অঙ্গারপর্ণ
প্যান্ডেলের একপাশে বড় লাইন। লাল পাড় শাড়ি আর পাজামা পাঞ্জাবি পরে মহাষ্টমীর অঞ্জলি দিয়ে উপোসীরা ভোগ নিচ্ছে। গরম গরম ফ্রায়েড রাইস আর কাশ্মিরি আলুরদম হু হু করে উঠে যাচ্ছে। ওটা মহাষ্টমীর ভোগ। পটলাদা একটু দূরে দাঁড়িয়ে কী করবে বুঝতে পারছিল না। এদিকে ঢাকের তালে তার শরীরও দুলতে শুরু করেছে। একেবারে মন খুলে নাচতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সেটা একেবারেই অসম্ভব। যেভাবে হোক তাকে সোজা থাকতেই হবে। কারণ উল্টোদিকের বুকস্টলে মার্ক্স, লেনিন, হো-চি-মিন এবং অম্বরদা। পুজোর এই পাঁচটা দিন তার ঠিকানা ওই বুকস্টল। ওখানে বসেই লক্ষ লক্ষ মানুষের জনসমাগম দেখতে দেখতে পটলাদা বিপ্লবের কথা ভাবে, সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু পটলাদার এই রোগটা! এটা যে খুবই সমস্যার। ঢাকের আওয়াজ শুনলে শরীর আর সোজা থাকে না। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দুলে ওঠে। রক্তে কেমন যেন একটা দোলা লাগে, প্রচণ্ড নাচতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পটলাদা বিলক্ষণ জানে যে একজন কমিউনিস্টকে এভাবে নাচতে নেই, ওভাবে ভোগ খেতে নেই।
মহাষ্টমীর এই ভোগটা এরা কিন্তু অসাধারণ করে। পটলাদা চিরকালই একটু পেটুক, খাবার দেখলে মাথার ঠিক থাকে না। গতবার রাজু সেক্রেটারি ছিল। ক্যানে ভরে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল। ঘরে বসে, পাঁচজনের আড়ালে পেট ভরে খেয়েছিল তার প্রিয় ফ্রায়েড রাইস আর আলুর দম— মহাষ্টমীর ভোগ। কিন্তু এবার তো সুখেন সেক্রেটারি… ও পটলাদাকে দেবে তো! সব শেষ হয়ে যাবে না তো!
পটলাদা একজন আদ্যন্ত কমিউনিস্ট। নিয়মিত পার্টি ক্লাস করে, বই পড়ে সে কমিউনিজম, মার্ক্সবাদ, সমাজতন্ত্র শিখেছে। নিজের জীবনেও খুব যত্ন করে এই শেখা ভাবনাগুলোকে পালন করে সে। ১৯৭৭ সালে পার্টি যখন ক্ষমতায় আসে তখন সে খুবই ছোট। সেসময় সে তার বাবা কাকাদের দেখেছে। দেখেছে মাটির দাওয়ায় শুকনো মুড়ি আর গুড়ের চা নিয়ে তারা বিপ্লবের কথা বলছেন, সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখছেন, মানুষকে রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত করছেন। একজন প্রকৃত কমিউনিস্ট হতে গেলে বা স্বাধীনভাবে কোনও বামপন্থী আন্দোলন গড়ে তুলতে গেলে যে শ্রম একাগ্রতা ত্যাগের দরকার সেটা তারাই আগে করে দেখাচ্ছেন, আর তাদের পথ দেখাচ্ছেন কাকাবাবু, প্রমোদ দাশগুপ্ত, সরোজ মুখার্জী, সোমনাথ লাহিড়ি বা হরেকৃষ্ণ কোঙারের মত নেতারা। সৎ এবং আন্তরিকভাবে একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক তত্ত্বকে ভিত্তি করে নির্দিষ্ট কোনও রাজনৈতিক পরিণতির দিকে একটু একটু করে এগিয়ে চলাই ছিল সেদিনের বামপন্থা। সেখানে মাটির দাওয়া থেকে ভেসে আসত ‘মাটির