Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দেবতার এক মানবপুত্র— রথীন্দ্রনাথ

কুন্তল রুদ্র

 

রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশার শেষ তিন দশক এবং তাঁর তিরোধানের পর আরও এক দশকেরও বেশি, অর্থাৎ নিজের জীবনের সবচেয়ে কর্মনিষ্ঠ চার দশকেরও বেশি সময় যিনি নিবিড়তম গ্রন্থিতে বিশ্বভারতীর সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন, যাঁকে ছাড়া প্রতিষ্ঠাতার শ্রীনিকেতন-স্বপ্ন স্বচ্ছন্দে বিকশিত হত না, যিনি বিশ্বভারতীর অস্তিত্ব সঙ্কটের কঠিনতম সময়ে প্রতিষ্ঠানের কর্মসচিব হিসাবে সামনে থেকে তাকে পরিচালনা করেছিলেন, যাঁর নীরব উদ্যোগ ও পরিকল্পনায় রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্মের বিপুল তথ্যপঞ্জির ভাণ্ডারভিত্তি গড়ে তুলে রবীন্দ্রভবনের সূচনা এবং বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর যিনি তার প্রথম উপাচার্য, বিস্ময়জনক হলেও সত্যি যে এমন একজন মানুষকে বিশ্বভারতী রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতেই ‘ভুলে’ গিয়েছিল। অবশেষে বিশ্বভারতী ও রবীন্দ্রপ্রসঙ্গে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে তাঁর মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী অতিক্রম করে এসে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী স্বীকৃতি দিল। জীবনের শেষ এক যুগ তাঁর বিশ্বভারতী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা, এমনকি শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে চলে যাওয়া, তাঁকে ঘিরে কেবল বিশ্বভারতীর অভ্যন্তরেই নয়, শান্তিনিকেতন ও দেশের বৃহৎ জনমানসে যে অর্ধসত্যের জাল বিস্তৃত হয়েছিল তার সত্যাসত্য, সূত্র এবং কার্যকারণ এই সবই আজ সঙ্গত কারণেই পুনর্বিচার দাবি করছে।

রক্তকরবীর বিশুপাগলের মত রথীন্দ্রনাথও হয়ত বলতে পারতেন চাঁদের যে পিঠে আলো পড়ে না তিনি সেই অমাবস্যার পিঠ! তাঁর সেই অনালোক অবশ্য বিস্ময়কর আলোকময় পিতার সৃজনী প্রতিভার অনিবার্যতাজনিত। কখনও কখনও কোনও কোনও জীবনে এমনও ঘটে। অবিস্মরণীয় সেই সৃজনী প্রতিভা আপন বিচিত্রধর্মী সৃজনের পাশাপাশি বিশ্বসভ্যতার সঙ্কটের কথা ভেবেছেন, ভেবেছেন দেশের কথা, গ্রামের উন্নতির কথা, নিরন্তর তাঁকে ভাবতে হয়েছে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় এবং পরবর্তী পর্যায়ে বিশ্বভারতীর কথা। তাঁর জীবনবোধ ও আদর্শচেতনার মধ্যে কোনও ফাঁক ছিল না। পিতা হিসাবে তিনি বিশেষভাবে সন্তানের কথাও ভেবেছেন, তাদের শিক্ষা কর্ম ও পরিণত জীবনের কথা। সেই ভাবনারও মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছিল তাঁর আদর্শচেতনাজনিত স্বপ্নসন্ধান। আর তার তীব্রতায় কখন যে নিজেরই আদর্শবোধের বিপরীতে দাঁড়িয়ে পড়েছেন খেয়ালও হয়নি। মানুষের মধ্যে সুপ্ত সম্ভাবনার বিকাশের লক্ষ্যে শিক্ষার যে ধারণা তিনি চর্চা করেছেন, তার অন্যতম প্রধান এক শর্তই হল মনের স্বাধীনতা। অপ্রিয় হলেও সত্য, শান্তিনিকেতন আশ্রম বিদ্যালয়ের একেবারে সূচনাপর্বের প্রথম পাঁচ ছাত্রের একজন হয়েও রথীন্দ্রনাথের জীবনে সে স্বাধীনতা প্রস্ফুটিত হয়নি। তুলনায় পরিণত পর্বের শিক্ষাজীবন নির্বাচন— আমেরিকার ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটিতে তাঁর কৃষিবিজ্ঞান পড়তে যাওয়া একেবারেই পিতার একক সিদ্ধান্ত, তা রথীন্দ্রনাথের ইচ্ছানিরপেক্ষ ছিল। পিতার প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধাশীল এই পুত্র পিতার ইচ্ছাতেই ‘চাষা’র জীবনকে সানন্দে বরণ করেছিলেন। কৃষিবিজ্ঞানী হয়ে ফিরে এসে পিতার ইচ্ছার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দিয়ে শিলাইদহের ক্ষেতে ট্রাকটরের স্টিয়ারিং ধরতেও তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত হননি। দেশ সম্পর্কে পিতার স্বপ্নাদর্শকে নিজের বলে মনে করেই সে কাজে ঝাঁপিয়েছিলেন রথী। সেই কর্মসূত্রে পিতার কাছাকাছি আসতে পেরে সেদিন তিনি খুশি হচ্ছিলেন। সে প্রসঙ্গে তাঁর মুখে পরবর্তী জীবনে কী তাৎপর্যব্যঞ্জক কথাই না উচ্চারিত হয়েছিল! ওই সময়ের কথা মনে করে রথীন্দ্রনাথ বলেছিলেন— ‘আমরা পিতাপুত্র পরস্পরের যত কাছাকাছি এসেছিলাম তেমন আর কখনও ঘটেনি।’

