Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সন্তোষ পাল — দুই

মৃণাল চক্রবর্তী

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

ওরা দার্জিলিং-এর গাড়ির খোঁজ করছিল। আমি যে স্মৃতিসরণির তালাশে আছি, তার মধ্যে পাহাড়ও আছে। দার্জিলিং পাহাড়। ওদের গাড়ি ছেড়ে দিতেই আমি আর একটা ছোট গাড়ি ভাড়া নিলাম। পুল্টুশ ঘ্যানঘ্যান করে উঠল।

–ওদিকে গিয়ে কোনও সুবিধে হবে না। খুব ঠান্ডা। তোমার পিঠব্যথা হবে।
–হলে হবে। অণু চলে যাচ্ছে দেখলে না?

আমার ড্রাইভার চা খাচ্ছিল একটু দূরে দাঁড়িয়ে। অণুদের গাড়িটা হৈচৈ করতে করতে চলে গেল তাকে ছাড়িয়ে। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

–যেও না ইন্দ্রজিৎ। তুমি বরং কোচবিহার চলে যাও। হোটেলে ফিরে খাও। তারপর ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে…
–তোমার মতামত দরকার হলে আমি বলব পুল্টুশ। এখন চেপে যাও। ড্রাইভার আসছে।

ওর পছন্দ না হলেও চুপ করে গেল।

ওদের গাড়িটা এখন কোথায়? পাহাড়ের দিকে ধোঁয়ার মত কুয়াশা। কুয়াশার আড়ালে মোটাসোটা হাসিমুখে অণু এবং পরিবার। আর ওই মেয়েটা? ও কি আমায় দেখেছে? গালে হাত বুলিয়ে বুঝলাম, দেখলেও লাভ নেই। আমাকে নিশ্চই খুব বাজে দেখাচ্ছে। এলোমেলো পাকা দাড়ি, পাতলা চুল উড়ছে বিকেলের বাতাসে। আমাকে এমনিতেই বছর পাঁচেক বড় দেখায়। আর এখন তো… গাড়ি চলতে শুরু করল। বেশ ঠান্ডা লাগছিল। আমার এই বাহারি জ্যাকেট ওখানে কাজ দেবে না। অন্তত ব্যাগের ব্যাপারে পুল্টুশ ঠিক বলেছিল। হোটেল থেকে ওটা নিয়ে বেরনো দরকার ছিল। কিন্তু আমি তো ভাবতে পারিনি সন্তোষ পালের সঙ্গে আমার দেখা হবে না। অণুর সঙ্গে দেখা হবে, এ-ও কি ভেবেছিলাম?

পেটের ভেতর একটা গোঁতলানো মত হল। পুল্টুশ রিয়াক্ট করছে। কসবার নির্মলা কাকিমা এভাবেই কাকুকে মনে করিয়ে দিত সে জীবনে যা যা কথা বলেছে, সব ঠিক হয়েছে কাকুর ক্ষেত্রে। শরীরে একটা গোঁতলানো দিয়ে বলত। কাকু তখন পুরনো রেসের বই পড়ত। নির্মলা কাকিমা মেঝেয় বসে জাঁতা দিয়ে সুপুরি কাটত, দুটো করে পান বানাত। কাকুর গভীর জুয়ামনস্ক চোখের সামনে বাড়িয়ে ধরত একটা পান। কাকু পান নিয়ে মুখে পুরে ব্ল্যাক স্ট্যালিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়ত আবার। কাকু এ-প্রশ্ন কখনও করেনি কেন নির্মলা কাকিমা তাকে ঘোড়া বিষয়ে ঠিক কথাগুলো আগে থেকে বলে দেয়নি। হেরে যাওয়া পুরুষের স্বল্পভাষী এবং অন্যমনস্ক হওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু করার নেই।

এখন না থামালে পুল্টুশ বাওয়াল চালিয়ে যাবে। তাই ওকে আমি স্টপ মোডে নিয়ে গেলাম। অ্যান্ড্রয়েড ফোনের মত কাঁপুনি তুলে থেমে গেল পুল্টুশ। আমি মৃদু গলায় স্যরি বললাম।

এর পর আজ আর কোনও গাড়ি দার্জিলিং যাবে না। গাড়ির সংখ্যা খুব কম। বেশ কয়েকটা ওদিক থেকে ফিরছে। সবাই ভেতরে ঝুপসি হয়ে বসে আছে বস্তার মত। বেশিরভাগ গাড়িতেই চালু সিনেমার গান বাজছে। ওরা এখনও পাহাড়ের স্মৃতিতে বিভোর থেকে বুঝতে পারছে না যে ভেতরটা ঘামছে।

