মলয় তেওয়ারি
৩৭০ ধারা বিলোপ প্রসঙ্গে মানুষকে মিথ্যা প্রচারে ভুল বোঝাচ্ছে বিজেপি আরএসএস। একটি মিথ্যা প্রচার তারা চালাচ্ছে বি আর আম্বেদকরের নামে। আসলে ৩৭০ ধারার বিশেষ ব্যবস্থাপনা বিলোপ করা অনেকটা এসসি এসটি ওবিসিদের সংরক্ষণ তুলে দেওয়ার মত। সংবিধানে অন্তর্ঘাত চালানোটাও আম্বেদকরের অবমাননা হিসেবেই গণ্য হতে পারে। তাই দলিত জনতার চোখে ধুলো দিতে আরএসএস আম্বেদকরের নামে মিথ্যা উক্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে। ওরা বলতে চাইছে যে আম্বেদকর ৩৭০ ধারার বিরুদ্ধে ছিলেন। ঝাড়খন্ডের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী সহ অনেক বিজেপি নেতাই এই ধূয়ো তুলেছে। কিন্ত বাস্তবে আম্বেদকরের চিন্তার ঠিক উল্টো পথেই হেঁটেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। আম্বেদকর ছিলেন একজন দৃঢ় গণতন্ত্রী। ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের সেনা যখন কাশ্মিরের একেক অংশে ঘাঁটি গেড়ে বসে এবং এই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধে, রাষ্ট্রসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় তা বন্ধ হয় এবং সিদ্ধান্ত হয় যে গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মিরের জনতা নিজেরাই ঠিক করবে তাঁরা স্বাধীন থাকবে নাকি ভারত অথবা পাকিস্তানে যাবে। এই সময় কাশ্মির সমস্যার স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান নিয়ে আম্বেদকরের যে অভিমত পাওয়া যায় তার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য এবং সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক মতামতকে সর্বোচ্চ মান্যতা দেওয়া। শিডিউল্ড কাস্টস ফেডারেশনের ঘোষণায় তিনি বলছেন–
কাশ্মির ইস্যুতে কংগ্রেস সরকারের নেওয়া নীতি শিডিউল্ড কাস্টস ফেডারেশনের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এই নীতি চালিয়ে গেলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এক অনন্ত শত্রুতার জন্ম দেবে ও এই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা বজায় থাকবে। শিডিউলড কাস্টস ফেডারেশন বিশ্বাস করে যে দুই দেশের মঙ্গলের জন্যই তাদেরকে সদ্ভাবসম্পন্ন ও বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হতে হবে। এই উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের প্রতি সঠিক নীতি গ্রহণ করতে হবে দুইটি বিবেচনার ভিত্তিতে, ১) পার্টিশন নাকচ করে দেওয়ার বিষয়ে আর কোনও আলোচনা করা চলবে না। পার্টিশনকে একটি নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়া বিষয় হিসেবে গ্রহণ করতে হবে যা আর আবার আলোচনা সম্ভব নয় এবং দুই দেশ আলাদা আলাদা সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিরাজ করবে। ২) কাশ্মিরকে দুটি ভাগ করতে হবে—মুসলিম প্রধান এলাকা পাকিস্তানে যাবে (ঐ উপত্যকায় বসবাসকারী কাশ্মিরীদের ইচ্ছা সাপেক্ষে) এবং জম্মু ও লাদাখের অমুসলিম এলাকা ভারতে আসবে।
এই নীতি গ্রহণ করলে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি এবং শিডিউল্ড কাস্টস ফেডারেশন এই নীতি লাগু করানোর চেষ্টা চালাবে। (Ambedkar\vol-017\vol17-01-05.indd page 396)
