প্রতিভা সরকার
নাপাক
ফজরের নামাজে সুরের ঢেউ উঠবে আর একটু পরেই, রাবিনা আকাশের রং দেখে বোঝে। তার শ্বশুরবাড়ির কাছের মসজিদে চারদিকে মুখ করে লাগানো মাইকগুলো থেকে খোলামুখ জলের কলের মতো অনর্গল ঝরতে থাকবে মোয়াজ্জিমদের সুরেলা কণ্ঠ— বিসমিল্লা ইর রহমান ইর রহিম। ঠিক ঢেউয়ের মতোই। আল্লাতালার জন্নত থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় যে ফেরেশতারা এসে মাটির পৃথিবীতে ধুলোমাখা ইনসানদের দেখভাল করেন তারা এইসময়টায় সব একসঙ্গে জড়ো হন। নিঃশব্দে চোখের তারায় নানা বার্তা বিনিময় করেন। তারপর সেই মজলিশ থেকেই আকাশ পানে সিধা উড়াল দেন। আল্লাপাক গম্ভীর গলায় তাদের শুধান,
–আমার বান্দাদের কেমন রাইখ্যা আইলা? কী করতেছে তারা?
–তারা সবাই ফজরের নামাজে ব্যস্ত হইয়া পড়ল বইলা, দীনদয়াল। এমনই দেইখা আসলাম আপনার বান্দাদের।
ফেরেশতাদের মস্ত মস্ত ডানায় কাঁপ লাগে ঝরঝর, খোদাতালার হাত ইশারায় তারা ফের উড়ালে যান। সকালের মতো রিপোর্ট শেষ।
সত্যি এইরম কোরানে লিখা আছে, মৌলবীস্যার? কাঁপা কাঁপা গলায় রাবিনা ছোটবেলায় জিজ্ঞাসা করত।
নয়তো কী? এইসময়টা তাই সবচেয়ে দামী সময়। দ্যাখছোনি ফজরের নামাজেই রোজার ডাক পড়ে। এইসময় হইল গা চিত্তশুদ্ধির সময়, আল্লাপাকের সামনে নিজেরে প্রমাণ করনের সময়।
রাবিনা এখনও এত ভারী কথা বোঝে না। কিন্তু ফজরের নামাজের ডাক শুনলেই তার ঘুম ভেঙে যায় সেই শিশুকাল থেকেই। যেন সে কল্পচক্ষে দেখতে পায় অনেক উঁচু প্রায় আন্ধার আকাশে ঘুমভাঙা পাখির মতো সারি সারি ওড়েন দেবদূতেরা, তাদের পথ বরাবর ফুটে থাকে একটি জ্বলজ্বলে শুকতারা। যেন আল্লাতালার আরসের একটি উজ্জ্বল মণি। ভারী ভালো লাগে তার। চোখে আর ঘুম আসে না। এই বিপুল বিচিত্র সৃষ্টি তাকে যেন দুহাত মেলে ডাকতে থাকে। সে উঠে শ্বশুরবাড়ির বাগানে যায়, গাছে পানি সিচায়, হাঁসমুরগি ঘরের আগল খোলে, একমনে নারকেল পাতার মরমর শব্দ শোনে, আবার হাঁ করে আকাশমুখো হয়ে থাকে কতক্ষণ।
এইরকম সময়েই সে একদিন ল্যাংড়া টিটুকে খুঁজে পায়।
কিছু বোকা মানুষের অন্যের কষ্ট হজম হয় না। তাদের যেন মাথা ঝিমঝিম করে, গা সুলসুলায়। পশু হোক, কী মানুষ, সব যেন নিজেরই কষ্ট। এদের জন্য আগুপিছু না ভেবেই গাড্ডায় লাফিয়ে পড়াই কষ্টখোরদের কপাললিখন। অন্যের ঝামেলা নিজের মনে করায় ঘরে বাইরে তাদের যতই হেনস্থা হোক, তবু স্বভাব যায় না মলে। যতই ঝাড় খাক, পরের দুঃখে একটুতেই তারা বড় বিচলিত হয়, আবার সুরাহা হলে চট করে খুশিও হয়। গোঁ যদি একবার ধরে তো রাস্তা থেকে মুসাফিরকে ঘরে তুলে আনবে। এইসব মানুষগুলিকে ঠকানো সোজা, কিন্তু গোঁ ছাড়ানো সহজ কম্ম নয়।
