সার্থক সেনগুপ্ত
ছিল ওলন্দাজ কলোনি। মাঝে মাঝে স্প্যানিশ হামলা। তারও আগে চৈনিক মিং রাজার তাড়া খাওয়া পর্তুগিজ জলদস্যু এসে দুদণ্ড জিরোত এই বনলতা সেন দ্বীপে। ভালোবেসে নামও দিয়েছিল একটা, “ইলা ফরমোসা”, “সুন্দর দ্বীপ”। তারও আগে চৈনিক দুঃসাহসিক মাছধরিয়েরা নৌকা নিয়ে আসত বোধহয়, কিন্তু সেসব প্রাগৈতিহাসিক ব্যাপার থাক। বরং শুরু করা যাক বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে। এইটুকুই, যে জাপানের কলোনি ছিল দেশটা। তারপরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পাশাখেলায় হারের পরে তুলে দিতে হল চিনের হাতে।
দেশটা? তাইওয়ান।
এদিকে রাজকন্যে তো গুলিসুতো খেয়ে ফেলেছে, থুড়ি, চিনের মধ্যে তো লেগেছে ঘোর ধাক্কাধাক্কি। কুওমিনতাং ঘরানার রিপাবলিক অফ চায়না (ROC) ডুবল আর উদয় হল কম্যুনিস্ট মনোভাবাপন্ন পিউপিলস রিপাবলিক অফ চায়না’র (PRC)। ROC’র শাসক চিয়াং-কাই-শেক মনের দুঃখে চাঁদিবাটি উত্তোলন করে গেলেন তাইওয়ানে। রাশিয়া চিন দোস্তি ও ঠান্ডাযুদ্ধের ফলশ্রুতি স্বরূপ, পাঁচটি গ্রাম নিয়ে মহাভারতীয় ভারত শাসনের কনসেপ্টে শেক-সায়েব মহাদেশ সাইজের দেশ হারিয়েও নামে চিনের প্রধান রইলেন বহুদিন। তারপর আমে দুধে মিশে গেল, সে খেতাবও রায়বাহাদুর বিশ্বম্ভরের মতন গেল তামাদি হয়ে। মনের দুঃখে শেক-বাবুও পরলোকে গেলেন। এলেন তার ছেলে। এরপরের গল্প ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার গদিতে আসার। সেসব শুকনো ব্যাপারও থাক বরং।
কিন্তু মাইক্রোস্কোপিক দেশটা এইসবের থেকে বেরিয়ে এসে ধীরে ধীরে এশিয়ার প্রথম চারটে বাণিজ্যিকভাবে শক্তিশালী দেশের মধ্যে নাম করে নিল। কীভাবে? সে গল্পের শুরুটা খুব ইন্টারেস্টিং। বিশেষত সেই বাঙালিদের কাছে যারা সিঙ্গুর কারখানা হওয়ার দাবিতে এবং পরে কারখানা না হতে দেবার ধর্নামঞ্চে, দুদিকেই খিচুড়ি খেয়েছেন। দেশের সমস্ত চাষযোগ্য জমি জমিদারদের হাত থেকে ছিনিয়ে বিলিয়ে দেওয়া হল কৃষকদের হাতে। বন্ধ্যা জমিতে হল ইন্ডাস্ট্রি, যার মালিকানার শেয়ার অথবা মিনারেলের খনির লভ্যাংশের ভাগ তুলে দেওয়া হল জমিহারা জমিদারদের হাতে। সাপ মরল, লাঠিও ভাঙল না। তবে বাকিটা জাতি হিসেবে পরিশ্রম আর শৃঙ্খলা।
তো, এপ্রিলে ফুলবাবু হয়ে গিয়ে পড়লাম সে দেশে। আপিসের কাজ। হপ্তাখানেক। কলকাতা থেকে ফ্লাইট নিয়ে যায় হংকং হয়ে (ছবি ১: হংকং এয়ারপোর্ট, বেশ একটা মেঘের দেশে এলেম মার্কা ব্যাপার)। ফেরতও দিয়ে যায়। কলকাতা হংকং ফ্লাইটে বাংলায় ঘোষণা শুনে সবে একটু “আমার সোনার হুঁ হুঁ” করেছি কি করিনি, হংকং তাইপেই (তাইওয়ানের রাজধানী, আমার গন্তব্য) ফ্লাইটে এয়ারহোস্টেস ঘুম ভাঙিয়ে বললেন “নি হাউ, হাঁউ মাউ খাউ, ঝিংচিকিচিকি”। ধরতে না পেরে ভেবলে গেছি, এমন সময় আবার বলা শুরু করলেন “ঝিনিমিনি, বিনোদিনী, ভেউভেউ, …..”। এরকম খান দশেক শব্দের পর হঠাৎ কানে এল “চিকেন”। ব্যস। স্থান কাল পাত্র ভুলে মাদামকে থামিয়ে বলে উঠলাম “হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ, চিকেন, ঐটাই”। দেখলাম ম্যাজিক এর মত কাজ হল। এরপর উপস্থিত হল একটি চিকেন হটডগ, একটি বিস্কিট ও একপ্যাক আইস টি। হটডগে কামড় বসিয়েই ……. একটা গন্ধ। এ গন্ধ আর বাকি যাত্রায় পিছু ছাড়েনি। শুধু জানিয়ে রাখি ৯ ঘণ্টার যাত্রা আমি কেবলমাত্র একটি বিস্কিট ও এক ঠোঙা ঠান্ডা চা দিয়েই কাটিয়েছি।
