Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

চলচ্চিত্র-চমৎকারা

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য

 

DISCLAIMER :  “If we could tell a film, then why make a film” – This is Not a Film

(১)

অন্ধকার স্ক্রিন। থমথমে প্রেক্ষাগৃহ। আননোন কৌতূহলে টনটনে চতুর্দিক। নেপথ্য কণ্ঠে গুরুগম্ভীর ফিসফিসানি—

“রাতের রাস্তা যেখানে শুনশান, সারি সারি ল্যাম্পোস্টের মধ্যবিরতির আলো যে দূরত্ব কখনোই স্পর্শ করতে পারে না— তার আধিজ্যামিতিক আদলের চারপাশে কুকুরেরা দৈনিক হাপিত্যেশ জোড়ে। যাবতীয় যুক্তি যেখানে অলুক্ষুণে প্যাঁচে পরিসীমার পরিখায় বাঁধা পড়ে থাকে; কথায় বলে— অতৃপ্ত আত্মার ঢল নামে ঐখানে।”

আলো আসে, সঙ্গে সাস্‌পিশাস মিউজিক…

ফিল্মের ফার্স্ট শট— নিশুতি রাতের রাস্তা— কেউ কোত্থাও নেই— বন্ধ দোকানপাট। নিস্তব্ধ বাড়িঘরে চাপ-চাপ স্বপ্ন লেগে— কালচে সোনালী। নিয়ন মায়ায় রাস্তার কলকলে চেহারা কোথায় না জানি ধুয়ে হারিয়ে গেছে। আকাশের রাতকে অপ্রাসঙ্গিক করেছে তার আলো। ক্যামেরা নীরবে অপেক্ষারত— চারপাশে চোখ ফেরায়; স্ক্রিনের ডানদিক থেকে কতগুলো কুকুর তারস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে— ভৌউউ-উ-উ-উ-উ-উ ভৌ-ভৌ-ভৌ-ভৌ… তাদের অসহ্য কান্নার সুর গোটা স্ক্রিনে চড়াও হলে চোখে পড়ে একটা গলি— স্ক্রিনের বাঁদিকে দুটো পাকা বাড়ির মাঝ-বরাবর হাত চারেক চওড়া— হাড়হিম করা রহস্য নিয়ে সড়কের মুখে এসে থম্‌ মেরে আছে। একে একে সব্বার চিৎকার থেমে এলে ঐ গলির দিকে চেয়ে ঘর্‌র্‌র্‌ ঘর্‌র্‌র্‌ শব্দে কিসের জন্য যেন প্রস্তুত হতে থাকে তারা। চারপাশ ফের চুপ। বড় বিচ্ছিরি হিমশীতল এক মুহূর্ত বোবামি—

আচমকাই কোনও বাড়ির অন্দরে একতাল বাসন মেঝেতে আছাড় খায়— পিলে চমকানো সারাউন্ড সাউন্ডে বিভ্রান্ত চোখদুটো গলির দিকে ফেরাতেই হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসে একটা দামড়া লোক— বেশ ভুঁড়িওয়ালা— টাক মাথা— চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা— নির্ঘাত প্রাণছুট দিয়েছে কিছুর তাড়া খেয়ে। শরীরের ভার সামলাতে না পেরে পড়ি কি মরি অবস্থা যাহোক করে সামলে নিয়ে ডানদিকে মোড় নেয় সে। কুকুরগুলো তাকে ঘিরে ভয়ানক চিৎকার শুরু করেছে ততক্ষণে। ক্যামেরা সপাটে এগিয়ে যায় তার দিকে— সারা মুখ বেয়ে টপটপে ঘাম, জামাপ্যান্ট ভিজে সপসপে। লোকটাকে লো-অ্যাঙ্গেলে তাক্‌ করে রাস্তা বরাবর ক্যামেরা ঘড়ঘড় করে ছুটতে থাকে চরিত্রের নির্ধারিত পূর্বপথে। হাঁপানিতে হাঁসফাস করে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, নোনা ঘামের ছিটেফোঁটা ক্যামেরার লেন্সের ওপর আবছা হয়ে ফেটে পড়ে। লোকটার উপস্থিতি যেন চ্যাটচ্যাটে জলছবি। যদিও পেছন থেকে কে বা কারা তাড়া করেছে সে বিষয়ে দর্শক এযাবৎ বেমালুম থেকে যায়—

হঠাৎ গুলি। দু-এক ফোঁটা রক্ত ছিটকে পড়ে ক্যামেরার গায়ে— কোথায় খেয়েছে কিছুতেই স্পষ্ট করে দেখতে পাই না। লোকটা থমকে নিয়ে ছোটার আগেই ফের গানশট। বিকট শরীরটা মুখ থুবড়ে পড়ে ক্যামেরার ওপর—