কত মেহেরবান, আনন্দে আজ গাইছে গান’ বা ‘শঙ্খচিল’-এর উদাত্ত সুর। সেখানে আত্মবিশ্বাস ছিল, আবেগ ছিল, আদর্শের ওপর ভরসা ছিল। কিন্তু সমস্যা হল ক্ষমতা। ক্ষমতার মিষ্টি হাওয়া একটু একটু করে কেমন যেন সব বদলে দিতে শুরু করল। পটলাদা দেখল তার চেনা মানুষগুলোও কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। প্রতিটি গ্রাম, নগর, শহরে তৈরি হওয়া লোকাল কমিটি, ব্রাঞ্চ, বুথ কমিটি ইত্যাদিতে পাই, গণ্ডার হিসেব রাখা মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তদের ভিড় বাড়তে শুরু করল। এদের বেশিরভাগই মার্কসবাদ বোঝেন না, বামপন্থা কী বা কেন বা একজন সাধারণ মানুষ অন্য মতবাদ ছেড়ে খামোখা কেন বামপন্থী হবেন জানেন না। তাদের কাছে ওই কমিটিগুলোয় যাওয়াই ছিল মূল লক্ষ্য, পদ ধরে রাখার জন্য শক্ত অঙ্ক করাই ছিল আসল কাজ। ওপর নেতৃত্বও তাদের রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত করার দায়টি ক্রমে ক্রমে ঝেড়ে ফেললেন। ফলে প্রতিটি জেলায় ছোট ছোট সরকার তৈরি হল। যার নেতৃত্ব দিল এলাকার কিছু পল্টু, সিরাজ, গোপালরা। এরা পৌরসভার ড্রেনের সমস্যা, কবিতায় ছন্দের অমিল বা বউ শাশুড়ির ঝগড়ার কারণগুলো টপ করে ধরতে পারলেও সামাজিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বুঝতেন না, বামপন্থী মতাদর্শ সম্পর্কে কোনও জ্ঞান ছিল না। সেই অর্থে, বামপন্থী ভাবাদর্শের দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের অশিক্ষিতই বলা যায়। স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃত বামপন্থার বিচ্যুতি শুরু হল। রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণের বদলে প্রতিটি জেলায় তৈরি হল হাজার হাজার সরকার… মূল সরকারের মধ্যে আরও অনেক সংগঠিত সরকার। শুরু হল ভোট, ভোট আর ভোট। বুথ কমিটি, লোকাল কমিটি, জোনাল কমিটি, জেলা কমিটি, রাজ্য কমিটি, সেন্ট্রাল কমিটি ইত্যাদির ভোট ছাড়াও পঞ্চায়েত, পৌরসভা, বিধানসভা, সংসদ ইত্যাদির ভোটে পার্টি নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার, ক্ষমতায় থাকার কাজ শুরু করল। কো-অপারেটিভ, লাইব্রেরি, স্কুল, ব্যবসায়ী সমিতি বা অটো ইউনিয়নের নির্বাচন বাদ দিলেও বছরে গড়ে অন্তত চার-পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে দলকে এবং নিজের গোষ্ঠীকে জেতানোর দায় এসে পড়ল ওইসব পল্টু, সিরাজ, গোপালদের ওপর। কোনওভাবেই ক্ষমতা হারানো যাবে না, শাসক তকমা ত্যাগ করা যাবে না। ক্ষমতা হারানোর ভয় থেকেই তৈরি হল ক্ষমতা ধরে রাখার নির্মম দায়। যেভাবেই হোক শাসক হয়েই থাকতে হবে… বিরোধী! নৈব নৈব চ। তাই একেবারে নিঃশব্দে মানুষের আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে বামপন্থী আন্দোলন একটু একটু করে ভোটের আন্দোলনে সীমাবদ্ধ হতে থাকল।
