রায়া দেবনাথ
আগস্ট মাসের এক প্যাচপ্যাচে গরমের সকাল। বৈদ্যুতিন মিডিয়ার কল্যাণে ‘আসমুদ্রহিমাচল’, থুড়ি কাশ্মির ব্যতীত বাকি ভারত, কেমন বাড়ি বসে, হঠাৎ করেই জেনে গেল কোনও রকম আলোচনা, বিতর্ক, মত বিনিময় ছাড়াই সংবিধানের ৩৭০ ধারা এবং ৩৫এ সেকশনটির অস্তিত্ব অবলুপ্ত হয়েছে। সংসদে প্রস্তাব পেশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতির ‘ইচ্ছানুসারে’ জম্মু-কাশ্মিরকে ‘বিশেষ মর্যাদা’ ও ‘বিশেষ অধিকার’ প্রদানকারী (‘নিন্দুকে’ অবশ্য বলে জম্মু-কাশ্মিরের ভারতে অন্তর্ভুক্তির প্রাকশর্তের প্রাথমিক ভিত বা সেতুবন্ধনই ছিল এই ধারা, তা যাই হোক) ধারা ‘ভ্যানিশ’ হয়ে গেল! মাত্র কয়েকঘণ্টার মধ্যে সব্বাই জেনে গেল, রাজ্য নয় এ’বার থেকে জম্মু-কাশ্মির কেন্দ্র-শাসিত অঞ্চল! অর্থাৎ, ‘বিশেষ মর্যাদা’ শুধু নয় জম্মু-কাশ্মিরের থেকে কেড়ে নেওয়া হল ‘রাজ্য’র মর্যাদাও! ভারতের মত ‘নেশন অফ স্টেটস’-এ একটি রাজ্যের যা যা অধিকার থাকে বা আছে জম্মু-কাশ্মিরের সেটুকুও রইল না। আপাতত পুরোটাই চলে গেল কেন্দ্র বা রাষ্ট্রশক্তির ইচ্ছা এবং মর্জি এবং ক্ষমতার অধীনে। আর সবটুকুই ঘটল মিথ্যে জঙ্গি হানার জিগির তুলে জম্মু কাশ্মিরকে সেনায় মুড়ে, সব রকম যোগাযোগ ছিন্ন করে, নেতা-নেত্রীদের গৃহবন্দি করে, কাশ্মিরের আমজনতার দিকে বন্দুক তাক করে! যদিও ৩৭০ ধারা, ৩৫এ, ইতিহাস ভূগোল গণতন্ত্র ইত্যাদি প্রভৃতিও আপাতত ব্যাক সিটে। আপাতত আমরা জেনে গেছি ডাল লেকের ধারে জমি বা ‘ফর্সা’ সুন্দরী কাশ্মিরী মেয়ে (নারীও যেহেতু জমির সমতুল্য, উভয়েরই অস্তিত্ব ‘অধিগ্রহণ’ নির্ভর) প্লেইন ল্যান্ডের পুরুষদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। আর জানব নাই বা কেন, বিজেপির বিধায়ক থেকে মুখ্যমন্ত্রী, সোচ্চারে কাশ্মিরী মেয়েদের ‘আমদানি’ করার আনন্দ প্রকাশ করে ফেলেছেন যে! উগ্র জাতীয়তাবাদের টনিক গিলিয়ে দিতে পারলে এ দেশের মানুষের ঘটমান বর্তমান সম্পর্কে যে বিশেষ হুঁশ থাকে না, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার দক্ষতার সঙ্গেই সে বিষয় উপলব্ধি করে ফেলেছে! ৪৫ বছরে বেকারত্বে শীর্ষস্থান, নারী ও শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনে ‘অনন্য’ নজির স্থাপন, ভ্রূণহত্যার নির্লজ্জ দলিল উত্তরকাশী, সেক্স রেশিওর কুৎসিত দশা, রেলে ঢালাও ছাঁটাই, পে কমিশন অবলুপ্তির প্রস্তাব, মোটর শিল্পের বেহাল দশা, মব লিঞ্চিং সংস্কৃতি, দলিত অপ্রেশন, রেল ও বিমান পরিষেবায় খুল্লামখুল্লা বেসরকারিকরণ, শিক্ষায় বাজেট হ্রাস, তীব্র জল সঙ্কট, উন্নাও… ওই এক কাশ্মির প্রসঙ্গে সব কেমন যেন আমাদের আলোচনার পরিসর থেকে হাওয়া হয়ে গেল, তাই না? যদিও সমস্যাগুলো রয়ে গেল, বেঁচে থাকল, পুষ্ট হল। শুধু কী এইগুলোই? উগ্রজাতীয়তাবাদের সুড়সুড়িতে সাড়া দেওয়া জনগণের নাকের ডগা দিয়েই কেমন বিনা হইচইয়েই, চুপচাপ পাশ হয়ে গেল এই নীচের বিল দুটি!
