Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

৩৭০ ধারা বিলোপ— সঙ্কট থেকে মানুষের মন ঘোরানোর নতুন চিত্রনাট্য

সৌমিত্র দস্তিদার

 

অর্থনীতির সাধারণ ছাত্রও একমত হবেন যে ভারতের আর্থিক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। সাত লাখ লোক ইতিমধ্যেই কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে গেছেন। শোনা যাচ্ছে রেলে প্রায় তিনলাখের ওপরে কর্মী কাজ হারাতে চলেছেন অথবা শূন্যপদ তৈরি হতে চলেছে যা আর ভর্তি করা হবে না। জিডিপি গ্রোথ কমছে। সর্বত্রই ছাঁটাই আর কোম্পানি বন্ধের আশঙ্কায় ভারতের বিপুল সংখ্যক মানুষ থরহরি কাঁপছেন। এই অবস্থায় মানুষের মন অন্যদিকে নিয়ে যেতে যা যা করার দরকার মহামান্য মোদি সরকার তাই-ই করছেন। গতবারের সরকার নোট বাতিলের মধ্যে দিয়ে ডিজিটাল ইন্ডিয়ার ডাক দিয়েছিলেন। মাত্র কয়েকদিন আগে ঘোষণা হয়েছে যে রেলে অনলাইন বুকিং করলে বেশি টাকা দিতে হবে। অনলাইনে নাকি সরকারের লোকসান হচ্ছে। অথচ সরকারের ঘোষিত নীতিই ছিল প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার। নোটবন্দি বা ডিমনিটাইজেশন নিয়ে হাঁকডাক ছিল আকাশছোঁয়া। এখন এই যে রেল বেসরকারিকরণ, তার আগে ঘুরিয়ে টিকিটের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত— এই সবকিছুই হচ্ছে লুকিয়ে, পিছনের দরজা দিয়ে।

প্রশ্ন সেখানেই। প্রশ্ন বিশ্বাসযোগ্যতার। ভোট জেতার অর্থ এই নয় যে সামগ্রিকভাবে মোদি সরকার দেশের মানুষের আস্থা পুরোপুরি অর্জন করেছেন! সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া মানেই তাদের সবকথা ‘বেদবাক্য ‘বলে মেনে নিতে হবে এটা রাজতন্ত্রে হয়। গণতন্ত্র তা নয়। ইবসেনের বহুচর্চিত নাটক— ‘এনিমি অফ দ্য পিপল’ বা গণশত্রু দেখলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে।

মুশকিল হচ্ছে ভারতে এখন যুক্তিকে পিছনে ফেলে চড়া আবেগের আবহ তৈরি হয়েছে। এক্কেবারে গোয়েবেলস ঘরানার মিথ্যে বলে বলে মিথ্যেকে সত্যি আর সত্যিকে মিথ্যের মধ্যে দিয়ে নতুন এক নির্মাণ হচ্ছে যা আধুনিক প্রযুক্তি ও কর্পোরেট পুঁজির সাহায্য দেশের বিরাট সংখ্যক জনমনে চারিয়ে যাচ্ছে। এই নির্মাণ উগ্র জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। নতুন নতুন আইন আসছে। সেখানে বলে দেওয়া হচ্ছে— বিজেপি বিরোধিতা মানেই দেশবিরোধিতা। এই হচ্ছে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা। এখানে বাকস্বাধীনতা,পাল্টা যুক্তি কোনও কিছুর জায়গা নেই।

