Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

শৌনক দত্ত ওরফে বুবাই

সায়ন্তনী বসু চৌধুরী

 

আজ সেপ্টেম্বরের শেষ দিন। অন্ধকার ক্রমশ ঘন হয়ে আসছে। সকাল সন্ধে হলঘরের বড় জানালা থেকে আমি যে আকাশটাকে দেখি তার রং এখন রক্তের মতো লালাভ। সরকারপাড়ার আকাশটাকে এখন আর আমার পরিচিত বলে মনে হচ্ছে না। একটু আগেই থানা থেকে ফোনটা এসেছিল।

–হ্যালো! মিস্টার দত্ত কথা বলছেন?
–হ্যাঁ, বলছি।
–বাইপাস থেকে একটা বডি এসেছে কাল রাতে। আমরা সন্দেহ করছি আপনার……

ইন্সপেক্টরের পরের কথাগুলো আমি আর শুনতে পাইনি। না কি শুনতে চাইনি? কার্যকারণ বিশ্লেষণ করে বলতে পারব না। ঘরের মেঝেতে শুয়ে থাকা শান্ত ধুলোর কণারা পাক খেতে খেতে আচমকাই একটা অভ্যন্তরীণ ঝড় হয়ে উঠেছিল আর শুকনো পাতার মতো ভাসতে ভাসতে কথাগুলো টেলিফোনের টেবিলটা ছাড়িয়ে অনেকটা পথ পেরিয়ে গিয়েছিল। আমিও তাদের ধরার চেষ্টা করিনি। পুপুর কান্নায় আমার কানদুটো তখন একেবারে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। বুবাইয়ের কিনে দেওয়া ছাপা শাড়ির আঁচলটা মুখে চাপা দিয়ে পুপু ফোঁপাচ্ছিল। আমার পাশেই দাঁড়িয়েছিল ও। ওর দিকে তাকিয়ে নিজেকে একটা আস্ত অপদার্থ বলে মনে হচ্ছিল আমার। গত কটা বছরে পুপুর চেহারাটা যে হারে ভেঙে গেছে তার জন্য কি আমি দায়ী নই? অবশ্যই দায়ী। আজ আমার অদ্ভুত একটা গিল্টি ফিলিং হচ্ছে। অথচ আগে তো কখনও এমন হয়নি। বুবাইটা চোখের সামনে ছিল বলেই কি হয়নি? জানি না।

পুপুর মুখটা থমথমে। বেরোনোর আগে ঘরের কাপড়টাও বদলাতে চাইল না। আমরা এখন বডি শনাক্ত করতে যাচ্ছি। আমাদের ছেলের বডি। পরশুর আগের দিন থেকে ছেলে বাড়ি ফেরেনি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাতছানি দিয়ে আমি একটা ট্যাক্সি ডেকে নিয়েছি। পুপু আমার কাঁধে মাথা রেখে চোখদুটো বন্ধ করে আছে। আমি জানি ও জেগেই আছে। কিন্তু ভীষণ ক্লান্ত। পরশু রাত থেকে বেচারি কিছু খায়নি। না খেয়ে থাকলে পুপুর শরীর খারাপ হয়ে যায়। আমি চোখ বুজতে পারছি না। চোখের পাতা এক হলেই বুবাইয়ের মুখটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এখন শীতকাল নয়। তবুও আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, জমাটবাঁধা কুয়াশা আমাদের ট্যাক্সিটাকে ধাওয়া করে আসছে। কেন জানি না মনে হল কুয়াশা যদি আমাদের ধরে ফেলে তাহলে আর ফেরার উপায় থাকবে না। একবার একটা ইংরিজি সিনেমাতে দেখেছিলাম, একটা আস্ত পরিবার জনমানবশূন্য নির্জন ভ্যালিতে বেড়াতে গিয়ে ঘন কুয়াশাতেই হারিয়ে গেল। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও বাবা মা আর ছেলে একে অন্যকে খুঁজে পেল না। ভ্যালিটার ভেতরে ঘুরে ঘুরেই ওরা তিনজন হয়রান হল শুধু। আমাদের বুবাইটা তখন বেশ ছোট। ইম্ম্যাচিওর। সিনেমাটা দেখে ও খুব কেঁদেছিল। ছেলেটা সেদিন আমার আর পুপুর মাঝখানে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। বুবাই বোধহয় আমাদের হারিয়ে ফেলার ভয় পেত। চশমাটা খুলে নিয়ে হাঃ হাঃ করে বুকের গরম ভাপ বের করে কাঁচ দুটো জামার হাতায় মুছে নিলাম আমি। আমি আজ বড্ড আকাশকুসুম কথা ভাবছি। এই সময় কুয়াশা হতে যাবে কেন? অবশ্য বৃষ্টি হতে পারে।