পটলাদা যে এসব নিয়ে একেবারেই প্রতিবাদ করেনি তা নয়, বরং অতি সরব হওয়ার জন্য একবার অম্বরদার কাছে খুব বকুনি খায় সে। অম্বরদা বলেন এভাবে পার্টি লাইনের সমালোচনা করলে নিজের অজান্তেই সে নাকি প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে যাবে। কিন্তু প্রতিক্রিয়া তো অনেক পরের বিষয়, ক্রিয়া নিয়েই তার গুলোতে শুরু করল। চূড়ান্ত মানসিক অশান্তির মধ্যে পটলাদার বাড়িতেও শুরু হল অশান্তি। সত্যনারায়ণের সিন্নি, লোকনাথের উৎসব বা নীলের পুজোয় উপোস তার বাড়িতে বন্ধই ছিল। পটলাদা কিছুটা হলেও বাড়ির লোকগুলোকে বোঝাতে পেরেছিল যে কমিউনিস্টদের এসব করতে নেই, কারন কমিউনিস্টরা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে বিশ্বাস করে। তার বউ কানন বেশ খানিকটা বুঝেওছিল, একটু রাগী দেবতা যেমন কালী, শনি ইত্যাদিদের বাদ দিয়ে কিছুটা মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু গোল বাধাল অম্বরদার বউ। বউবাজারে এক জ্যোতিষীকে দেখিয়ে ফেরার পথে একেবারে কাননের মুখোমুখি। কানন ওর পিসির নাতনির জন্মদিনের নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিল। অম্বরদার বউকে ছেড়ে দিলেও বাড়িতে এসে একেবারে রুদ্রমূর্তি, চিৎকার করে বলতে শুরু করল…
‘তোমার অম্বরদার বউ জ্যোতিষী দেখাচ্ছেন… উনি তো আবার তোমাদের মহিলা সমিতির নেত্রী…’
পটলাদা খুব আলতো করে বলল, ‘তার জন্য আমি কী করব?’
‘তুমি কী করবে মানে? অম্বরদার বউ জ্যোতিষী দেখাবেন, তার বাড়িতে ধুমধাম করে সরস্বতীপুজো, কালীপুজো হবে, বাড়িতে লুকিয়ে নিত্যপুজোও চলবে, আর অম্বরদা খোশমেজাজে দাঁতে কাঠি দিতে দিতে বলবেন উনি কমিউনিস্ট, উনি নেতা থেকে আরও বড় নেতা হবেন?’
পটলাদা আরও মিহি করে বলল, দেখো এগুলো যে যার ব্যক্তিগত বিষয়, মানে…
–ব্যক্তিগত মানে? তুমিই তো আমাকে বলেছ, কমিউনিস্ট পার্টিতে ব্যক্তিগত বলে কিছু হয় না… কি? বলোনি?
–হ্যাঁ তা বলেছি, মানে হয় না তো… মানে…
–চুপ করো, ওই মানে… মানে করে মিউ মিউ করবে না। অম্বরদার ছেলেমেয়ে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে মাল্টিন্যশানাল কোম্পানিতে চাকরি করবে, রাজনীতির ধার মাড়াবে না। আর এদিকে তোমার ছেলে পুলিশের লাঠিপেটা খেয়ে ছাত্রআন্দোলন করবে, ব্রিগেড ভরাবে। তোমার বাড়িতে সত্যনারায়ণ, লোকনাথ বন্ধ হবে আর তুমি… ’
কাননকে থামিয়ে দিয়ে পটলাদা খুব সাবধানে বলল, ‘দেখো কানন, এটা তো অম্বরদার বউ মানে… অম্বরদা তো এসবের মধ্যে নেই।’
–অম্বরদা নেই মানে! পুজোর বাজার করা থেকে শুরু করে পুরুত ডেকে আনা, সরস্বতী ঠাকুর কেনা, সাজানো সবই তো তিনিই করেন। আর তাছাড়া তিনি যদি এর মধ্যে নাও থাকেন তাহলে তিনিই তার বাড়িতে একমাত্র কমিউনিস্ট? তার মত বা তার আদর্শের সঙ্গে তার বাড়ির লোকজনই একমত নয়?’
