অনির্বাণ ভট্টাচার্য
আঁখি
কাজল চোখে দেখে না। আঁখি বলেছিল। সেদিন মন্মথবাবুর ঘরে, আঁখি বলেছিল ওই সময়টা বাবু নেই, বাইরে গেছে, কাজল যদি আসে। কাজল এসেছিল। অন্ধকার ঘর। স্টোর রুম। খাটিয়া। বাঁদিকের দেওয়ালের বিধান রায়ের ফটো। কাজল ডাক্তারবাবুকে জোড় হাত করল। ওর বাবা করত। দেখাদেখি সেও। আঁখি সব করল। শুরু থেকে শেষ ওই। কাজল গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স। আঁখির কণ্ঠার কাছে একটা তিল। কাজলের ঠোঁটে বিড়ির গন্ধ। আঁখি ছিটকে গেছিল। ‘মুখ ধুয়ে আয়’। আঁখি কাজলকে তুই করে বলে। কাজল মানা করেনি। দিব্যি লাগে। কেমন একটা দোস্ত দোস্ত ভাব। বিয়ের পরে এটাই চায়। দোস্তানা। ওসব সোয়ামি স্ত্রী মার্কা কিছু ভালো লাগে না। হাত ধরাধরি করে যত দিন পারা যায়। আঁখিকে একগাল হেসেছিল। ‘ধুর, আগে বিয়েটা হোক’। সেই আঁখি। মন্মথ লোকটা শালা হারামি। আঁখি বলেছিল কেমন চোখে দেখে। ‘ছেড়ে দিস না কেন?’ – ‘থাক, দুদিন দেখি। এখনও তো গায়ে হাতটাত দেয়নি’। মন্মথ দেওয়ালে ডাক্তারবাবু। পাশে জোড়া কুলুঙ্গির ওপরে স্বস্তিক। আঁখির বুক ভারী হয়ে আসে কাজলের ওপর। আঁখি চেপে ধরে। কাজল শুধু ওই তিলটা ভালোবাসে। স্বাদ নিতে চায়। উত্তেজনায় এপাশ ওপাশ। ‘আঃ, কামড়াস না। চোখে দেখিস না নাকি?’। কাজল সাবধানী হয়। চোখটা ঝামেলা করছে। মাঝেমাঝে ঝাপসা। কাঁপছে চারপাশটা। জল জল লাগে। দেখাতে হবে কাউকে। পাড়ার বুড়ো অক্রুর দত্ত মোটা ভিজিট নেয়। ওর কম্পাউন্ডারের বাড়ির ইলেক্ট্রিকের কাজ করেছিল কাজল। মাই ডিয়ার লোক। পটাতে হবে। যদি কমটম নেয়। আঁখির শরীরে গন্ধ আছে। কারেন্টের। কাজল জানে। প্রথম যেবার কাছে এসেছিল, শক খেয়েছিল। পরের দিকে শুরুতেই গন্ধটা পেত। সেই গন্ধ। এখানে কারেন্ট মারার ভয় নেই। শুধু গন্ধ আছে। উত্তেজনা আছে। প্রোটেকশন নেই। কাজল আরও সাবধানী হয়। আঁখির চোখ বন্ধ। কাজল অন্ধকার ঘরে আরও কম দেখে। দরকার নেই। দোকান হয়েছে। এবার বাড়াবে। লাকটা কাজ করছে মাইরি। আঁখিকে তুলবে এবার। আঁখি। মা বলেছিল, মেয়েটা ভালো। তবে একটু চটপটে। মা বলেছিল, পাল্টাবে। বিয়ের পর। সংসার টংসার করলে। কাজল খয়েরি দাঁতে হেসেছিল। আঁখিও। সব কিছু হয়ে যাওয়ার পর আঁখি সালোয়ার ঠিক করল। কাজল আগে বেরিয়ে গেছিল। আঁখি গুছিয়ে আসবে। কাজলের দোকান। মন্মথকে একটু বলতেই জায়গাটা পেয়ে গেছিল। তারপর বাড়ানো। কাউন্সিলরের হাতের লোক। যদি হয়। কাজল জানে না। ও ভেবেছে লাক, খাটুনি, ভগবান। আঁখি জানে অন্য কথা। মন্মথই ভগবান, লাক সবকিছু। আঁখিকে বলতে হয়নি। মন্মথর চোখে ছিল সব। মেয়েরা বুঝতে পারে। এই ঘর। সপ্তায় কয়েকবার। চারপাশে ছড়ানো ছেটানো। মন্মথ পরিষ্কার করত না। নোংরা লোক। আঁখিই করত। খাটের তলা। এদিক ওদিকে ছড়ানো। বাঁদিকে ফোল্ডিং চেয়ারের পাশে ব্লাউজের ছেঁড়া