- ট্রান্সজেন্ডার পারসন্স (প্রোটেকশন অব রাইটস) বিল, ২০১৯
- ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন বিল
মজার বিষয়, এই দু’টি বিল যাঁদের জন্য অর্থাৎ প্রথমটির ক্ষেত্রে দেশের এলজিবিটিকিউ ক্ষেত্রের মানুষজন এবং দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে ডাক্তার ও ডাক্তারির পড়ুয়ারা প্রভূত আপত্তি জানিয়ে আসছেন বেশ কিছুদিন ধরেই। কিন্তু তাঁদের মতের বিশেষ তোয়াক্কা না করেই কেমন চুপিসারে রাষ্ট্র সুকৌশলে পাশ করিয়ে নিল এই দু’টো বিলকেই! নিজেদের ইচ্ছানুসারেই! তারজন্য বেছে নিল এমন একটা সময়, যখন এ নিয়ে আলোচনার কণামাত্র ‘ফুরসত’ আমজনতার নেই!
কেন সমস্যা এই বিল দু’টো নিয়ে, কীসের বিতর্ক? আসুন, খানিক চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
ট্রান্সজেন্ডার পারসন্স (প্রোটেকশন অব রাইটস) বিল, ২০১৯
নামটি মনোহরা হলেও ২০১৪ সালের প্রস্তাব লগ্ন থেকেই এই বিল এ দেশের রূপান্তরকামী, রূপান্তরগামী সহ সমস্ত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকার এবং সুরক্ষা কতটা সংরক্ষিত করতে পারবে বিতর্ক, আপত্তি সব কিছুই ছিল কিন্তু তা নিয়েই। কারা আপত্তি তুলেছিলেন? যাদের নিয়ে, যাদের ‘জন্য’ এই বিল নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন তারাই! মূলত তাঁদের লাগাতার ওজর আপত্তি বিক্ষোভের জেরেই প্রস্তাবিত টিজি বিলে কিছু ‘সংশোধনী’ আনা হয়। সেই সংশোধিত বিলটিই সংসদের উভয় কক্ষেই পাশ হয়েছে সম্প্রতি। কিন্তু ‘সংশোধিত’ হওয়ার পরেও কী মিটল সমস্যা? না মিটল না।
- এই বিলে নির্দিষ্টভাবে বেশ কিছু বিষয়কে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দটির সংজ্ঞা হিসাবে ‘না পুরুষ-না নারী’-র মত ভয়ানক বক্তব্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তার বদল হলেও এই বিলের প্রণেতাদের বিষয়টি সম্পর্কে বোধের অভাব যে কতটা সাঙ্ঘাতিক তা আগেই প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল। এখন বদলে ‘ইন্টারসেক্স’-এর আলাদা সংজ্ঞা যুক্ত করা হলেও, এই বিলের ‘ট্রান্সজেন্ডার’ সংজ্ঞার সঙ্গে তাকে পুনর্বার মিশিয়ে ফেলা সেই বোধের অভাবকেই পুনঃস্বীকৃতি দেয় মাত্র! ফলে, কোথাও গিয়ে ইন্টারসেক্স মানুষদের অস্তিত্বই প্রশ্নের মুখে পড়ে যাচ্ছে এখন!