মাননীয় অমিত শাহ যেভাবে সংসদে ৩৭০ ধারা বাতিল করেছেন, কোনও সন্দেহ নেই তা কোনও গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ নয়। পুরোপুরি স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা। আপনি বলতেই পারেন, যে যাই হোক দেশের বিরাট সংখ্যক জনমনে কিন্তু বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের রাজনৈতিক কৌশল দাগ কেটেছে। একশোবার একমত হব। কিন্তু মিনু মাসানির মতো দক্ষিণপন্থী তাত্ত্বিক একবার লিখেছিলেন— কাশ্মির কোনওদিনই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়। এখন হলে মাসানির নামেও নির্ঘাত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হত। মিনু মাসানির লেখা থেকে আর একটু পড়ি। মাসানি লিখছেন— “জম্মু ও কাশ্মির কোনওদিনই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল না। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় লর্ড মাউন্টব্যাটেন স্থানীয় রাজা হরি সিংকে পাকিস্তান বা ভারতের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে বলেছিলেন। বস্তুত, শেখ আবদুল্লা ও সমর্থকদের চাপাচাপিতেই হরি সিং ভারতের সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিলেন।” শেখসাহেব বুঝেছিলেন— কাশ্মিরের সামনে তিনটে রাস্তা খোলা আছে। এক- ভারতের সঙ্গে যোগ দেওয়া। দুই- পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। তিন- আজাদ কাশ্মির। আবদুল্লার যুক্তি ছিল যে ভারতে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি শক্তিশালী। এখানে ভূমিসংস্কার করাও সোজা। ওই সময় অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে শেখ সাহেব যখন ভারতের হয়ে গলা ফাটাচ্ছেন, তখন জম্মুতে জন্ম নিচ্ছে প্রজাপরিষদ, যার নেতৃত্বে ছিলেন কট্টর হিন্দুত্ববাদী, একদা জনসঙ্ঘের সর্বভারতীয় নেতা বলরাজ মাধোক। তিনি ও তাঁর সংগঠন প্রথম থেকেই শেখ আবদুল্লার বিরোধী ছিলেন দুটি কারণে। এক, চরম মুসলিমবিদ্বেষ ও দুই, ন্যাশনাল কনফারেন্সের ভূমিসংস্কার নীতি। শেখসাহেবের ভূমি নীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল উচ্চবর্গের হিন্দু ভূস্বামীরা। লড়াই ছিল ভূমিব্যবস্থা ও জমিদারি অত্যাচারের বিরুদ্ধে। ভূমিহীন কৃষকদের নেতা ছিলেন শেখ আবদুল্লা। অন্যদিকে জমিদারদের কায়েমি স্বার্থের রক্ষক ছিলেন আজকের সঙ্ঘ পরিবারের পূর্বসূরিরা। গত সপ্তাহে জাতির উদ্দেশে ভাষণের সময় কাশ্মির সমস্যার এই প্রেক্ষিত নিয়ে প্রধানমন্ত্রী একটি কথাও বললেন না। শাসকদের এই দ্বিচারিতা নীতি নিয়েই সন্দেহ দৃঢ় হয়। ৩৭০ ধারা বিলোপ কাশ্মিরের ভালোর জন্য নাকি ধর্মীয় মেরুকরণের মধ্যে প্রবল জাতীয়তাবাদের হাওয়া তুলে যাবতীয় অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে মানুষের মন অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে একধরনের নতুন নাটকের আধুনিক চিত্রনাট্য।

৩৭০ ধারা প্রাথমিকভাবে কাশ্মিরকে নিশ্চিতভাবে কিছু রক্ষাকবচ দিয়ে ছিল। হরি সিং ভারতভুক্তি নিয়ে যে চুক্তি করেছিলেন তা ৩০৬এ ধারা। সেখানে প্রাথমিক পর্যায়ে ঠিক হয়েছিল, যে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভারত দেখবে। বাকি বিষয় জম্মু ও কাশ্মিরের আভ্যন্তরীণ স্বায়ত্তশাসন। তা নিয়ে ভারত মাথা ঘামাবে না। পরে, ১৯৫২ সালের ২৪ জুলাই ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও শেখ আবদুল্লার মধ্যে আর একটা চুক্তি হয়। সংশোধিত চেহারায়। সেটাই বিতর্কিত ৩৭০। এরপরেও অনেকবার পাল্টেছে এই ৩৭০। বস্তুত মূল রক্ষাকবচের শাঁস বলে আর কিছু ছিল না। আইসিইউতে ধুঁকতে থাকা রোগীর অক্সিজেন নল খুলে নিয়ে মোদি-অমিত শাহ জুটি ৩৭০ ধারার ক্লিনিক্যাল ডেথ বা আনুষ্ঠানিক মৃত্যু ঘোষণা করলেন মাত্র। অথচ প্রচারের ঢাকঢোল পিটিয়ে ভাবটা এমন করা হচ্ছে যেন ভারতের যাবতীয় সাম্য এবার আর কোনও শক্তি আটকাতে পারবে না।