টুকরো, সেফটিপিন। শরীর। আঁখির ঘাড়ের কাছটা। কাজল বুঝতে পারে না। দেখতে পায় না। একটা দাগ। আড়াআড়ি। মন্মথ জন্তুর মতো। দাঁতের জোর। এসবই করতে হয়েছিল। এবার কাজটা ছাড়বে আঁখি? কাজলের দোকান তো হল। ঘর আলো হতে হতে ঘাড়ের দাগ মেলাবে। মন্মথ চাবি দিয়ে গেছে। লোকটা আসার আগে আরও বেশ কয়েকবার কাজল আসবে এখানে। এই ঘরেই। কোথায় কী ছড়ানো ছেটানো। কোথায় দাঁতের দাগ। কাজল দেখবে না।
কাজল চোখে দেখে না। আঁখি জানে…
নয়ন
নয়নের দুঃখ একটাই। ওই টাইটেল মোঙ্গিয়া নয়। তবে ও উইকেটের পাশে দাঁড়ায়। বল কোথায় যাবে জানে। পাড়ার ক্রিকেট টুর্নামেন্টের ফাইনাল। দীঘির একটা আব্দার ছিল। ক্যাচ ফস্কালে হবে না। ব্যাটে রান না করুক। যেটুকু করছে, সেটুকুই ভালো করুক। দীঘি। টলটলে জল। প্র্যাকটিসে স্ট্যান্স নিতে যাওয়ার আগে নয়নকে দুবলা করে দিত ওই জল। গ্লাভস পরতে পরতে হাত ভেজাত, কাঁপাত। নয়ন জানে এসব হরমোন। আসল হল কনসেন্ট্রেশন। সেটাই করতে হবে। করতে হত। একটু এদিক ওদিক হয়ে গেল। জিৎ। গাঙ্গুলি না। নাচাগানের লোক না। লক্কড়ে জিন্সের না। চশমা, পিঙ্ক টিশার্ট, চাকরি বাগানো পাক্কা একটা জোয়ান জিৎ। চাকরিটা নয়নেরও হয়ে যাবে। লাট্টুদা বলেছিল। ‘দুতিনটে টুর্নামেন্টে নজর কাড়। তারপর দেখছি।’ দুটো ছেলে। জিৎ ওদিকে, বর্ডারের বাইরে, উইকেটের সামনে, সেফ খেলা মাল। আর নয়ন পেছনে। সোনাদা এসব বোঝে। সোনাদা পাড়ার স্কুল ফুটবল দলের সেক্রেটারি। রেলে যেদিন চাকরি পেল হেব্বি খাইয়েছিল। সোনাদা ব্যাপারটা বোঝে। ‘দেখিস, জিৎ ফিৎ দুদিনের মাল। সরে পড়বে।’ নয়ন দীঘি ওর বাড়ি যায়। দীঘি পড়ে। সোনাদার বাবার লাইব্রেরি। নয়নের টাকা নেই। নাহলে কিনে দিত। সব বই। সব। আর নয়ন ঘণ্টার পর ঘণ্টা গ্যাঁজায়। সোনাদা না থাকলে টিভিতে পুরনো ম্যাচ। ইঞ্জিনিয়ার, অ্যালান নট, গিলক্রিস্ট, আর হ্যাঁ, মোঙ্গিয়া। নয়নের ওসব বই ফই পোষায় না। টুর্নামেন্ট। সেমিফাইনালে একটা স্ট্যাম্প করেছিল। কয়েক মাইক্রোসেকেন্ডে। টপ ব্যাটসম্যান। ম্যাচটা ওখানেই ছেড়ে দেয় ফুলবাগান ক্লাব। নয়নকে নিয়ে টিমের অক্ষয়, বিজন, দুদিকে ছুঁড়েছে। বোলার রঞ্জন নিজের ওই ডেলিভারিটা ভুলে কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরেছিল ওকে। সেই নয়ন। গতবারের ফাইনালে চোখের নীচে ফুলিয়েছিল। খেলতে পারেনি। এবারে সাবধানে খেলতে হবে। নয়ন জানত। সেই ফাইনাল। এবারের। ওর কিছু করার ছিল না। আজ ওর দিন না। পা কাঁপছিল। দুটো বল ফস্কাল। ক্যাচ ছিল না। বাই হল। ‘কী হল বস?’ স্লিপ থেকে গগনের গলা। নয়ন বুঝতে পারছিল না। ব্যাটে সুবিধে করতে পারছে না অপোনেন্ট গোলাবাগান। বিরাট টার্গেট। নয়ন জানে এভাবে চললে ওদের পাড়ার কাপ বাঁধা। বেপাড়া থেকে ভাড়া করা অনিল নস্কর সেঞ্চুরি করেছে। নয়ন জানে এটা প্রেস্টিজের সওয়াল। এভাবে জিতলে টোন্ট খাবে। ‘নিজেদের লোক নেই? ভাড়া করিস?’ নয়ন জানে ব্যাটে কিছু হবে না। ফ্লুকে একটা দুটো ম্যাচ বের করেছিল লিগের ম্যাচে। রোজ পারবে না। আজ ফাইনালে নেমেছিল। বারো করে রান আউট হল। দীঘি কোথায়? আজ এতবার উঠছে কেন? সোনাদা ওর পাশে বসে। যাক, ভরসা। বলবে, নয়ন ট্রাইড হিজ বেস্ট। রান আউট কাউন্টেবল না। গোলাবাগানের ব্যাট। এতটা রান তোলা মুশকিল। ট্রফি আসছে। কিন্তু ট্রফিটা ওকে তুলতে হবে। নয়ন জানে, একটা ক্যাচ, একটা স্ট্যাম্প। ম্যাচ উইনিং। দীঘির চোখ। একটাও পায়নি সেভাবে। একটা ফস্কেছে। কানায় লেগেছিল সিওর। একটা মাথার ওপর দিয়ে অনেকটা। পিঠে একটা টান হচ্ছে। নয়ন ইচ্ছে করেই লাফায়নি তেমন একটা। রঞ্জন আবার বল হাতে। সেমিফাইনাল। নয়নের বুকে উত্তেজনা। রিপিট হবে? সেই স্ট্যাম্প? দুটো বল। একটা পাশ দিয়ে বেরোল। নয়ন নাগাল পায়নি। দুনম্বরটা আট নম্বর মিস করল। নয়নের বুকে সজোরে। ‘আঃ…’। পাশ থেকে গগন এগোতে গেল। ‘থাক, কিছু হয়নি তেমন। চল।’ চোখ বুজে ব্যাট করছিল আট নম্বর। গ্যালারিতে সোজা দীঘি। সব কিছু ব্লার নয়নের। ফোকাস। ডিফোকাস। সাইট স্ক্রিন টাইপের কিছু থাকে না পাড়ার ম্যাচে। তিন নম্বর বল। গ্ল্যান্স করতে গেল। ডিফ্লেক্ট হল বল। চান্স। একটা শব্দ। ধাতব যেন। কিছু দৃশ্য। অবিশ্বাস। অন্ধকার। নয়নের বাকিটা মনে নেই।
রঞ্জন দুবার দেখতে এসেছিল। কাঁদছিল। ছেলেটা ওকে ভালোবাসে খুব। কাপটা ওই তুলেছিল। ভাইস ক্যাপ্টেন। বাঁ চোখ অপারেট করতে হবে। বলটা সরাসরি লেগেছিল। ‘আবার চোখে লাগালি? তর চোখটাই শালা কালপ্রিট।’ খিল্লি টাইপের করেছিল ওপেনার অর্জুনদা। ‘কী হয়েছিল বস? এতটা ভুল?’ প্রশ্ন? গগন, বিজন, দীপের চোখে জিজ্ঞাসা, আকুতি। মা দুবারের বেশি হাসপাতালে আসতে পারেনি বোনের বাড়ি থাকায়। ওর বাচ্চা হবে আজ কালের মধ্যেই। কী নাম রাখবে? দীঘি বলেছিল পার্থিব রাখতে। ও বইটই পড়ে। শীর্ষেন্দু না কী যেন, তার লেখা কেউ। তবে নয়ন জানে পার্থিব একটাই। পার্থিব প্যাটেল। দীঘি বলেছিল নিজের কাজটা করতে। কিপিংটা। ব্যাটটা না পারুক। দীঘি। সোনাদার পাশে বসে। তিন নম্বর বল। নয়ন আড়চোখে গালির দিকে গ্যালারিতে বসা জিতের দিকে তাকিয়ে সব কিছু সেফ ভেবে চোখ রেখেছিল রঞ্জনের হাতে। ওর ডেলিভারি। আঙুল। বলটা ছেড়েছিল রঞ্জন। মাইক্রোসেকেন্ড। সাইট স্ক্রিন টাইপের কিছু নেই। দীঘির হাত ধরে আছে সোনাদা। পাশাপাশি আর কোনও গ্যাপ নেই। ওদের চোখ, কথা ম্যাচে নেই। নয়নের খেলায় নেই। অন্য কিছু। জিৎ? নয়ন নিজে? রেড হেরিং। আট নম্বর শট খেলতে গেল। লাইব্রেরিতে বই। দীঘি। নয়নকে ম্যাচের সামনে, মোঙ্গিয়ার সামনে, ইন্ডিয়ার সামনে বসিয়ে রেখে মাঝে মাঝে উঠে যেত সোনাদা। কেন? প্রেজেন্ট টেন্স। ফাইনাল। এখন। গ্ল্যান্সের পর সম্বিৎ ফেরে নয়নের। ততক্ষণে অন্ধকার। ততক্ষণে ব্যাটের কানায় লেগে একটা দর্শনীয় ক্যাচের সম্ভাবনার অকালমৃত্যু।