- এই বিলে ‘পরিবার’ বিষয়টিকে ‘বায়োলজিক্যাল পরিবার’ এই ধারণার মধ্যেই আবদ্ধ রাখা হয়েছে। অথচ রূপান্তরকামী, রূপান্তরগামী, রূপান্তরিত, হিজড়া, ইন্টারসেক্স সহ তৃতীয় লিঙ্গের অনান্য মানুষরা বারবার এই বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে এসেছিলেন। তাঁরা সাফ জানিয়েছিলেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাথমিক বৈষম্য, নিপীড়ন, অত্যাচার, হিংসা শুরু হয় তাঁদের ‘বায়োলজিক্যাল’ পরিবার এবং তৎসংলগ্ন পারিপার্শ্বিক থেকেই। বেশিরভাগ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ আদতে তাদের বায়োলজিক্যাল পরিবারের সঙ্গে বাসই করেন না। সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট লিঙ্গভিত্তিক কমিউনিটির মানুষজনই তাঁদের পরিবার হয়ে ওঠেন। ফলে ‘পরিবার’ সংজ্ঞাটির পরিধি বর্ধিত না করে বায়োলজিক্যাল পরিবারের উপর ভিত্তি করে কোনও নিয়ম লাগু করলে এ’দেশের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের আখেরে খুব একটা লাভ কিছু হবে না।
- প্রস্তাবিত বিলে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ মানুষদের ‘চিহ্নিতকরণে’র যে চরম অবমাননাকর পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়েছিল লাগাতার প্রতিবাদে তার খানিক বদল করা হয়েছে বটে, কিন্তু তার পরেও যেটা থেকে যাচ্ছে, তা কী খুব সম্মানের? উত্তর হল ‘না’, নয়। একজন মানুষ ‘ট্রান্সজেন্ডার’ কিনা, এবং তার উপর ভিত্তি করে তিনি ‘সুযোগ সুবিধার’ অধিকারী কিনা, তা ঠিক করার অধিকার ন্যস্ত করা হয়েছিল ‘ডিস্ট্রিক্ট স্ক্রিনিং কমিটি’র উপর। আপাতত, সেই কমিটি নেই। এখন একজন মানুষের লিঙ্গপরিচিতির ‘ছাড়পত্র’ দেওয়ার অধিকারী হয়েছেন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। অর্থাৎ একজন ট্রান্সজেন্ডার মানুষকে তিনি ট্রান্সজেন্ডার কিনা প্রমাণ করতে কিছু ‘ডকুমেন্টস’ জমা দিতে হবে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে! সেই ‘ডকুমেন্টসের’ ভিত্তিতে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ঠিক করে দেবেন সেই ব্যক্তির লিঙ্গপরিচিতি বা জেন্ডার! এবার ধরুন এক ব্যক্তি ট্রান্সজেন্ডার কিন্তু কোনও বায়োলজিক্যাল লিঙ্গ পরিবর্তনে বিশ্বাসী নন বা তাঁর সেই ক্ষমতা নেই। কী ডকুমেন্টস, কী মেডিক্যাল সার্টিফিকেট জমা দেবেন তিনি? সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারির পথে যদি কেউ হাঁটতে না চান বা হাঁটতে না পারেন তার লৈঙ্গিক পরিচিতি কীভাবে নির্ধারিত হবে? কেনই বা তা অন্যের দ্বারা নির্ধারণের মুখাপেক্ষী হবে? কেনই বা এসআরএসের ভ্যালিডিটিও নির্ভর করবে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিসস্টেট নামক এক পদাধিকারীর উপর? সরকার থেকে কী ঐচ্ছিক ব্যক্তিদের এসআরএসে আলাদা করে সাহায্য করা হবে? এই নিয়েও কোনও স্বচ্ছ বক্তব্য উঠে আসেনি।
- এই বিলে কমপ্লেইন্ট অফিসার নামক এই পদাধিকারীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যার কাছে অভিযোগ দায়ের করলে ‘আইনানুগ’ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু কীভাবে নিয়োজিত হবেন এই অফিসার? যোগ্যতা কী হবে তার? পদ্ধতিটিই বা কী? ইলেকশন? সিলেকশন? নমিনেশন? কেউ জানে না।
- এই বিলে ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের ‘উদ্ধার, সুরক্ষা এবং পুনর্বাসন’ অংশটিতে শেল্টার হোমের যে প্রসঙ্গ আনা হয়েছে, তার উপর ভরসা রাখতে পারছেন না ট্রান্সজেন্ডাররাই। এই রেসকিউ বা শেল্টার হোমগুলোতে এর আগে থাকার তাঁদের অভিজ্ঞতা মোটেও সুখের নয়। বরং সেখানেও বিবিধ শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁদের।