স্পষ্টতই কাশ্মির উপত্যকার সাধারণ মানুষের ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করার কথা বলছেন তিনি। এবং একথাও স্পষ্ট যে তাঁর সমগ্র পরিকল্পের উদ্দেশ্য সদ্য গঠিত ও যুযুধান দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ শান্তির স্থায়ী পরিবেশের শর্ত নিশ্চিত করা। কাশ্মিরী জনসাধারণের এই ‘ইচ্ছা’ অবশ্য বাস্তবে কোনওদিনই যাচাই করা হয়নি, ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান দ্বারা একেক অংশ অধিকৃত হয়ে বাস্তবে কাশ্মির দ্বিখণ্ডিত হয়েই থেকেছে এবং এই বিরোধকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে এক স্থায়ী যুদ্ধ পরিস্থিতি সর্বদাই বিরাজ করেছে।
আম্বেদকর কাশ্মির প্রসঙ্গ আবার উল্লেখ করেন নেহরু মন্ত্রীসভা থেকে তাঁর পদত্যাগ ঘোষণা করার ভাষণে, ১০ অক্টোবর ১৯৫১। হিন্দু কোড বিলের মাধ্যমে হিন্দু সমাজের মেয়েদের যে অধিকার প্রতষ্ঠার লড়াই আম্বেদকর চালিয়েছিলেন তাতে নেহরুর সহযোগিতা না পাওয়াকে পদত্যাগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণ হিসেবে বর্ণনা করেন। সংসদের এই ভাষণে কাশ্মির নীতির বিষয়ে শিডিউল্ড কাস্টস ফেডারেশনের পূর্বোক্ত পরিকল্পের কথা টেনে আনেন তিনি। বলেন যে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের ঝগড়া আমাদের বিদেশনীতির অংশ হয়ে গেছে এবং তা নিয়ে তিনি ভীষণ অসন্তুষ্ট। তিনি বলেন যে ইস্ট বেঙ্গল ও কাশ্মিরকে কেন্দ্র করেই এই ঝগড়া। কাশ্মির প্রসঙ্গে বলেন যে কে সঠিক সে প্রশ্নের থেকেও বড়ো প্রশ্ন হল কোনটা সঠিক। কোন সমাধানটা সঠিক সে প্রশ্নে তিনি আবার শিডিউল্ড কাস্টস ফেডারেশনের পূর্বোক্ত অবস্থান তুলে ধরেন এবং তার সঙ্গে একথাও যুক্ত করেন যে সমগ্র জম্মু কাশ্মিরে একত্রে গণভোট হওয়া উচিৎ নয়। কারণ হিসেবে তিনি বলেন—
যে বিষয়টা নিয়ে শঙ্কা হয় তা হলো প্রস্তাবিত গণভোট হবে সামগ্রিকভাবে এবং সেক্ষেত্রে কাশ্মিরের হিন্দু ও বৌদ্ধদের নিজেদের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই হয়তো পাকিস্তানে টেনে নেওয়া হবে এবং যে অবস্থা আজ আমরা ইস্ট বেঙ্গলে ফেস করছি এখানেও আমরা আবার তার সম্মুখীন হব।
মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগের পরবর্তী সময়ে সংসদে চলা বাজেট বিতর্কেও কাশ্মিরের সামরিক সমাধানের বিরুদ্ধাচরণ করে গণভোটের ওপর জোর দিচ্ছেন আম্বেদকর। বিভিন্ন ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে কেন দেশের জনতার স্বার্থে খুব দ্রুত কাশ্মির বিরোধের নিষ্পত্তি করা দরকার এবং গণভোটই হল একমাত্র সদর্থক রাস্তা—
আমরা ভেবেছিলাম আর আশা করেছিলাম যে দেশটা যখন স্বাধীন হয়েছে তখন অনেক কিছু বদলাবে, সরকার কেবলমাত্র ট্যাক্স কালেক্ট করার এজেন্সি বা অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার ম্যাজিস্ট্রেট হয়েই থাকবে না, সরকার তার অধিক কিছু করবে, বিংশ শতকের সভ্য সরকারগুলির মতই আমাদের সরকারও কাজ করবে… [বাজেটে] আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আমরা পুরনো ব্রিটিশ ইতিহাসকেই রিপিট করছি, ট্যাক্স কালেক্ট করো আর অপরাধীদের শাস্তি দাও। সোশাল বেনিফিটের জন্য কোনও ব্যবস্থাই নাই…
তারপর, স্যার, আমাদের দিক থেকে আমরা বোধহয় কখনওই একথা বুঝতে সক্ষম হলাম না যে যত তাড়াতাড়ি আমরা কাশ্মির সমস্যা সমাধান করব ততই আমাদের মঙ্গল। কারণ কাশ্মিরের দোহাই দিয়ে যদি আমরা আমাদের প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় এত বিপুল পরিমাণ বৃদ্ধি করি তাহলে কি আমাদের কিছু কর্তব্যও তৈরী হয় না? সেই সমস্যা দ্রুত নিষ্পত্তি করার দায়ও কি আমাদের ওপর বর্তায় না?