আজীবন রথীন্দ্রনাথ পিতার কর্মের শরিক হতেই চেয়েছেন। পিতার স্বপ্নকে সফল করে তোলাই ছিল তাঁর কাছে সবচেয়ে বড়। তাঁর ‘পিতৃস্মৃতি’ গ্রন্থের ভূমিকায় এল কে এলমহার্স্ট উল্লেখ করেছেন, কীভাবে নিজের বাল্য ও যৌবনের স্বপ্নগুলি সরিয়ে রেখে পিতার স্বপ্ন সফল করতে নিরন্তর প্রয়াসী ছিলেন রথীন্দ্রনাথ। নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে পিতার পায়ে সঁপে দিয়ে তৃপ্ত থেকেছেন, ধন্য বোধ করেছেন। তাঁর জীবনে দু’বার এর ব্যতিক্রম ঘটে। সচেতনভাবে নিজের দাম্পত্যজীবনকে কেবল পিতৃনির্দেশিতই নয়, সুস্থ স্বাভাবিক সঙ্গত পরিণামেই চালিত করতে চেয়েছিলেন তিনি, প্রতিমাদেবীর রূপে-গুণে মুগ্ধতা ছিল তাঁর, স্ত্রীর প্রতি শুধুমাত্র দায়বোধই নয়, একধরনের ভালোবাসাও তাঁর মনে জেগেছিল, স্ত্রীর মন পেতে চাওয়ার গভীর ব্যাকুলতার কথা প্রতিমাকে তিনি জানিয়েও ছিলেন। আর লিখেছিলেন দুই হয়েও একার যন্ত্রণাজনিত অন্তর্লীন গভীর ক্ষরণের কথা। স্ত্রীর প্রতি তিনি সৎ থাকতেই চেয়েছেন, তাই নিজের ব্যক্তিত্বের বিশেষ সমস্যার কথাও জানিয়েছিলেন তাঁকে। ডেকে বলেছিলেন— তিনি পারছেন না, প্রতিমা যেন উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসেন। বুঝতে পারছিলেন অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে কাছাকাছি আসতে না পারলে সঙ্কট অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে একদিন। বুকের গুহার তরলিত অন্ধকার জমাট বেঁধে কঠিন ও স্থায়ী রূপ ধারণ করবে, আর তার পরিণামে প্রতিমাকে ‘চিরকাল … কষ্ট পেতে হবে।’ আর তাঁর নিজের কষ্ট? বিশ্বভারতীর কাজে নিজেকে গভীরভাবে নিয়োগ করেই যতখানি সম্ভব সে কষ্ট তিনি ভুলে থাকতে চেয়েছেন।

