Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

জৈব চাষের ডায়েরি: ২০১৯-এ বীরভূমে খরা এবং ধান চাষ

অপরাজিতা সেনগুপ্ত

 

শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো যে এই প্রতিবেদনটি লিখছি অত্যন্ত অনিচ্ছায়। না, দোষটা পুরোপুরি সম্পাদকের নাছোড় তাড়ার নয়। আসলে যে অভিজ্ঞতাটা সুখকর নয়, কিন্তু প্রয়োজনে বার বার সেটা নিয়ে আলোচনা করতে হয়, তার একটা মানসিক চাপ আছে। এ যেন মামলা জেতার কোনও আশা নেই জেনেও দুর্ঘটনার সাক্ষী দিয়ে চলা আদালতে, এবং দিবারাত্র যে দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি, তার মধ্যে বারে বারে নিমজ্জিত হওয়া। এ অবস্থায় হয়ত একজন সাংবাদিকের প্রয়োজন ছিল আমাদের; কিন্তু চাষ নিয়ে সংবাদমাধ্যম মাথাও ঘামাতে চান না, আর চাষির সমস্যার মতো বেরঙিন খবর পৌঁছে দিতে বিশেষ উৎসাহও পান না আর। যাঁদের এখনও অবধি উৎসাহ আছে, তাঁরা কখনও চাষ করেননি, তাই চাষির মুখ থেকে কথা শুনে বিভ্রান্তিকর এবং ভুল তথ্যে ভরা সংবাদ শহরে পৌঁছে দেন। অতএব আমাকেই বলতে বলতে হবে, আমাদেরকেই।

এবছর, অর্থাৎ ২০১৯-এ দেশব্যাপী বন্যার নেপথ্যে বীরভূমে (এবং আরও বিভিন্ন জায়গায়) প্রচণ্ড খরাও হয়েছে। যারা চাষ করেন, তাঁদের প্রত্যেকের জন্য তো বটেই, যারা ভাত খান, তাঁদের জন্যও এই খবরটা একটু আশঙ্কাজনক, কারণ প্রকৃতির চিরকালীন খামখেয়ালিপনার ওপরেও গত কয়েক বছরে আরও কয়েক দফা অনিশ্চয়তা ঘনিয়ে এসেছে। ভারতে বর্ষা পিছিয়ে গেছে প্রায় সব জায়গাতেই, এবং যে সময়ে যে বৃষ্টিপাত হত, তার চেয়ে বেশি বা কম হবার একটা ধারাবাহিক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আমরা যারা দেশি ধান চাষ করি জৈব এবং সুস্থায়ী পদ্ধতিতে, অর্থাৎ রাসায়নিক সার, বিষ, মাটির তলার জল ইত্যাদি ব্যবহার করতে চাই না, বৃষ্টির জল তাদের