এত দেরিতে আমি কখনও পাহাড়ে উঠিনি। একবার, অনেক বছর আগে, গ্যাংটক থেকে গেজিং গিয়েছিলাম বেশ রাতে। অন্ধকারে বাস চলছিল থামছিল চলছিল। রাবাংলায় এসে কাঁপুনি দিয়ে শীত লাগল। অণু ওর চাদরটা আমাকে দিয়ে বলেছিল, এটা জড়িয়ে নাও। তোমার ঠান্ডা লাগছে। একটা কমলা রঙের পুলোভার পরেছিল অণু। গাড়ির মোলায়েম আলোয় ওর মুখটা নরম দেখাচ্ছিল। চাদরটা নিয়ে আমি শুঁকেছিলাম। ও এতক্ষণ আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছিল। চাদরে ঘুমন্ত অণুর গন্ধ। জেগে-থাকা অণু খুব মিষ্টি করে হাসল আমার দিকে তাকিয়ে। আমার খুব ভাল লাগছিল। কিন্তু এত হিসু পেয়ে গিয়েছিল যে আমাকে নেমে যেতে হল। কত রাতে আমরা গেজিং পৌঁছেছিলাম মনে নেই। তখন ওখানে কেউ যেত না শুধু জোংরিগামী ট্রেকাররা ছাড়া। সেই টিমটিমে আলো-জ্বলা গেজিং-এ বাস দাঁড়িয়ে গেল। আর কোথাও যাবে না। অণু আমাকে আঁকড়ে ধরে ঘুমোচ্ছিল। ওকে ধাক্কা মেরে জাগানো যেত না। নিয়ম ছিল, প্রথমে মাথায় হাত বোলাতে হবে। তারপর কপালে সুড়সুড়ি দিয়ে বলতে হবে, ওঠো অণু, আমরা এসে গেছি। তখনই চোখ খুলবে অণু। হাসবে আমার দিকে তাকিয়ে। তারপর আমরা নামব বাস থেকে।

তিস্তা পেরিয়ে থামলাম। চা খেলাম। অণুদের দেখলাম। দোকানের বাইরে। অণু-পরমাণু সবাই মিলে খুব হুল্লোড় করছে। অণু ছেলেটাকে বলছে টুপি পরে নিতে। টিনএজার ছেলে শুনছে না। মেয়েটা বাবার গায়ের সঙ্গে সেঁটে কী যেন খাচ্ছে। আর রাই হেডফোন লাগিয়ে গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে গান শুনছে। আমি রাই নামটা ওকে তক্ষুনি দিলাম। খুব বেশি গাড়ি নেই আশপাশে। আমি গাড়ি থেকে নেমে দোকানে ঢুকতে গিয়ে অণুকে স্টিল ফ্রেম হয়ে যেতে দেখলাম। ছেলের মাথায় জোর করে টুপি পরাতে গিয়ে আমাকে দেখল অণু। স্থির হয়ে গেল। আমি হাসলাম। দোকানের ভেতরে ঢুকে গেলাম।

ড্রাইভার চা আর মোমো খাচ্ছিল। আমি তার উল্টোদিকে বসে দেখলাম বাইরে অণু গিয়ে রাইকে ডেকে আমায় দেখাচ্ছে। অজান্তেই আমার হাত চলে গেল থুতনিতে। ওখানেই সব চেয়ে বেশি পাকা দাড়ি। রাই কান থেকে হেডফোনের ছিপি খুলে অবাক হয়ে দেখতে লাগল আমায়। আমি অস্বস্তিতে পড়ে ড্রাইভারের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলাম। কিন্তু রাই এগিয়ে এল। আমার ঠিক উল্টোদিকের চেয়ারে ড্রাইভারের পাশে বসে বলল,

–আপনি ইন্দ্রজিৎ। আমি মনোরঞ্জনা। কল মি মন। আপনি বৌদির প্রেমিক ছিলেন?

ড্রাইভার নেপালি হলেও বাংলা পরিষ্কার বলে। সে হাঁ করে শুনছিল। মুখের ভেতর মোমো দেখা যাচ্ছিল।

–সে কবেকার কথা। — আমি বুঝলাম এ-মেয়ের সঙ্গে সাবধানে কথা বলতে হবে।

–ওভাবে ডিফেন্সিভ হয়ে যাবেন না। আয়ম নট আ গালিবল উওমন। বিয়ে করেছেন?