রাবিনা যে এদের একজন সেটা বোঝা যায় বহুদিন আগে মকবুলের আকিকা বা অন্নপ্রাশনের সময়। মকবুল রাবিনা আমিনার পর জন্ম নেওয়া একচিলতে পুরুষ-খোকা, আবদুল সাহেবের পুরুষকারের বিলম্বিত চিহ্ন। বাচ্চার গৌরকান্তি, এক মাথা কালো চুল আর লাল টুকটুকে ঠোঁট দেখে বাপের স্নেহ কাদাজলে বড় শোলমাছের মতো এমন ঘাই মারে যে পরদিনই আবদুলসাহেব একটি গতরওয়ালা খাসি কিনে নিয়ে আসেন। তার কপালে একটি সাদা চন্দ্রচিহ্ন আর শরীরে বেজায় ফূর্তি। এসেই রাবিনা আমিনার হাত থেকে ঘাসের গোছা চিবিয়ে চার ঠ্যাঙে হেভি নাচনকোঁদন। তখন শ্রীদেবীর দ্রুত ওঠানামা করা বিশাল বুক, আধো বুলি আর ঘন থাইয়ের জমানা, তাই ইমামসাহেব আসার আগেই শিন্টুমামা তার নামকরণ করে ফেলে চাঁদনি। ইমামসাহেবও এই দ্রুততায় হতভম্ব হয়ে গিয়ে কুরবানির পশুর নাম রাখা বিধিসম্মত কিনা তাই নিয়ে ফুফাতো ভাই বড় ইমামের সঙ্গে ফোনে বাক্যালাপে মগ্ন হয়ে পড়েন এবং কোনও ফতোয়া দেবার আগেই মগরেবের নামাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে স্থানত্যাগ করেন।
অবশ্য তার আগেই আব্বু এবং মৌলবীর কথাবার্তা রাবিনার মাথার পোকা নাড়িয়ে দেয়। সে ছুটতে ছুটতে ঘুমন্ত ভাইয়ের বিছানার পাশে যায়।
আম্মি, চাঁদনিকে কুরবানি দেওয়া হবে? ভাইজানের জন্মের চল্লিশ দিনের ভিতরে?
কুলসুম বেটা হওয়ায় খুবই আনন্দিত ছিলেন, হঠাত দশ বছরের মেয়ের এই বেখাপ্পা প্রশ্নে চমকে গেলেন,
–তোরে কে কইল?
–কেন ইমামসাহেব আর মৌলবীসাহেব মিলেজুলে আব্বুকে বুঝাল যে! আমি কিন্তু চাঁদনিকে পুষবোওও।
–চাঁদনিকে পুষবওওও।
অবিকল রাবিনাকে নকল করে ভেঙান কুলসুম বিবি। ধাড়ি মেয়ের বায়নাক্কা শুনে তিনি অবাক! হায় আল্লা, কুরবানির নাম করে আনা পশু পুষতে চায় এ কেমন মেয়ে! পাপপুণ্যের বোধ ওর এখনও হয়নি জেনেও খেঁকিয়ে ওঠেন তিনি,
–চুপ যা, চুপ যা, রাবিনা। আমার মা দাদি তোর বয়সে পর্দা রাখা করত। যত আদর পাইতেছ, তত বান্দর বনতেছ, না? রও, আইজ তুমার একদিন কী আমার একদিন।
গালে পাঁচ আঙুলের দাগ নিয়েও পরদিন চুপি চুপি চাঁদনির গলার দড়ি খুলে দিয়েছিল রাবিনা। তবে নির্বোধ পশু বেশিদূর যাবার আগেই শিন্টুমামা তাকে ধরে ফেলে। গালের দাগ এবার চাকা চাকা হয়ে রাবিনার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লেও সে মকবুলের আকিকার দিন না খেয়ে থাকে।
মৌলবীমশাই মেধাবী ছাত্রীটিকে স্নেহ করতেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