সার, তাদের বিষ, এবং অবশ্যই তাদের একমাত্র জলের উৎস। কেউ কেউ নদী বা খালের জল ব্যবহারের কথা বলেন, কিন্তু নদী/খালে শিল্প এবং কৃষিজাত রাসায়নিকের পরিমাণ সম্পর্কে সচেতন হলে আর সে কথা বলা সম্ভব হয় না। ধানের বীজ একটি চমৎকার বস্তু, যেমন সব বীজই আসলে একেকটি মির‍্যাকল, ছোট্ট একটি আধারে ভয়ানক জটিল সব কোড, অসম্ভব শক্তিশালী কিন্তু অত্যাধুনিক যে কোনও যন্ত্রের মতো অসম্ভব স্পর্শকাতর। দেশি ধান কী, তা বুঝতে হলে প্রথমে জানতে হবে দেশি বীজ আমরা কাকে বলি। যে বীজ বপন করলে সন্ততি আকারে প্রকারে অবিকল পূর্ব প্রজন্মের মাতাপিতার মত হয়, তাকেই দেশি বীজ বলা যায়। থাইল্যান্ড বা কাম্বোডিয়ার চাষিরা গত ১০০ বছর ধরে একটি ধানের বীজ রেখে থাকেন, তাকেও আমরা দেশি ধান বলব। এই বীজ চাষিরা বহু বছরের পরিশ্রমে একাধিক প্রজাতির মিলন ঘটিয়ে স্থায়ী করে তুলেছেন; অর্থাৎ পর পর প্রজন্ম একই রকম হবে, এবং চাষির বীজ কেনার প্রয়োজন হবে না। দেশি বীজ কিন্তু এককালের সঙ্কর বীজ; তবে বহু শতাব্দী ধরে বহু সাধারণ চাষির বহু পরীক্ষানিরীক্ষার (আপনারা জানতেন যে অত্যাধুনিক গবেষণাগার ছাড়া বিজ্ঞানচর্চা হয় না!) পর এখন স্থায়ী। হাইব্রিড এবং উন্নত বীজ একধরনের পরীক্ষার প্রথম বা প্রথম দিককার ধাপ; সেগুলি দেশি বীজের মত স্থায়ী নয়, চাষি সেই বীজ ব্যবহার করলে বার বার বীজ কিনতে বাধ্য হন, এবং বীজ কোম্পানিরা মুনাফা করে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি যে জৈব বীজ কথাটা বীজের ক্ষেত্রে খুব একটা খাটে না। আমরা যদি জৈব বলতে রাসায়নিক সার এবং বিষবিহীন চাষ বুঝি, তবে হাইব্রিড, উন্নত, এমনকি অত্যাধুনিক গবেষণাগারে জিন প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি জিএম বীজও জৈব হতে পারে, কিন্তু জৈব কৃষি বা কৃষকের জন্য এই ধরনের বীজ একেবারেই বর্জ্য।

