চার নম্বর নিউজডেস্ক
কিছুদিন আগে হয়ে গেল লোকসভা ভোট, এদিকে বিধানসভা ভোটের ঢাকেও কাঠি পড়ে গেছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত— মেইনস্ট্রিম এবং অল্টারনেটিভ মিডিয়া জুড়ে প্রতি মুহূর্তে চলছে চাপান-উতোর, অজস্র ইস্যু ডুবছে, ভাসছে আবার ডুবে যাচ্ছে, ডান-বাম সব পক্ষই এত মানবপ্রেম দেখাচ্ছে যে কলোনিয়াল যুগে হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেন ঘাড়ে তুলে নেওয়ার জন্য ইওরোপীয় দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে ছেঁড়া-কামড়ার কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু বাকি সব ইস্যু নিয়ে মুখর হলেও পরিবেশ সঙ্কট সম্পর্কে মোটের ওপর উদাসীন সমস্ত রাজনৈতিক দল। এই একটা ব্যাপারে তাদের মাঝে অদ্ভুত ঐকমত্য।
চটজলদি ক্ষমতায় আসা আর যতদিন পারা যায় সে ক্ষমতা আঁকড়ে পড়ে থাকায় আগ্রহী আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলির দৃষ্টিক্ষমতা ভবিষ্যতের দিকে খুব বেশি হলে বছর পাঁচেক প্রসারিত হয়। তাই পরিবেশ সঙ্কট সম্পর্কে তাদের উদাসীনতা ও নীরবতা সহজবোধ্য। অবশ্য শুধু আমাদের দেশেই নয়, প্রায় সব দেশেরই রাষ্ট্রনেতারা পরিবেশ সঙ্কট ব্যাপারটিকে পারলে উড়িয়ে দেন। এই পরিস্থিতিতে একমাত্র আশা পরিবেশ আন্দোলন। যদি সচেতনভাবে পরিবেশ সঙ্কটের মোকাবিলা করার জন্য বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্রগুলির ওপর প্রবল চাপ তৈরি করা যায় একমাত্র তবেই কিছু কাজের কাজ হতে পারে। আশার কথা, দেশের নানা প্রান্তে এইধরনের সচেতন পরিবেশ আন্দোলন গড়ে উঠছে।
এইরকমই একটি সচেতন পরিবেশ আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকোনা শহরে। হাজার কুড়ি মানুষের এই শহরে গত আঠাশে জুলাই পরিবেশ সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে পথে নেমেছিল ‘বুনো মোষের বাগাল’ নামের একটি সংস্থা। শহর পরিক্রমার সময় তাদের মিছিল থেকে স্লোগান উঠল, “ঝিঁঝির ডাক, পাখির গান/একটি গাছ অনেক প্রাণ”, “বোজাও যারা পুকুর-জলা/নিজের শিশুর টিপছ গলা”, “যদি হাঁপ ধরে না মরতে চান/গাছ লাগান, গাছ লাগান”, “কিসের হুকুম? কিসের সাজা?/ভাঙছে আইন দেশের রাজা”, “ছাত্র যত, ছাত্রীরাও/এই মিছিলে পা মেলাও”, “তোমরা ছাড়া লড়বে কে?/আগামীকে গড়বে কে?”, “ধর্ম পরে, পরে দেশ/আগে বাঁচুক পরিবেশ”। মিছিলে হাঁটলেন প্রায় শ’খানেক নানা বয়সী মানুষ, যদিও কমবয়সীদের সংখ্যা, এবং তাদের উৎসাহ, ছিল চোখে পড়ার মত। ব্যানারে সংস্থার নামের নীচে লেখা ‘যা কারোর নয়, তাই আমাদের কাজ’।
বিকেলবেলা কাছাকাছি সময়ে শহরে একাধিক রাজনৈতিক দলের মিছিল থাকা সত্ত্বেও এই মিছিলে যারা হেঁটেছেন তাদের অনেকেই মিছিল চলতে চলতে যোগ দেন। বাস স্ট্যান্ড আর গাছশীতলা বাজারে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দুটি মিনিট পনেরোর ক্যাম্পেইনও মন দিয়ে শুনলেন অনেকে, এগিয়ে এসে লিফলেটও নিলেন।