মিটিং মিছিল ছিল একদিন। বাকি দিনগুলো এদিক ওদিক এর ওর কাছে যাওয়া। উবার আছে। ড্রাইভাররাও মিশুকে। কিন্তু সে ভাষার মর্মোদ্ধার করা বাল নরেন্দ্র, এগজাম ওয়ারিওর ও কথাঞ্জলি পড়ার থেকেও কঠিন। গাড়িতে উঠেই ড্রাইভারের সম্ভাষণের উত্তরে আপনাকে শুধু বলতে হবে “লোকেশন, লোকেশন” (সোনার কেল্লার “মিসটেক মিসটেক”-এর সুরে)। বেশ সুন্দর সুন্দর সব গাড়ি। বিএমডব্লিউ, লেক্সাস, টয়োটা। তবে একটা মডেলও চেনা নয় (বলে রাখা ভাল পৃথিবীর সমস্ত বিলাসবহুল সেরা গাড়ির মেকাট্র্নিক্স পার্টস তাইওয়ানই উৎপাদন ও সরবরাহ করে)। সরাসরি ক্রেডিট কার্ড থেকে ভাড়া কেটে যায়, এবং অফিসের বিলে জুড়ে যায়, তাই মনটা বেশ ফুরফুরে। ঝকঝকে শহর। বিশাল চওড়া রাস্তা (ছবি ২)। আকাশফোঁড়া সব টাওয়ার (ছবি ৩)। ট্রাফিক নিয়ম মানাতে যান ও জনগণ দুপক্ষেরই অসম্ভব শৃঙ্খলা।
রাতে হোটেলের পাশে তাইপেই ১০১ টাওয়ার (ছবি ৪)। ১০১ তলা বিল্ডিং, না, পুরোটাই শাড়ি নয়, খান দশ তলা ও খান দুয়েক বেসমেন্ট জুড়ে মল ও খাওয়ার জায়গা। বাকিটা অফিসকাছারি। খাওয়ার জায়গার কাছে যেতেই আশির দশকের শুরুর এক ঘটনা মনে এল (ইয়ে, মানে, অন্নপ্ৰাশনের ভাত উঠে এল)। সেই কালান্তক গন্ধ। অগত্যা হোটেলে ফিরে আইসক্রিম আর ফ্রুট স্যালাড দিয়ে ডিনার।
আচ্ছা, রাতের তাইপেই কিন্তু বেশ সুন্দর। আধুনিক সব বিল্ডিং বা ব্যস্ত রাস্তার মধ্যে হঠাৎ করে উঠে আসে মিং রাজাদের স্থাপত্য (ছবি ৫)। ব্রেকফাস্টের জন্য বেরিয়ে সকালে শহরের ঝকঝকে রাস্তা দেখতেও বেশ লাগে (তবে ব্রেকফাস্ট করা আর হয়ে উঠত না সেই গন্ধের জন্য। অগত্যা প্যাকেটের জুস আর জ্যাম পাউরুটি ডিমসেদ্ধ)। চেনা আধুনিকতার পাশে হঠাৎ করে একটা দেওয়াল ভরা গ্রাফিটি বা ওলন্দাজ স্থাপত্যের গির্জা (ছবি ৬)। শহরের একটু বাইরের দিকে অসীম নির্জনতা আর চোখভোলানো সিম্পলিসিটি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বৌদ্ধ মন্দির (ছবি ৭)। শেষদিনে বাঙালির দিঘা আর পুরীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটা উত্তর তাইওয়ানের বিচও ঘুরে নিলাম (ছবি ৮)। তবে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, লেবুচাওয়ালা ও “দাদা, একটা ছবি তুলে দেব?” আবেদন না থাকায় বড্ড ফাঁকাফাঁকা সে সমুদ্র। ফেরার পথে শহরে ঢোকার মুখে মিং রাজাদের বাড়ি (ছবি ৯ ও ১০। মাইরি বলছি, ডালহৌসি অফিস পাড়ায় ভাঙা বাড়িতে অফিস করেছি বছর চারেক। সেই কারণেই কিনা জানি না, পুরনো বাড়ি দেখলেই আমার কেমন যেন নিশির ডাক আসে)। সে বাড়িতে হারেম একটি, কিন্তু পড়ার ঘর পাঁচটা। কোনও সন্দেহ নেই এত পড়াশোনা করেই ডাচদের হাতে রাজ্যপাট হারান মিং-বাবু।
ফেরার হুইসল। তাইপেই বিমানবন্দরে বসে ভাত ডাল আলুসেদ্ধর কথা ভাবতে ভাবতে ট্যাবে কিন্ডলের পাতা ওল্টাচ্ছি, হঠাৎ করে চোখে এল অনুজ ধরের ‘ইন্ডিয়াজ বিগেস্ট কভারআপ’ বইয়ের প্রচ্ছদ। ফ্ল্যাশব্যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে এই একই বিমানবন্দর থেকে উড়েছিল একটা প্লেন, তখন এই জায়গার নাম ছিল তাইহোকু। টোকিওর উদ্দেশ্যে। শোনা যায় কোনাকুনির জায়গায় সোজা নাক বরাবর আকাশের দিকে উঠে যায় প্লেনটা, তারপর একটা বিস্ফোরণ, সর্বাঙ্গে আগুন লাগা অবস্থায় ছিটকে পড়েন টারম্যাকে এক ভদ্রলোক। যমে মানুষে টানাটানির শেষে নাকি চোখ বোজেন শতাব্দীর দ্বিতীয় সেরা বাঙালি। নাকি ওড়েইনি প্লেনটা? রাশিয়া? সাইবেরিয়ার জেল? প্লেনের জানলা দিয়ে আকাশ আর টারম্যাকটা দেখবার চেষ্টা করছিলাম। ঐদিকেই কি? প্লেনের ভেতরটা বড্ড ঠান্ডা ছিল। আর বাড়ির কথা মনে পড়ছিল।