Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বন্যা নিয়ন্ত্রণ কোন পথে?

বন্যা নিয়ন্ত্রণ কোন পথে? -- কপিল ভট্টাচার্য

কপিল ভট্টাচার্য

 

শ্রী কপিল ভট্টাচার্যের জন্ম ১২ সেপ্টেম্বর ১৯০৪-এ পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে প্রকৌশল বিদ্যা শেষ করেন ১৯২৮-এ। তিরিশের দশকে ফ্রান্সে উচ্চতর শিক্ষা শেষে স্বদেশে সরকারি কাজে যোগ দেন। তাঁর কাজের অংশ হিসেবেই বাংলার নদ-নদীর গতি-প্রকৃতির ওপর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে 'বাংলাদেশের নদ-নদী ও পরিকল্পনা' গ্রন্থটি বই আকারে প্রকাশিত হলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সরকারি স্তরে ভুল পরিকল্পনায় নদী-মৃত্যু, প্রকৃতি ধ্বংস নিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশে আওয়াজ তুলেছিলেন৷ ভাগীরথীর অপমৃত্যু, পদ্মার সর্বনাশের পূর্বাভাসে ফরাক্কা ব্যারেজের বিরোধিতা করে জুটেছিল দেশদ্রোহীর তকমা৷  নদী বিষয়ে তাঁর আরেকটি গ্রন্থের নাম ‘স্বাধীন ভারতে নদ-নদী ও পরিকল্পনা’ (১৯৮৪)। পেশাগত জীবনে অ্যাসোসিয়েশন অফ ইঞ্জিনিয়ার্স সহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা কাল থেকে আমৃত্যু গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির (এপিডিআর) সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর কলকাতায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

নিম্নলিখিত অংশটি ১৯৮৭ সালে লিখিত কপিলবাবুর একটি বন্যা বিষয়ক লেখার পুনরুদ্ধার। লেখাটি সম্প্রতি 'উৎস মানুষ' প্রকাশিত 'বাঁধ বন্যা বিপর্যয়' নামক সঙ্কলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

…এখন আমরা একটু খতিয়ে দামোদরের বন্যার ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করি। প্রধানত বর্ধমান জেলার নিম্নাংশ, হুগলী, হাওড়া, মেদেনীপুরের কিছুটা দামোদরের বন্যায় শিকার হত। হুগলি নদীর সঙ্গে যেখানে দামোদর নদ এসে মিশছে সেখান থেকে প্রায় বর্ধমান শহর পর্যন্ত যে ব-দ্বীপ, তার দৈর্ঘ্য একশো মাইলের মতো। আর সঙ্গম থেকে ছোটনাগপুরের পাহাড়ে দামোদরের উৎস প্রায় ৩৬০ মাইল। দামোদরকৃত বন্যার প্রকোপ দেখা যায় নীচের এই একশো মাইলের মধ্যেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দামোদরের বন্যা কি কখনও এখানে নিয়ন্ত্রিত হয়নি? ব্রিটিশ রাজশক্তির কৃপাদৃষ্টির জন্যই কি এই অঞ্চলের মানুষ চাতকের মতন যুগের পর যুগ ধরে অপেক্ষা করছিলেন? মোটেই না। সেই ভগীরথের আমল থেকেই এখানকার মানুষেরা দামোদরের বন্যাকে তাঁদের চাষবাসের কাজে ব্যবহার করতেন। বন্যায় বয়ে আনা পলিকে কাজে লাগাতেন জমির সার হিসেবে। কোনো কালা আদমি নয়, একেবারে আগাপাছতলা সাদা চামড়ায় মোড়া ডাক্তার কেস্টলি, স্যার উইলিয়াম উইলককস অ্যাডামস উইলিয়াম প্রমুখ সাহেব বিশেষজ্ঞদের মতে – আষাঢ়ের প্রথম বন্যায় দামোদর যে কোটি কোটি মাছের ডিম ও চারাগাছ ধানের খেতগুলোতে ছেড়ে দিত তারা বাড়ত মশার ডিম খেয়ে। ফলে ম্যালেরিয়ার বাহন মশককুলের ডিম একেবারে উজাড় হয়ে যেত। কৃষকদের কপালে জুটত সস্তায় প্রচুর মাছ। মানব শরীরের অন্যতম উপাদান অ্যানিমাল প্রোটিন। যে সাহেবের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাঁরা মূলত এই অঞ্চলের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবনতির জন্য তাঁদের দেশের শাসকদেরই দায়ী করেছেন। তাঁরা স্পষ্ট বলেছেন, ব্রিটিশ আমলে দামোদরের উপকূলে সুদৃঢ় বাঁধ রক্ষা করে তার বন্যার জলকে জমিতে প্রবেশ করতে না দেওয়ার ফলেই এই অঞ্চলের কৃষিযোগ্য জমির উর্বরতা কমে গেছে, কমে গেছে মাছের প্রাচুর্য।