সংস্থার পক্ষ থেকে সভাপতি ধ্রুবজ্যোতি মুখার্জি বললেন, ‘পরিবেশ সঙ্কট আর কোনও দূরের ব্যাপার নয়, ঘাড়ের পেছনে তার উষ্ণ নিশ্বাস আমরা সবাই টের পাচ্ছি। অথচ এই সঙ্কটের কথা গায়ের জোরে উড়িয়ে দিতে চাইছেন প্রায় সব দেশেরই রাষ্ট্রপ্রধান। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। যুক্তি হিসেবে দেখানো হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন থমকে যাওয়ার জুজু। এমন ভাব করা হচ্ছে যেন পরিবেশের কথা যারা বলছেন তারা নেহাৎই আবেগে ভোগা মূর্খ মানুষ, সভ্যতার রথ পেছনে চালাতে চাইছেন তারা। এভাবে পরিবেশবাদীদের tree hugger বলে দাগিয়ে দিয়ে, তাদের উপেক্ষা করে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই ধ্বংস আর নয়ছয় করা হচ্ছে আমাদের যাবতীয় প্রাকৃতিক উত্তরাধিকার। এটা সমস্ত স্তরেই হচ্ছে, আমাদের ছোট্ট শহরেও।
এই শহরে এখনও ইতিউতি ছড়িয়ে আছে শ’খানেক ছোট বড় পুকুর। কয়েকটা তো বিশালাকার— লালসাগর, জহরাপুকুর, বেনেপুকুর, দালালপুকুর, এবং সর্বোপরি রাজার মায়ের দীঘি। এই শেষোক্তটি পৌরজনের স্বার্থে খনন করিয়েছিলেন রাজা মিত্রসেনের মা লক্ষণাবতী, সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি। এই পুকুর ও দীঘিগুলি, যেগুলি সব অর্থেই ‘হেরিটেজ’, বর্তমানে তাদের সব পাড় ঘিরে বাড়ি গজিয়ে উঠেছে, আর সব বাড়ির ময়লা এসে পড়ছে সোজা তাদের জলে। ফলত বেশিরভাগ পুকুরই হারিয়েছে ব্যবহারযোগ্যতা। সংস্কারের অভাবে নোংরা হয়ে যাচ্ছে, ব্যবহৃত হচ্ছে ডাম্পিং জোন হিসেবে। অথচ মাত্র কয়েক দশক আগেও পুরবাসীর স্নান, কাচাকুচি, ধোয়াধুয়ি হত পুকুরের জলেই। যদি পুকুরগুলি সংস্কার করে ফের ব্যবহারযোগ্য করে তোলা যায় তাহলে মাটির তলার জলের ওপর নির্ভরশীলতা অনেক কমবে। আরও একটা বড় উপকার হবে— নিয়মিত পুকুরগুলো ব্যবহার হলে জমি-মাফিয়ারা আর এত সহজে সেগুলো বুজিয়ে ফেলতে পারবে না।’
এছাড়াও প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করার দাবি উঠল, উঠল ডিজেবক্স নামক আসুরিক উপদ্রব বন্ধ করার দাবিও। শেষোক্ত সমস্যাটি, ধ্রুবজ্যোতির কথায়, শিব-শীতলা-মনসার পুজার সঙ্গে বেশি জড়িয়ে, অতএব বড়ই স্পর্শকাতর। এতটাই, যে প্রশাসন এ ব্যাপারে উদাসীন। “মজার ব্যাপার, শিব-শীতলায় পূর্ণমাত্রায় ভক্তি রাখা বেশিরভাগ মানুষ ডিজেবক্স বস্তুটাকে আপদ হিসেবেই দেখে। কিন্তু এর পক্ষে যারা, সেইসব লক্ষ্মীছাড়াদের বোঝানোর রিস্ক কেউ নিতে চায় না। সংস্থার পক্ষ থেকে এই কাজে চন্দ্রকোনার সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যোগ দেওয়ার ডাক দেওয়া হবে। আমরা বিশ্বাস করি সমাজের ছাত্র-শিক্ষক অংশটি চাইলেই একমাত্র ডিজেবক্স বন্ধ হতে পারে।”
মূলস্রোতের রাজনীতি থেকে এখনও ব্রাত্য পরিবেশ ভাবনাকে সবার চোখের সামনে টেনে নিয়ে আসার লক্ষ্যে ‘বুনো মোষের বাগাল’দের প্রচেষ্টা সফল হোক, পত্রিকার তরফ থেকে এই কামনা রইল। আশা করি এইসব টুকরো আন্দোলন একদিন পরস্পরের সাথে জুড়ে গিয়ে পলিসি মেকিং-এর স্তরে স্থায়ী ও কার্যকর প্রভাব ফেলবে।