- বায়োলজিক্যাল পরিবারের হাতে নির্যাতিত ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁকে ‘উদ্ধার’ করে শেল্টারহো্মে বা রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে এই বিল। বলে, চাইলে আদালতে আইনের দ্বারস্থও হতে পারবেন তারা। কিন্তু যাঁদের আদালতে মামলা লড়ার বা সামাজিক সঙ্গতি থাকবে না, তাদের কী হবে? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি দায়িত্ব নেবে? উত্তর জানা যায় না এই বিল থেকে। বায়োলজিক্যাল পরিবার থেকে বেরিয়ে আসা বহুক্ষেত্রেই ট্রান্সজেন্ডার মানুষজনদের ক্ষেত্রে আবশ্যক হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু, পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানালে পরিবার ব্যতীত যাওয়ার ঠিকানা এই বিল সেই রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারেই বেঁধে দিচ্ছে। ফলে, নিয়ন্ত্রিত, ক্ষুণ্ণ হচ্ছে ব্যক্তিমানুষের স্বাধীনতাই।
- পাশ হয়ে যাওয়া সংশোধিত বিলটিতে ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতি হিংসা, অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ছিল তা অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। ট্রান্স ব্যক্তিদের প্রতি হিংসা, বৈষম্যর জন্য সর্বাধিক শাস্তির মেয়াদ, দু’বছর! এখানেই শেষ নয়, অধিকাংশ ট্রান্সব্যক্তিই সম্ভবত কোনও না কোনও রকম যৌন নির্যাতনের শিকার হন। তাঁদের মধ্যও ধর্ষিতের সংখ্যা মারাত্মক বেশি। কিন্তু, এই বিল জাত আইনে, ট্রান্সজেন্ডারদের উপর যৌন নির্যাতন, ধর্ষণের শাস্তির মেয়াদও ওই দুই বছরই!
- ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ ট্রান্সজেন্ডার পারসন্স-এ ৩০ জন সদস্যদের মধ্যে ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির প্রতিনিধি সংখ্যা মাত্র ৫। এবং এই সদস্যদের প্রত্যেককেই নিযুক্ত করবে, বেছে নেবে কেন্দ্র সরকারই। ফলে সংস্থাটির ‘অটোনমি’ আদতে আদৌ কার্যকরী হবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
- কোনও রকম বিকল্প কর্মসংস্থান ছাড়াই ট্রান্সজেন্ডারদের ভিক্ষাবৃত্তিকে প্রাথমিকভাবে অপরাধের আওতায় আনলেও সম্মিলিত প্রতিবাদে সংশোধনী বিলে তা আপাতত অপরাধের আওতামুক্ত। কিন্তু তার বদলে এসেছে নয়া নিয়ম। ট্রান্সজেন্ডারদের জোর করে কোনও পেশায় নিযুক্ত করা যাবে না। এমনিতে শুনতে ভালোই। কিন্তু ভারতে আগে থেকেই তো লিঙ্গ নির্বিশেষে অ্যান্টি বন্ডেজ লেবার ল ছিলই। তাহলে এই নয়া আইনের আলাদা প্রয়োজন কেন পড়ল?
- এই বিলে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের স্বাস্থ্য বিষয়টি ভীষণভাবেই অবহেলিত। তাঁদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য নির্দিষ্ট গঠনমূলক কোনও পরিকল্পনার রূপরেখাই এই বিলে স্পষ্ট হয়নি।
বিলটি পাশ করার সময় মাননীয় মন্ত্রীমশাই জোর গলায় বলেছেন ট্রান্সজেন্ডাররা আমাদের সমাজে অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর এই বিল নাকি তাদের মঙ্গল সাধনাতেই। ঠিক কাশ্মিরের মত শোনাচ্ছে না? উভয় ক্ষেত্রেই ‘অবিচ্ছেদ্য অংশ’দের ‘মঙ্গল সাধনায়’ তাদের বিরোধ মতামতের তোয়াক্কা না করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ক্ষমতাসীন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’র রাষ্ট্রশক্তি।
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন বিল
১৯৫৬-র ইন্ডিয়ন মেডিক্যাল কাউন্সিল অ্যাক্ট বদলে ফেলে চলে এল ন্যশনল মেডিক্যাল কমিশন বিল। ২০১০ সালে এমসিআই-র তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট কেতন দেশাইয়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনে সিবিআই। এর পরেই এমসিআই-এর পরিবর্তে এনএমসি বিলের প্রস্তাব আসে। কিন্তু, এই বিল প্রস্তাবনার সঙ্গে সঙ্গেই বিরোধিতা শুরু হয় ডাক্তার এবং মেডিক্যাল পড়ুয়াদের পক্ষ থেকে। এই বিলটিও কেমন নিঃশব্দেই পেরিয়ে গেল সংসদের উভয়কক্ষই। যদিও বিলটি নিয়ে এখনও ডাক্তার ও ডাক্তারি পড়ুয়াদের বিরোধ অব্যাহত। কেন বিরোধ বিলটি নিয়ে?
