Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মুসাফির এ মন

নীলাঞ্জন হাজরা

 

চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের গত সংখ্যার (পয়লা অগস্ট, ২০১৯) রিজার্ভ্‌ড বগি-তে আমরা নীলাঞ্জন হাজরার দীর্ঘ ভ্রমণবৃত্তান্ত ‘মুসাফির এ মন’-এর প্রথম অংশ প্রকাশ করেছিলাম। এ-সংখ্যায় রইল সেই লেখাটির দ্বিতীয় পর্ব, আমাদের নতুন নিয়মিত বিভাগ ‘ডিসট্যান্ট সিগন্যাল’-এ। এই বিভাগে লেখাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে। -- স্টেশন মাস্টার, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম

 

মুসাফিরি ২

মেক্সিখানা

নামটা জেনে নিয়েছিলাম আগেই৷ ঠিক কী ভাবে আজ আর খেয়াল নেই, কিন্তু ওটা আমি করি প্রায় যন্ত্রবৎ৷ উত্তর সিকিমের তাজ্জব অঞ্চল প্রায় ১৮০০০ ফিট উচ্চতায় গুরুদোংমার হ্রদ দেখে ফেরার পথে যে বাঙালি গরম ভাত আর মাছের ঝোলের দাবিতে গলা ফাটান, তাঁদের দলে কোনও দিনই ভিড়তে পারিনি৷ আমার উসুল— যেখানে যাব, সেখানকারই খাব৷ তা যাই হোক না কেন৷ রসনার অভিযানের থ্রিল আর কিছুতে আছে নাকি? অবিশ্যি তার ফাঁড়া যে কেমন হতে পারে তাও হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছিলুম প্রবল ঝড়ের এক রাতে, কালিপোখরিতে, সন্দাকফুর পথে৷ আজ থেকে বছর পঁচিশ আগে৷ কিন্তু সে গপ্পো অন্যত্র৷ আজ সন্ধ্যা হতেই বেরিয়ে পড়েছি৷ ছবির মতো ছোট্ট একরত্তি শহর স্যান্টা ফে৷ কিন্তু সাতটা বাজতে না বাজতেই তা যে এমন জনহীন হয়ে পড়ে কল্পনাও করতে পারিনি৷ ভূগোলে আমি বরাবরই নিটোল গোল৷ লক্ষ্য স্যান্টা ফে-র সব থেকে জনপ্রিয় স্থানীয় খাবারের রেস্তোরাঁ— দ্য শেড৷ এ রাস্তা সে রাস্তা খুঁজে বেড়াচ্ছি৷ একটা লোক নেই যে জিজ্ঞেস করি৷ এক্কেবারে ওয়াইল্ড ওয়েস্ট ফিল্মের ক্লাইম্যাক্সের মতো জনহীন রাস্তা৷ দু’পাশে খয়েরি-কাদা রঙের বাড়ি-দোকান৷ Adobe, এই ধরনের বাড়িকেই বলবে স্থানীয় ভাষায়৷ দোকানের জানালা দিয়ে টিমটিমে আলো৷ নোটিস ঝোলানো— ক্লোজড৷ কোনও শব্দ নেই৷ মাঝে সাঝে হুস্‌হাস্ করে দু’একটা গাড়ি৷ এই বুঝি বনবন করে তর্জনীতে পিস্তল ঘোরাতে ঘোরাতে বেরিয়ে আসবে কোনও ‘বাউন্টি হান্টার’!

এমনই খুঁজতে খুঁজতে একটা গুঞ্জন কানে আসে৷ মৃদু৷ এগিয়ে যাই৷ অবশেষে নীল দরজা— মোটা মোটা হরফে লেখা— দ্য শেড৷ ঢুকেই চমক! স্যান্টা ফে নিউ মেক্সিকোর রাজধানী ঘোষিত হয় ১৬১০ সাধারণাব্দে৷ এটা ২০১০৷ কাজেই দুটো পাইন্ট গ্লাস (এক একটি গ্লাস পাক্কা ৩৭৫ এমএল!) স্ট্রেট আপ মার্গারিটা (মানে নিখাদ, বরফ বা অন্যান্য সিরাপ ছাড়া) নিলে ৪০০ বছর উপলক্ষ্যে তৈরি বিশেষ সেই পাইন্ট গ্লাসগুলির একটি আপনার৷ আমি সে রাতে দু’টি গ্লাস নিয়ে হোটেলে ফিরেছিলাম! ঠিক কী ভাবে ফিরেছিলাম জিজ্ঞেস করবেন না প্লিজ৷ তবে তেমন ধারালো মার্গারিটা আমি আর কখনও খেয়েছি বলে মনে পড়ে না৷

ভালো কথা, মার্গারিটা মেক্সিকোর জাতীয় ককটেল বলা যায়৷ মূল উপাদান— টেকিলা (আমি ব্লাঙ্কো, মানে সাদা পছন্দ করি৷ কিন্তু ওরো বা সোনালি দিয়েও দিব্যি হতে পারে) কন্থ্রো আর লেবুর রস৷

মার্গারিটা

৩৫ এমএল টেকিলা৷
২০ এমএল কন্থ্রো৷
৩৫ এমএল লেবুর রস৷
দু’-তিন কিউব বরফ৷

ককটেল শেকারে পুরে ভালো করে ঝাঁকিয়ে নিন৷ খাসা স্ট্রেট আপ মার্গারিটা তৈরি৷

দ্য শেড-এ আর খেয়েছিলাম চারবয়েল্ড স্টেক, চিজ় অ্যান্ড আনিয়ন ব্লু কর্ন এনচিলাদা৷ সঙ্গে পিন্তো বিন্‌স্৷ অহো! অহো! কী খাইলাম জন্ম জন্মান্তরে ভুলিব না! স্টেক আমি ‘মিডিয়াম’ খাওয়াই পছন্দ করি৷ মানে, মাংসের যে পুরু লম্বা টুকরোটি আসবে তার মাঝখানের রং হবে রূপসীর ঠোঁটের মতো৷ যাঁরা আর একটু অ্যাডভেঞ্চারাস তাঁরা খেতে পারেন ‘রেয়ার’৷ ফিকে রক্ত লেগে থাকবে৷ আর যাঁদের কলজে একেবারেই দুর্বল তাঁদের জন্য ‘হোল-ডান’— ফ্যাকাসে গোলাপি৷