নিজের এই দ্বিতীয় বিবাহে বালবিধবা প্রতিমার ভিতরে যথেষ্ট বাধা ছিল, প্রাথমিকভাবে পিতৃহীনা কন্যার মাতারও সম্মতি ছিল না। অনেক চেষ্টার পর অভিভাবকমণ্ডলী তাঁদের সম্মত করান প্রধানত রবীন্দ্রনাথের আগ্রহেই। স্বভাবতই রবীন্দ্রনাথ সমস্যাটি জানতেন, বুঝতেনও। বিবাহের পরেও তিনি সে ব্যাপারে যে কিছুটা চিন্তান্বিত ছিলেন তা বোঝা যায় রথীর প্রতি তাঁর উপদেশ ও পরামর্শে, প্রতিমার মন যাতে ‘মুষড়ে না যায়’ এক চিঠিতে তার জন্য পুত্রকে উদ্যোগী হতে বলেন তিনি। তাঁর সে পরামর্শ আজ যেন কিছুটা তাত্ত্বিক বলে মনে হয়। আশ্চর্যের কথা, রথীর দিক থেকেও যে মানসিক বাধা আসতে পারে একবারও ভাবেননি তিনি। ভাবেননি বলেই এই বিবাহ সম্পর্কে রথীর মতামতের প্রয়োজনও তিনি অনুভব করেননি। কী ভেবেছিলেন তিনি, পিতার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ পুত্রের অন্তরে পত্নীপ্রেম সততই জেগে উঠবে? অকালে নিজের পত্নী এবং একাধিক পুত্রকন্যার মৃত্যুর বেদনার মতই পরবর্তী জীবনে রথী-প্রতিমার দাম্পত্যের মৃত্যুও তিনি মেনে নিয়েছিলেন।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা বিভ্রান্তি ও কুৎসার ধুম্রজাল দূরে সরে যাওয়ায় এখন দিনের আলোর মতই এই সত্য স্পষ্ট যে প্রতিমাদেবীর সঙ্গে রথীন্দ্রনাথের দাম্পত্যজীবন কোনওদিন দানা বেঁধেই ওঠেনি, এটি আসলে এক বেদনাঘন মানসিক অবিবাহ। পিতার ইচ্ছানুসারে রূপবতী বিধবা আত্মীয়াকে রথীন্দ্রনাথ বিবাহ করেন। পিতার প্রতি শ্রদ্ধায় রথী এতটাই নিবিষ্ট এবং তাঁর সিদ্ধান্তে এমনই আস্থাশীল ছিলেন যে তাঁর মনে প্রাকবিবাহপর্বে কোনও দ্বিধাও জাগেনি। প্রতিমাদেবীর জন্মের কিছুদিন পরেই মাতা মৃণালিনী দেবী তাকে রথীর জন্য কন্যা হিসাবে নির্বাচন করেছিলেন— এই সংবাদ রথীন্দ্রনাথের পক্ষে জানা স্বাভাবিক এবং তেমন ঘটে থাকলে তার সেন্টিমেন্টাল দিকটিও রথীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করা একান্তভাবেই স্বাভাবিক। বিবাহের পর সম্পূর্ণ ভিন্নতর এক বাস্তবতার মুখোমুখি হন তিনি। বুঝতে পারেন আনুষ্ঠানিকতা উত্তীর্ণ হয়ে এই বিবাহ দুই মনের সম্মিলিত গান হয়ে উঠল না। তবু প্রতিমা এবং রথী, দুজনেই পরস্পরের প্রতি সৎ থাকতে চেয়েছেন। শ্রীনিকেতনের কাজে আত্মনিয়োগ করে তার মধ্যেই ডুবে থেকেছেন রথীন্দ্রনাথ। আড়াল থেকে পিতার ইচ্ছা, কর্ম, যাপন ও সৃষ্টিতে নিজেকে উৎসর্গ করে গেছেন। ভেবেছিলেন এই তবে তাঁর জীবনের নিত্যযাত্রাপথ। পিতার মৃত্যুর পর অনেক বেশি দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর কাঁধে, সে দায়িত্বকে তিনি মহৎ কর্তব্যজ্ঞানেই গ্রহণ করেন, নিজের সব আলোটুকু সেই কাজে ঢেলে দিয়ে উত্তরায়ণের অনুজ্জ্বল গুহাঘরে ফিরে আসতেন তিনি। ওই গুহাঘর তাঁর জীবনকে যেন এক আশ্চর্য প্রতীকী ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করে। লোকচক্ষুর অন্তরালে প্রায় আলোহীন এক কক্ষে তিনি নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়ে গেছেন।