- এই বিলে সাড়ে তিন লক্ষ ‘হাতুড়ে’ চিকিৎসক বা কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডারদের আধুনিক ওষুধ প্রেসক্রাইব করার, বা বলা ভালো চিকিৎসা করার লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। এই বিল অনুযায়ী নির্দিষ্ট কিছু ক্রাইটেরিয়ার উপর ভিত্তি করে প্রাইমারি এবং প্রিভেন্টিভ অসুখের ক্ষেত্রে ওষুধ প্রেসক্রাইব করতে পারবেন এই কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডাররা। রোগী ডাক্তার অনুপাতের প্রবল অসাম্যের ফলে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার যা বেহাল দশা, সরকারের দাবী এই লাইসেন্স প্রদান সেই দশার খানিকটা হলেও শাপমুক্তি ঘটাবে। অন্যদিকে, ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের দাবী এই ‘কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডার’-এর সংজ্ঞা এতই ধোয়াশাপূর্ণ, এর ফলে স্বাস্থ্য বিষয়টি সম্পর্কে ন্যূনতম বোঝাপড়া বা জ্ঞান ব্যতীতই যে কেউই এই লাইসেন্স আদায় করে ফেলতে পারে, এবং তার অপপ্রয়োগের সম্ভাবনা এর ফলে এতই বেশি থাকবে যে উন্নতির বদলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার অবনতি হওয়ার সম্ভাবনাই এতে বৃদ্ধি পাবে।
- ন্যাশনাল মেডিক্যাল বিল পাস হয়ে যাওয়ার অর্থ এমসিআই-র চিরতরে ইতিহাস হয়ে যাওয়া। যতই দুর্নীতির অভিযোগ থাকুক না কেন দেশের সব রাজ্যের মেডিক্যাল কাউন্সিলের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই এর সদস্য ছিলেন। তার ফলে একটা পর্যায় পর্যন্ত অটোনমি কাজ করত। নয়া বিলে কিন্তু এমন নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বমূলক কোনও বডি থাকছে না। ১৩৩ জন নির্বাচিত প্রতিনিধির বদলে সিলেকশনের ভিত্তিতে বেছে নেওয়া হচ্ছে ২৫ জনকে! এই সিলেকশনের ৮০ শতাংশরই অধিকার থাকবে কেন্দ্র সরকারের হাতে! দেশের সব কটি রাজ্য নয়, পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আংশিক সময়ের জন্য এই কমিশনের অংশ হতে পারেন এবং সেটিও থাকছে কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছাধীনই। মেডিক্যাল কলেজগুলির পাঠক্রম, মান নির্ধারণ, এথিক্স এবং রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত কিছু অটোনমাস বোর্ডের কথা নয়া বিল ঘোষণা করলেও এই সব কটি বোর্ডের টিকি কিন্তু বাধা থাকছে কমিশনের কাছেই, যে কমিশন আবার পুরোপুরি কেন্দ্র সরকারের অধীনস্থ। এমনি এই বোর্ডগুলোতেও থাকছে খুল্লামখুল্লা সিলেকশন পদ্ধতি এবং এই সব বোর্ডের সদস্য হতে গেলে আর চিকিৎসক হওয়ার প্রয়োজনও থাকছে না! জ্যোতিষী থেকে গো-বিজ্ঞানী বা ময়ূরের কান্না এক্সপার্ট যে কেউই কেন্দ্র সরকারের কল্যাণে এই বোর্ডের সদস্য হয়ে যেতেই পারেন।