আমি খুব একটা বিস্তারিত বলতে পারব না, কিন্তু কাশ্মির প্রশ্নের নিষ্পত্তির জন্য নেগোশিয়েশনের ক্ষেত্রে ভারত সরকারের ভূমিকা নিয়ে এখন পর্যন্ত যেটুকু পড়াশোনা করতে পেরেছি তাতে একথা দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে আমি একটি শব্দও খুঁজে পাইনি যাকে নেতিবাচক প্রস্তাবের বদলে ইতিবাচক প্রস্তাব বলা যেতে পারে যার মাধ্যমে ভারত সরকার বিরোধ নিষ্পত্তি করবে।
একমাত্র যা নিয়ে চিন্তাচর্চা করা হচ্ছে তা হল সামরিক বরাদ্দ। পৃথিবীর ইতিহাসে গণভোটের বিষয়টা তো নতুন কিছু নয়। এই ধরনের গণভোটের মধ্যে দিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির উদাহরণ খুঁজতে তো আমাদের প্রাচীন ইতিহাসে ফিরে যাওয়ার দরকার পড়ে না… আমরা কাশ্মির সমস্যা দ্রুত নিরসনে যথোপযুক্তভাবে তা প্রয়োগ করতে পারি যাতে আমরা প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে অতিরিক্ত ৫০ কোটি টাকা মুক্ত করে সাধারণ মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করতে পারি। (BAWS Vol. 15, page 849)
বলাই বাহুল্য যে আম্বেদকরের মতকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে গেলে বিজেপির উচিত কাশ্মির উপত্যকায় গণভোট করানো। তার বদলে রাজ্য হিসেবেই জম্মু-কাশ্মিরকে বিলুপ্ত করে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল বানিয়ে দেওয়া হল। সংবিধানগতভাবে বিশেষ অধিকার পাওয়া রাজ্য থেকে এক ধাক্কায় দু’টুকরো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। যে কোনও রাজ্যের সীমানা পুনর্নির্ধারণ বা এমনকি নাম বদলানোর জন্যও সেই রাজ্যের অনুমোদন দরকার। এক্ষেত্রে কোনও আলোচনাই করা হল না। সংবিধানের ৩৫(ক) ধারাতে কাশ্মিরের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে বলা ছিল যে সে রাজ্যের অনুমতি ছাড়া এসব করা যাবে না। এই প্রসঙ্গেও আম্বেদকরের একটি বক্তব্য ৩৫(ক) ধারা বিলোপের বিরুদ্ধে যাবে। ব্যাঙ্গালোরের অধ্যাপক বিনীত কৃষ্ণ গত ২ আগস্ট The Print ওয়েব পোর্টালে এই বিষয়টি তুলে ধরে লিখছেন—
১৩ ডিসেম্বর ১৯৪৬ কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্ব্লিতে ‘অবজেক্টিভ রেজলিউশন’ নিয়ে আলোচনা শুরু করতে গিয়ে দেখা যায় যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিদল অনুপস্থিত। তাঁদের অনুপস্থিতিতে সংবিধান রচনার কাজ চালিয়ে যাওয়া হবে, নাকি স্থগিত রাখা হবে এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। বি আর আম্বেদকর তখন এসেম্বলিকে সতর্ক করে নিম্নলিখিত কথাগুলি বলেন যা যে কোনও সরকারকে ৩৫(ক)-এর মত ধারা বিলোপ করার পদক্ষেপ নেওয়ার আগে ভাববার পরামর্শ দেবে—
“হতে পারে যে আপনাদের সেরকমটা করার অধিকার আছে। আমি যে প্রশ্নটা তুলছি তা এই। এটা করা কি আপনাদের পক্ষে বিচক্ষণতার কাজ হবে? আপনাদের পক্ষে এটা করা কি সুবিবেচকের মত কাজ হবে? ক্ষমতা এক জিনিস, আর প্রজ্ঞা সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। এবং আমি চাই কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলির ওপর ন্যস্ত ক্ষমতার দৃষ্টি থেকে নয় বরং এই সভা বিষয়টি বিবেচনা করুক ভিন্ন দৃষ্টি থেকে, অর্থাৎ বিবেচনা করুক যে তা প্রজ্ঞার কাজ হবে কি না, রাজনৈতিক নেতাসুলভ কাজ হবে কি না, এই পর্বে ওটা করা আদৌ সমীচীন হবে কি না।”
আম্বেদকর ছিলেন একজন অটল গণতন্ত্রী। কাশ্মিরের বিভিন্ন অংশের জনগণের সম্মতির ওপর ভিত্তি করে কাশ্মির সমস্যার দ্রুত ও স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের জন্য ধারাবাহিকভাবে লড়ে গেছেন তিনি। সামরিক খাতে ব্যয়বৃদ্ধিকে আক্রমণ করেছিলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের চির অশান্তি দূর করার শর্ত তৈরি করতে লাগাতার সোচ্চার ছিলেন। বিজেপি-আরএসএস তাদের মিথ্যা প্রচার দিয়ে এই সত্যগুলি ঢেকে দিতে পারবে না। বর্তমান কেন্দ্র সরকার দ্বারা ৩৭০ ও ৩৫(ক) ধারাগুলি বিলোপ করার আইনি তাৎপর্য আগামী দিনে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হবে, কিন্তু বিজেপির এই উদ্যোগ যে ভারতীয় সংবিধান ও ভারতের একতা প্রশ্নে ভীমরাও আম্বেদকরের শিক্ষা ও আকাঙ্খার ওপর চরম আঘাত তা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।