ভেবেছিলেন এভাবেই পিতার স্বপ্নসাধ বিশ্বভারতীর কাজে মগ্ন থেকে নিজের শূন্যতার অনুভূতি থেকে সরে থাকবেন, ছিলেনও তাই। বিশ্বভারতী থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে হল পিতার মৃত্যুর এক যুগ পর। ততদিনে দেশ স্বাধীন হয়েছে। রাজনীতির যোগবিয়োগে রবীন্দ্রোত্তর বিশ্বভারতীতে ক্ষমতার নতুন চক্র গড়ে উঠেছে। পাওয়ার পলিটিক্স দ্রুত সামনে জায়গা করে নিতে সচেষ্ট, প্রতিষ্ঠাতার স্বপ্ন আদর্শ পিছু হটছে। একটু একটু করে রথীন্দ্রনাথ বুঝতে পারছেন রবীন্দ্রনাথের অনুপস্থিতিতে জেতার চ্যালেঞ্জ নয়, ধীরনিশ্চিতভাবে আপসপন্থার বিকারে স্বপ্ন তার উজ্জ্বলতা হারাচ্ছে। নতুন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষয়িক প্রাপ্তির সম্ভাবনার হিসাবনিকাশ চলছে জোরকদমে। একটা শূন্যতার বোধ জেগে উঠছে যেন রথীর মনে। উপাচার্যের আসনে বসে বুঝতে পারছেন হেরে যাচ্ছেন তিনি। পিতার স্বপ্নকে আঁকড়ে থাকার জোর হারিয়ে সর্বরিক্ত মানুষটি অবলম্বন খুঁজছেন। দাম্পত্যজীবনের ব্যর্থতাকে পাশে সরিয়ে রেখে প্রতিমা এসে সামনে দাঁড়িয়ে পিতার স্বপ্নরক্ষায় রথীর পাশে থাকার প্রত্যয়ী বাণী শোনালে হয়ত নতুন আশায় বুক বাঁধার গল্প হলেও হতে পারত। তা ঘটেনি, কারণ মধ্যবর্তী শীতলতা শূন্য ক্রমাঙ্কেরও নীচে চলে গেছে ততদিনে। সুতরাং নতুন যা ঘটল সে যেন এক বিস্ফোরণ, প্রায় হাহাকারের মত শূন্যে ছুঁড়ে দিতে চাওয়া হাত ধরার যখন আর কেউ নেই, তখন সেই সর্বরিক্ত মানুষটির হাত ধরতে এগিয়ে এলেন বন্ধু মীরা। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ তছরূপের এক গল্পও ডালপালা বিস্তার করতে শুরু করেছে। কী হাস্যকর সেই অভিযোগ! যে পরিবার তাদের সর্বস্ব বিশ্বভারতীর জন্য উজাড় করে দিয়েছে সেই পরিবারের সন্তানের বিরুদ্ধে বিশ্বভারতীরই অর্থ তছরূপের অভিযোগ? ডাঃ শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের পারিবারিক সূত্র অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন সাক্ষ্য দেয়! ১৯৩৮ থেকে ৫১— এই এক যুগ সময়ে অর্থাভাবে প্রায়শই ছাত্র কর্মী বা অধ্যাপকদের চিকিৎসা বন্ধের পরিস্থিতি হত, আর রথীন্দ্রনাথ গোপনে নিজের ব্যক্তিগত খরচের টাকা থেকে নিয়মিত তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন। সেকালে সেই অর্থের অঙ্ক ছিল বছরে দশ থেকে পঁচিশ হাজার টাকা। তাঁকেই কিনা তছরূপের কুৎসার মুখে পড়তে হল! এই কাদা গায়ে মেখে শান্তিনিকেতনে থাকা রথীর পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠল। প্রায় গুটিয়ে যাওয়া মেরুদণ্ড থেকে ছিটকে বের হল যেন বিদ্যুৎ, ঘোষণার মত শোনা গেল— ‘আমি লুকিয়ে চুরিয়ে যাচ্ছি না, এখানে সবাইকে জানিয়েই যাচ্ছি মীরা আমার সঙ্গে যাচ্ছে।’