এ ক্ষেত্রে এল বিফ-এর যে টুকরো, তাকে বলে এনওয়াই স্ট্রিপ৷ নিউ ইয়র্ক স্ট্রিপ৷ গরুর যে পাঁজর তার থেকে লেজের দিকে এগোলে পিঠ-পাশের যে মাংস তাকে বলে ‘শর্ট লয়েন’৷ এই মাংসই লম্বাটে চাকাচাকা করে কেটে এনওয়াই স্ট্রিপ৷ কাঠ-কয়লার আঁচে গ্রিল করা (তবেই চারবয়েল্ড)৷ সঙ্গে খাস নিউ মেক্সিকান গাঢ় নীল ভুট্টার রুটি ‘তরতিয়া’ দিয়ে তৈরি র‍্যাপ— এনচিলাদা৷ তার পেটে চিজ় আর পেঁয়াজ কুচি৷ আর খানিকটা রাজমার মতো পিন্তো বিন্‌স্৷ খাস মেক্সিকান খানা৷ এরপর একটাই কাজ বাকি থাকে— লাগামবিহীন কুচকুচে কালো একটা ঘোড়ায় লাফিয়ে উঠে দু’বাহু প্রসারিত করে নিজেকে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া!

 

মহম্মদ

আমার প্রথম আমেরিকা দর্শনের অনেক ছেঁড়া ছেঁড়া ছবি মনের মধ্যে ভেসে ওঠে মাঝে সাঝেই৷ তার মধ্যে সব থেকে বেশি মনে পড়ে মহম্মদের কথা৷ মহম্মদ৷ সানা৷ ইয়েমেন৷ মনে পড়ে যতবার টিভি-তে, খবরের কাগজে ভেসে ভেসে ওঠে এক্কেবারে আফ্রিকা ঘেঁষা পশ্চিম এশিয়ার এই দেশটির রাজধানী সানাতে ভয়াবহ সব সন্ত্রাসবাদী হামলার ছবি৷ ২০০৮ সালে সানা শহরে মার্কিন দূতাবাসে হামলার ছবি৷ কিংবা ২০১৩ সালে সারা শহর জুড়ে বোমা বিস্ফোরণ৷ ক্ষতবিক্ষত, আতঙ্কিত মানুষের মুখচ্ছবি৷ সেই সব মুখচ্ছবি মিশে যায় সোনা-ঝরা আকাশের মতো মহম্মদের হাসি-ভরা মুখচ্ছবিতে৷

ওয়াশিংটন ডিসি৷ যেমনটা বলেছি মুসাফিরি-১-এর গোড়াতেই, ডালেস এয়ারপোর্টে নেমে নানা আজগুবি বাধা টপকে পৌঁছলাম যেখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল সেই অ্যাপার্টমেন্টে৷ সে পাড়ার নামটিও কম আজগুবি নয়— ‘ফগি বটম’! কোনও বেয়াদব বাংলা করলে দাঁড়াবে— কুয়াশাচ্ছন্ন পশ্চাদ্দেশ! নিরাপত্তা ও গাড়ি বিভ্রাটে আমার পৌঁছতে একটু দেরিই হয়েছিল৷ দুপুর ১২টা-১টা হবে৷ নির্দিষ্ট অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে লবিতে রিসেপশনিস্ট-এর কাছ থেকে ঘরের চাবি নিয়ে, দরজা খুলেই দেখি মেঝেতে পড়ে আছে একটা মোটকা ফাইল৷ তাতে আমাদের পরবর্তী দু’হপ্তার প্রোগ্রাম৷ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সহকর্মীদের নাম এবং তারা কোন কোন ঘরে রয়েছে তার নম্বরের তালিকা৷

আমার একটা সুবিধা-সমস্যা হল, জেট-ল্যাগ নামক ব্যাপারটা আমার হয় না৷ চান-টান করে, একটু জিরিয়ে বিকেল-বিকেলে ফোন করা শুরু করলাম৷ কোথাও রিং হয়ে গেল৷ কেউ খুব ঘুম জড়ানো গলায় জানাল— ‘ভীষণ জেট-ল্যাগড৷ কাল সকালে দেখা হবে৷’ কোনও সঙ্গী পাওয়ার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েও শেষ নম্বরটা ঘোরাতেই ওপার থেকে ভেসে এল দরাজ খোলতাই গলা— হ্যাল্লো৷ গলা শুনেই মনে হল এক মুঠো হাসি৷ নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করি— ‘আজ তো সারা দিন আপিসের কোনও প্রোগ্রাম নেই৷ বেরোবে?’ তৎক্ষণাৎ উত্তর— ‘শিওর, শিওর! আমি একটু আগেই ঢুকেছি৷ নমাজটা সেরে নিই৷’ একটু ভাঙা ভাঙা ইংরেজি৷ আরবি টান৷

সেই বিকেল-সন্ধ্যার দু’টি ছবি মনে আজও ঝলমলে৷ এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে, কোথায় যাই, কোথায় যাই করতে করতে মেট্রো স্টেশনের তালিকায় ‘ক্রিস্টাল সিটি’ নামটা দু’জনেরই পছন্দ হল৷ কাজেই ট্রেনে চেপে পড়লুম৷ প্রথম বিশ্ব যে কাকে বলে তার কোনও ধারণাই ছিল না তার আগে৷ দু’জনেই দুই দরিদ্র দেশের বাসিন্দা৷ মনে আছে স্টেশনে নেমেই চোখ ছানাবড়া! এ কি স্টেশন, না শপিং মল! সারি সারি ঝাঁ চকচকে দোকান৷ তার তাকে তাকে ঝলসাচ্ছে থরে থরে ক্রিস্টালের নানা সামগ্রী৷ বেশ মনে আছে, ভয়ে দর পর্যন্ত করিনি৷