পটলাদা আর কিছু বলতে পারছিল না। কাননের প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই। একটা জরুরি মিটিং আছে বলে বেরিয়ে গিয়ে সে যাত্রায় রেহাই পেয়েছিল বটে, কিন্তু খুব জরুরি হয়ে উঠেছিল কাননের ওই প্রশ্নগুলো। সত্যিই তো, এও তো একধরনের দ্বিচারিতা। মাথায় গিজগিজ করছে দন্দ্বমূলক বস্তুবাদ আর চোখের সামনে ভেসে উঠছে কাননের মুখ। জ্যোতিষী, অম্বরদার বউ, মার্কসবাদ, মহাষ্টমীর ভোগ আর ঢাকের তাল সব কেমন যেন একাকার! এগুলো সবই কি প্রাসঙ্গিক নাকি এ সব কিছুই একের থেকে আলাদা? একজন প্রকৃত কমিউনিস্টের কী করা উচিত আর কি কি করা উচিত নয়? লিও শাওচির ‘একজন সাচ্চা কমিউনিস্ট হতে গেলে কী করতে হবে’ বা ভগৎ সিং-এর ‘কেন আমি নাস্তিক’ বইদুটো বেশ মন দিয়েই পড়েছে সে। পার্টির গঠনতন্ত্র বা কমিউনিস্ট আন্দোলন নিয়ে সুরজিৎ, নাম্বুদিরিপাদ বা অনিল বিশ্বাসের বেশ কিছু বইও তার পড়া, তাছাড়া সে অম্বরদা, অখিলদা বা মৃণাল চ্যাটার্জির পার্টি ক্লাসও খুব মন দিয়েই করেছে, কিন্তু…। সবকিছু কেমন গুলিয়ে তাল হয়ে যাচ্ছিল তার।
পটলাদা জানে এই গুলোনো তার একার সমস্যা নয়, এ গুলোনো সবার, বলা যায় পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি বামপন্থীর। তারা পুজোআচ্চাকে উৎসব বলবে নাকি ধর্মীয় উৎসবকে পুজো বলবে… জানে না। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বা পুজো উৎসবের মিলনমেলার মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে রেখে নিজের নীতি, আদর্শ, সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা করবে নাকি এসব কিছু থেকে সরে গিয়ে নিজের আদর্শের প্রতি অনড় থেকে সৎভাবে নিজের ভাবনাকে তুলে ধরবে… জানে না। দেশজ সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে কমিউনিজমকে প্রতিষ্ঠিত করবে নাকি পুরোপুরি আন্তর্জাতিক ভাবধারায় দেশবাসীকে প্রভাবিত করে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে অগ্রসর হবে… জানে না। চৈতন্য, লালন বা কবীরের মধ্যে দিয়ে লেনিন, চে-গুয়েভারা বা মাওরা আসবেন নাকি… আসলে তারা কি আন্তর্জাতিক? নাকি দেশজ, নাকি লোকাল কমিটির! নাকি… না, পটলাদা আর ভাবতে পারছিল না, মাথা ভার হয়ে যাচ্ছিল।
এসব নিয়ে কিছু ক্ষেত্রে পার্টির নির্দিষ্ট লাইন থাকলেও সেটা কেবলমাত্র অনুশাসন। সংস্কৃত ভাষার মত ওগুলো বিশেষ অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়। বেশিরভাগ পার্টি সদস্যদের জীবনের মধ্যে কোথাও এই অনুশাসন নেই, নেই কোনও দায়বদ্ধতা। তারা লেভি দিয়ে এবং লেভি নিয়ে নিশ্চিন্তে দায়িত্ব শেষ করেন। ফলে সংসদীয় রাজনীতিতে কমিউনিস্টদের ভূমিকা কি হবে, যদি সরকার গঠনের মত কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয় তবে তারা সরকারে যাবে কিনা, সরকারে গেলে বা না গেলে তাদের নির্দিষ্ট ভূমিকা কী হবে… এসব সম্পর্কে ঘোর ধোঁয়াশা থেকে যায়, কোনও ধারাবাহিক নীতি তৈরি করা যায় না। সবকিছুই ছেড়ে দেওয়া হয় ঠিক ভোটের আগে বা পরের উদ্ভূত পরিস্থিতির ওপর। কিন্তু এভাবে তো জয়ললিতা, মুলায়ম বা কেজরিওয়ালরা দল চালায়… ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিও এভাবে চলবে?