পিতার স্বপ্নের আবেশ ছেড়ে, মৃত দাম্পত্যের ঘেরাটোপ ছেড়ে, পরাজয়ে জ্বলে ওঠা একজন মানুষের শান্তি খুঁজতে যাওয়া, সমতলের চড়াই-উৎরাই ছেড়ে দেরাদুনের স্নিগ্ধ পাহাড়ে। সঙ্গিনী বন্ধুপত্নী, যিনি তাঁর জন্য কলঙ্কতিলক মাথায় নিতে দ্বিধাহীনা। এহেন পরাজয়েও মাপে যেন একটু বড় হয়ে গেলেন রথীন্দ্রনাথ। পিতার প্রতি সমর্পিতপ্রাণ মানুষটি জীবনে এই প্রথম পিতার আলোকবৃত্তের বাইরে এসে দাঁড়ালেন। আর রসালো কুৎসাকারীরা? যেমন চিরকাল হয়, তাদের কণ্ঠস্বর শোনা গেলেও মুখ দেখা যায় না। আজকের ঢাকঢোলের বিশ্বভারতী সংবাদ-শিরোনামে নিত্যদিন, আর কথায় কথায় উচ্চারিত আশ্রম আর গুরুদেবের কথা। রথীর কথা হেথা কেহ তো বলে না! না না, বলে! উত্তরায়ণের বাগান ও অন্যান্য গাছেরা, শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনের স্থাপত্যগুলি, রবীন্দ্রভবনের সংগ্রহশালা, শ্রীনিকেতনের কৃষিখামার ডেয়ারি ফার্ম— এরা কথায় বলে না, বলে নিজেদের নীরব অস্তিত্বে, তাদের দেহে-প্রাণে যে সেই মানুষটির স্পর্শের অনুভব। আর রায়পুর, রূপপুর, গোয়ালপাড়া, আদিত্যপুর, লালদহ, সর্বানন্দপুর, আলবাঁধা-সহ বিভিন্ন গ্রামের মানুষ— একদা যারা বিশ্বভারতীর গ্রামোন্নয়নের কাজে সামিল হয়েছিল— তারা এখনও সরবে বলে রথীবাবুর তাদের গ্রামে আসার বিচিত্র কাহিনী, গ্রাম জাগানিয়া গল্পকথা। শেষবার শান্তিনিকেতনে এসে ফিরে যাওয়ার সময় শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনের সঙ্গে নাড়ির বাঁধন ছিঁড়ে যাওয়া মানুষটির চোখে কে যেন অশ্রুকণার উৎসার দেখেছিল।

এই মানুষটি নিজের জীবনের সর্বস্ব পিতাকে নিবেদন না করে একটু যদি স্বার্থপর হতে পারতেন, যদি কলম-তুলির কারবারে আর একটু সময় দিতেন, তাহলে বাংলা সাহিত্যে আরও একজন ঠাকুরের জন্য আসন পাততে হত আমাদের, ছবির জগতে রবি অবন গগনের পাশেও থাকত তাঁর আসন বাঁধা। ‘পিতৃস্মৃতি’র মত অমন লোভনীয় স্মৃতিকথা বাংলা ভাষায় আর ক’খানা আছে? শুধু বাংলাই বা কেন, On the Edges of Times? এটি যে আজও ইংরাজি ভাষায় রবীন্দ্রস্মৃতিমূলক সবচেয়ে সুখপাঠ্য গ্রন্থ কারও সংশয় আছে নাকি! তথ্যের ভার নেই, তরতর করে ছিপনৌকার মত এগিয়ে চলা কথা-ভাষা। সামান্য কিছু ছবি এঁকে রেখে গেছেন, অধিকাংশই ফুলের। সে ছবি সম্পর্কে প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী স্টেলা ক্রামরিশের কথা হল— সেগুলি এমন যে ছবির পশ্চাৎপট ফুলের স্পন্দনে দুলে ওঠে।