–ছি মা, মেয়ামাইনষের এত জিদ নাপাক। খোদাতাল্লা নারাজ হন।
বিয়ের পর এই প্রথম বছর রোজা শুরু হওয়া তক রাবিনার ফজরের নামাজের ডাকে ঘুম ভাঙার ব্যাপার চুকেবুকে গেছে। শাশুড়ি মরার আগে নিজে হাতে পাকঘর সামলাতেন বলে তাকেও এখন উঠতে হয় প্রায় মাঝরাতে। কাজের মেয়ে মাইমুনা আছে সাহায্য করার জন্য, কিন্তু রাশভারী শ্বশুরমশাই তার হাতে খান না। পঞ্চায়েত প্রধান বলে রোজা শুরু এবং ভাঙার কালে অনেক ভাইবেরাদরের ডাক পান তিনি। কিন্ত নেহাত নাচার না হলে হাইপার অ্যাসিডিটির রোগী সিরাজসাহেব ঘরের তৈরি খাবার ছাড়া কিছুই খাবেন না। ফলে মাইমুনা সব যোগাড় করে রেখে দিলেও মাঝরাতের পর থেকে রাবিনা আধোঘুমে গ্যাস জ্বেলে অবশ হাতে খুন্তি নাড়ে। হঠাত উঠে পড়ে যদি সিরাজ সাহেব পাকঘরের সামনা দিয়ে গোসলখানায় যান, এই বিবেচনায় তার মাথার ঘোমটা নড়ে না। রান্না সারা হলে তবেই সে সাবিরকে ডাকে,
–উঠ গো সাহেব। তুমার আব্বাজানকে ডাকো। মসজিদে তালা খুলার শব্দ শুনি যে।
উত্তরে সাবির তাকে শক্ত করে জাপটে ধরে চওড়া বুকের ওপর। রাবিনা কালো হিলহিলে শরীরে সাপের মতো মোচড় দিয়ে ফিসফিসায়,
–করো কী, করো কী! মাইমুনার আসার টাইম হইছে। হ্যায় দ্যাখলে কী কইবে!
–রাখো তুমার মাইমুনা। সে যার সাদি করা বৌ হ্যায় কি অরে ছাইড়া দেয়!
এইসময় সিরাজ সাহেবের গলা খাকারি শোনা গেলে সাবির রাবিনাকে ফিসফিসিয়ে বলতে থাকে,
–হাতে পায়ে বড় বেথা রে বৌ। মোটর সাইকেল চড়ার ইসসা হয় না আর। তুমাকে দিয়া যে এট্টু টেপাটিপি করাব সে উপায়ও নাই।
সাবিরের প্রাইমারি স্কুল প্রায় পনের কিলোমিটার দুরের এক গ্রামে। মুজনাই নামে এক নদী পড়ে যাবার পথে। এমনিতে পায়ের পাতার ওপর দিয়ে তিরতিরে বয়, কিন্তু বর্ষাকালে যুবতীর ভরন্ত শরীরের মতো কুহকী। খালি ডোবাতে চায়। সে এক গভীর বনস্থলীর ভেতরকার নদী, দুপাশে ঘন অরণ্য। বর্ষাকালে এপাশের মোটা গাছ বেড় দেওয়া হাতিশুঁড়ের ভারী লতা অনেক ফেরতা দিয়ে কম উচ্চতায় ওপাশের গাছে জড়ানো থাকে। বেকায়দা ভেসে যাবার কালে কেউ যেন ধরে ফেলতে পারে। ফ্ল্যাশ ফ্লাডের পানি কমলে তবে প্যান্ট গুটিয়ে বাইক ঠেলে বর্ষার দিনগুলিতে মুজনাইকে পেরোনো। ফলে সাবির হাতে পায়ে ব্যথার কথা বললে বিশ্বাস করাই জায়েজ। এছাড়া আছে হাতির উপদ্রব। বাস্তবে কখনও না গেলেও সাবিরের বাইকের পেছনে বসে কল্পনায় কতবার সে রাস্তায় পারাপার করেছে রাবিনা। দেখেছে কালচে সবুজ চা বাগানের নাতিউচ্চতা থেকে নেমে আসছে হাতির দল। বিশাল সাদা দুধেল দাঁতের দেখানো পথে বাচ্চা আগলে