- এই বিল স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা উভয় ক্ষেত্রেই বেসরকারিকরণের পথকে পরম যত্নে আরও খানিক মসৃণ করে ফেলেছে। ব্যবসায়ীদের শিক্ষা আর স্বাস্থ্য ভাঙিয়ে অর্থ উপার্জনের পথ মোটামুটি রেডি। বেসরকারি কলেজগুলোর ৫০% আসন এখন কলেজমালিকরা ইচ্ছামত যে কোনও দামে অনায়াসে বেচে ফেলতে পারেন। বাকি ৫০% আসনে নাকি ফিজ ‘রেগুলেশন’ থাকবে, কিন্তু কীরকম রেগুলেশন তা নিয়ে স্পষ্ট করে কিছুই জানা যায়নি এখনও। কলেজগুলোর ‘গুণমান’ নির্ধারণে কমিটি বা বডি থাকলেও, যে বডির নিজেদের ‘গুণমান’-ই প্রশ্নের মুখে তারা কতটা অন্যের ‘মান’ নির্ধারণ করতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। অন্যদিকে, শুধুমাত্র ট্যাঁকে কোটি টাকা থাকার জোরে যারা ডাক্তার হবেন তাঁদের গুণমানের প্রশ্নও একদিকে যেমন অক্ষত থেকে যাচ্ছে, অন্যদিকে কোটি টাকা খরচের পর এই পেশার সঙ্গে জড়িত ‘সেবা’ শব্দটিকে তারা কতটা গুরুত্ব দিতে শিখবেন তাও কারওই জানা নেই।
- নেক্সট (ন্যাশনাল এগজিস্ট টেস্ট) নামক আর একটি সর্ভারতীয় কম্বাইন্ড পরীক্ষার কথা এই বিলে ঘোষণা করা হয়েছে। অদ্ভুত এই ‘খিচুড়ি’ পরীক্ষাটির মাধ্যমে নাকি ফাইনাল ইয়ার এমবিবিএস পরীক্ষা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন পাওয়া এবং পোস্টগ্র্যাজুয়েশনে এন্টার্ন্স, একই সঙ্গে হয়ে যাবে! অথচ এমবিবিএস শেষ বছরের পরীক্ষা এবং পোস্টগ্র্যাজুয়েশন এন্টার্ন্স পরীক্ষা যৌক্তিক কারণেই চরিত্রে এবং উদ্দেশ্যে একেবারে পৃথক। যে কোনও বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেই প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা থিওরির মতই সম গুরুত্বের সমপ্রয়োজনের। মেডিক্যাল সায়েন্সের পঠন প্র্যাকটিক্যাল ব্যতীত সম্ভবই নয়। এই কমন ‘খিচুড়ি’ পরীক্ষায় প্র্যাকটিক্যাল বা মৌখিক পরীক্ষার অবস্থান কোথায়? কী করে তার পৃথক ইমপ্লিমেনটেশন সম্ভব গোটা দেশ জুড়ে একই সঙ্গে একই দিনে, তাও বোধের অগম্য। কী করে শেষ হবে এমবিবিএস পাঠ্যক্রম ফাইনাল প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা ছাড়া? মান, দক্ষতার বিচারই বা কী করে হবে? কেউ জানে না।
কিন্তু আপাতত এ’দেশ ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ পর্যায়ে বিচরণ করছে। আপনার জানার অধিকার আরটিআই সঙ্কোচনের সঙ্গেই আদতে গত হয়েছে। ইউএপিএ-র জঘন্যতম রূপের কল্যাণে আজ স্টেটকে প্রশ্ন করলে কালকেই আপনি টেররিস্ট হয়ে যেতে পারেন। অবশ্য, এই সব নিয়ে যৌথ আওয়াজই বা তুলবে কে? আপাতত তো দেশ নেশায় মেতে,স্বপ্নে কাশ্মীরের ছটাক ছটাক জমি কিনে ফেলা হয়ে গেছে! শুধু আতঙ্ক একটাই, স্বপ্ন যখন ভাঙবে, বাস্তব ততদিনে দুঃস্বপ্নের অট্টালিকার উপর দাঁড়িয়ে থাকবে। সামাল দিতে পারব তো? সামাল দিতে পারবেন তো?