স্টেশন থেকে বেরিয়ে বহুক্ষণ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ালাম দু’জনে৷ একে অপরের দেশ, সংস্কৃতি নিয়ে নানা গল্পে মশগুল৷ এবং বুঝলাম আমরা সম্পূর্ণ পথ হারিয়েছি৷ গোধূলি ঠেলে তখন সন্ধ্যার মোহনা৷ আকাশ বেগুনি৷ রাস্তার আলো জ্বলে গিয়েছে৷ শুনশান রাস্তা৷ একটা লোক নেই৷ জনহীন পার্ক৷ হুস্-হাস্ করে পেল্লায় পেল্লায় গাড়ি চলে যাচ্ছে মাঝে সাঝে৷ বিশাল বিশাল বাড়ির পর্দা ভেদ করে বড় বড় কাচের জানালা দিয়ে ডিফিয়ুজড হলদে আলো৷ আর কোনও কোনও বাড়ি থেকে ভেসে আসছে গান-বাজনা৷

কী করি? এদিক-ওদিক খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম, যদি মেট্রো স্টেশনের পথটা চিনতে পারি৷ সন্ধ্যা গভীরতর হয়েছে৷ ঠিক যখন মনে শিরশিরে বাতাসের মতো একটা ভয়-ভয় ভাব ধরতে শুরু করেছে, দেখি দূরে একজন হেঁটে চলে যাচ্ছে৷ প্রায় দৌড়তে দৌড়তে গিয়ে হাজির হই৷ বছর পঁচিশেকের একটি মেয়ে৷ পরিস্থিতি ভেঙে বলি৷ সে একগাল হেসে, মিনিট খানেক ধরে আমাদের দিক্‌নির্দেশ দেয়৷ আমরা হ্যাঁ-হ্যাঁ-আচ্ছা-আচ্ছা করে মাথা নাড়তে থাকি৷ নারীর সহজাত ক্ষমতায় মেয়েটি অচিরেই বুঝে ফেলে আমরা বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ছি বটে, কিন্তু কিস্যু বুঝিনি৷ হঠাৎ সে বোঝানো বন্ধ করে বলে ওঠে, ‘Come, lemme show you!’ সে যে দিকে যাচ্ছিল তার সম্পূর্ণ উল্টো দিকে অন্তত আধ কিলোমিটার হেঁটে একটা জায়গায় পৌঁছে সে তর্জনী নির্দেশ করে— There’s your metro station! মেয়েটিকে ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা ছিল না আমাদের কাছে৷ ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকা কি আজও তেমনই আছে? অনেক কাল যাওয়া হয়নি৷

এরপর ফগি বটমে ফেরার আগে ইচ্ছা হল একটু কফি খাওয়া যাক৷ স্টারবাক্স-এর কফি৷ নামই শুনেছি এতকাল৷ না জানি কী অমৃত৷ রাস্তার পাশে একটা ছোট্ট দোকানে ঢুকি৷ বেশ ভিড়৷ আজ আর ঠিক মনে নেই আমি কেন আগে কাউন্টার থেকে কফি নিয়ে টেবিলে গিয়ে বসেছিলাম৷ মহম্মদ বোধ হয় একটু হালকা হতে ‘মেন্স রুম’-এ গিয়েছিল৷ একটু পরে দেখি মহম্মদ কাউন্টারে পৌঁছেছে৷ কিন্তু কফি নিয়ে আসছে না৷ লাইন বাড়ছে৷ লাইনে যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন তাঁদের মধ্যে একটা উসখুসে ভাব বাড়ছে৷ কারণ লাইন এগোচ্ছে না৷ হঠাৎ মহম্মদের উদ্বিগ্ন গলা— ‘নীল, হে-নীল!’ আমি দৌড়ে যাই৷ কী ব্যাপার? মহম্মদ উত্তেজিত৷ ‘আই ওয়ান্ত মিল্ক উইথ কফি৷ বাত, দে সে নো মিল্ক! বাত আই সি পিপল তেকিং কফি অ্যান্দ মিল্ক!’ কাউন্টারের ওপারের ভদ্রলোকও উত্তেজিত— ‘আমি ওঁকে বলছি যে আমরা শুধু কফি বিক্রি করি৷ দুধ বিক্রি করি না!’ আমিও ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারছি না৷ দুধ দেওয়া কফি দিতে সমস্যাটা কোথায়? হঠাৎ পিছন থেকে একজন অসহিষ্ণু গলায় হেঁকে ওঠেন— ‘Please, give the guy some cream, man৷’ বোঝো কাণ্ড! মার্কিনিরা কফিতে ‘মিল্ক’ দেয় না, ‘ক্রিম’ দেয়! নিজে বুঝে, মহম্মদকে বোঝাই, সে যেটা চাইছে— দুধ দেওয়া কফি, মার্কিন মুলুকে সেটাই ‘কফি উইথ ক্রিম’! সেখানে বোতলে বোতলে খাস দুধও মেলে, যা অনেক মার্কিনিকেই দেখেছি ফ্রিজ থেকে বার করে ঢকঢক করে খেতে৷ যেমনটা এ দেশে সচরাচর দেখা যায় না৷ ইয়েমেনেও বোধহয় না৷ কারণ ‘ক্রিম’-সমাধানে কাউন্টারের ঝামেলা মিটলেও বুঝি দুধের সাধ ক্রিম-এ মেটানো মহম্মদের ঘোর না-পসন্দ্, গজগজ করতে শুনি— ‘ক্রিম? হোয়াত ক্রিম? মিল্ক ইজ মিল্ক!’