এখানে অবশ্য উল্লেখযোগ্য যে, দামোদরের দুই পাড়ে বাঁধ দেওয়ার রেওয়াজ আজকের নয়, এই রেওয়াজ চার হাজার বছরের পুরোনো। তবে সে বাঁধ উঁচু ছিল না। প্রতি বছর বন্যার সময় সেই বাঁধ কেটে দিতেন কৃষকেরা। দামোদরের বয়ে আনা পলি আর অজস্র মাছকে নিজেদের কাজে লাগাতেন। আর এই বাঁধ কাটার কাজটা যৌথভাবেই করতেন স্থানীয় কৃষকেরা। সরকারি কর্তৃত্ব ছিল না বললেই চলে। ফলে এই নিয়ন্ত্রিত বন্যার ব্যবহারের জন্য যে তথাকথিত সেচব্যবস্থা, সে বাবদ তাঁদের কোনও রাজস্ব দিতে হত না। বন্যার প্রাকৃতিক তাঁরা রোদ, বৃষ্টি, জলের মতন বিনামূল্যেই উপভোগ করতেন। উইলককস সাহেব আরও বলেছেন- হাওড়া, হুগলীর সমস্ত কানা নদীগুলি দামোদরের নিয়ন্ত্রিত বন্যার সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য কাটা খাল ছাড়া আর কিছুই নয়। তাঁর মতে, ভারতীয় পৌরাণিক যুগের রাজারা ব্যাবিলন মানে বর্তমান ইরাক থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়ে এসে এই খাল বা ক্যানেলগুলো কাটিয়েছিলেন। ক্যানেল শব্দটাই বহুদিন ধরে ভাঙতে ভাঙতে অবশেষে বাঙালির নিজস্ব ‘কানা’ শব্দে পরিণত হয়েছে।

অসভ্য ভারতীয়রা যে প্রাচীনকালে যথেষ্ট সুসভ্য ছিল একথা বহু সাহেবই ঢোঁক গিলে স্বীকার করেছেন। স্বীকার না করে উপায় আছে কি? জলজ্যান্ত নিদর্শন রয়ে গেছে যে। বহু বহু প্রাচীনকালেই আমাদের দেশে নদীর ওপর সেতু নির্মিত হয়েছে। বিরাট মন্দিরগুলির স্থাপত্য-সৌকর্য বিশ্বের মানুষের কাছে অত্যাশ্চর্য ঘটনা। বারাণসীর পত্তন হয়েছিল বরুণা অসি নদীকে নিয়ন্ত্রণ করে।

