবার দেখা করা যায় না?” আর তর সয় না আমার।
“নিশ্চয়ই যায়। আপনি আমাদের এত বড় উপকার করেছেন। এটুকু তো করাই যায়।”
মেয়রসাহেব বেয়ারাকে হাঁক দেন। গাড়ি বার করার আদেশ হয়।
মিনিট দশেকের মধ্যেই আমাদের গাড়ি একটা বাংলোর সামনে দাঁড়ায়। মেয়রের গাড়ি দেখে দারোয়ানরা শশব্যস্ত হয়ে ছুটে এসে ফটক খুলে দেয়। গাড়ি এগিয়ে চলে তারপর এসে দাঁড়ায় সদর দরজার সামনে। হাতিছানার বাবা-ই ঘরের মালিক।
গাড়ি থেকে নেমে দেখি সপার্ষদ বাবা হাতি দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের স্বাগত জানানোর জন্য। খাতির করে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসানো হয় আমাদের। কুশল বিনিময় হয়, মেয়র সাহেব আমাদের পরিচয় দেন। ইতিমধ্যে প্রচুর খাবার আসে আমাদের জন্যে। কিন্তু এখন খাবার খাওয়ার সময় না। আমি অস্থির হয়ে পড়ি। আমাকে উশখুশ করতে দেখে মেয়র সাহেব কাজের কথায় আসেন। পুরো ঘটনা শোনার পর হাতিছানার বাবা আর বসে থাকতে পারলেন না, আনন্দে চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি আরও কীসব অজানা ভাষায় দারুণ সব প্রশস্তিবাক্য বলে চললেন। এদিকে তখন চাপে আমার দম বেরিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।
এবার না ছাড়লে বুকের সবকটা হাড় গুড়ো হয়ে যাবে। উপার না দেখে বলে উঠলাম “ইয়ে, তার সঙ্গে একবার দেখা করা যায় না?”
“নিশ্চয় নিশ্চয়। ওগো খুকির মা খুকিকে নিয়ে এদিকে একবার এসো তো। খুকি দেখো কে এসেছে।”
বেশিক্ষণ বসতে হয় না, মিনিট দুয়েকের মধ্যেই সিঁড়িতে একটি বহু পরিচিত মুখ দেখতে পাই। আমার আদরের হাতিছানা। উৎসুক চোখে আমাকে খুঁজে নিতে তার বিন্দুমাত্র সময় লাগে না। তারপরই শুঁড় উঁচিয়ে সে আমার দিকে ছুটে এগিয়ে আসে।
আমার মতো এক ক্ষুদ্র মানুষের সাধ্য কী চেয়ারে বসে থাকে। আমিও দৌড়ে যাই তার দিকে। কাছে এসে সাঁই করে আমার কোলে লাফ দেয় হাতিছানা। টাল সামলাতে না পেরে দুজনে মিলে পড়ি মেঝেতে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার আর যন্ত্রণা হচ্ছে না। হাতিছানা গায়ে মাথায় শুঁড় বুলিয়ে দিতে থাকে, গাল চেটে দেয়। আমিও তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। যদিও সে আমার নিজের মেয়ে নয় তবুও অপত্যস্নেহে মন ভরে ওঠে।
এদিকে হাতিছানার মা তো অবাক। কন্যার এরকম আচরণের কারণ তো জানা নেই তাঁর। হাতিবাবার মুখ থেকে জানার পার তিনিও যেভাবে নেচে ওঠেন আমি ভয় পেয়ে যাই ইনিও পাছে আমার গায়ে ঝাপিয়ে পড়েন। তবে সৌভাগ্যবশত এরকম কিছু ঘটে না।
মা হাতি জানান “আসলে মেয়ে একেবারে ছোট তো তাই মুখের বুলি ফোটেনি। কিন্তু ইশারায় সে আমাদের বলেছে আপনি কত ভালো লোক।”
দাঁত বের করে হাসি আমি। ইতিমধ্যে মেয়র উঠে পড়েন, কোনও একটা কাজে তাঁকে বেরিয়ে যেতে হবে এক্ষুনি। যাওয়ার আগে আমাকে বললেন “মশাই সামনের মাসে একটা সংবর্ধনা সভার আয়োজন করছি। জানি আপনার ঋণ শোধ করার ক্ষমতা আমাদের নেই, কিন্তু এটুকু না করলে আমারা আর শুঁড় উঁচিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারব না। এই কয়েকটা দিন নাহয় আমার বাড়িতেই থেকে যাবেন।”
“ওমা সে কী কথা! আপনার বাড়ি কেন উনি আমদের বাড়িতে থাকবেন। ওনার জন্যে আজ আমাদের মেয়ে সুস্থ শরীরে বাড়ি ফিরেতে পেরেছে। ওনার সামান্য সেবা-যত্ন করা আমাদের কর্তব্য।”
আমি আপত্তি করি না। এই সুযোগে নিজের একটা হিল্লে করে রাখি।
“একটা অনুরোধ ছিল। এই সংবর্ধনা চুকলে যদি আমাকে একটু নিজের জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার বন্দোবস্ত করে দেওয়া যেত তাহলে…”
“একশো বার। আমি নিজে আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসব।” আশ্বস্ত করেন বাবা হাতি।