কেমন আছে মহম্মদ, তার উত্তাল দেশে? এখনও কি আছে মার্কিন দূতাবাসে? তারও কি মনে পড়ে কখনও সেই সন্ধ্যার কথা? কে জানে?

 

উড়ান

ওয়াশিংটন ডিসি-তে প্রথম যাত্রায় যা-দেখছি-তাতেই-হাঁ-হয়ে-যাচ্ছি গোছের অবস্থাটা বেশ কয়েক দিন ছিল৷ আর তা যে ছিল তার একটা প্রধান কারণ অবশ্যই সফরের দ্বিতীয় দিনের প্রায় পুরোটাই এক অলীক দুনিয়ায় কাটানো৷ এবং তার মধ্যে কিছুটা সময় এক আশ্চর্য মানুষের সঙ্গে কাটানো৷

আগের দিন আমাদের আপিসের প্রোগ্রামের যে নির্ঘণ্ট দেওয়া হয়েছিল, সেই অনুযায়ী সক্কাল সক্কাল আমাদের ফগি বটম-এর অ্যাপার্টমেন্টের লবিতে হাজির হয়ে অন্যান্য দেশ থেকে আসা সকলের সঙ্গে একপ্রস্থ আলাপ পরিচয় হল৷ সেও এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা৷ ইয়েমেন-এর মহম্মদের কথা তো আগেই বলেছি৷ মিশর, ভিয়েতনাম, ইউক্রেন, রাশিয়া, আয়ারল্যান্ড, চিলে, নিউ জিল্যান্ড, কলম্বিয়া, তোগো, লুক্সেমবুর্গ, বেলারুস, দক্ষিণ আফ্রিকা, জার্মানি… সব তো মনেও নেই৷ স্পষ্ট মনে আছে, নিউ জিল্যান্ডের ওয়েলিংটন থেকে আসা ডেভিডের সঙ্গে কফি খেতে খেতে সাংঘাতিক উৎসাহ নিয়ে বলেছিলাম, ‘তোমার দেশে আমার দুই আইডল থাকেন৷’

‘তাই নাকি? তাই নাকি? কে কে শুনি!’ ডেভিডের মুখ উজ্জ্বল৷
‘মার্টিন ক্রো আর রিচার্ড হ্যাডলি৷ বিশেষ করে ক্রো৷ ওই কভার ড্রাইভ? ওঃ! ভাবা যায় না৷ একটাই বিশেষণ হয়— সুইট! আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় ডান-হাতি ডেভিড গাওয়ার! অবশ্য গাওয়ারের থেকে…’

উৎসাহের আতিশয্যে একগাদা কথা বলেই চলেছি৷ হঠাৎ খেয়াল হল ডেভিডের চোখ-মুখ থেকে উদগ্রীব হাসিটা যেন ক্রো-এর ব্যাট থেকে বেরোনো বলের মতো বাউন্ডারির ওপারে মিলিয়ে গেল৷ ঘাড় নাড়ছে বটে কিন্তু মুখ জুড়ে কেমন একটা অসোয়াস্তির ভাব৷ একটু থতমত খেয়েই থেমে যাই৷ ‘ক্রো-কে তোমার পছন্দ নয় বুঝি?’

স্পষ্ট মনে আছে ভীষণ আমতা আমতা করে ডেভিড প্রায় ক্ষমা চাওয়ার ঢঙে বলেছিল, ‘ইয়ে, মানে, আমাদের একটা ক্রিকেট দল আছে বটে৷ কিন্তু আমি না ঠিক… !!’

বোঝো কাণ্ড৷ মনে মনে একবার ভাবলুম— এ আবার কী? ক্রিকেট না নিউ জিল্যান্ডের ‘সামার ন্যাশনাল গেম!’৷ আবার এও ভাবলুম, ভারতীয় কোনও হকি হিরোকে নিয়ে যদি এই মহূর্তে কেউ আমার সঙ্গে আড্ডা জমাতে চায়, আমারও তো ঠিক এই দশাই হবে৷

শুনলাম ডেভিডের দেশে আসল মাতামাতি নাকি রাগবি নিয়ে৷ এখন মনে হয়, সত্যিই, যথেষ্ট কোচিং পেয়ে রঞ্জি স্তরেও খেলা তো দূরের কথা, দেশের নব্বই শতাংশ শিশুর বাপ-মায়ের পক্ষে যে খেলার সাজ-সরঞ্জাম কিনে দেওয়াই সাধ্যের বাইরে, সেই খেলাকে নিয়ে এমন মাতামাতি কোনও সভ্য দেশেই হয় না৷ আট-দশটি দেশের প্রতিযোগিতার বাঁশবনে শেয়াল-রাজা হয়ে ভারতের কী দাপট! কিন্তু কোটি কোটি শিশু তাতেই বুঁদ৷ কোনও ক্রমে তিনটে ব্যাড়া-ডাল বা লাঠি দিয়ে, বস্তির রাস্তায় ইট সাজিয়ে কিংবা কুঁড়ের দেওয়ালে চক দিয়ে উইকেট বানিয়ে সে কী উত্তেজনা— ক্রিকেট-স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই সচিন৷ প্রতিভার কী ভয়ঙ্কর অপচয়৷ এদের যদি ফুটবল বা অ্যাথেলেটিক্স বা তেমন অজস্র অনেক সস্তার খেলায় মাতিয়ে দেওয়া যেত, এই ১২০ কোটির দেশ থেকে কত অলিম্পিক বিজয়ীই না সৃষ্টি করা যেত৷ কিন্তু তা তো হওয়ার নয়৷ ভারতে ক্রিকেট যে বিগ-বিজনেস! পাছে মুক্ত অর্থনীতির চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি-আওয়ারের চাপে (সেল-ফোন খরচ তো কোম্পানি দিচ্ছে!) আসলি ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা কমে যায়, খেলাটাকেই বদলে দাও৷ তাও ভি আচ্ছা, কিন্তু ক্রিকেট চাই৷