ড্রাইভার হাত-মুখ ধুতে যাচ্ছে না। এরকম অবস্থায় আমি আগে একবার পড়েছিলাম যখন ইচ্ছে আমাকে বিয়ে করতে চায়। ডেঞ্জারাস মেয়ে। প্রায় দশ বছর আগে একটা পার্টিতে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তার কদিন আগেই ওর দু-মাসের এক্স-বর অভি আমাকে বলেছিল,

–ইচ্ছে মেনিয়াক। মেগালোমেনিয়াক, নিম্ফোমেনিয়াক, পাইরোমেনিয়াক। আমি জব্বলপুর চলে যাচ্ছি। টেক কেয়ার, শি হ্যাজ অ্যান আই ফর ইউ।

আমি এরকম কোনও ইশারা পাইনি ইচ্ছের কাছ থেকে। ইশারা করার মত মেয়েই নয় ও। মার্শাল আর্ট জানে। আমি হালকাভাবে বললাম,

–তুই কুংফুমেনিয়াকও বলতে পারতি।

–কুংফু না, কাং ফু। — অভি আমাকে শুধরে দিয়ে বলল— এতদিনে মাত্র  দুবার আমি সেটা বুঝতে পেরেছি। বাদবাকি মেনিয়াগুলো সাত দিন থাকলেই বোঝা যায়। আমি জুনিয়র বেঙ্গলে ফুটবল খেলেছি, তাই সামলাতে পেরেছি। তোর কম্মো না।

এই জুনিয়র বেঙ্গলে খেলার ব্যাপারটার পক্ষে আমরা কোনও প্রমাণ কখনও পাইনি। ওর সঙ্গে আমার কলেজে বন্ধুত্ব হয়। তখন এসব কিছু বলেনি। ইচ্ছের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কিছু দিন বাদেই কথাটা বলতে শুরু করে। অন্যান্য বন্ধুরাও আমাকে কনফার্ম করেছে যে তারা জানতই না ও ভাল ফুটবল খেলতে পারে। যাহোক, অভি আমাকে সতর্ক করে জব্বলপুর চলে যায়।

হরেন বসুর সিরিয়ালের পার্টিতে ইচ্ছের সঙ্গে আমার দেখা হয়। ও প্রোডাকশনে কোনও কাজ করছিল মনে হয়। শক্ত মুখে একটা আমারই বয়েসি, তখন আমি চল্লিশ, লোকের সঙ্গে মদ খেতে খেতে কথা বলছিল। ওকে কথা বলতে দেখলেই বরাবর মনে হত ও পরদিন সকালে উঠে হিমালয়ের কোনও দুর্গম জায়গায় ট্রেকিং-এ চলে যাবে। তার আগে কিছু খোঁজখবর নিচ্ছে। তবে ওদের বিয়ে হওয়ার পরে এমনিতেই আমি ও বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তাই ভয়ের কোনও কারণ ছিল না। সেদিন সন্ধেবেলা আমাকে দেখে ইচ্ছে দূর থেকে হাই বলল। আমিও হাত নেড়ে সরে গেলাম। তখন আমি মিতুনের প্রেমে পড়েছিলাম। ওর বিয়েটা ভাঙি ভাঙি করছে খবর পেয়ে ঘুরঘুর করা শুরু করেছিলাম। সেদিন মিতুন আমাকে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে দুটো মোটা লোকের সঙ্গে কথা বলছিল। তাই আমি বার কাউন্টারে দাঁড়িয়ে একজন ভালো মনের মানুষের সঙ্গে কথা বলছিলাম। সন্তোষ পালের মত মানুষ। পিঠে খোঁচা দিয়ে ইচ্ছে ডাকল,

–ইন্দ্র। কী খবর তোমার?
–ভালো। তুমি কেমন আছ?
–সুপার। ওই মালটাকে ঘাড় থেকে নামিয়েছি। জানো বোধ হয়।
–তুমি কি অভির কথা বলছ?
–আবার কে? কটা বিয়ে করেছি আমি? চলো ওখানে গিয়ে বসি।

আমি নাম না জানা সেই মানুষকে বিদায় দিয়ে যেতে বাধ্য হলাম। সে হাসিমুখে তার সিটে আর একটু তলিয়ে গেল। দুটো সিটের একটা টেবিলে বসে উল্টো দিকের চেয়ারে আমাকে বসতে বলল ইচ্ছে। ফটাস করে সিগারেট ধরাল।

–বিয়ে করতে পারলে এর মধ্যে? তমাল বলছিল, তুমি নাকি মেয়ে খুঁজছ?