নয়ন এই ম্যাচটা নিজে ট্রফি ওঠালে চাকরি হত। আরও উঠত কেরিয়ারে। নয়ন জানে ওর নামটাই শুধু নয়ন। ও জানে ও কোনওদিন মোঙ্গিয়া হবে না …
লোচন
লোচনদাস আজকাল কিছুই দেখে না। লোচনদাস আমাদের পাড়ায় থাকে। আমার ঘরে আসে। মা এটা ওটা খেতে দেয়। গান শোনায়। ‘যদি মক্কা গেলেই খোদা মিলত, শিব মিলত কাশীতে/ আবার বৃন্দাবনে কৃষ্ণ মিললে কেউ চাইত না আসিতে’। লোচনের গান। কাকারা বিরক্ত হয়। মা তবু শোনে। আমিও। মা বলে বাবা থাকলে ভালোবাসত। আমার মনে হয় না। বাবা শেষদিকে শুনতে পেত না। একটা খাতা ছিল। ওখানেই স্কেচ করত। খাতাটা দেখিনি। ইচ্ছে হয়নি। আসলে বাবার সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিশেষ হয়নি। অসুখ। তারপর …। সুযোগ পাইনি, বাবা, আমি কেউই। সেই বাবা। কানটা গেছিল শেষদিকে। তবু, গ্রামাফোনে সায়গল, কাননদেবী চালাতে বলত। কী যে শুনত জানি না। শুধু চোখ দিয়ে জল পড়ত। মনে হয়, কথায় নয়, স্মৃতিকথায়। নিয়তিতে। এটা মা-র কথা। নিয়তি। আমি ওসবে বিশ্বাস করি না। মা করে। বলে, নিয়তি আমাকে একা করে পালাল। কিচ্ছু রাখল না। মানুষ, ধন কিচ্ছু না। এই কথাটা লোচনদাস শুনেছে। শুনেই মনে ধরেছে। মা বলে কথাটা ওর জন্যেও। লোচন গান ধরে। ‘যদি ভোগ দিলেই ভগবান মিলত, খোদা মিলত সিন্নিতে/ তারে পরখ করে ভোগ সাজাইয়া রাজায় পারত কিনিতে …’। মা চলে গেলে থামে লোচনদাস। তখন আমার সঙ্গে কথা। কান্না। হ্যাঁ। লোচনদাস একা একা কাঁদে। ওর সঙ্গিনীর জন্য। সঙ্গিনী? ‘হ্যাঁ রে, ক্ষুদে, সঙ্গিনী।’ আমি যদিও কলেজ পেরোচ্ছিলাম, তবু, সেই ছোটবেলার অভ্যেসের ডাকটা ছাড়েনি লোচনদা। ক্ষুদে। সঙ্গিনীর কথা বলত। পার্বতী। ওর দেওয়া নাম। আসল নামটা? অন্ধ লোচন পার্বতীকে খোঁজে। বনে, বাদাড়ে, বাড়ির দালানে। লোচনদাস বাউল না। সুফিও না। গুরু টুরু নেই। গান কার একটা পাল্লায় পড়ে শুনে শুনে শিখেছিল। লোচনদাস ম্যাট্রিকে ফেল। দুটো কাপড়ের দোকান আর একটা সাইকেলের দোকানে, যতক্ষণ চোখ ছিল কাজ করেছিল। তারপর থেকে বন্ধ। লোচনদাস একা। এখন টিমটিম করে দৃষ্টি যেটুকু আছে, ওতে সামনে হাত বাড়িয়ে নিশ্চিৎ হয়, তারপর হাঁটে। গুষ্টিতে কেউ নেই। মামার বাড়ি থাকত। তাড়িয়েছে।, তাই, লিটারেলি পথেঘাটে ঘোরে। আমার মা-র স্নেহ। ওটুকুই। পয়সা নেই। তাই লোচনের চোখ ঠিক করার কথা পাড়তে পারে না কাকাদের। লোচনের পার্বতীকে কেউ চেনে না। মা পাড়ায় আছে বহুদিন, জিজ্ঞেস করেছিলাম, পাত্তা দেয়নি। লোচন বাড়িতে আসে অনেকদিন হল। কী হয়েছিল পার্বতীর? চলে গেল কেন? ‘যায়নি তো। এই তো পাশেই আছে’। লোচন গল্প বলে। পার্বতীর। ওর চুল, টানা টানা চোখ, হাতের রান্না এসব। গানে। যেটুকু বুঝি, মনে হয় একটা কেউ ছিল, পার্বতীর। লোচন ঘেঁষতে পারেনি। চোখ নষ্ট হচ্ছে, ভবিষ্যৎ নেই। শুধু গানের গলায় কদ্দিন?