যাই হোক, সকাল ন’টার মধ্যেই প্রাথমিক আলাপ-পর্বের শেষে স্টেট ডিপার্টমেন্টের দপ্তরে গিয়ে আরও কী সব আগডুম-বাগডুম ছিল আজ আর মনে নেই৷ মোটামুটি দুপুর ১২টা নাগাদ আমাদের বলা হল— আজকের কাজ শেষ৷ এবার তোমরা চরে খাও৷ ব্যস! আমি তো তক্কে তক্কেই ছিলাম৷ যেমনি বলা, অমনি ধাঁ৷ ঠিক করেই রেখেছিলাম প্রথম সুযোগেই আগে স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়ামে ঢুঁ মারব৷ হাজির হলাম৷ জীবনে অনেক কিছুই প্রথম বার দেখে চোখ টেরিয়ে গেছে, কিন্তু আর কোনও প্রতিষ্ঠানে গিয়ে এমন খাবি খেতে হয়নি৷ জানতাম বিশ্বের বৃহত্তম জাদুঘর৷ কলকাতা জাদুঘরও তো এশিয়ার সব থেকে বেশি দ্রষ্টব্যের জাদুঘর৷ কিন্তু এ জিনিস কল্পনাতেও আসেনি৷ এ তো একটা গোটা পাড়া৷ ১৯টা মিউজিয়াম আর গ্যালারি৷ গবেষণা কেন্দ্র৷ বাগানের পর বাগান৷ গোলাপ বাগান৷ প্রজাপতির বাগান৷ ছাদে বাগান৷ কফি শপ৷ রেস্তোরাঁ৷ মাথাটা কেমন ভোঁ-ভোঁ করতে লাগল৷ নাঃ, এভাবে হবে না৷ একটা বেঞ্চিতে বসি৷ সময় হিসেব করি৷ ওয়াশিংটনে পৌঁছেই আমরা প্রত্যেকেই নিজেদের ঘরে-রাখা যে মোটকা ফাইল পেয়েছিলাম তাতে আর পাঁচটা দর্শনীয় জায়গার সঙ্গে স্মিথসোনিয়ানেরও একটা ফ্লায়ার ছিল৷ সেটা দেখে দুটো বা তিনটে গ্যালারি বাছি৷ এক কাপ কফি খাই৷ একটা সিগারেট ফুঁকি৷ তারপর ট্যুর শুরু করব৷ সবই ফ্রি৷ কোনও টিকিট নেই৷ দেখে শুনে বেছে নিলেই হল!

সে বাছায় প্রথম উঠল ‘এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়াম’! কেন সেটাই বাছলাম আজ আর মোটেই মনে নেই৷ কিন্তু ভাগ্যিস৷ কী কী দেখেছিলাম সেখানে, সে তালিকা অবান্তর৷ চোখের সামনে পরতে পরতে খুলে যাচ্ছিল মানুষের সব থেকে দুর্দম স্পর্ধার ইতিহাস৷ মাধ্যাকর্ষণকে চ্যালেঞ্জ করে হারিয়ে দেওয়ার ইতিহাস৷ বিশ্বকে তুড়ি মেরে ব্রহ্মাণ্ডে ঢুকে পড়ার ইতিহাস৷ কিন্তু সেদিন, সেইক্ষণে আমার কপালে জুটে গেল তার থেকে আরও অনেক অনেক বেশি কিছু৷

কাউন্টারে হাজির হয়ে দেখি, নিখরচার গাইড সার্ভিস রয়েছে৷ যদ্দূর মনে পড়ে, ঘণ্টায় ঘণ্টায়৷ আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে এমনি এক দফা সার্ভিস৷ সময়টা আজ মনে নেই, কিন্তু যেখান থেকে গাইডেড ট্যুর শুরু হওয়ার কথা, কাঁটায় কাঁটায় নির্ধারিত সময়ে সেইখানে হাজির হলেন মাঝারি হাইটের সোনালিচুলো এক শ্বেতাঙ্গিনী৷ আমাকে দেখেই এগিয়ে এসে বললেন, ‘আমি ক্যাথি৷ আমি গাইড৷ তুমি একা?’

‘হ্যাঁ৷ আর তো কেউ আসেনি দেখছি৷’
‘আমরা আর একটু ওয়েট করি? এসো, গপ্পো করি৷’ একটা খালি বেঞ্চে গিয়ে বসলাম৷
‘তুমি বুঝি স্মিথসোনিয়ানে চাকরি করো?’
‘ওঃ! না-না৷ আমি ভলান্টিয়ার৷ এরা আমায় কোনও পয়সা-কড়ি দেয় না৷’
‘তা হলে করো কেন?’
‘দারুণ লাগে৷ কত মানুষ আসেন, মহাকাশ, এরোপ্লেন এসব তাঁদের বোঝাতে, ঘুরিয়ে দেখাতে দারুণ লাগে৷ কয়েক জনও যদি এ থেকে উৎসাহিত হয়ে ব্যাপারগুলো নিয়ে আরও খোঁজখবর করেন, সেটাই আমার কাছে খুব বড় পাওয়া৷’
‘এটাই তোমার হবি বুঝি? নেশা?’