–ড্রাইভার ভাই, বৃষ্টি পড়ছে নাকি?
–নহি তো সাহেব। আজ মৌসম বড়া সুহানা হ্যায়। গরমি ভি কাফি কম হ্যায়।

চুপ করে গেলাম। তাহলে হয়তো আমার মনের ভুল। নিজেকে বোঝালাম, হয়তো বৃষ্টি আমার মনের ভেতরে ঝরছে তাই চারদিকটা এরকম ঘষা ঘষা ঝাপসা লাগছে। কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে পুপু। নিশ্বাসের তালে তালে ওর অপ্রশস্ত পিঠটা ওঠানামা করছে। ঘুমোলে পুপুকে এখনও বেশ সুন্দর লাগে। আমাদের ছেলেকেও লাগত। বুবাই ঘুমোলে মনে হত কোনও দেবশিশু ঘুমোচ্ছে। এই তো পঁচিশ বছর আগেও ছেলেটা ঘুমোলে দোলনার পাশে বসে আমি হাঁ করে ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকতাম। আমার মা বলতেন,

–আহ্ বড় খোকা! এইভাবে হাঁ করে ঘুমন্ত বাচ্চাকে দেখতে নেই রে। জানিস না, বাপ মায়ের নজর বড্ড তাড়াতাড়ি লেগে যায়।

ছেলে ঘুম থেকে উঠলে বিজোড় সংখ্যায় শুকনো লঙ্কা এনে ওর গায়ে বুলিয়ে দিতেন আমার মা। সেগুলো উনুনের আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হত। রান্নাঘরের চার দেওয়ালের ভেতরে চিড়বিড় করে লাল লঙ্কা পুড়ত আর বাড়িশুদ্ধু সকলে হেঁচে কেশে মরত। আমার ভারি মজা হত। মা বেঁচে থাকলে আজ বাড়িটা মাথায় করে তুলত। আচ্ছা, বুবাইয়ের জন্ম থেকে আজ অবধি এই ছাব্বিশটা বছরে আমি ওকে কতবার নজর দিয়েছি? হিসেব নেই। তবে কি আমার নজরের দোষেই আজ…

যেদিন পুপু আমার জীবনে এসেছিল, মনে হয়েছিল ভাঙা মন্দিরে কেউ একজন সজোরে ঘণ্টা বাজাচ্ছে। আনন্দে আমি সারারাত জেগেছিলাম। পুপুকে মুখ ফুটে মনের কথা বলতে গিয়ে মনে হয়েছিল, আরও একবার হাত পা ছুড়ে মায়ের গর্ভ থেকে যুদ্ধ করে বাইরের আলোয় বেরোতে হচ্ছে আমাকে। কিন্তু বুবাই যেদিন এসেছিল সেদিন আমি ঠান্ডা বরফের মতো শান্ত হয়ে ছিলাম। আমার বড্ড ভয় করছিল। আসন্ন দিনগুলোর কথা ভেবে আমি বারবার ঘেমে যাচ্ছিলাম। সেই প্রথম দিনই বুবাইকে আমরা হারিয়ে ফেলতে ফেলতেও পেয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার বলেছিলেন,