কাট্‌ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা চলে যায় ফ্ল্যাশব্যাকে— আধঘণ্টা পিছিয়ে। লোকেশন একটা বাজার— প্রচণ্ড ঘিঞ্জি, কাদা-কাদা পথ, সরু-সরু নালি, নালিতে পাতা-পচা আনাজ, স্থানবিশেষে রক্ত। বাজারটার ভেতর দিয়ে আমার মত লোকের খানিক নাক চেপেই চলতে হয়; ভ্যারাইটি রকম মাংস কাটা হয় ওখানে। মাংসের মাথা, পাঁজর ও অন্যান্য দেহভাগ দেখতে না চাইলে সিনেমা চলাকালীন চোখ বুজে রাখার পরামর্শ দেব—

বাল্বের নীচে চকচকে বোয়াল-কাতলা-ইলিশ-পুঁটি আর ধারালো আঁশবটিগুলোর ওপর দিয়ে সবেগে প্যান করে ক্যামেরা ক্যাচ করে একটা মাংসের দোকানকে— ছোট্ট টিভি-টায় ভোজপুরি সিনেমা চলছে, এরই মধ্যে শোনা যায় কুচকুচে ধুমসো মালিকের গলা— “আরে বাবুজি হাম বকরি পে পানি নেহি মারতে হ্যায়— বিলকুল সহি ওয়াজন আছে” সঙ্গে পানচেবানো কালো হাসি। এটা দেখিয়েই ক্যামেরা চলে যায় দোকানের পেছন দিক্‌কার দরজাবন্ধ একটা একতলা বাড়ির দিকে। দরজা খুলে একজন বেরিয়ে আসে— সাট্টার ঠেক; লম্বালম্বি ঘরটার দৈর্ঘ্য খুব একটা কম নয়, তবে চওড়ায় বেশ ছোট। ন্যারোস্ক্রিনে আরও খানিক কনজেস্টেড দেখায়। জুয়াড়িদের বসার বেঞ্চগুলো দুটো সারিতে লম্বালম্বি সাজানো— মধ্যিখানে দু-একজনের বেরোনোর মত পথ, যে যার সামনে টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে ভাগ্যচালনায় মত্ত। সঙ্গে একগ্লাস করে দিশি মদ, ভুলিয়ে রাখার দুরন্ত প্রক্রিয়া। ক্যাশ আর মদের কাউন্টারটা ভেতরের দিকে— অন্য কোনও ধান্দা আড়াল করার চেষ্টা যেন; ওইদিক থেকেই একটা ভুঁড়িওয়ালা টাক্‌লা লোককে বেরোতে দেখা যায় মাঝখানের সরু গলতাটা দিয়ে— ফোন বেজে ওঠে তার জামার বুকপকেটে— ধরতে গিয়ে সে হোঁচট খায় এক জুয়াড়ির পায়ে— ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই জুয়াড়িটা ভ্যাবলাকান্তের মত হেসে পা ঢুকিয়ে জড়সড় হয়ে বসে। ব্যোমকে যাওয়ারই কথা— লোকটার চেহারা অনেকটা ভোঁতকা ভাল্লুকের মতন, ফুট ছয়েক লম্বা— টাক মাথা তায় মুখটা গোল— চোখে সরু ফ্রেমের চশমা— যেন এই খ্যাঁকায় কি ওই খ্যাঁকায়। ফোনটা ধরার পর নীচের ঠোঁটটা উলটে নিয়ে কীসব যেন বলতে থাকে— মুখে গুটখা— স্পষ্ট করে শুনলে বোঝা যাবে, “আরে দাঁড়া না বাঁড়া! মালটা ডেলিভারি দিয়ে আসি, আধাঘণ্টায় পৌঁছচ্ছি— এমএলএ-র ছেলেটা মিস মেরে মেরে ফোনের গাঁড় মেরে দিচ্ছে।” এই বলে ঠেকের বাইরে এসে পিক্‌ করে ক্যামেরার মুখে থুথু ছুঁড়ে দিয়েই সে গাপ্‌ হয়ে যায়—

রাস্তা দিয়ে চলাকালীন লোকটার ফোনে অনবরত মিস্‌ড কল আসতে থাকে। চোখেমুখে বিরক্তি লেগেই আছে। ডান হাতে একটা চৌকো হ্যান্ডব্যাগ— কব্জিতে ফিতেটা জড়ানো থাকলেও মোটা চেনের ব্রেসলেট ফাঁকে ফাঁকে ঠিক উঁকি দিয়ে যায়। হাঁটা দেখেই বোঝা যায় তাড়া আছে। প্রসঙ্গত গোটা ফ্ল্যাশব্যাকটাই ঘটে চলে লালাভ আলোআঁধারি স্ক্রিনে— সঙ্গে কিছু ব্রুটাল স্টক মিউজিক— বাংলায় যাকে বলে খতরনাক্‌–