মা, দাইমা, অল্পবয়েসীরা। চলার তালে তালে তাদের মাথা নড়ে, চা বাগানের ছেলেরা তাড়া করলে পাকানো শক্ত লেজ তুলে ভয় পাওয়া গলায় অদ্ভুত ক্ক ক্ক শব্দ করতে থাকে। মনে হয় যেন অজানা কোনও অতিকায় কিন্তু অসহায় পাখির ডাক। লাল নেইলপালিশ লাগানো নখ ততক্ষণ গেঁথে গেছে সাবিরের সার্টের কাঁধে, কানের কাছে মুখ নিয়ে আতঙ্কে ফিসফিস করে রাবিনা বলেছে,
–জোরে চালায়েন সাহেব। আসল বইলা।
এইরকম দিবাস্বপন দেখা মেয়ে রাবিনা গত পরশু সকালে সাবিরকে টা টা করে বাগানের বাখারির দরজায় অনেকক্ষণ ঝুকান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সিরাজ সাহেব যেদিন মীমাংসা বা অন্য কাজে আশেপাশের গ্রামে গিয়ে রাত্রিবাস করতে বাধ্য হন সেইদিন তারও কাজ অনেক কম থাকে। সাবির স্কুলে বেরিয়ে গেলে সারাদিন চলে রাবিনার অলস প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ, বাগানের গাছগুলির পরিচর্যা। এই রাস্তায় ঘুরপথ হয় বলে বাড়ির সামনে লোক চলাচলও খুব কম। ওপাশের বড় পুকুরে হাজার লাল শাপলা ফুটেছে, প্রচুর মৌমাছি, ফড়িংয়ের ওড়াউড়ি, সে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিল কে জানে! মাইমুনার ডাকে হুঁশ ফিরে পেয়ে রাবিনা যখন বাগানের মাঝামাঝি তখন কাঁঠাল গাছের নীচে, ডাঁই করা শুকনো পাতায় সে খসখস আওয়াজ পায়। হবে দিনমানে পথ হারানো মোটা চিকা, কিন্তু চিকা তো আর মানুষের দিকে বিনা কারণে আগায় না!
একটা কিছু তার দিকে নির্ভুল এগোচ্ছিল এটা সে দূর থেকেও বুঝতে পারে, ছোট কোনও প্রাণী, মন্থর চলন, পিছনে কি ছোট একখান লেজ নড়ে তুরতুর তুরতুর? রাবিনা দ্রুত পায়ে এগোয় আর মাটির দিকে ঝুঁকে পড়ার দু সেকেন্ড পর তার কোলে উঠে আসে একটি মোটাসোটা কুকুরের বাচ্চা, একটি পায়ে জোর কম। কিন্তু লাল টুকটুকে জিভ দিয়ে সে চাটতে থেকে রাবিনার আঙুল। সুড়সুড়ি লাগছে বলে হাসতে হাসতে তাকে লম্বালম্বি কাঁধে ফেললে শুরু হয় কাঁধচাটা। বিব্রত রাবিনা গলা ছেড়ে চেঁচায়,
–মাইমুনাদিদি গ্যালা কই? দ্যাখো আমি কী কুড়ায়ে পালাম।
মোটা শরীরে ছুটে এসে হাঁপায় মাইমুনা, তারপর গম্ভীর হয়ে যায়,
–কুত্তার বাসসা নাপাক। তুমার শউর ফিরার আগেই এইডারে তাড়ায়ে দিও বৌ।
নাপাক!!!
আকাশ থেকে পড়ে রাবিনা। কে কইল এই পাকা বুড়িডারে! সে তো আব্বাঘরে কখখুনো শোনে নাই এমন কুনো ফতোয়া। তাইলে তাগো পাড়ায় এত কুত্তা ভোখে কেমন কইরা। তারে না কইছে মৌলবীসাহেব, তার গৃহশিক্ষক, না কইছে গার্লস স্কুলের দিদিমণিরা। মাইমুনা কুথাকার পন্ডিতানী যে কুরাণহাদিশি সব পইড়া ফ্যালাইছে!