কাঠবেড়ালিভায়ার সঙ্গে কথা ছিল, যতদিন না আমার কিছু একটা গতি হচ্ছে ততদিন সে আমার সঙ্গে থাকবে। এখন আমার বাড়ি ফেরার রাস্তা পাকা হয়ে গেল দেখে সে বিদায় চাইল। হাজার হোক পেশাদার মানুষ, অকারণে আমার সঙ্গে লেগে থাকলে তো আর চলবে না। বিদায় বেলায় দুজনের চোখেই জল দেখা দিল। এই কদিনেই আমাদের মধ্যে দারুণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। খুব করে কোলাকুলি করে তাকে বিদায় জানাই। সে আমাকে তার ফোন নম্বর দিয়ে যায়, আমিও নিজের নম্বরটা দিয়ে দিই। আমাদের মধ্যে চুক্তি হয় প্রতি ছয়মাসে এক জন আরেকজনের বাড়ি গিয়ে দেখা করে আসব। এরপর মেয়র হাতি আর কাঠবেড়ালি এক সঙ্গেই বেরিয়ে পড়েন।
এদিকে হাতিছানাকে ফিরে পেয়ে আমি তো ভীষণ খুশি। মাসটা যে কীভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারি না। আমার সংবর্ধনার দিন চলে আসে। অর্থাৎ আমার বিদায়ের সময় উপস্থিত। সভা মেটার পরের দিন গিয়ে হাতিছানার বাবাকে বলি, “এদিককার সব কাজ তো মিটল। এবার যদি আমাকে বিদায় দেন তো ভালো হয়।”
শুনে তাঁর মুখ কালো হয়ে যায়। ভারি গলায় তিনি বলে ওঠেন “এরই মধ্যে চলে যাবেন? আমার মেয়ের কীরকম মন খারাপ হবে ভাবুন একবারটি। আরেকটা মাস নাহয় থেকেই যান। তারপর আর আপত্তি করব না।”
হাতিছানার কথা ভেবে আমি কিছু বলতে পারি না। অগত্যা থেকে যেতে হয়। আবার খেলাধুলো শুরু করে দিই তার সঙ্গে।
শুধু একটা জিনিস ভারি অদ্ভুত লাগে। সেটা হল হাতি বাবার চাউনি। খালি মনে হয় তিনি আমার সব কার্যকলাপ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। অস্বস্তি হয় কিন্তু কিছু বলতে পারি না। কে জানে হয়তো বয়স্ক হাতিরা এভাবেই তাকায়। আর কয়েকটাই তো দিন, একটু না হয় সহ্য করে নিই।
এক মাস কেটে যায়, আবার বাবামশাইকে গিয়ে ধরি।
“ধরণীবাবু, আমি খুবই দুঃখিত। আমার এখন একটা কাজ পড়ে গেছে। শেষ করতে এক মাসের মতো সময় লাগবে। আমি জানি আপনি বিজ্ঞানী মানুষ, সময়ের প্রচুর দাম। কিন্তু কী করব বলুন? এই কাজটা আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই বলছি আরও কয়েকটা দিন থেকেই যান না। আর এমনিতেও মেয়ের সঙ্গে তো বেশ আনন্দেই দিন কাটছে আপনার। কী বলেন?”
আনন্দে দিন কাটছে ঠিকই, কিন্তু অকারণে বসে থকে ভালো লাগছে না আর। চিরকাল কাজের মধ্যে কাটিয়েছি, আর এখন প্রায় তিন-চার মাস ধরে শুয়ে-বসে-ঘুরেফিরে কাটাচ্ছি। বনমালী, আমার আরামকেদারা, বাগানের ফুলগাছ সব কিছুর কথা বড্ড মনে পড়ছে। কিন্তু এনাদের দয়া না হলে তো ফেরার কোনও উপায় নেই।
মাঝখানে কিছু দিন বিকেলের দিকে সময় পেলেই প্রবল বেগে হাত-পা নাড়ছিলাম। যদি কোনওভাবে উড়তে পারা যায় তারই চেষ্টা আর কি। উড়তে পারলে নিজেই বাড়ি ফিরে যেতে পারতুম। কিন্তু মানুষ কি হাতি যে উড়তে পারবে? তাই এখন সেসব চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছি।
হাতিছানার বাবা বললেন বটে তাঁর দারুণ গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে; কিন্তু তাঁকে দেখে আদৌ বোঝা যায় না। প্রায় সারাটা দিনই লোকটা নিজের ঘরে বসে কাটিয়ে দেন। একদিন দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম, চোখে চশমা এঁটে খসখস করে ডাইরিতে কী যেন লিখে চলেছেন। সব্বোনাশ করেছে! এ লেখক-টেখক নাকি? পুজোবার্ষিকীতে পাঠানোর জন্য কিছু লিখছে বুঝি? কে জানে, হতেও পারে। এদেশে কিছুই অসম্ভব নয়। অবশ্য আমার এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। এবার টালবাহানা করলে আমি অন্য কাউকে দিয়ে আমাকে ফেরানোর বন্দোবস্ত করে দিতে বলব।
কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারি না। একদিন দুপুরবেলা হাতিছানার বাবা ঘর থেকে বেরোতেই আমি সুট করে ঢুকে পড়ি। তারপর ডাইরির যে জায়গাটায় বুকমার্ক দেওয়া ছিল সেই পাতায় যাই। দেখতে পাই, গোটাগোটা অক্ষরে লেখা—
“আমার কাছে যে মনুষ্য স্যাম্পেলটি রয়েছে তাকে গত তিনমাস যাবৎ পরীক্ষার দ্বারা আমি এই সিদ্ধান্তে এসেছি, যে মানুষ কখনও বাঁদর বা গোরিলাজাতীয় প্রাণীর বিবর্তনের ফলে সৃষ্টি হয়নি, হতেও পারে না। বরং খাদ্যাভাস, পায়ের তুলনায় দৈর্ঘ্যে ছোট হাতের উপস্থিতি, দাঁত এবং হাতের ও পায়ের নখের গড়ন দেখে আমি এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে মানুষ হল ডাইনোসরের বিবর্তিত রূপ!”