ঘুটঘুটে অন্ধকারে তৈরি হতে চলা একটা ন্যাড়া কমপ্লেক্স। ক্যামেরা সেই গা-ছমছমে কমপ্লেক্স— পাশের কালো পুকুর— এক চিলতে অন্ধকার মাঠ— এগুলোকে ক্যাপচার করে বেশ উঁচু থেকে। সেখান থেকে আচমকাই জুম-ইন্‌ করে নির্দিষ্ট একটা বিল্ডিংয়ের ছাদে নেমে দাঁড়ায়। ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশের অন্ধকারটা হালকা মেপে নিয়েই ধড়ফড়িয়ে নামতে থাকে সিঁড়ি বেয়ে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। ঠিক তিনতলা নামার পর ক্যামেরা ঢোকে একটা ঘরে। মায়াবী নীল আলোয় গোটা স্ক্রিনের দমবন্ধ হয়ে আসে। ঘরে ঢুকতেই দেখা যায় তিন-চারটে ছেলে ছড়িয়েছিটিয়ে পড়ে আছে খড়খড়ে মেঝেটায়। মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে একজন অনবরত মোবাইল টিপে চলেছে— সে তাদেরই একজন কিনা সেই বিষয়েও সন্দেহ জাগতে পারে বাকিদের শুয়ে থাকার ভঙ্গি দেখে। এক অদ্ভুতুড়ে মৃত্যুছোঁয়াচ পরিবেশকে গাঢ়তর করে তোলে। থেকে থেকে ঘুমন্ত ছেলেগুলোর ওপর ঝলসে যায় ক্যামেরা—

এমন সময় অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে একজন ভুঁড়িওয়ালা লোককে উঠতে দেখা যায় ক্ষীণ আলোয়— সেই টাক্‌লা ভুঁড়িবাবু যার হাতে ব্যাগ।

মোবাইল-টর্চের আলো ডান হাতে ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই সে চাপা চ্যাঁচাতে থাকে, “তোরা বাঁড়া রোজ আমার থেকেই স্টক নিবি আর ওয়েট করার বেলায় একটু ওয়েট করতে পারবি না? কাল তো কতটা এক্সট্রা দিয়ে গেছিলাম ভাবলাম আজ আর লাগবে না— তা বাঁড়া…”

কথাগুলো হড়হড়িয়ে বলে ফেলে সে কিছুটা হাঁপিয়েই শ্বাস নেয়, আর ঠিক তখনই নিস্তব্ধতা ফুঁড়ে একটা বুলেট বেরিয়ে যায় তার বাঁ-কানের পাশ কাটিয়ে— ভুঁড়িবাবু কিছুই বুঝে উঠতে পারে না, অগত্যা দৌড় লাগায়—

কাট্‌ করে ফ্ল্যাশব্যাক থেকে ক্যামেরা ততক্ষণে পগারপার। পরবর্তী স্থান হাইকোর্ট বিল্ডিঙের চত্বর। নিউজ চ্যানেলের ঝাঁক ছেঁকে ধরেছে পাবলিক প্রসিকিউটারকে। কালো স্যুটের ভি-আকৃতির ফাঁক দিয়ে সাদা শার্টের ঝলকানি। চারপাশে কিছু ছাপোষা মানুষকে ভিড় করে থাকতে দেখা যাচ্ছে। মব ও রিপোর্টারদের হালকা ক্যাঁওম্যাঁও দখল নিয়েছে ব্যাকগ্রাউন্ডের। তিনি বেশ সুচারু ভঙ্গিতে বলে চলেন, “আপনারা নিশ্চয়ই কভার করেছেন এই বীভৎস ক্রাইমের স্টোরি; তবু যে দাবীগুলো নিয়ে আমরা মহামান্য আদালতের কাছে বিচারপ্রার্থী, সেগুলো আপনাদের সামনে একবার স্পষ্ট করে বলে রাখতে চাই।” একটা পেপার হাতে ধরে তিনি বলতে থাকেন, “প্রথমত এই আসামী চারজন যুবককে অতিরিক্ত মাত্রায় ড্রাগ পাঞ্চ করে খুন করেছে, যাঁদের মধ্যে আপনারা জানেন যে রাজ্যের মাননীয় বিধায়কের পুত্রও ছিলেন। এবং একজন নিরীহ ভদ্রলোক গোটা ঘটনার সাক্ষী হয়ে যাওয়ায় তাঁকেও নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করেছে, যা শুধুমাত্র কোনও বিকৃতমনা খুনির পক্ষেই সম্ভব…” কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বা একটু আগেই ক্যামেরা হাওয়া। দৃশ্যটি হারিয়ে যায়—