যদিও বছর ঘুরতে চলল, তবু এই সংসারে তার শেকড় ছড়ায়নি, আঁচলে চাবিও ওঠেনি, সাবিরের ভালোবাসা আর দৈহিক আকর্ষণ ছাড়া এখনও সে কিছুদিনের জন্য বেড়াতে আসা সাগাই বা অতিথির মতোই, এই সত্য বিস্মৃত হয়ে সে মাইমুনাকে জোরগলায় বলে,
–কইসে তুমারে! আহারে, শিয়ালের খ্যাদা খাইয়া আইসা ঢুকছে মনে লয়। এইডারে আমি পুষুম। যাও পাকঘরে, দুধ নিয়া আসো। খিদা পাইছে বাচ্চাডার। চাইট্টা চাইট্টা আর কিছু বাকি রাখতাছে না।
পেটমোটা বাচ্চাটা যখন শান্ত হয়ে ঝুড়ির তলায় ঘুমাচ্ছে তখন পুকুরের ওপাশে সাবিরের বাইকের আওয়াজ পায় রাবিনা। উত্তেজনায় গেটে ছুটে যায় সে, সাবিরের বাইক প্রায় কাত হয়ে পড়ে আর কি।
–দেইখা যাও, আমার টিটুরে। আমি অর নাম রাখসি টিটু।
–আরে আরে অত টাননের কী আসে। আমি তো তুমার লগে এমনিই যাইতাসি।
বাচ্চাটা যদিও হাঁচড়ে পাঁচড়ে তার গায়ে উঠতে চাইছিল, তবু সাবির ওটাকে দেখে খুব গম্ভীর হয়ে যায়। তার মনে পড়ে যায় কমাস আগে দশ কিলোমিটার দূরের সীমান্তের ওপার থেকে পাসপোর্ট ভিসা নিয়ে এপারে আসা এক নামকরা হুজুরের ওয়াজ মেহফিলের কথা। মাইকের সামনে হুজুরের কতরকম বিধান দান! বাপের হুকুমে তার পিছু পিছু গিয়ে ফরাসে বসে পড়ে সে, সিরাজসাহেবকে মহা সমাদরে একদল লোক মঞ্চের ওপর উঠিয়ে নেয়।
মাঝবয়েসী হুজুর মাঝে মাঝে গান গেয়ে, চমৎকার ভঙ্গিতে অনেক উপদেশ দিচ্ছিলেন যেগুলো মেনে চললে কপালে জন্নতনাচা ধার্মিক মুসলমান হওয়া যাবে। যেমন কুকুর পোষা।
আজকাল শহুরে ঢং হয়েছে কুকুরের মুখে চুমা খাওয়া।
সুন্দর সুন্দর নারীরা শুদু চুমা দিয়া ক্ষান্ত হয় না, কুত্তার গলায় চেন লাগাইয়া কত ভঙ্গি কইরা হাইটা যাসসে— হুজুর এই জায়গাটা সুর লাগিয়ে গান করেন। শোনায় যেন হাইটাআআআ যাসসেএএএএ।
শুদু তো হাঁটা নয়, এই নারীরা পর্দা রাখেন না। বেপর্দা নারীরা খসমের চাইতে কুত্তা বেশি ভালোবাসেন। এই নারীরা ঘরে থাকলে জান্নাতের পথ চিরকালের জন্য বন্ধ। কুত্তা থাকলেও তাইইইই।
এইখানে দুইহাতে হুজুর এমন ভঙ্গি করেন যে সমবেত সবাই বুঝে যায় নারী পর্দার বাইরে থাকলে আর কুকুর পুষলে জান্নাতের পথ খুলবার আর কোনও সম্ভাবনাই নেই।
এইবার গান বন্ধ হয়ে আবার অনর্গল কথা শুরু।
ভাইবেন না আপনেরা, বর্ণনাকারীর মুখ থিকা শুনা হইছে বইলা এই হাদিশ কমজুরি।
এই কথা মনে আসলে আপনি যাইবেন সিধাআআআ দোজখে।
কই যাইবেন ভাইসাহেব ?