আশপাশের পাঁচজনকে চমকে দিয়ে হো-হো করে হেসে ওঠেন ক্যাথি, ‘নেশা নয়৷ পেশা৷ ছিল অনেক কাল৷ এখন অবশ্য রিটায়ার করেছি৷ আর প্লেন ওড়াই না৷ তবে ট্রেনিং দিই এখনও৷’

‘তুমি পাইলট? মানে পেশাদার পাইলট?’ বিস্ময় চাপতে পারি না৷

‘কেন? দেখে মনে হচ্ছে না?’ ক্যাথি আরও এক প্রস্থ অট্টহাসি করে নেন৷

যা জানতে পারি, তাতে হিন্দু হোস্টেলের জীবনের একটা পুরনো কথাই মনে ভেসে ওঠে— কোথায় খাপ খুলেছ শিবাজী?…

বুকে নেম ট্যাগ— ক্যাথি লা সস৷ অ্যান লুইস কুপার আর শ্যারন রেজনাস-এর বই ‘Stars of the Sky, Legends All’-এ একটা আলাদা চ্যাপ্টারই আছে যাঁর ওপরে, সেই ক্যাথি লা সস৷ সে অধ্যায় থেকে দু’টি লাইন তুলে দিলুম— ‘The 89th Military Airlift Wing (MAW)… is the unit responsible for providing air transportation for the US President, Vice President, Cabinet members, members of Congress, senior Defense Department officials and foreign heads of state. Kathy was the first woman pilot selected to fly with this elite wing!’

মার্কিন উড়ানে মহিলাদের অবদানের ইতিহাসে ক্যাথির নাম থাকবেই থাকবে৷ MAW-এর প্রথম মহিলা পাইলট হওয়া ছাড়াও ক্যাথি ছিলেন নর্টন এয়ারফোর্স বেস্‌-এর প্রথম মহিলা এয়ারক্র্যাফ্ট-কমান্ডার। এ মুহূর্তে তিনি আমার পাশে বসে গপ্পো করছেন সেটা ভেবে শিহরণ হল নিশ্চয়ই, কিন্তু এটা ভেবে আরও অনেক বেশি অবাক হলাম যে, সে মানুষটি বিনা পারিশ্রমিকে বা অন্য কোনও বৈষয়িক কিচ্ছুর আশা না করে, স্রেফ উড়ানের প্রেমে সপ্তাহের কিছু নির্দিষ্ট দিনে সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা কিছু মানুষকে মিউজিয়াম ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন৷ মার্কিন ‘ভলান্টিয়ারিজম’— শুধু ভালোবাসা আর বিশ্বাসের জোরে অতি সাধারণ মানুষ থেকে জগদ্বিখ্যাত ব্যক্তিরাও এ দেশে শ্রম দান করেন৷ নীরবে৷ পিট সিগারের মতো কিংবদন্তি গায়ক, সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন হাডসন নদীর দূষণ বন্ধ করার কাজে! আর আমরা? সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলাম টেলিভিশনের সবজান্তা টক-শো কিংবা মদের ঠেকে রাজা-উজির মেরে! মার্কিন ভলান্টিয়ারিজম-এর স্পিরিটের এক চুল যদি আমরা পেতাম দেশের চেহারা অনেকটাই অন্য রকম হত৷ ক্যাথির সঙ্গে সে দিন যে ঘণ্টাখানেক কাটিয়েছিলাম তা সারা জীবন মনে থাকবে৷ জ্ঞানের কথা তো ছেড়েই দিলাম৷ তার থেকেও বড় কথা, কী ভালোবাসা-একাগ্রতা-উৎসাহ নিয়ে তিনি আমাদের সব বোঝাচ্ছেন, দেখাচ্ছেন, পরবর্তী ঘণ্টাখানেকে তা টের পেয়েছিলাম৷ টের পেয়েছিলাম তাঁর সমস্ত অস্তিত্বে, সারাটা শরীরে যেন উড়ান লেগে আছে!

 

অলীক মাছ ভাজা

বিশ্বের সেরা মিউজিয়ামে সারা দুপুর কাটানোর পরও সেদিনই সন্ধেয় যে আরও চমক থাকতে পারে তা ভাবতেই পারিনি৷ রেক্স মোজের নামক ভদ্রলোকটিকে আমি মনে রাখব অনেক কারণে৷ রেক্সই আমার চেনা একমাত্র আমেরিকান যিনি কলকাতার আমেরিকান সেন্টারের ডিরেক্টরের ‘ট্যুর অফ ডিউটি’ শেষ করে চলে যাওয়ার আগের দিন আমায় বলেছিলেন, যদি কোনও দিন বাংলায় ফিরি, আর কোথাও যাই না যাই আবার একবার বিষ্ণুপুর যাবই৷ এই সাড়ে ছ’ফুটি মানুষটিকে যদি আদ্যোপান্ত না চিনতাম, তবে নির্ঘাৎ ভাবতাম, তিনি সেটা বলছেন নিতান্তই আমার ভালো লাগবে বলে৷ কিন্তু না৷ রেক্সকে আমি চিনি৷ ইয়াঙ্কিরা শিল্প-সংস্কৃতিকে পাত্তা দেয় না— বহুল প্রচলিত এই প্রগাঢ় জ্ঞানটি চিরকালের মতো আমার মন থেকে ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন রেক্স৷ দিনের পর দিন দেখেছি সাংঘাতিক কাজের চাপে নাক অবধি ডুবে আছেন রেক্স৷ হঠাৎ একটা ফোন এল৷ ‘ও মাই গশ্’ বলে সব কিছু যেমনটি ছিল তেমনটি ফেলে, কম্পিউটারটি পর্যন্ত বন্ধ না করে, হনহন করে আপিস থেকে বেরিয়ে গেলেন রেক্স৷ সেক্রেটারিকে জিজ্ঞেস করি— কী ব্যাপার? না, খবর এসেছে অমুক জায়গায় দুর্দান্ত কাঁথা স্টিচের প্রদর্শনী হচ্ছে৷ দেখতে ছুটলেন তিনি৷ দেখেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা পটুয়াদের পট দেখছেন আর এক বর্ণ না বুঝেও মাথা নেড়ে নেড়ে তাঁদের গান শুনছেন৷ রেক্সকে যাঁরা জানেন, তাঁরা জানেন তিনি এক বিরল মানুষ৷ অন্য ধরনের মানুষ৷