প্রচারের বর্শামুখ এমন যেন মনে হয় যে এতদিন কাশ্মির একমাত্র রাজ্য যেখানে ভারতের অন্য প্রদেশের কেউ জমি কিনতে পারবেন না। বাস্তবে হিমাচল প্রদেশ থেকে শুরু উত্তর পূর্ব ভারতের বহু রাজ্য আছে যেখানে বাইরের রাজ্যের মানুষের জন্য জমি কেনাবেচা নিষিদ্ধ। অরুণাচল নাগাল্যান্ডের মতো অনেক অঞ্চলে ঢুকতে গেলে আলাদা পারমিট লাগে। সেসব কথা আড়াল করে শুধু কাশ্মির কাশ্মির করে চেঁচিয়ে গলা ফাটানোর আসল উদ্দেশ্য ধর্মীয় বিভাজন ও জাতিয়তাবাদী আবেগ জোরদার করা ছাড়া অন্য কিছু নয়। নরেন্দ্র মোদি জাতির উদ্দেশে ভাষণে একবারও কাশ্মিরিয়াৎ-এর গৌরবজনক অধ্যায় নিয়ে একটি শব্দও খরচ করলেন না। বললেন না পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ কাশ্মিরের মরণপণ লড়াই-এর কথা, যা ছিল একান্তই তাঁদের ভারতে থাকার আকুতি।

৩৭০ ধারা বাতিলের মধ্যে দিয়ে কাশ্মিরে শান্তি ফিরবে না। কারণ মিলিটারি নামিয়ে কাশ্মিরকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে কোনও সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয় না। বিজেপি সরকার আসলে দুটি কাজ তথাকথিত দেশপ্রেমের নামে করলেন। এক— কাশ্মিরের জমি কর্পোরেট পুঁজির কাছে ছেড়ে দিলেন। আর দুই— ফেডারেল রাষ্ট্রকাঠামোর প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থা বিশ্বাস যে তাদের নেই তা নতুন করে ঘোষণা করলেন। এই অতিকেন্দ্রায়নের রাজনীতিই বিজেপি আরএসএসের রাজনীতি। ৩৭০ ধারা ভালো কি খারাপ অবান্তর প্রশ্ন। চুক্তি হয়েছিল কাশ্মিরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ভারত সরকারের। সেই সরকার কংগ্রেসের না বিজেপির তাও গুরুত্বপূর্ণ নয়। সরকারি চুক্তি কলমের এক খোঁচায় বাতিল করা যায় কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। ধরুন, তৃণমূলের আমলে কেউ একজন সরকারি চাকরি পেলেন। বিজেপি এসে যোগ্যতা থাকলেও লোকটির চাকরি বাতিল করে দিল। এই মনোভাব কিন্তু গণতন্ত্রের পক্ষে ভালো নয়। ঘটনাচক্রে বিজেপি এবার এই কাজটাই করেছে বুক ফুলিয়ে। কিন্তু কাজটি যে অগণতান্ত্রিক তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।