এইসব সাতপাঁচ ভাবনা আর কাননের চিৎকার শুনতে শুনতে এসে গেল বিধানসভা নির্বাচন। পটলাদার এবার আর নাওয়াখাওয়ার সময় থাকবে না। ভোটার স্লিপ তৈরি, লিস্ট স্ক্রুটিনি, ক্যান্ডিডেট ঘোরানো, পথসভা, মিছিল, লিফলেট বিলি, বুথ মিটিং… একেবারে সাজানো কর্মসূচি। পটলাদা এসবে অভ্যস্ত। বহুদিন ধরে খুব যত্ন করে এসব করছে সে… কিন্তু এবারটা কেমন যেন অন্যরকম। চারদিক থেকে একটা স্লোগান ভেসে আসছে, ‘জোট বাঁধো তৈরি হও’। ভোটের আগে সে এই স্লোগানটা আগেও শুনেছে। সে জানে এটা সলিল চৌধুরীর ‘শপথ’ কবিতার লাইন। কিন্তু এবারে এই স্লোগানটায় কেমন যেন অন্যরকম শপথের সুর। এ জোটে কেমন যেন…। পার্টি অফিসে এসে অম্বরদা বললেন, এবার জোট হবে কংগ্রেসের সঙ্গে। চমকে ওঠে পটলাদা। পার্টির সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু অম্বরদা বোঝান এটা নাকি মানুষই চাইছে, এটা মানুষের জোট। পটলাদার আবার সব গুলিয়ে যেতে শুরু করে। এটা মানুষ চাইছে? এত সহজে অম্বরদা বুঝলেন আর সে বুঝতে পারল না! ক্লাব, চায়ের দোকান, রাস্তাঘাট কোথাও তো এমন চাওয়ার কথা শোনেনি সে! বরং সাধারণ মানুষ এবার শাসকদল সম্পর্কে বেশ বিরক্তই বলা যায়। শিক্ষা, প্রশাসন, দুর্নীতি, দলতন্ত্র ইত্যাদি ইস্যুতে শাসকদল একটু হলেও কোণঠাসা। সরকার পরিবর্তন হবে কিনা সে জানে না কিন্তু পটলাদার মনে হচ্ছিল বামফ্রন্ট এবার ভালোই রেজাল্ট করবে। কিন্তু এ সময় হটাত এমন একটা জোট… মানুষ নিতে পারবে তো!
ওপর নেতৃত্ব পটলাদাদের বোঝাল, বলল এই জোট করলে মানুষের কাছে অনেক তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে, কর্মীরা মানসিকভাবে অনেক জোর পাবে। বন্ধ পার্টিঅফিসগুলো খোলা যাবে। তৃণমূল স্তরের কর্মীরা বলভরসা পাবে। পটলাদা দেখল যুক্তিগুলো বেশ জোরালো কিন্তু এত সব যুক্তি তো শুধুমাত্র পার্টিকর্মীদের শক্তিশালী করার জন্য, এখানে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ কোথায়? পার্টিকর্মী আর ভোটার কি এক? মিছিলে হাঁটার বা বাসে করে ব্রিগেড যাওয়ার লোকজন বাদ দিলে একটা বড় অংশের মানুষ আছেন যারা জানলার ফাঁক দিয়ে পটলাদাদের মিছিলের দিকে তাকিয়ে থাকেন, রুটি সেঁকতে সেঁকতে পটলাদাদের স্ট্রিট কর্নারের বক্তব্যে কান রাখেন, বসার ঘরে মুড়ি শশা খেতে খেতে পটলাদাদের দিয়ে যাওয়া লিফলেট পড়েন… তাঁরা? তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয় যে মানুষ এই জোট চেয়েছেন তবে মাত্র তিনমাসের মধ্যেই সেটা একেবারে জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল! বিগত সাড়ে চার বছরে অজস্র ইস্যু যেমন সারদা, সুদীপ্ত, অধ্যক্ষ নিগ্রহ, ধর্ষণ, প্রশাসনিক দলতন্ত্র, শিক্ষা ইত্যাদি বহু ক্ষেত্রে পার্টির সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন কোথায়? ২০০৬-এ সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার গঠনের পর থেকে যদি মমতার আন্দোলন পদ্ধতির দিকে চোখ বোলানো যায় তাহলে দেখা যাবে যে সামান্য বা অসামান্য ইস্যুতে মমতা চূড়ান্ত আন্দোলন করেছেন, কারণে (!) অকারণে রাজ্য অচল হয়েছে। এই আন্দোলন পদ্ধতি ভুল বা ঠিক সেটা বিতর্কের বিষয়, কিন্তু এটা হঠাত করে তৈরি হয়নি। এই আন্দোলনের মধ্যে যথেষ্ট পরিশীলিত হোমওয়ার্ক এবং দূরদর্শিতা ছিল। এই সময় মমতার দল কিন্ত খুব ভালো অবস্থায় ছিল না। মাত্র তিরিশজন বিধায়ক নিয়ে তিনি তার মত করে আন্দোলন চালিয়ে যান। এ আন্দোলন নিয়ে সমালোচনা থাকতে পারে, তার ইংরাজি না বলতে পারা, শব্দপ্রয়োগে অসতর্কতা বা ভুল ইতিহাস বলা নিয়ে ফেসবুকে ঝড় উঠতে পারে কিন্তু এই আন্দোলনই তাকে সাধারণ মানুষের কাছে মানবদরদী করে তোলে। মানুষ মনে করতে শুরু করে এ আমাদেরই লোক। ভুল ঠিক যাই হোক মানুষ কিন্তু তাকে ভরসা করতে শুরু করে।
পটলাদার রাতে ঘুম হয় না। ভোটার স্লিপ লিখতে লিখতে ভাবে ২০১১-র মারাত্মক বিপর্যয়ের পরও প্রায় ৬২ জন বিধায়ক নিয়ে অজস্র ভয়ঙ্কর ইস্যুকে হাতের কাছে পেয়েও বামপন্থী আন্দোলন কেমন যেন আলুনি ছিল। চলচ্চিত্রের ভাষায় সেই টুইস্ট নেই। সবক্ষেত্রেই একটা ঠান্ডা, অতিসতর্ক, পরিশীলিত আন্দোলন। ২০১৫ পর্যন্ত এভাবেই সতর্কভাবে এগিয়ে এসে নির্বাচনের মাত্র তিনমাস আগে হঠাত শুধুমাত্র পার্টিঅফিসগুলো খোলা আর কর্মীদের মানসিকভাবে চাঙ্গা করার জন্য কংগ্রেসের সঙ্গে জোট! পটলাদা নিজেকেই প্রশ্ন করে, আচ্ছা, পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাবদলের ইতিহাসে পার্টি অফিসের সংখ্যা কবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল? বরং খুব সামান্য সংখ্যক পার্টি অফিস নিয়েই এ রাজ্যে ক্ষমতা বদল হয়েছে। কংগ্রেস, বামফ্রন্ট বা তৃণমূল সব দলের ক্ষেত্রেই এই প্রবণতা ঐতিহাসিকভাবে সত্যি। হ্যাঁ, সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এই জোটের হয়ত কোনও প্রাসঙ্গিকতা থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু সেটা সম্পূর্ণভাবে সংসদের কথা ভেবেই হওয়া উচিত… এটা হবে শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধাচরণের জন্য। রাজনৈতিক ভাবাদর্শের প্রেক্ষাপটে যার বিন্দুমাত্র প্রভাব থাকবে না…