****

জানি না ঠিক কী করে এই সিনেমা হলে এসে পৌঁছেছি আমি, কখনই বা আমাকে এই এন্টারটেনমেন্টের ভাগীদার করে নেওয়া হয়েছে; লাক্সারি চেয়ারে বসে আছি, কোলে সুস্বাদু লাঞ্চ, তবু উপভোগ করতে পারছি কই? চারদিকে অন্ধকারে আরও অনেক-অনেক মাথা দেখা যাচ্ছে আমার মত, এখনও হাঁ করে মেগাস্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে। তবে কি কোনও আফটার থটে ডুবে আছে তারা? হয়ত সিনেমা ও সিনেমার সমাজনীতি নিয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কিছু ভাবছে…

এসব ভাবাভাবির মাঝেই ফের চালু সিনেমা। এতক্ষণ খেয়ালই করিনি আগের সিকোয়েন্সটার পর একটা খানিকক্ষণের পজ্‌ ছিল।

 

(২)

হলে ছায়াছবির মরা আলো…

নির্জন রাত। মফস্বলের ঝাঁপ বন্ধ করে ব্যস্ততা গুটিগুটি পায়ে কেটে পড়েছে। শরীরজুড়ে নিঃসঙ্গতা মেখে পিচরাস্তা বরাবর দুরন্তগতিতে হেঁটে চলেছে একটি মেয়ে— পরনে সাদা সালোয়ার কামিজ। ক্যামেরা পিছন থেকে ন্যারোস্ক্রিনে শুধু তার চলাটুকু লক্ষ করায় মেয়েটির মুখ দেখা যাচ্ছে না। মাথার বিনুনি করা চুল পিঠ অবধি নেমে গেছে, বাঁ কাঁধের ব্যাগটা বারবার পিছলে যাওয়ায় কন্টিন্যুয়াসলি সেটা ঠিক রেখে চলতে হচ্ছে তাকে—

ক্যামেরা খানিক জুম-আউট করলে দেখা যায় মেয়েটার ঠিক ডানপাশ দিয়ে দুটো লোক তাকে ফলো করে চলেছে। লোকদুটো ঢ্যাঙা— পরনে হাতকাটা গেঞ্জি আর ট্র্যাকস্যুট— চলাফেরা চ্যাংড়া ছোকরাদের মতন। দুজনেরই বাঁহাত বুক থেকে কোমর অবধি চলাফেরা করছে। একটা সাইকাডেলিক মিউজিক ধীরে ধীরে ফ্রেমের অন্ধকার ছাপিয়ে বেরিয়ে আসছে—

ক্যামেরা যথাক্রমে ওই লোকহীন রাত্রিরাস্তা— ডানদিক থেকে মেয়েটির বিপুল স্তনের ওঠানামা এবং ওই ডানদিক দিয়েই চলতে থাকা দুটি লোকের অবাধ্যতার ওঠানামার ক্লোজ-আপ নিতে শুরু করে। ক্লোজ-আপটা বাঁদিক থেকে নিলে বা লোকগুলোও বাঁদিক দিয়ে গেলে সিকোয়েন্সটা ঠিক মিরর্‌ ইমেজ হত কিনা সে কথা পরিচালক মেনশন করেন না একবারও। যাই হোক, সেই একই বিন্যাসে তিনটে ফ্রেম পর্যাবৃত্তভাবে এগোতে থাকে ক্রমশ দ্রুতিতে। বেশ কয়েকবার এমনটা হওয়ার পর যখন ফ্রেমগুলোকে আর পৃথক করা যাচ্ছে না— একই ফ্রেম মনে হচ্ছে— ক্যামেরা দাঁড়ায়, আচমকা—

মেয়েটার হাত ততক্ষণে কাঁধব্যাগে ঢুকেছে। হঠাৎই ব্যাগের ভেতর থেকে কিছু একটা চকচক করে ওঠে আর লোকদুটোও উল্টোদিকে পাঁইপাঁই করে ছুট লাগায়। মেয়েটার মুখের ক্লোজ-আপ— শক্ত চোয়াল, দৃঢ় চাউনি— ক্যামেরা যথারীতি ব্যাকস্ট্রোক নেয়। কাট্‌ করে চলে যায় একটা অন্ধকার রুটের অটোকে ফ্রেমে ধরতে— কোনও এক অদৃশ্য রাতপ্যাঁচার চোখ দিয়ে সে অটোটাকে পাকড়াও করে ফেলে। পপুলার হিন্দি গানের ঝিনচ্যাক্‌ উঠে আসতে থাকে বাতাস বেয়ে। দু’পাশে বিরাট বিরাট মাঠ – পুকুর, মাঝে রাস্তা। অটো ছুটতে থাকে—