কাশ্মিরী পণ্ডিতদের কথা না বলে কাশ্মির নিয়ে কথা বলা শেষ হতে পারে না। আমরা যখন কাশ্মিরের পণ্ডিতদের নিয়ে কথা বলি তখন মনে রাখি না মানবেন্দ্রনাথ রায়ের অনুগামী কট্টর মানবতাবাদী প্রেমনাথ বাজাজের কথা। বস্তুত, তাঁর প্রভাবেই শেখ আবদুল্লা দলের নাম মুসলিম কনফারেন্স বদলে ন্যাশনাল কনফারেন্স রেখেছিলেন। প্রেমনাথ কাশ্মিরের স্বাধিকারের পক্ষে ছিলেন। ১৯৯০ সালের পর থেকে পণ্ডিতদের ওপর উপত্যকার হিংসা নিয়ে সারা দেশের বড় অংশের মানুষ আজ প্রবল সোচ্চার। এই অভিযোগ নিত্যদিন শুনতে হয় যে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতন্ত্রপ্রেমী লোকজনরা খুব একপেশে, পণ্ডিত নির্যাতন নিয়ে মুখ খোলেন না। বিপ্লবী প্রেমনাথ বাজাজ নব্বই দশকের শুরুতে উপত্যকার পণ্ডিতদের হেনস্থা হওয়ার আগেই মারা যান। বেঁচে থাকার সময় সবসময় বলেছেন যে পণ্ডিতদের অধিকাংশই শোষক, অত্যাচারী। বছরের পর বছর ধরে তারা নির্মমভাবে শোষণ চালিয়ে গেছেন বিপুল সংখ্যক দরিদ্র কৃষক জনতার ওপর, যাদের বেশিরভাগই মুসলমান ও নিম্নবর্গের হিন্দু। ফলে কাশ্মিরে গণতন্ত্রের জন্য যে লড়াই তার পিছনে কিন্তু কোনও ধর্মীয় ভাবাদর্শ ছিল না। যা ছিল তা একান্তই জমির অধিকারের আন্দোলন। স্বাধীনতার পরে ধীরে ধীরে বিষয়টিতে ধর্মের রং লাগতে থাকে। এর পিছনে পাকিস্তানের হাত নেই তা বলা যাবে না। বরং বাংলাদেশের জন্মের জন্য ভারতই দায়ী— এই মনোভাব থেকে কাশ্মিরে যে কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে পাকিস্তানের মদত না থাকাটাই আশ্চর্যের। কিন্তু তাহলেও কাশ্মিরে আজকের পরিস্থিতির জন্য ভারতের ভুল নীতি অনেকাংশে দায়ী।

পণ্ডিত প্রসঙ্গ এলেই মনে পড়ে যাচ্ছে ৯০ সালে জম্মু ও কাশ্মিরের তৎকালীন রাজ্যপাল জগমোহনের নাম। জগমোহনের প্ররোচনা ছিল পণ্ডিতদের নিজভূমে পরবাসী করে তোলার। এক ঢিলে উনি দুটো পাখি মারতে চেয়েছিলেন। প্রচারের লক্ষ্যে ছিল কয়েক হাজার পণ্ডিতকে বাধ্য হয়ে উপত্যকা ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। অন্যদিকে বিশাল সংখ্যক পণ্ডিতদের সরিয়ে গোটা উপত্যকায় নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়কে চাঁদমারির নিশানা করে তোলা।

পাশাপাশি, জম্মু থেকে কয়েক লাখ মুসলিম স্বাধীনতার পরে পরেই কোথায় যে অদৃশ্য হয়ে গেল তা নিয়ে কিন্তু আমাদের ব্রাক্ষণ্যবাদী বিবেক প্রশ্ন তোলে না। ১৯৪১ সালে জম্মুর মোট জনসংখ্যায় মুসলমানের সংখ্যা ছিল ৪০ শতাংশ। আর এখন ২০১১ সালের সেনশাস রিপোর্ট অনুযায়ী সংখ্যাটা নেমে এসেছে মাত্র সাত শতাংশে। এই মধ্যবর্তী সময়ে পণ্ডিতদের পাশাপাশি মুসলিম মানুষজনের জীবন নিয়েও তদন্ত করার সময় এসেছে।

কাশ্মিরে নতুন আইন করে অন্য প্রদেশের মানুষের জমি কেনাবেচার যে বন্দোবস্ত করা হচ্ছে তার পিছনেও কেন্দ্রীয় সরকারের অন্য ভাবনা থাকতে পারে। জনবিন্যাসের বদল ঘটিয়ে জম্মুর মতই শ্রীনগর ভ্যালিতেও মুসলিম জনসংখ্যা কমিয়ে ফেলা। কাশ্মির ও ৩৭০ কোনও কিছুই বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। এর সঙ্গে জড়িত আছে নানা মাত্রার বিবিধ রাজনৈতিক অভিসন্ধি। কোথাও এনআরসি কোথাও আবার মিলিটারি নামিয়ে নাগরিকদের তটস্থ করে তোলা, আর যাই হোক গণতন্ত্রের পক্ষে সুখকর নয়।