ধান ভান্‌তে বীজের গীত গাওয়ার কারণ হল এটা বোঝানো যে এই জাতগুলি বাঁচিয়ে রাখতে গেলে চাষ চালু রাখতে হবে। কৌটো বন্দি করে তাপমাত্রা বজায় রেখে বীজ সংরক্ষণ করা হয়ত সম্ভব, কিন্তু তার চেয়ে অনেক চালু এবং অনেক সস্তা উপায় হল বছর বছর বীজগুলি চাষ করা। বিশেষ করে ধানকে বীজ হিসেবে সাধারণ অবস্থায় রেখে দিলে পরের বছর অঙ্কুরোদ্গমের হার অত্যন্ত কমে যায়। দেশি বীজগুলি দিয়ে বহু রকমের উচ্চতা, তাপমাত্রা এবং জল সহনশীলতার অবস্থায় চাষ করা সম্ভব বলে এগুলির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

এ বছর বৃষ্টি না হবার ফলে, এবং তার থেকেও বেশি সঠিক আবহাওয়ার আগাম সতর্কতা না পাওয়ার কারণে বীরভূমে চাষিদের ক্ষতি হয়েছে। যে দেশে ঘন ঘন চাঁদ এবং মঙ্গলে যাবার পরিকল্পনা শুনতে পাচ্ছি, সেখানে বিজ্ঞানের কোন অসহায়তার ফলে বৃষ্টি কখন এবং কতটা পড়বে সঠিক নির্ধারণ করা যায় না তা জানি না। এগুলিকে অবহেলা বলব না ইচ্ছাকৃত মর্কটবৃত্তি বলব তাও জানি না। মোটমাট চাষিদের যদি খরার প্রস্তুতি থাকত, তবে জৈব চাষিরা খরাসহিষ্ণু ধান চাষ করার চেষ্টা করতে পারতেন। আমাদের ৫ রকমের ধানের মধ্যে যে ধানটি খরা সহনশীল, সেটি ফলতে সময় কম নেয়। বীজতলা তৈরি করার পর যে সময়ে এসে বোঝা গেল যে বৃষ্টি সত্যিই হবে না, তখন এই ধানটি ছিটিয়ে (অর্থাৎ রোপণ না করে সরাসরি) চাষ করার সময়ও শেষ। আরও খরা সহনশীল বীজ জোগাড় করা হয়ত সম্ভব, কিন্তু এসব বীজ থাকে কেবলমাত্র সংরক্ষকদের কাছে, ফলে অল্প পরিমাণে। যতদিন না এসব বীজের চাষ ব্যাপক হচ্ছে, ততদিন বিপর্যয় পরিস্থিতিতে চট করে চাষের জন্য পরিমাণমত বীজ পাওয়া যাবে না। যারা চাষ নিয়ে পড়াশুনো করেন তারা জানেন যে ডাল বা মিলেট জাতীয় জিনিস খরায় চাষ করা সম্ভব। কিন্তু পরের দিকে বৃষ্টি হলে এসব শস্য নাও বাঁচতে পারে। এই বছর শ্রাবণের মাঝামাঝিও রোপণ করার মত জল না থাকায় মাঠে চাষ দেওয়া সম্ভব হল না। আমরা শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম যে উদ্বৃত্ত ধান যা আছে গত বছর থেকে, তা দিয়ে আমাদের এই বছরের মতো খাওয়া হয়ে যাবে। কিন্তু তাতেও শান্তি নেই দুটি কারণে। এক, বীজ রক্ষার জন্যও সামান্য হলেও চাষ করতেই হবে, অর্থাৎ চাষের যে খরচগুলি (বীজতলা করা, চাষ দেওয়া, ধান পোঁতা, নিড়েন দেওয়া, ধান কাটা এবং ঝরানো) খানিকটা করতেই হবে। দুই, চাষ দিতে না পারলে মাঠে সবুজ সার করার জন্য যে ধঞ্চে লাগানো হয়েছিল, সেইগুলি বড় বড় গাছ হয়ে গেলে চাষ দেওয়াই যাবে না পরবর্তীকালে, হাল বা ট্রাক্টর রাজি হবে না এই কাজটা করতে। ফলে চাষের এই খরচাটাও করতে হবে। এছাড়া, ধান বা চাল বিক্রি করে যে রোজগার করি, তাও এ বছর আর করা সম্ভব হবে না।

আমাদের আশপাশের চাষিরা জল কিনছেন অজস্র পয়সা খরচা করে। ডিপ টিউবওয়েল বা সাবমারসিবেল পাম্প থেকে নিলে বিঘা প্রতি দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা! খাল থেকে পাম্প লাগিয়ে নিলে পাম্প ভাড়া ১০০ টাকা প্রতি ঘণ্টা। চাষিরা এত খরচা করেও ধান লাগাচ্ছেন, কারণ অন্য কী করা যেতে পারে তাঁরা জানেন না। আমরা হিসেব করে বুঝতে পারছি যে মাটির তলার জলের ওপর মায়া শিকেয় তুলে যদি চাষ করিও, তাহলেও অর্থনৈতিক লাভ শূন্যর কোঠার দিকে গড়াবে। বর্ষার শেষের দিকে বৃষ্টিতে যদি চাষ দেওয়া সম্ভব হয়, তবে আমাদের খামারে আমরা কিছু রাগি চাষ করব।