এমন এক শিল্পীসত্তা যে প্রেমিক হবেন সে আর আশ্চর্য কী! একজনের ক্ষেত্রে সাড়া মেলেনি, সেই ঊষরতা ঢাকা পড়েছিল দেরাদুনে ‘মিতালি’ বাড়িতে আর একজনের ভালোবাসায়। কিন্তু তাই তাঁর পিতার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যাওয়ার কারণ নয় মোটেই, সে ছিল তাঁর পিতার স্বপ্নের এবং নিজের কর্মের অনিবার্য করুণ পরিণামের ছবি দেখার প্রতিক্রিয়া। যাওয়ার আগে হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও ডাঃ শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সহ স্বল্প কয়েকজন শুভানুধ্যায়ীর কাছে তাঁর বিশ্বভারতী তথা শান্তিনিকেতন ত্যাগের কারণ ব্যক্ত করে তিনি বলেছিলেন—

তিনটি কারণে আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি, যেটা আমি মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। প্রথম হচ্ছে, আমার নিজের বাড়িতে আমি একজন বেতনভোগী কর্মচারী মাত্র এই আমার সংজ্ঞা। দ্বিতীয়ত আমি উপাচার্য পদ থেকে যেদিন পদত্যাগ করব সেদিন থেকে এখানকার আমি কেউ নই, নতুন লোক সব বাইরে থেকে আসবে তাদের কাছে আমার কোনও মূল্য নেই। আমি রাস্তা দিয়ে যেতে গেলে দারোয়ান আটকে দেবে, বলবে এখান দিয়ে বাইরের লোকের যাতায়ত নিষেধ। … তৃতীয়ত, … বাবামশাই তাঁর ‘তোতাকাহিনী’ গল্পে এই আশ্রমের সম্বন্ধে যে ভবিষ্যৎবাণী করে গেছেন তা দেখবেন আপনারা। কারণ যারা বাইরে থেকে আসবে তাদের কাছে এসব আদর্শ, নীতি মূল্যহীন; তারা এই আশ্রমটাকে বানিয়ে ফেলবে একটা টাকা রোজগারের কারখানা। আমরা অনেক পরীক্ষা করে একজন কর্মী বা অধ্যাপককে নিযুক্ত করতাম তাঁর এই আশ্রমের প্রতি কতখানি ভালোবাসা আছে, কতখানি কাজের দক্ষতা আছে এই সব দিক দেখে। এখন থেকে আর এসব না দেখে সরকারি নীতি নিয়ম অনুযায়ী তিনি নিযুক্ত হবেন, ফলে বাইরের আর পাঁচটা ইন্সটিটিউশনের মতো এটাও হয়ে যাবে; এর নিজস্বতা আর থাকবে না। এটা আমার কাছে খুব বেদনাদায়ক। অতএব এখান থেকে দূরে থাকা অনেক ভালো এবং উচিত।

যে সংশয় রবীন্দ্রনাথের মনে শেষ জীবনে দানা বেঁধেছিল তাকেই কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবে ঘোরতর হয়ে উঠতে দেখে বেদনামথিত হৃদয়ে রথীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী ত্যাগ করেন। প্রচলিত গল্পকথার কিছু বাস্তবভিত্তি থাকলেও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিয়ে মহত্তম এক স্বপ্নের বিকার থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর কাজটি সফলভাবেই ঘটিয়ে তোলা হয়েছিল, আর মানবিক হৃদয়দৌর্বল্যের প্রতি ধিক্কারে কুৎসার ধুলিধূসরিত ধ্বজা উড়েছিল কতিপয় আশ্রমিকের সৌজন্যে। এর কোনও প্রতীকমাত্রা আছে কিনা জানি না, তবে অনন্য শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের সূচনাকারী এক প্রাক্তন ছাত্র বিশ্বভারতীর জন্য সর্বস্ব দিয়ে শান্তিনিকেতন থেকে অনেক দূরে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে চিরদিনের মত শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আর হ্যাঁ, তিনি মোটেই কোনও ঠাকুর ছিলেন না, ছিলেন— একটি স্বপ্নের মৃত্যুতে বেদনাবিদীর্ণ ভীষণরকমের রক্তমাংসের একজন মানুষ!