–আপনিই তো হাজব্যান্ড? আপনাকেই বেছে নিতে হবে। আইদার মাদার অর বেবি। তাড়াতাড়ি করুন, সময় কম।

পুপুর বাবা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিলেন। আমার মায়ের সবেতেই তাড়া দেওয়া স্বভাব ছিল।

–কিরে বড় খোকা? এত ভাবছিস কী? বলে দে না আমরা বৌমাকেই চাই।

হাসপাতালের কাগজে কলমে আমি পুপুকেই বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু সত্যি বলতে কী আমি আমাদের সন্তানকেও হারাতে চাইনি। আমার মনটা বিদ্রোহ করে কেঁদেছিল। প্রায় আড়াই ঘণ্টা সময় লেগেছিল ওঁদের। ওটির আলো নিভে যেতেই আমার মন বলেছিল আমি তাকে হারাইনি। কাঁচের বাক্সের বাইরে দাঁড়িয়ে আমি বুবাইকে দেখেছিলাম। ওকে ছুঁতে যে কী ইচ্ছে করছিল আমার!

আজ আমি আবার বুবাইকে দেখতে যাচ্ছি। সেবার আমাদের পরিবারের সকলে ছিলেন। এবার সবাই অচেনা।  আমি কোনওদিন মর্গে যাইনি। কাউকে শনাক্ত করতে আমাকে কোনওদিন ডেকে পাঠানো হয়নি। আমার তেমন কোনও আপনজন এইভাবে হারিয়ে যায়নি কোনওদিন। জীবনে এই প্রথমবার আমি কারও ডাকে নিজের ছেলেকে চেনাতে যাচ্ছি। না কী নিজেই চিনে নিতে যাচ্ছি নিজের আত্মজকে! আচ্ছা, বুবাইকে আমি চিনতে পারব তো?

একটু আগে পারিজাত ফোন করেছিল। পারিজাত বুবাইয়ের গার্লফ্রেন্ড। কলেজের সময় থেকেই ওরা একে অন্যকে ভালোবাসে। আমরা জানতাম। বুবাই আমাদের কাছে কোনও কথাই লুকোয়নি। মেয়েটা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করছিল,

–কাকিমা ঠিক আছেন তো কাকু? একঘণ্টার মধ্যে আমি আসছি।
–বেশ। সাবধানে এসো।
–টেক কেয়ার কাকু।

পারিজাত! নামটা বড্ড সুন্দর। মেয়েটাও বড় মিষ্টি। স্বর্গের ফুলের মতোই। আমাদের সন্তান পৃথিবীতে আসার আগে পুপুর বড্ড মেয়ের শখ ছিল। আমার হঠাৎই মনে হল বুবাই হারিয়ে গেলে এই মেয়েটা কি আর আমাদের মনে রাখবে? হয়তো না। হয়তো…

 

***

প্লাস্টিকে মোড়া আকাশী রঙের লিনেনের শার্টের হাতার খানিকটা অংশ দেখে পুপু চেঁচিয়ে উঠল। আকাশী নীলের ওপর রক্তের দাগ লেগে আছে।

–বুবাইয়ের শার্ট। এটা আমার বুবাইয়েরই শার্ট। গেলবার পুজোয় ছেলেটা কিনেছিল।
–শার্ট দেখেই তুমি নিশ্চিত হচ্ছো কী করে? জামাকাপড় তো আর একটাই ম্যানুফ্যাকচার হয় না! হয়তো একই ব্র্যান্ডের একই রঙের শার্ট।

জামার হাতায় লেগে থাকা সাদা রঙের প্লাস্টিকের বোতামটা দেখিয়ে পুপু বলল,

–সাদা সুতো ছিল না বলে সেদিন আমি কালো দিয়ে টেঁকে দিয়েছিলাম। এটাও কি আমি চিনতে পারব না? মায়ের চোখ কি এত ভুল করবে?