আবহাওয়ার এই পরিস্থিতিতে সাধারণ চাষির জন্য সরকারি ক্ষতিপূরণ যথেষ্ট নয়। যতক্ষণ না সুস্থায়ী চাষব্যবস্থা ব্যাপক হচ্ছে, ততক্ষণ চাষির লাভের মুখ দেখার আশা নেই। চাষি বীজ, সার এবং বিষ কিনে যা খরচা করছেন, তাতে লাভের অংশ এমনিতেই কম, এবং আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে এই লাভ আরও কমে আসবে। সরকারি দায়িত্ব সর্বোপরি সঠিক সময়ে সঠিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেবার ব্যবস্থা করা; এর জন্য চাঁদ মঙ্গল যাওয়া পিছিয়ে যদি আবহাওয়ার জন্যেই স্যাটেলাইট প্রয়োজন হয়, তার জন্য ব্যয় করা। বিভিন্ন দেশি ধান প্রজাতি সংরক্ষণ এবং চাষ করা, এবং শুধুমাত্র ধান ছাড়া অন্যান্য ফসল চাষ করাও অপরিহার্য। আমাদের মিশ্র খামারে এবার খরার কারণে লেবুর পরিমাণ সাধারণ বছরের থেকে অনেক বেশি, তাই আমরা লেবুর বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে বিক্রি করতে পেরেছি। এছাড়া ডাল, আলু, পেঁয়াজ, বিভিন্ন সবজি, শাক, পেঁপে, কাঁচকলা, সজনে, ডুমুর, মাছ, কাঁকড়া, গুগলি, হাঁসের ডিম, ইত্যাদি আছে বলে খাদ্যের অভাব হবে না।

মাঠের পর মাঠ ধানের যে চিত্র দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি তা অস্বাভাবিক, এবং কোনওক্রমেই সুস্থায়ী নয়; আবহাওয়া পরিবর্তনের এই সময়ে বিভিন্ন মিশ্র চাষের মাধ্যমেই বাংলার কৃষক লাভবান হতে পারেন। ধান বিক্রি করে ডাল, সবজি, ফল না কিনে বরং বিভিন্ন ধরনের চাষ করে অর্থনৈতিক এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখা যেতে পারে।  কিছু কিছু ক্ষেত্রে গত তিরিশ বছরের খাদ্যাভ্যাস পালটে অতিরিক্ত ভাত, আলু, বা গরমে গাজর, বাঁধাকপি, ফুলকপি খাওয়া কমানোর প্রয়োজন আছে। তবে ভাত খাওয়ার সঙ্গে বাংলার চাষির সম্পর্ক কেবলমাত্র ক্ষুন্নিবৃত্তির নয়। এ সম্পর্কে মিলেমিশে আছে ইতিহাস, জীবিকা, শান্তি, সম্পত্তি, মানসিক স্থৈর্য, পরম্পরা, উৎসব। ধান শুধু ভাতের থালা নয়, কৃষিজীবনের তালযন্ত্রও। কিন্তু ধানের দেশি বীজ বা পরম্পরাগত কৃষি বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব এসে পড়ছে কার ওপরে? জৈব চাষিরা সংখ্যায় হাতে গোনা, আর অজৈব চাষিরা তো গত ৩০-৪০ বছর ধরে কোম্পানি এবং কৃষিবিভাগের গিনিপিগ। তাঁরা বিষ নিয়ে কাজ করতে করতে অসুস্থ, চাষে লাভ না করতে করতে ক্লান্ত, বার বার নিজেদের সমস্যার কথা বলতে বলতে মানসিকভাবে ধ্বস্ত, চশমা-নাকে শিক্ষিত কৃষি আধিকারিক, সরকার এবং কোম্পানির ধাপ্পায় বিশ্বাস রাখতে রাখতে বিভ্রান্ত, এবং সন্তান অন্য জীবিকা খুঁজে নেওয়াতে গভীরভাবে অসুখী। পরিবেশ এবং বীজসম্পদ রক্ষার দায়িত্ব কিন্তু সকলেরই, এমনকি শহরের মানুষদেরও। শহরে ও গ্রামে বিষমুক্ত ক্ষুদ্র মিশ্র চাষের বহু উদ্যোগ, আবহাওয়ার আগাম সতর্কতা, এবং নীতিনির্ধারকদের কৃষি এবং পরিবেশ সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছাড়া পরিবেশ বিপর্যয়ের দিনে কৃষি ক্রমশ অসাধ্যসাধন হয়ে উঠবে।