এই কথাটা খুব চাউর হয়ে গেছে। তমাল একটা শুয়োরের বাচ্চা। একদিন ওদের বাড়িতে মদ খেয়ে মনের কথাটা বলে ফেলেছিলাম। ও আর মন্দ্রা সেটা বাজারে ছেড়ে দিয়েছে। কী চাপ! মন্দ্রার নাম করে মহিলারা আমাকে ফোন করছিল। গলা সুবিধের নয়, একদম পাক্কা প্রো।

তা বলে এই কথা ইচ্ছেকে বলতে হয়! বাস্টার্ড!

–হ্যাঁ, মানে ঠিক ওভাবে নয়, মানে একটা অ্যাবস্ট্র্যাক্ট জায়গা থেকে… একটা সার্চ… একটা
–শাট আপ! বিয়ে করতে চাইলে ইউ হ্যাভ ইওর ব্রাইড সিটিং রাইট ইন ফ্রান্ট অব ইউ।

এই কথাটা বলে সব কটা ঝকঝকে দাঁত দেখিয়ে শক্ত হাসি হাসল ইচ্ছে। আমি কথাগুলোর অর্থ ঠিক বুঝতে পারিনি, পেছন দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম ও কাকে ব্রাইড বলছে। নিজের দিকে আঙ্গুল দেখাল ইচ্ছে।

–ইন ফ্রান্ট। আমি আমি।

ইচ্ছেকে খুব ভাল দেখতে। একটা ঘসা ডেনিম আর খোলামেলা জংলা ধরনের টি শার্ট পরে ছিল। লকলকে ফিগার। কিন্তু অভির সতর্কতা অ্যাম্বুলেন্সের শব্দের মত কানে বেজে উঠল। আমি নিজেকে সেই গাড়িতে দেখতে পেলাম। স্ট্রেচারে একটা ব্যান্ডেজে বাঁধা পা পতাকার মত তুলে চলে যাচ্ছি। পাশে বসে ইচ্ছে একটা ট্যাব নিয়ে খেলছে।

–আমি এখন সেরকম কিছু ভাবছি না। — পেগটা শেষ করলাম।

–হুঁ, ফাইন। কিন্তু তাহলে যেন অন্য কারও সঙ্গে ঘোরাঘুরি করতে না দেখি। আই ব্রেক বোনস, নট হার্টস। চলো, দেখা হবে।

মাথুরের দিকে এগিয়ে গেল। হয়ত ওকে প্রোপোজ করতে। আমি ধা।

এখন রাই-এর মুখের দিকে তাকিয়ে ভয় নয়, একটা সম্ভাবনা মাথায় এল। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আমাকে হাঘরে টাইপের লাগছে। তাই মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি চালাক ভঙ্গিতে বললাম,

–না, ইন সার্চ।

আমার আন্তরিক হাসিকে উপেক্ষা করে রাই বলল।

–বেশি স্মার্ট হবেন না। আমি বুঝতে পারছি আপনি আসলে বৌদির কারণেই আর বিয়ে করেননি। এটা আমার খুব রোম্যান্টিক লাগছে। এই রকমের পুরুষ আজকাল দেখা যায় না। বৌদি একটা স্টুপিড মেয়ে। অসাধারণ একটা রোমান্সের চান্স পেয়েও এগোল না। বিয়ে করে বসল একটা টোটালি বিষয়ী লোককে। আমি হলে…
–কী করতেন?

ভুলে গেলাম আমার দাড়ির কথা। বয়েসের ব্যবধান। আমি উতলা হয়ে তাকিয়ে রইলাম। যদি বলে, যদি কিছু বলে।

কিন্তু এই সময় পেছন থেকে পুরুষকণ্ঠ গলা তুলে রাইকে ডাকল। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, অণুর বর ডাকছে। দুজনে খুব মন দিয়ে আমাকে দেখছে। গাড়ি হর্ন দিচ্ছে বার বার।

হাসল রাই। নিচু গলায় বলল,

–কোথায় যাচ্ছেন? দার্জিলিং তো? ওখানে কথা বলব। বাই।

উচ্ছল ভঙ্গিতে রাই চলে গেল। আমি মায়াজালে মন বিছিয়ে বসে রইলাম। ড্রাইভার তাড়া দিল। আচ্ছন্নের মত টাকাপয়সা মিটিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম।

দার্জিলিং-এ দেখা হবে। কী বলবে রাই?

 

আবার আগামী সংখ্যায়