উত্তর দিলাম না। কিন্তু আমার মন বলছে, এটা আমাদের বুবাইয়ের শার্ট নয়। আমার আত্মজ শৌনক দত্তর ছোঁয়া এ কাপড়ে লেগে নেই। আমি জোর করেই আমার স্ত্রীয়ের চিন্তার ওপরে আমার মত আরোপ করে দিচ্ছি। কিন্তু কুয়াশার মতো ভয় ভেতর থেকে আমাকে ক্রমাগত আঁকড়ে ধরছে। ভয়ঙ্কর ময়াল সাপের মতো পায়ের দিক থেকে পেঁচিয়ে ধরে ভয়টা আমার বুকের দিকে উঠে আসছে একটু একটু করে। ঠিক যেমন বুবাইয়ের অ্যাডমিশন টেস্টের দিন হয়েছিল। ওর মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্টের দিনে হয়েছিল। ওর ম্যানেজমেন্টের শেষ পরীক্ষার দিনে, ওদের ক্যাম্পাসিং-এর দিনে আমার হয়েছিল, আজ অবিকল তেমনই হচ্ছে। আমার ছেলে আর স্ত্রীয়ের হিম্মত বাড়িয়ে গিয়েছিলাম আমি একা; কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমার নিজের যে কী হয়েছিল সে কেবল আমিই জানি। আমার ছেলের প্রত্যেকটা কঠিন দিনে একসঙ্গে একশোটা শকুন আমার হৃদপিণ্ডটা ঠুকরে ঠুকরে খেত। আমি প্রকাশ্যে ওদের কাউকে দেখাতাম না সে যন্ত্রণা। আজও দেখাব না। আমি মাথা উঁচু করে পুপুর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বারবার ধমকে ওকে থামিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু সাদা চাদরটা সরে গেলে যদি বুবাইয়ের মুখটা বেরিয়ে আসে…! আমার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল।

ইন্সপেক্টর আমাদের সঙ্গেই আছে। আমাকে সাহস যোগাচ্ছে। পুপুর সঙ্গে কথা বলার সাহস ওর নেই। ছেলেটার বয়সও খুব বেশি নয়। ছত্রিশ সাঁইত্রিশ হবে। হয়তো পুপুর মনের ভেতরকার ভাংচুরটা সে আন্দাজ করতে পারছে। আড়ে আড়ে বারবার পুপুর দিকে তাকাচ্ছে।

 

***

মর্গ। একটা বিরাট বড় ঠান্ডা ঘর। দরজা ঠেলে খুলে দিল হাল্কা নীল রঙের হাফহাতা জামা পরা একটা কমবয়সী ছেলে। ওরাই এই ঘরের ডিউটিতে থাকে। বোধহয় ডোম। বডির পাহারাদার। ছেলেবেলায় বুবাই ঘুমোলে আমি ওকে পাহারা দিতাম। হতচ্ছাড়া মশাগুলো মশারির মধ্যেও সেঁধিয়ে আমার ছেলেটার ঘুম ভাঙিয়ে দিত। ছেলের হাতে পায়ে গায়ে গালে লাল লাল র‍্যাশ হয়ে থাকত। সকলে বলত বুবাইয়ের রক্ত বড্ড মিঠে। রাতে একবার উঠে পড়লে ছেলে আর ঘুমোতে চাইত না। পুপুর বড্ড ঝঞ্ঝাট হত। আমি তাই ছেলের পাহারদার সাজতাম। ওকে কাঁধে ফেলে বারান্দায়, বসার ঘরে পায়চারি করতাম। গুনগুন করে গান গাইতাম। ওকে নিয়ে বসে থাকতে থাকতে কত রাত যে আমার বিনা ঘুমেই কেটে গেছে তার হিসেব তো করিনি কোনওদিন!