অটোতে বসেছিল একটা মেয়ে— ঐ মেয়েটা। সবুজ ফ্রেমে তার ফর্মাল শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট অস্বাভাবিক কালো দেখাচ্ছিল। দুপাশে দুজন যাত্রীযুবক বসেছিল গায়ে গা এঁটে— ক্যামেরা ক্লোজ-আপ নিচ্ছিল একে-একে— ছেলেদুটোর বগলজোড়া ঘামের ছাপ— মেয়েটার গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম, সঙ্গে গাঁক-গাঁক করে বাজতে থাকা হিন্দি সং। পুরো ব্যাপারটা ছবিপর্দার ডাইমেনসন বাড়িয়ে দেখানো গেলে যেটা দাঁড়াত তা অত্যন্ত ভ্যাপসা একটা পরিস্থিতি। ভ্যাঁসভ্যাঁসে ঘামের গন্ধে হল ভুরভুর করত। মেয়েটা বারবার ড্রাইভারকে তাড়া দিচ্ছিল— অটোটাও যাকে বলে, উড়ছিল—

ড্রাইভার ওর সাইডের আয়নায় মেয়েটার দেহটাকে সেট করে রেখেছিল, সেদিকে তাকিয়ে সাউন্ড সিস্টেমটা অফ্‌ করে দিল এক মোচড়ে— “বহুত্‌ তাড়া দেখছি! ক্যানো গো, হিস্যু পেয়েছে?” বলেই সে দাঁতের ফাঁক দিয়ে শিস্‌ দিতে থাকে স্‌-স্‌-স্‌ করে—

হঠাৎ যেন সব কিছু দুইয়ে দুইয়ে চার হতে শুরু করে— সমস্ত আশঙ্কা— ভয়াবহতা। মেয়েটার ডানপাশের ছেলেটা কথার রেশ ধরে ন্যাকা সুরে বলে ওঠে— “সাইড করে রাখ্‌ না বাঁড়া— একসঙ্গেই হিস্যুটা সেরে নিই তা’লে, তবে ভাই একটাই কেস আমরা সবাই কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করব”— ‘স’-গুলোর ওপর অত্যধিক ঠেস দেয় সে। বলেই ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে হেসে ফ্যালে—

মেয়েটার চোখে জল; সরু গলায় বলে— “চলো না দাদা একটু তাড়াতাড়ি। বাড়িতে বাবা-মা টেনশন করছে”…

“আরে না না, দাঁড়িয়ে করতে অসুবিধা হলে আমরা নাহয় বসেই এক রাউন্ড করে নেব—”

“ধুর বাঁড়া এত না চুদিয়ে অটোটাকে সাইড করে রাখ তো” বাঁদিকের বডিবিল্ডারটা চেঁচিয়ে ওঠে—

অটোটা থামে নির্জন পুকুরের সামনে। চারপাশে জংলা গাছ— অবাধ্য মেয়েটা নামতে চাইছিল না কিছুতেই, টেনে হিঁচড়ে নামায় সবকটা মিলে। ঝোপের গহ্বরে আছড়ে ফেলা হয় তার শরীর— ঝিঁঝিঁর ডাকে প্রেক্ষাগৃহ বধির হয়ে আসে। মেয়েটার মুখচাপা চিৎকার— উন্মত্ত ধর্ষকের নাচুনি—

স্ক্রিনে একটা প্যারালাল ফ্রেম দেখা দেয়— গভীর জঙ্গলে একদল ট্রাইবাল গোষ্ঠীর লোক ছিঁড়ে খাচ্ছে একটা মেয়েকে, কেউ তার স্তন ছুরি দিয়ে কেটে নিচ্ছে কেউবা ঠোঁট কামড়ে টেনে ধরছে। আচ্ছা আচ্ছা লোকের হালুয়া টাইট হয়ে যাওয়ার কথা ওইসব ক্যানিবালদের দেখে; কিন্তু কেন জানি না— পরিচালকের মোটিভে নাকি টেক্‌নিকের কারণে কোথাও ব্যাপারটাকে খেলো মনে হয়—

দৃশ্য দুটো একসঙ্গে পজ্‌ড হয়। সিনেমার নিজের দৃশ্যটা একটা ওয়েবসাইটে আপলোডেড হয়। টাইটেল— হট মুভি সিন; ক্যাটেগরি— এন্টারটেইনমেন্ট; নোটিস— এজ-রেস্ট্রিক্টেড ভিডিও (বেসড অন কমিউনিটি গাইডলাইনস)।

ওই ওয়েবসাইট থেকেই দৃশ্যটা ফের চালু হয়। তলায় লাইক-ডিজলাইকের অপশন, সঙ্গে কমেন্টস সেকশন। এরপর রিলেটেড ভিডিওস-এ কারসর্‌টা ডাব্‌ল ক্লিক্‌ড হয়ে একের পর এক ভিডিও চালু করে দেখাতে থাকে। দৃশ্যগুলো বিভিন্ন পপুলার সিনেমায় ব্যবহৃত ধর্ষণ বা মোর স্পেসিফিক্যালি গণধর্ষণ জাতীয়; ভিলেনের শেয়াল-শেয়াল চোখ— ত্যারচা বদনের হাসি— ভিক্টিমের আকুতিভরা আর্তি— ঘষটে-ঘষটে পিছিয়ে যাওয়া; এরকম পাঁচটা দৃশ্যটুকরো চালিয়ে দেখানো হয়। কী যে দেখছিলাম আর কী-ই বা ভাবছিলাম কিচ্ছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না—