আমি ওয়াশিংটন ডিসিতে আসার দিনই বেশ রাত করে শুতে যাওয়ার আগে ক্যাঁ-ক্যাঁ করে ঘরের টেলিফোন বেজে ওঠায় চমকে উঠেছিলাম৷ কে আবার এত রাতে? বাড়িতে কোনও বিপদ হল না তো? একটু উদ্বেগ নিয়েই ফোন তুলি৷

‘হ্যালো৷ ইজ দ্যাট নীল্যানজ্যান?’ ভরাট গলা৷ খাস ইয়াঙ্কি উচ্চারণ৷ জানাই, আমিই সেই অধম৷ ‘গুড ইভিনিং৷ আমার নাম রেক্স৷ রেক্স মোজের৷ পরের মাসেই আমি কলকাতা যাচ্ছি৷ আমার নতুন পোস্টিং৷’ খবরটা জানতাম৷ আসার আগেই শুনে এসেছিলাম৷ আগাম স্বাগত জানাই৷

‘তোমার সঙ্গে একটু দেখা করা যায়?’
‘এখন?’
‘ওঃ! না-না৷ হাও অ্যাবাউট ডিনার টুমরো? চলো কাল তোমাকে আমি ডিনার খাওয়াই৷’

খাসা প্রস্তাব৷ রাজি না হওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না৷ ঠিক হল পরের দিন সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ রেক্স এই ফগি বটম-এর অ্যাপার্টমেন্টে এসেই আমাকে নিয়ে যাবেন৷

খাওয়া নিয়ে এমনিতেই আমার একটা ছোটখাটো সমস্যা হয়েছিল৷ আপিসের দাদারা বলে দিয়েছিলেন, খামখা একদম রেস্তোরাঁয় যাবে না৷ ‘সেভেন-ইলেভেন’ বা ওই ধরনের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে কোল্ড-ফুড কিনে নেবে৷ জলের দর৷ অনেক পয়সা বাঁচবে৷ প্রথম দিন তাই করেছিলুম৷ স্পষ্ট মনে আছে সামান্য কিছু ডলারে যা কোল্ড চিকেন লেগস, পোর্ক সসেজ, পাঁউরুটি, চিজ় এই সব কিনেছিলাম তার ঠোঙাটা প্রায় আমার সাইজের হয়েছিল৷ আমাদের প্রত্যেকের ঘরেই আলাদা কিচেন ছিল৷ চার বার্নারের অভেন, মাইক্রো অভেন, কফি-মেকার— সব৷ কিন্তু রান্নাবান্নার ঝামেলায় কে যাবে? তাই শুধু গরম করেই খাওয়া যায় এমন খাদ্যই কিনেছিলাম৷

প্যাকেট থেকে হৃষ্টপুষ্ট একটা চিকেন-লেগ বার করে মাইক্রো অভেনে পুরলাম৷ এর আগে এ যন্ত্রটি কখনও ব্যবহার করিনি৷ গরম করার প্রি-সেট বোতাম টিপে দিলুম৷ ভিতরে আলো জ্বলে, মৃদু গোঁ-গোঁ শব্দ করে ভিতরের কাচের থালাটা ঘোরা শুরু হল৷ সঙ্গে একটা সস্তার হোয়াইট ওয়াইনও এনেছিলাম৷ খুব তরিবৎ করে সেটা খুলে, তাক থেকে একটা কেতার ওয়াইন গ্লাসে হাল্কা সোনালি তরল রস ঢেলে, প্লেটে প্লেটে চিজ পাঁউরুটি সাজাচ্ছি, হঠাৎ ফটাস্ করে একটা বিকট শব্দে বুকটা ধড়াস করে উঠল৷

দৌড়ে গিয়ে দেখি অভেনের ভিতরে ধোঁয়ায় ধোঁয়া৷ আবছা দেখা যাচ্ছে যে ঠ্যাং ঘুরে চলেছে৷ লাফ কেটে কারেন্টের সুইচ বন্ধ করে যন্ত্রটিকে স্তব্ধ করলাম৷ দরজা খুলতেই ভক করে যে গন্ধটা বেরোলো তাতেই সন্দেহ হয়েছিল৷ এক কামড় বসিয়ে বুঝলাম, আজ রাতটা চিজ়-পাঁউরুটি-ওয়াইন খেয়েই কাটবে৷ পরে পাঁউরুটি-চিজ় ছাড়া আর যা-যা কিনেছিলাম ঠোঙা শুদ্ধু ট্রাশ-ক্যানে ফেলে প্রতিজ্ঞা করেছিলুম, পয়সা যায় যাক, মর্গে রাখা মাংস আর কখনও খাব না৷ শুধু বিস্বাদই নয়, এ ধরনের কোল্ড-মিট-এ যে প্রিজারভেটিভ দেওয়া হয় তার এমন একটা বোঁটকা গন্ধ আছে যেটা আমি জাস্ট নিতে পারি না৷

যাই হোক, স্মিথসোনিয়ানে বিভোর হয়ে বাড়ি ফিরতে একটু দেরিই হল৷ সবে স্নান সেরেছি, দরজায় বেল৷ রেক্স মোজের৷

রেক্স গাড়ি এনেছিলেন৷ নিজেই চালাচ্ছেন৷ ‘অশ্লীল বড়লোক’ ছাড়া এ দেশে— কোনও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশেই— ড্রাইভার রাখার কোনও গপ্পো নেই৷ কোথায় যাওয়া হবে তা হলে? উত্তর শুনে মন ভেঙে গেল— ‘চলো আজ তোমায় এক্সেলেন্ট মাছ খাওয়াব৷ আর ওয়াইন৷’ মাছ? বঙ্গদেশ থেকে যাকে অনায়াসেই বলা যায় দুনিয়ার হরেক কিসিমের রেস্তোরাঁর ছড়াছড়ির নিরিখে খানাদানার রাজধানী (সেটা অবিশ্যি পরে আবিষ্কার করেছিলাম) সেই শহরে উড়ে এসে, আমি বঙ্গসন্তান দুরন্ত খিদের মুখে আমায় মাছ খাওয়াতে নিয়ে চলেছেন এক ইয়াঙ্কি ভদ্রলোক— রসিকতা কি এর থেকেও নিষ্ঠুর হতে পারে?