ঘরটায় ঢুকতেই ওষুধের উগ্র গন্ধওয়ালা কনকনে ঠান্ডা বাতাস আমার গায়ে এসে লাগল। মনে হল আমার ছেলে শৌনক ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরছে।

–বাবা, এত দেরি করলে কেন বলো তো? সেই কখন থেকে ছোট্ট টেবিলটায় শুয়ে আছি আমি! একটু জলদি আসতে পারলে না? উফ! শুয়ে শুয়ে ঘাড় পিঠ টনটনিয়ে উঠেছে আমার!

সারি সারি স্টিলের টেবিল। আচ্ছা, প্রতিটাতেই কি কারও না কারও ছেলে ঘুমিয়ে আছে? সাদা কাপড়ে আচ্ছাদিত শান্তির ঘুমই কি তাদের উপহার? নীল জামা পরা ছেলেটা কি আসলে ঘুমের পাহারাদার? কাজের চাপে আমার বুবাই কত রাত ঘুমোতে পারেনি। শুধু কাজ কেন? তার আগে, পড়াশোনার চাপেও তো ও রাত জাগত। বাবা হিসেবে আমি কি ওকে খুব চাপ দিয়েছি? আরও একটু নরম হলে কি আমি বেশি ভালো বাবা হতাম? জানি না। জানি না। কিন্তু এখন এসব ভাবছি কেন আমি? কী লাভ এসব ভেবে? আমার মাথাটা আর কাজ করছে না। বুবাই আছে। বুবাই আছে। নিজেকে এতক্ষণ একটানা বোঝাতে বোঝাতে আমি পজিটিভ চিন্তার ট্র্যাক হারিয়ে ফেলেছি। পুপু আমাকে আঁকড়ে আঁকড়ে হাঁটছে। এখন আর কাঁদছে না ও। উত্তেজনায় কেমন যেন চুপ হয়ে গেছে। আর পারিজাত! সামনের নভেম্বরে বুবাইয়ের সঙ্গে ওর বিয়ের তারিখ। মেয়েটার মুখের দিকে তাকানোর সাহস আমার নেই। আমি শুধু আবছা দেখেছি মেয়েটা এসেছে।

–বাইক অ্যাক্সিডেন্টের বডিটা কত নম্বর টেবিলে?
–চৌত্রিশ নম্বর স্যার।

ছ’ফুট লম্বা একটা নির্মেদ শরীর। টানটান, দৃঢ়। আমাদের বুবাই জিমে যেত। বুবাই আর আমার উচ্চতা প্রায় এক। উনিশ আর বিশের ফারাক আছে। ছেলে বলত বাপ লম্বা। আর আমি বলতাম ছেলে লম্বা। ইন্সপেক্টর ছেলেটা আমার কাঁধে হাত রাখল।

–নিজেকে সামলান মিস্টার দত্ত। কাজটা করতেই হবে।

সাদা ধবধবে কাপড়টা এবার সরে যাবে। এইবার…। হঠাৎ মনে হল, সাদা আচ্ছাদনের নীচে স্টিলের টেবিলের ওপর টানটান হয়ে শুয়ে আছি আমি। অভিরূপ দত্ত। আমার বডি শনাক্ত করতে এসেছেন মিসেস পুপু দত্ত আর ছেলে শৌনক দত্ত। ছেলে মাকে শক্ত করে আঁকড়ে রেখেছে নিজের বুকে। বারবার বলছে,

–বাবার বডি নয় এটা। আমার মন বলছে। তুমি দেখো মা। মিলিয়ে নিও।

আমি শুয়ে শুয়ে হাসছি। ওদের কথা শুনছি। আমার জন্য পুপু খুব কাঁদছে। বুবাই ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। এরই মধ্যে সাদা চাদরের আবরণ সত্যি সত্যিই সরে গেছে কখন, আমি টের পাইনি। আমাকে জড়িয়ে ধরেছে পারিজাত।

