সৌমিত্র দস্তিদার
রথীন মিত্র চলে গেলেন। চলে যাওয়ার বয়সও হয়েছিল। তাই অকালে গেলেন তাও বলা যাবে না। কিন্তু ওই যে সেই প্রায় প্রবাদ হয়ে যাওয়া কথাটা… ‘কোনও কোনও মৃত্যু পাহাড়ের মতো ভারী’… রথীন মিত্রের ক্ষেত্রেও বলা যায়। বলছি বটে, আবার বলতে বলতেই ভাবছি এত বড় একজন শিল্পীর মৃত্যু সত্যিই কি আমাদের দুঃখ দিয়েছে! একটা সময় ছিল যখন রথীন মিত্র বিদেশে গেছেন শিল্পকলার পাঠ দিতে। নিজেও ছবি আঁকতেন অজস্র। অধিকাংশই তেল রং-এ। কিন্তু আচমকাই ওঁর জীবনে, দৃষ্টিভঙ্গিতে বদল ঘটে গেল রাধারমণ মিত্রের ‘কলকাতা দর্পণ’ বইটি পড়ার পরে পরেই। জীবনের প্যাশন হয়ে উঠল নিজের শহর কলকাতা। অলিগলি ঘুরে রঙিন শহরকে মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলেন তিনি। সাবেক রীতি পাল্টে কলকাতার প্রাচীন সৌধ, স্থাপত্যে, মন্দির মসজিদ গির্জার স্কেচ করতে লাগলেন সাদা কালোয়। এত গভীর সে রং যা দেখতে দেখতে কখন যেন টাইম মেশিনে চড়ে পৌঁছে যেতাম পুরোনো কলকাতায়। বাগবাজারে পেরিন সাহেব যেন নিজের বাড়ি বানাতে ব্যস্ত। শোভাবাজারের দেববাড়িতে লর্ড ক্লাইভের বোলবোলা। ফিটন চেপে চাঁদনি রাতে ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী মরিয়মকে নিয়ে হাওয়া খেতে বেরিয়েছেন। গোবিন্দরাম মিত্তিরের নবরত্ন মন্দিরের কাছেই যেন শোনা যাচ্ছে কবিগান আর খেউরের তরজা।
আসলে রথীন মিত্র এ শহরকে আবিষ্কার করেছিলেন পায়ে হেঁটে। ঘুরতে ঘুরতে ভালবেসে ফেলেছিলেন এই স্মৃতির শহরকে। এই একটা কলকাতার মধ্যে আছে অজস্র কলকাতা। কত বৈচিত্র্য। একদিকে সাহেবপাড়া। অন্যদিকে নেটিভ জনবসতি। কত কত বাজার, গলির গলি তস্য গলি। কোথাও চালা কোথাও আবার রত্নমন্দির। চিৎপুরে একা হয়ে রয়ে গেছে এ শহরের প্রাচীনতম মসজিদ— বশরি শা।
ইদানিং হেরিটেজ ভ্রমণের একটা হাওয়া উঠেছে। নো ইওর নেবার বা ওয়াক ফর হেরিটেজ ইত্যাদি ইভেন্টের রমরমা দেখি মুলত সোশ্যাল মিডিয়ায়। নিশ্চিতভাবে ভালো উদ্যোগ। তবে ভয় হয় একেক সময় যে গোটা বিষয়টির পিছনে হুজুগ বা আবেগের পাশাপাশি নিখাদ কলকাতা প্রেম সত্যি সত্যিই কতটা আছে তাই নিয়ে। যেমন আমাদের গুরু তারাপদ সাঁতরা বলতেন দেখনদারি আর গভীর উপলব্ধি এক নয়। ওঁর পাল্লায় পড়ে অনেককিছু শিখেছিলাম; খানকা আর দরগার পার্থক্য থেকে শুরু করে রোড টু চিৎপুরের আসল অবস্থান। ঠিক তেমনিভাবেই, রথীন মিত্রের আঁকা ছবি দেখার আগে ব্রিটিশ যুগের বেশ কয়েকজন সাহেবের আঁকা দেখার সুযোগ হয়েছিল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ভেতরের গ্যালারিতে। ড্যানিয়েল বা অন্যান্য অনেক শিল্পী কলকাতার একটা সময়কে নিশ্চিতভাবে স্থায়ী করে গেছেন নিজেদের দক্ষতায়। কিন্তু রথীন মিত্রের মতো কলকাতার সামগ্রিক ছবি কোনও একজনের আঁকায় পাইনি। কেউ হয়তো নেটিভ কলকাতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন, কারও ছবিতে আবার ধরা পড়েছে সাহেবপাড়ার দৈনন্দিন জীবনের রোজনামচা। রথীন মিত্রের অ্যালবাম হাতে নিলে নিঃসন্দেহে আস্ত জীবন্ত এক কলকাতা আপনার চোখে ভেসে উঠবে। কলকাতার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ শহরকে রেখায় তুলিতে এমনভাবে ডকুমেন্টেড করে রাখার ঐতিহাসিক মূল্যও অপরিসীম। স্রষ্টা বেঁচে থাকেন তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে। রথীন মিত্রও নিশ্চয়ই থাকবেন কলকাতার প্রতি তাঁর নিখাদ ভালবাসার জন্য। তাঁর অসাধারণ সব চিত্রশৈলীর দৌলতে। কোনও সন্দেহ নেই শহর কলকাতা তার সত্যিকারের এক প্রেমিককে হারাল।