মেহফিলের সবাই সমস্বরে ধুয়া ধরে,
–দোজখে।
মোটাসোটা মানুষটির মুখের হাসি চওড়া হয়, আট আঙুলে আট রকম আংটিপরা ফুলো হাত মাইকের সামনে নেড়েচেড়ে তিনি বলতে থাকেন,
একদা সুফিয়ান ইবনু আবু জুহায়ির মসজিদের দরজায় মানুষের নিকট হাদিশ বয়ান করতেসিলেন। তিনি বলেন, ভাইসকল, আমি রাসুলুল্লাহের, সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, নিকট শ্রবণ করেসি যদি কুনো ব্যক্তি কুকুর পালে, তা পালবে খেত খামার ছাগল হেপাজেতের জইন্য। তা বাদে যদি ঐ চুমা দিবার জইন্য পোষে তাইলে তার নেক আমল থিকে প্রতিদিন এক কীরাত পরিমাণ নেক কমতে থাকবে। এক কীরাত মানে এক উবুদ পাহাড় সমান। বোঝলেন তো?
তাইলে কয় কীরাত কমবে ভাইসব?
–এক কীরাত, হজুর।
–রোজ এক কীরাত কমতে থাকলে খুব শিগগির তা শূন্য হয়ে যাবে এইটা বুঝেন তো আপনেরা, নাকি বুঝেন না?
মেহফিল জোরসোরে বলে,
–বুজি বুজি খুউব বুজি।
–যে আবাসে ছবি থাকে আর এই নাপাক পশু থাকে সেইখানে ফেরেশতারা প্রবেশ করেন না।
হুঙ্কার দেন হুজুর। বোধহয় কথাটা মেহফিলে সবার মাথায় ভালোমতো ঢোকাবার জন্যই।
এইসব মনে পড়তে সাবির সেই যে চুপ মেরেছে আর মুখ খোলে না সারা রাত। যতই রাবিনা টুয়েলভ পাস করা ইতিহাসের বিদ্যায় স্বামীকে বোঝাতে যাক আরবেরা ছিল পশুপালকের জাত, কুকুর তাদের কাছে সম্পদ ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না, যতই সে উদাহরণ দিক গিয়াসুদ্দিন তুঘলকের সমাধির, যেখানে মূল সমাধি গৃহের বাইরে মার্বেলের নিরাভরণ কবরে শায়িত আছে বাদশাহের আদরের কুকুর, ততই মুখ গোঁজ করে বসে থাকে সাবির। সেটা কতটা ওয়াজ শোনার ফল, আর কতটা বাপের ভয়ে তা বুঝতে পারে না রাবিনা, কিন্তু এই প্রথম সাবিরের ওপর তার রাগ হতে থাকে। অবুঝ গোঁয়ার একটা।
মায়াহীন নিষ্ঠুর পুরুষ মেয়েদের দুচোখের বিষ। বিয়ের একবছরের মাথায় স্বামীর মধ্যে নিজের আব্বার গাঢ় ছায়া রাবিনার চোখে জল এনে দেয়। মাঝরাতে উঠে তাকে রান্নাঘরে ঢুকতে হবে, তাই কথা না বাড়িয়ে সে শুয়ে পড়ে। শোবার আগে টিটুকে প্লাস্টিক কৌটোর ঢাকনায় দুধ খাওয়াতে ভোলে না। হাঁটু মুড়ে ঝাঁপ চাপা দিতে গিয়ে হঠাত চাঁদনির কথা মনে পড়ে যায় রাবিনার। পুকুরের পাড়ে ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে দেখেছিল কীভাবে শিন্টুমামা দক্ষ হাতে পশুটাকে চিত করে ফেলে।
টিটুর জন্য মস্ত ছুরি নেই, কিন্তু শেয়ালের দাঁত আছে। ঘুমন্ত রাবিনা স্বপ্নের মধ্যে উঁ উঁ আওয়াজ করে পুকুরপাড়ের শেয়াল তাড়ায়। অবশ দুহাত তুলতে গিয়ে বালিশ থেকে তার মাথা গড়িয়ে পড়ে যায়।
মুয়াজ্জিনরা ফজরের নমাজের ডাক দেবার আগেই রান্নাঘরের দরজার সামনে সাবিরের ছায়া পড়ে।
–খাওয়া হইসে?