সিনেমাটিক রেপ সিন্‌গুলো দেখতে দেখতে চোখ যখন থিতু হয়ে আসছে, নিভৃত অঙ্গতন্ত্র সব পুরুষ হওয়ার মুখে— ব্রাউজারের পেজটা উধাও হয়ে সিনেমা নিজের দৃশ্যে ফিরে যায়—

দৃশ্য চালু হয়ে নৃশংসতর হয়ে উঠেছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে নারকীয় সব চিৎকার; এমন সময় হঠাৎই ছেলেগুলোর রাতফুর্তির মাঝে বিকট গুলির শব্দ। তিনজনের একজন খেয়েছে— কপালের ঠিক মাঝখানে, গোল হয়ে যাওয়া ফুটোয় রক্ত জমে আসার আগেই সে উপুড় হয়ে পড়ে যায় মেয়েটার ওপর। বাকি দুজনও কিছু বুঝে ওঠার আগেই খেয়ে গেল, দুজনেই বিলো দ্য বেল্ট। পাতলুন রক্তে ভিজে এলে তারা মেয়েটার দু’পাশে শুয়ে কাতরাতে লাগল। আরো দু-রাউন্ড গুলি চলল প্রাণেরা নিস্তব্ধ হওয়ার আগে। ধর্ষিতা ও তাকে ঘিরে তিন নির্বীর্য ধর্ষক–

ক্যামেরা আবৃত করল উঠে বসা মেয়েটিকে– বামস্তনহারা— সে চেঁচিয়ে কেঁদে ওঠে; বন্দুকধারী কালো ছায়া ম্যাগাজিন ভর্তি করে মেয়েটার হাতে দিয়ে চলে যায়; নিজের মাথায় বন্দুক ঠেকাতেই ধপ্‌ করে পড়ে যায় সে—

হাইকোর্ট চত্বরের পূর্বরেশ… পাবলিক প্রসিকিউটারের কথায় “…আসামীর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে অস্ত্রপাচারের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের সপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণও আমরা মহামান্য আদালতের সামনে হাজির করেছি। আপনারা ভেবে দেখুন, এভাবে চলতে দিলে খুব শিগগিরি দেশে নিরাপত্তা বলে আর কিছু থাকবে তো?…”

 

(৩)

ফের লোকেশন শিফ্‌ট হয় নানান রকমের মাংস কাটা সেই ঘিঞ্জি বাজারটায়। ব্যস্ত মানুষজন সন্ধে-সন্ধে বাজার সেরে নিচ্ছেন। বেশ ভিড়। মাছ ব্যাপারীদের ধারালো দা-এ একেকটা আড়-বোয়ালের মাথা ঘ্যাঁচ-ঘ্যাঁচ শব্দে ছিটকে পড়ছে—

ওদিকে সাট্টার ঠেক— মদের গন্ধে ম-ম করছে গোটা এরিয়া, টেবিলের ওপর হামলে পড়ে যে যার ভাগ্যে ডুবে রয়েছে। ঠেকের ভেতরের প্রান্তে লাল অন্ধকারে কী যেন চলছে, অনেকটা নারী শরীরের মতই লাগে— মধুচক্র কিনা স্পষ্ট করে বলা যায় না—

এবং সে-ই মাংসের দোকান— লুঙ্গি পরা ধুমসো মালিক হাঁটুর ওপর হাত ঝুলিয়ে বসে আছে। দোকানে আজ লম্বা লাইন। টিভিতে রসিয়া-টাইপ একখানা ভোজপুরি গানা বাজছে, খদ্দেররা মাঝে মাঝে চোখ তুলেই স্যাট্‌ করে নামিয়ে নিচ্ছেন—

দোকানের গা ঘেঁষে সাট্টার ঠেকটা পেরিয়ে ডানপাশে যেতেই দেখা যায় একটা ঈষৎ আলো-আঁধারি জায়গা; চাঁদনি রাতের আলো সেথায় রহস্যখেলায় মত্ত; হঠাৎই দেখা যায় একটা মানুষছায়াকে খানিক নিচু হতে— সে যেন কিছু একটা রাখে, উঠে দাঁড়াতেই ছায়াটা আঁতকে ওঠে— ‘‘বোম-বোম’’ করে সে চ্যাঁচাতে শুরু করলে সেই ‘‘বোম-বোম’’ বাজারে “ব্যোম-ব্যোম” করে ছড়িয়ে পড়ে। কিছু মুহূর্তের জন্য একটা চাপা আতঙ্ক তৈরি হয়। ডিসিশন টেকিং প্রসেস। এরপরই সবাই তাড়াহুড়ো করে বেরোতে যায়— চারদিকের স্যাঁতস্যাঁতে পরিস্থিতি আরও কদর্য হয়ে ওঠে— সাট্টাঘর দু-সেকেন্ডে খালি হয়— বেঞ্চবুঞ্চ সব উলটে পালটে একাকার, তাদের দু-তিনজন মাছের বটিতে আড়-বোয়ালের চেয়েও দ্রুত গলা দেয়। দু-তিনটে মানুষের গলা— অজস্র মাছের গলা সব মিলিয়ে দর্শকের গলগন্ড পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যায়—