–শৌনক নয় কাকু, আমাদের শৌনক নয়।

বডিটা আমি দেখিনি, আমার চোখের দৃষ্টিকে আমি আবছা করে নিতে পারি। কেমন যেন লাল নীল সবুজের আবছা একটা আবরণ তৈরি করে চোখের সামনেটা বিলকুল ঢেকে দিতে পারি। ঠিক যেমন করেছিলাম ছেলের রেজাল্ট দেখার সময়। পুপুকে প্রথমবার প্রেম নিবেদন করার সময়। পুপুর সি-সেকশন অপারেশন সেরে ডাক্তার যখন বেরিয়ে আসছিলেন, সেই সময়ে। পুপু বলল,

–যার ছেলেই হোক, বাবা মায়ের সঙ্গে যেনো শেষ দেখাটুকু হয়। হে ঈশ্বর দয়া করো! অনেক পরীক্ষা নিয়েছ আমার। এইবার ছেলেকে সুস্থভাবে ফিরিয়ে দাও আমার কাছে।

মর্গের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে। নরকের ঠান্ডা আবহ ছেড়ে আমরা বাইরে বেরিয়ে এসেছি। পুপু আর পারিজাত অনেক হাল্কা এখন। ওদের বিশ্বাস বুবাই ফিরে আসবে। হয়তো আর কদিন পর, কিংবা ক’মাস পর। ইন্সপেক্টর আরও কী কী বলে যাচ্ছেন। আমি কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছি না। হ্যাঁ, শুনতে চাইছি না বলেই পাচ্ছি না। এবার অবশ্য কারণটা আমার কাছে পরিষ্কার। আমি ওদের কারও সাথে নেই, অথচ ওদের সঙ্গে সঙ্গেই হাঁটছি আমি। একটা চেক চেক শার্ট আর প্যান্ট পরা আমি, অভিরূপ দত্ত, এখন সেই সিনেমায় দেখা নির্জন ভ্যালিটায় ঢুকছি। কুয়াশা… বাপরে কী ঘন কুয়াশা জমেছে চারিদিকে! আমি জানি না কেন এইখানে এলাম। কখন এলাম। পারিজাতের ছেঁড়া ছেঁড়া কথা আমার কানে আসছে।

–চাদরটা যখন সরাচ্ছিল, আমার দম আটকে আসছিল কাকিমা। আমার মন বলছে, শৌনক ঠিক আছে। আমাদের এত প্রার্থনা বিফল হবে না দেখো তুমি।

পারিজাতের মা বাবা পুপুকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। ঈশ্বরকে স্মরণ করছেন। আমি ওদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। আমার চোখে, কানে, সমস্ত ইন্দ্রিয়ে এখন কুয়াশার ঘন আস্তরণ! কুয়াশা আমাকে গ্রাস করেছে। লোকের গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে আমি ছুটছি। সেই সিনেমাটায় দেখেছিলাম যুবক বাবাটা দু’হাতে কুয়াশা সরিয়ে সরিয়ে ছেলেকে খুঁজছে। আমিও তাই করছি এখন। দু’হাতে, প্রাণপণে আমি ধোঁয়া ধোঁয়া ভারি বাতাস কেটে কেটে আমার বুবাইয়ের দিকে এগোনোর রাস্তা খুঁজে মরছি। এখন আর কিছুতেই আমি চোখ বন্ধ করব না। আর আমি পালাব না।

দরকার হয়, এই সাড়ে পঁয়ষট্টি বছরের ভেতো বাঙালি অভিরূপ দত্ত আস্ত একটা ইংরিজি সিনেমার শেষটাই বদলে দেবে আজ। তবুও শৌনক দত্ত ওরফে বুবাইকে আজ খুঁজে পেতেই হবে।