রাবিনা কথার উত্তর দেয় না। তার আলুথালু চুল, ফোলা চোখ মনখারাপের কথা বলতে থাকে।
–মাইমুনা আইলে অরে চাবি দিয়া চল বাইরিয়া পড়ি।
–কই যাব?
–টিটুরে একটা ভালো জায়গায় রাইখা আসি।
–তুমার দেখি খুব চিন্তা!
–ক্যান আমারে দেইখা অমানুষ মনে হয় নাকি? চল তরে আমার ইস্কুলও দেখাই। আব্বা তো কবেই পারমিশন দিয়া রাখসে।
রাবিনা এই প্রথম মেঝে থেকে চোখ তোলে। সাবিরের মুখ ফোলা ফোলা। যেন সারা রাত সেও ঘুমায়নি। চোখের তারা চঞ্চল। আব্বাহুজুর বাড়ি ফেরার আগেই নিজেকে রাবিনার কাছে প্রমাণ করবার তাগিদে সে অস্থির হয়ে রয়েছে যেন। নাকি নিজের কাছেই নিজেকে প্রমাণ করবার তাগিদ! তবে কি তার বোঝার ভুল হল! রাবিনা ভাবে। এক নাপাক পশুর দরদে রোজাক্লান্ত শরীরে দুজনেই কি সারারাত জেগে কাটাল তারা!
ভোরের ঠান্ডা হাওয়া কেটে তীব্রগতিতে বাইকটি যাচ্ছিল মুজনাই নদীর দিকে। মেঘ ফাটিয়ে, গাছপালার আড়াল আবডাল থেকে উদিত সূর্যের যেটুকু আলো এসে পড়ে তার ধাতব শরীরে, তাতেই খুব উজ্জ্বল দেখায় ধাবমান যানটিকে। পেছনে বসে রাবিনা ভাবে যেন ভোরবেলায় দেখা সেই উজ্জ্বল তারাটির সওয়ার তারা। গন্তব্য সাবিরের স্কুলের কাছে আদিবাসী বস্তি। সেখানে চায়ের দোকান চালায় দয়ামণি ওঁরাও, পনেরটি কুকুর তার পেছন পেছন ঘোরে সবসময়। টিটু আপাতত থাকুক তার কাছে, বড় হলে, শেয়ালের সঙ্গে লড়তে পারলে সাবির আবার তাকে ফিরিয়ে আনবে শিয়াখালায়। এর মধ্যে সে কোরান ঘেঁটে সেই কাহিনীটি নিয়ে আলোচনা করবে আব্বাহুজুরের সঙ্গে, যেখানে বলা আছে নিজের মোজায় ভরে মৃতপ্রায় একটি কুকুরকে জল খাইয়ে সুস্থ করেছিল বলে একটি ভ্রষ্টা মেয়ের অতীতের সব পাপ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন পরম করুণাময়। আব্বারা সব আগের দিনের লোক, তাদের সঙ্গে লড়ে কী হবে। বোঝাতে হবে ভালো করে। বাইক চালাতে চালাতে মাঝে মাঝেই মাথা ঘুরিয়ে কথা বলে সাবির, তার খাড়া নাকের পাশে অবিন্যস্ত চুলের ওড়াউড়ি দেখতে দেখতে রাবিনার তাকে লাগে যেন ভোরের ফেরেশতা। ভুল বোঝাবুঝির জন্য মরমে মরে যায় সে, নিজের আব্বার সঙ্গে তুলনা করার জন্য লজ্জা হয়। তরুণ স্বামীর জন্য হঠাত ভারী গর্ব হয় তার, আস্তে নিজের থুতনি নামিয়ে আনে সাবিরের ঘাড়ের ওপর। আর এক সতর্ক হাতে ধরে থাকে কোলের ওপর ব্যাগের ভেতরে রাখা টিটুকে। যেন তার জাহানের দুইটি টুকরা।
রাবিনা বোধহয় ঠিকই ভেবেছিল, কারণ ভোরের আবছা নির্জন রাস্তায় দুই তরুণ তরুণীকে নিয়ে ছুটে চলা যানটির অবয়ব যেন সত্যিই দূরের নক্ষত্রের মতোই উজ্জ্বল আর একরোখা।