শেষে বম্ব-স্কোয়াডসুদ্ধ পুলিশ আসে— ঘেয়ো কুত্তাগুলো চারদিক শুঁকে শুঁকে দেখতে থাকে— বিঃ দ্রঃ কুকুরেরা ভূত ছাড়া বোমার অস্তিত্বও টের পায়— স্ক্রিনের একপাশে ভেসে থাকে সাদা অক্ষরে—

লম্বা ছান্‌বিনের পর ব্যাগটাকে সাবধানে তুলে প্রচুর ড্রাগ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ স্টেশনের টেবিলে সাজিয়ে রাখা ড্রাগের বহর দেখিয়ে ক্যামেরা কাট্‌ করে—

পরদিন সকাল। টি-টেবলে চায়ের কাপের সঙ্গে অনেকগুলো খবরের কাগজ সাজানো— প্রতিটার হেডলাইনেই “বোমা বিস্ফোরণে মৃত” শব্দবন্ধ, সঙ্গে মৃতদের বীভৎস ছবি। এরই মধ্যে একটিতে উঁকি মারে “বোমাতঙ্কে মৃত চার”— কাগজটা হাতে নিয়ে একজন গলাকাটা লোক (মুখটা স্ক্রিনের বাইরে) বুকের ছাতির সামনে মেলে ধরে। হেডলাইন— ফ্রন্টপেজ ফটো— দুটো মাথা— চারটে দেহ— ইনসেটে একব্যাগ ড্রাগ—

ক্যামেরায় ফের নিউজ চ্যানেলের সামনে পাবলিক প্রসিকিউটারের ওপেন সেশন— “… আসামীর ভুয়ো চিৎকারে সেদিন বাজারে চারজন প্রাণ হারায়। যদিও আপনাদের সামনে আমি স্বীকার করছি, এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই প্রচুর কেস মুলতুবি ছিল। খবর আছে, ওরা ঐ বাজারেই বেআইনি জুয়া আর দেহব্যবসা চালাত। হুম্‌ম্‌ ওরা অ্যান্টিসোশ্যাল, তবে ওদের হত্যার জন্য কেউ দেশের আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে না।

আমরা মূলত এই বিষয়গুলো উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ ও আরগুমেন্ট সহ মহামান্য আদালতের কাছে পেশ করেছি। আশা রাখছি, আগামী শুনানিতেই আমরা মহামান্য বিচারপতির সিদ্ধান্ত জেনে নিতে সক্ষম হব।’’— বক্তব্য শেষ হতেই পিঁইইই আওয়াজ করে ক্যামেরা নো সিগন্যাল দেখিয়ে দেয়।

 

(৪)

স্ক্রিনে ভেসে ওঠে বিখ্যাত নিউজ চ্যানেলের হেডলাইন— অবশেষে উদ্‌ঘাটিত রহস্যময় আসামীর পূর্বপরিচয়—