পটলাদা বারে বারেই ভোটারদের নাম ভুল লিখছিল। মনে তখন অজস্র প্রশ্ন ভিড় করছে… চারপাশ থেকে তিরের মত ভেসে আসছে অজস্র ভাবনা। বামফ্রন্টের দিক দিয়ে দেখলে অন্তত কুড়ি বছরের নিরন্তর আন্দোলন, অজস্র প্রাণ, রক্ত, অনেক ঘর সংসার আর স্বপ্নের বিনিময়ে যে বামপন্থী জোট তৈরি হয় সেটা মানুষের জোট, সেটা অনেক বেশি হৃদয়ের জোট। দুম করে সেটাকে এভাবে উড়িয়ে দেওয়া যায়? দুম করে সেই হৃদয়গুলোতে অন্য কোনও সুর বসিয়ে দেওয়া যায়? দুম করে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, রাষ্ট্রীয় পুঁজির নিবেশ তৈরির ভাবনা থেকে সরে এসে সাম্রাজ্যবাদী মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেট পুঁজির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা মনমোহিনী তত্ত্বকে আঁকড়ে ধরা যায়? কমিউনিস্টদের কাছে সংসদ হল গণআন্দোলন তীব্র করার প্ল্যাটফর্ম… দুম করে সেই প্ল্যাটফর্মে একেবারে নতুন রাজনৈতিক ভাবধারায় আবির্ভূত হওয়া যায়? কংগ্রেসের দিক থেকেও এ রাজ্যে এটা রাজনৈতিকভাবে খুবই সন্তাপের। চৌতিরিশ বছর ধরে লাগাতার অত্যাচার, অবহেলা, ব্যঙ্গ সহ্য করে যারা দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে রইল, হাজার চাপ লোভ সত্ত্বেও যাদের মমতায়ন ঘটল না, যারা পশ্চিমবঙ্গে আবার ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখার সাহস দেখাতে পারত, দুম করে তাদের বলা হল তেরঙ্গায় রাঙা হাত দিয়ে শক্ত করে ধরো কাস্তে হাতুড়ির বাঁট। সব অতীত ভুলে মিশে যাও লাল মিছিলে। বড় নির্মম এই তত্ত্ব, বড় নির্মম এই আদেশ। তার বার বার মনে হচ্ছিল পশ্চিমবঙ্গের মানুষ চরিত্রগতভাবে কিন্তু বামপন্থীই আছে, তাহলে এ রাজ্যের বামপন্থা কি বদলাচ্ছে? নাকি বামপন্থা এভাবেই বদলায়, এভাবেই…।
পটলাদার চোখে জল। তার মনে পড়ে তার জ্যাঠা, বাবা, কাকার কথা। সেই সাদা পাজামা, ফতুয়া আর সাইড ব্যাগের কথা, সেই গান, মিটিং, মিছিল, গণআন্দোলনের কথা। পটলাদা ভাবে, ‘আচ্ছা এই ইউস অ্যান্ড থ্রো’-র যুগের সঙ্গে তালমিলিয়ে আমরাও কি শর্টকার্টে সব পেতে চাইছি? এমনকি বামপন্থাকেও? জ্যাঠা বলতেন ‘বামপন্থা হল সাধনা। এটা করতে গেলে সাধক হতে হয়। বামপন্থার মানে না জানা তথাকথিত বামপন্থী কর্মীর থেকে লাভসর্বস্ব ব্যবসায়ীও ভালো।’ পটলাদা আর পারছিল না। নিজের সঙ্গে তর্ক করতে করতে ভোটার স্লিপ, পেন, ভোটার লিস্ট সঙ্গে নিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল জানে না। মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে ওঠে পটলাদা… ‘এ রাজ্যের মানুষ কিন্তু বামপন্থীই আছে…!’ ঘেমে নেয়ে বিছানায় উঠে বসে দেখে জানলা দিয়ে একফালি জ্যোৎস্না তার বিছানায়। বাইরে পূর্ণিমার চাঁদ। সকালে উঠে তড়িঘড়ি পার্টিঅফিসে গিয়ে গনতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা মেনে জোটে সামিল হল পটলাদা, কিন্তু মানুষ! তারা কেমন যেন চুপ করে গেল। তারা কি অপেক্ষা করছিল হত্যা, আত্মহত্যা, পরিবর্তন বা আরও একটা পূর্ণিমার জন্য… কে জানে!