এইধরনের গল্পের কোনও টুইস্ট থাকে না। তবে, বড় প্রিয় দাদার মৃত্যুদিনে ছোটভাইদের একটা দায় থাকে। বছরভর কীর্তন বসে। সন্ধে পেরোলে। ওইসময়টাই। সেদিন স্লিপে ফিল্ডিং করতে গিয়ে চোট পেয়ে বাড়ি ফিরছি। মা জানত। বলেছিল, আজ যাস না। কে শোনে। কাকারা বাড়ি নেই। ঢুকতেই হোঁচট খেলাম। ‘কেন তখন বেরিয়ে এলে না?’ – ‘কীভাবে বেরোব? মানুষটা ধরে থাকত। অসুখটা যখন বাঁধাল, অনেক দেরি হয়ে গেছে। ফেলে পালাতাম?’ –‘নাহ…’। একটা দীর্ঘশ্বাস। -‘রতনদা মানুষটা ভালো ছিল। তাই, বিয়ে ঠিক হয়ে গেলেও বেপরোয়া কিছু করার ভরসা পাইনি। তোমাকে নিয়ে পাগল ছিলাম। কী করব? দেখতে পাই না। যেটুকু আলো তখনও আছে, ওতেই বাড়ির আশেপাশে থাকি। সেই আলোও কমে এল। ক্ষুদে হল। আমার রংটা পেল। ভয় ছিল। নাহ, বেশি কিছু পায়নি…।’ আমারও বেশি কিছু শুনতে ইছে করল না। ঘুরপথে বাবার ঘরে ঢুকলাম। সেই খাতা। দেরাজের চাবিতে ফাঁকা ঘরে আওয়াজ হয়। হল না। আজ মৃত্যুদিন। আজ ধূপ। আজ খাতা, কিছু ফুল ছবির সামনে রাখা। কেউ দেখবে না, এই বিশ্বাস মায়ের, দাদাদের। পাখা চলছে না প্রদীপের জন্য। বাইরে লোচনদাসের গান। ‘…আন্দাজে করলে সাধন, কোন সাধনে মিলবে রে সে পরম ধন’। আমার হাত। খাতার পাতা। মোটা, জীর্ণ হলদে স্মৃতির গন্ধ। বাবা। ছবি কত …। মা। আমি, ছোট থেকে বড়। তোলা না, আঁকা। বাবার সেই স্কেচ। অবিকল জ্যান্ত। ঘুরেফিরে আসছে একটা লোক। মায়ের পাশে। দূরে, থার্ড ম্যান হিসেবে বাবা। কোথাও সেই লোকটা বাবার জায়গায়। লোকটার ছবি। মুখ। মাথায় ফেট্টি। ঠোঁটের পাশে তিল। খাতা বন্ধ করলাম।
বেরোতে বেরোতে শুনলাম সন্ধে দেওয়ার আওয়াজ। মার শাঁখ। একটু পরে লোক বসবে। সময় হল। দুটো হাত সামনে বাড়িয়ে সদর দরজা খুলছে লোচনদাস। মাথায় সেই ফেট্টি। এই এত দূর থেকেও বুঝতে পারলাম, লোচনদাসের ঘাম চকচক করে নামছে ঠোঁটের পাশের কালো তিলের দুদিক দিয়ে …