নীচে সারি দিয়ে বিজ্ঞাপন— BURN FACT LOSE WEIGHT UPTO………………

সুন্দরী তরুণী ধারাভাষ্য পড়ে চলে, “অবশেষে আমাদের চ্যানেলের একটি বিশেষ টিম-রিসার্চের ফলে সামনে এল রহস্যময় আসামীর পূর্বপরিচয়। রিপোর্ট অনুযায়ী— এই মধ্যবয়স্ক যুবকের বাবা মা তার ছেলেবেলাতেই মারা যান। তখন অনাথ কিশোর শহরের এক ভিখারির দলে নাম লেখায়। প্রায় আট-ন বছর ঘৃণা-অবহেলা সহ্য করে তাদের হয়ে কাজ করার পর সে যোগ দেয় কুখ্যাত সমাজবিরোধী চোখকটা বাচ্চুর দলে। পরবর্তীকালে সে বাচ্চুর প্রধান অবলম্বন হয়ে ওঠে। দলের অন্যান্য সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে— বহুদিন ধরেই তারা আসামীর মধ্যে একধরনের খামখেয়ালিপনা লক্ষ করছিল, তাদের কথায় এইসব খুন-রাহাজানি করে করে আসামী তার হাত ময়লা করে ফেলেছিল। রাতে সকলে ঘুমানোর পর সে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বসে থাকত আর চোখের জল ফেলত— এসবের থেকেই তার এই মতিভ্রম বলে আসামীর বন্ধুস্থানীয়রা মনে করে। বর্তমানে এই ব্যক্তি যে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত এবং সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক— তা নিয়ে বিশেষজ্ঞমহলে কোনও দ্বিমত নেই—” একইসঙ্গে কতগুলো অ্যানিমেটেড স্টিল ফটো দেখানো হয় গোটা রিপোর্টটার। অ্যাঙ্কর তরুণীটির মুখ ভেসে ওঠে স্ক্রিনে, “আসুন দেখে নিই সাধারণ মানুষ কী বলছেন এই বিষয়ে”— পথচলতি সাধারণ মানুষ আচমকা নিউজ চ্যানেলের খপ্পরে পড়লে তার মুখে যে হতবুদ্ধি হাসি ফুটে ওঠে তেমনই পাঁচ-ছজনের আঁ-উঁ দেখিয়ে ক্যামেরা চুপ করে—

সে স্ট্রেট চলে যায় আদালতে। সিনেমায় বহুল ব্যবহৃত সাবেকি সেটিং; অন্ধ নারীমুর্তি ফেট্টি বেঁধে দাঁড়িয়ে তুলাদণ্ড হাতে। স্ক্রিনের ডানদিকের কাঠগড়ায় আসামী, তার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকজন খাকি আর সাদা উর্দির পুলিশ। দেওয়ালে অস্পষ্ট কয়েকজন মনীষীর ফোটোফ্রেম, পেন্ডুলাম দোলানো ঘড়ি। বিচারপতি মগ্ন হয়ে লিখে চলেছেন, পাশে তাঁর শোয়ানো কাঠের হাতুড়ি। একজন কেরানি গোছের লোক গম্ভীরভাবে দাঁড়িয়ে তাঁর থেকে হাত দেড়েক দূরে।

ক্যামেরা প্রথমবারের মত লক্‌ করে আসামীর মুখ। ফুরফুরে ফর্সা মুখের কোনায় বাঁকা হাসি; এত ফর্সা যে স্পষ্ট করে চেনা যায় না। ধবধবে সাদা-কালো স্ট্রাইপওলা পোশাক। আসামীকে নেওয়া হয় হাই-ব্রাইটনেসে— চোখটোখ যাকে বলে ঝলসে যাওয়ার জোগাড়—

নিশ্চুপ বিচারপ্রাঙ্গন; শাস্তিদানের পালা। অ্যাডভোকেট বেঞ্চ ব্যগ্রবদনে অপেক্ষারত। গোটা আদালতেই একটা চাপা টেনশন খেলে বেড়াতে দেখা যায়। হঠাৎই আমার মনে হতে থাকে আমি কি অন্ধ হয়ে যাচ্ছি, ক্যামেরা যতবার আসামীকে ধরছে আমার মনে হয় অনেকগুলো ইমেজ মুখ থুবড়ে পড়ছে একটা আরেকটার ওপর— সঙ্গে চিড়িক্‌-চিড়িক্‌ করে ইলেকট্রিকাল সাউন্ড-নয়েজ; আশ্বস্ত হই বাকি আদালত দেখার পর— সব ঠিকঠাক, নির্দেশক কেবল আসামীকে ঘিরেই কিছু ইল্যুশন তৈরি করতে চাইছেন—

বিচারপতি আদালতের রায় শোনানোর জন্য প্রস্তুত; সবার চোখ তাঁর দিকে; ক্যামেরাও অবিচল স্থির—

একটা বদ্ধ-বিস্ফোরণের শব্দে ক্যামেরা ঘাবড়ে গিয়ে বাঁদিক ধরলে দেখা যায় আসামী আর কাঠগড়ায় নেই, উলটে হাজার হাজার লাল পিঁপড়ে ঘুরে বেরাচ্ছে এদিক-ওদিক। এদের কিছুসংখ্যক যাঁরা এতক্ষণ লালা ঝরাতে ঝরাতে বিচার দেখছিলেন তাঁদের কাপড়জামায় ঢুকে এলোপাথাড়ি কামড়ে অস্থির করে তুলেছে—

গোটা রুমভর্তি লাল-পিঁপড়ে, কামড়ের চোটে সবার প্রাণ একেবারে ওষ্ঠাগত। এরই মধ্যে দেখা যায় তারা লাইন বেঁধে কোর্টরুমের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে— কাট্‌ করে একটা বিস্ফোরণ— আসামী ফেটে পিঁপড়ের ঢিবি হয়ে গেল— কাট্‌– নির্দেশকের নাম— কান চিড়ে দেওয়া হাই ফ্রিকোয়েন্সি মিউজিকের সঙ্গে—