বহু চেষ্টা করেও কোনও পাড়া, কোনও রেস্তোরাঁ আজ আর কিছুতেই মনে করতে পারছি না, কিন্তু ঝাঁ চকচকে শুনশান নিস্তব্ধ একটা রাস্তায় একটা বিশেষ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রেক্স দরজাটা খুলে ধরা মাত্র মনে হল একটা ভীষণ ঝড়ের দমকা এসে আমার সমস্ত অস্তিত্বে আঘাত করল৷ সম্মিলিত চ্যাঁচামেচির একটা দুরন্ত গমগমে আওয়াজের ঝড়৷ আর তার থেকেও বেশি গমগমে বহুবিধ সুখাদ্যের সুবাসের একটা ঝড়৷ সে কী ভিড়! আর কী হৈ চৈ৷ বিরাট একটা হলঘর৷ গিজগিজ করছে গোল গোল টেবিল ঘিরে চেয়ার৷ তাতে থিকথিক করছে কালা-ধলা-নারী-পুরুষ-ছেলে-বুড়ো-আধবুড়ো-ছোঁড়া-ছুঁড়ি৷ তিল ধারণের স্থান নেই৷ সাদা অ্যাপ্রন পরা ওয়েটারদের নিমেষে এ টেবিল ও টেবিলে আনা খাদ্য থেকে ওঠা হাল্কা ধোঁয়ার সঙ্গে নরম হলদেটে আলো মিশে একটা অদ্ভুত পরিবেশ৷ রেক্স বোধ হয় একটা টেবিল বুক করেই রেখেছিল৷ কারণ, একটু খোঁজা-খুঁজি করে এক ওয়েটার আমাদের একটা টেবিলে বসিয়ে দিল৷

মাছের কথা শুনে মনটা যে একেবারে ভেঙে পড়েছিল, রেস্তোরাঁর হাল হকিকত দেখে তা কিছুটা উঠে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে৷ তবু তো মাছ! মনে কাঁটার মতো খচখচ করছে৷ ততক্ষণে ওয়েটার মেনুকার্ড নিয়ে এসেছে৷ চামড়ায় বাঁধানো একটা চওড়া পুরু বই-ই বলা চলে৷ মাঝে মাঝে আমার মাথাটাও কাজ করে— তুরন্ত্ নিজেকে রেক্স-এর হাতে ছেড়ে দিলাম৷ অর্ডার হল— প্যান-সিয়ার্ড চিলিয়ান সি বাস৷ আর শিরাজ় ওয়াইন৷ যতটা মনে পড়ছে সঙ্গে ছিল ‘গ্রিল্ড্ ভেজিটেবল’৷ ‘মাছের সঙ্গে হোয়াইট ওয়াইনটাই ভালো যায় না?’ বলে মৃদু প্রশ্ন তুলেছিলাম৷ রেক্স শুধু বলল, ‘ট্রাই ইট, ট্রাই ইট!’

মাছ ভাজা তার আগে ও পরে অনেকই খেয়েছি৷ কিন্তু আমাদের খাঁটি সরষের তেলে ভালো ইলিশ ভাজাকে যে সত্যিই কেউ ঘামাসান টক্কর দিতে পারে, সেটা সেই একবারই মনে হয়েছিল৷ ওহ্! সে এক অলীক স্বাদের মূর্ছনা৷ অথচ তাতে একগাদা মশলাপাতির কোনও জগঝম্প নেই৷ পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেতারের মতো, সহজের উদ্‌যাপন৷ বিরাট এক পিস্ সরস মাছের ফিলে, হাল্কা করে ভাজা৷ তার মধ্যে খেলা করছে অলিভ অয়েল, মাখন, রসুনের বিন্দু বিন্দু দানা আর পার্সলে কুচির স্বাদের মিড়৷ মুখে দিচ্ছি আর সমস্ত শরীর জুড়ে তার তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে৷ তাল দিচ্ছে মিডিয়াম শিরাজ় ওয়াইনের সঙ্গত!

খাস বঙ্গসন্তানকে কোনও বিদেশি যে মাছভাজা খাইয়ে কিস্তি মাৎ করতে পারে তা কল্পনাও করতে পারিনি৷ সাধে কি বলে ভ্রমণে মনের প্রসার বাড়ে! এর পরে আর কোনও কথা থাকতে পারে না৷ শুধু এখানের খাদ্যরসিকদের কাছে ছোট্ট সাজেশন— চিলিয়ান সি-বাস্ এখানে মিলবে না৷ কিন্তু ভালো ভেটকি-র ফিলে পেলে চেষ্টা করে দেখতে পারেন৷ শুধু দুটো জিনিস খেয়াল রাখতে হবে— মাছটা ভাজতে হবে হালকা করে৷ সাদা ফিলেতে হাল্কা সোনালি রং ধরে দু’এক জায়গায় একটু-আধটু খয়েরি হওয়া অবধি৷ আর রসুনটা মিহি করে বেটে ফেলবেন না৷ মুখে পড়ার মতো দানাদার হতে হবে৷ দুধের সাধ ঘোলে মেটার থেকে আর একটু বেশি মিটবে৷ ট্রাই ইট, ট্রাই ইট!

 

(চলবে)