এই বঙ্গদেশের মানুষ আজ মনে রেখেছে, আগামী শতকেও মনে রাখবে বর্গির হাঙ্গামার কথা। আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক রাজনৈতিক জীবনে এই হাঙ্গামা বিপুল বিপর্যয় ডেকে আনে। সেই সময়ই দামোদর ও কানা নদীগুলির সংস্কার এবং সঠিক ব্যবহার রুদ্ধ হয়ে যায়৷ আর ঠিক সেইসময়েই সওদাগরবেশী ইংরেজরা দখল করল শাসনভার। তৎকালীন ওই বনিক শ্রেণির পক্ষে দামোদরের বাঁধগুলো বা কানা নদীগুলোর সার্থকতা বোঝা অসম্ভব ছিল, তারা ভেবে নিল বাঁধগুলো বন্যা নিরোধের জন্যেই তৈরি আর নদীগুলিকে ভাবল মানুষের কাটা অকেজো খাল। ইংরেজদের তৈরি বিভিন্ন আইনের বলে এই বাঁধগুলো হয়ে গেল জমিদারের সম্পত্তি। এতকাল যেগুলো ছিল জনগণের নিয়ন্ত্রণাধীন। এরই ফলে দেখা যেতে লাগল কোনো কোনো বছর দামোদর তার কঠিন বাঁধ দু-এক জায়গায় ভেঙে ফেলে, গ্রাম-বসতি, মানুষ, পশু ও কৃষিসম্পদ ভাসিয়ে দেওয়া শুরু করল। এই ঘটনাগুলোই আজকের মানুষের কাছে দামোদরের উদ্দাম বন্যার ধ্বংসলীলা বলে পরিচিত। ইতিমধ্যে ইংরেজ নিজেদের শাসন ও শোষণ ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য নির্মাণ করতে থাকল বড়ো বড়ো রাজপথ আর নিয়ে এল রেলপথ। সেই সময় ১৮৫৫ সালে, দামোদরের বন্যা খাস বর্ধমান শহরকেই ভাসিয়ে দেয়৷ তখন তাঁর দক্ষিণ দিকের বাঁধ ভেঙে দেওয়া হয় আর বামপাড়ের বাঁধ আরও উঁচু করা হয়। ইতিমধ্যে বয়ে আনা পলি নদীটির গর্ভে জমে জমে উঁচু হতে থাকে আর সঙ্গে সঙ্গে এই বাঁধ আরও উচ্চতর ও দৃঢ় হতে থাকে। তখন থেকেই নষ্ট হতে শুরু হল নদীর দক্ষিণ গর্ভের জমির এক বিশাল অংশ। আরামবাগ মহকুমার জীবনে অভিশপ্ত দিনেরও শুরু সেই সময় থেকেই।

ব্রিটেন সাম্রাজ্য তার বিশেষ স্বার্থরক্ষার জন্যই হাওড়া, হুগলী, জেলায় শিল্পবাণিজ্য প্রসারে নদীর ধারে ধারে কলকারখানা গড়ে তুলল। গ্র‍্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড আর রেলপথগুলোকে রক্ষা করাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। আর এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই দামোদরের বাঁ কূলের বাঁধের উচ্চতা ও দৃঢ়তা বৃদ্ধি পেতে পারে। উর্বর পলিমিশ্রিত দামোদরের বন্যার জল রাজপথ আর রেলপথের বাঁধে আটকা পড়ে যায়। সাম্রাজ্যবাদী শোষণের সর্বনাশা নীতির ফলে জমির উর্বরতা নষ্ট হল। মাছের চারা আর ধানখেতে প্রবেশ করতে পারল না। সর্বনাশা ম্যালেরিয়ার ধারক মশার ডিম এভাবেই রক্ষা পেয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ম্যালেরিয়া বিষ ছড়িয়ে দিল। দেশের মানুষ ম্যালেরিয়ায় উজাড় হয়ে যেতে লাগল।

ইতিহাসের পাতা ওল্টালেই দেখা যাবে ১৯২৮-৩০-এর প্রচণ্ড রাজনৈতিক আন্দোলনকে সামাল দেবার জন্যই ব্রিটিশ শাসকরা মিস ম্যাকলিয়ডের মারফত পৃথিবী বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ উইলকক্‌স্‌কে আনিয়েছিলেন শুধুমাত্র তাদেরই স্বার্থ রক্ষার্থে। কী সেই স্বার্থ? কে এই উইলকক্‌স্‌ সাহেব? মিশর দেশে নীল নদের বাঁধের জন্য তিনি পৃথিবীবিখ্যাত। মিশরের তুলো চাষ ব্রিটেনের বস্ত্রশিল্পকে দৃঢ় বুনিয়াদের ওপর দাঁড় করিয়েছিল – একথা কখনোই ভোলা চলে না। সুতরাং ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে অবিরাম খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্যেই উইলককসের ভারতে আবির্ভাব। এদেশের মানুষ প্রাচীনতম পদ্ধতি অনুসারে চাষবাসে ফসল ফলাক আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি দৃঢ়তর হোক- এই ছিল তাঁর মূল নীতি। তাই তিনি সুপারিশ করলেন মুখ্যত সেচের জন্য দামোদর ও কানা নদীগুলির পুনরুদ্ধারের আর একথাও বললেন, বছরের কিছু সময় কৃষকদের উপযোগী প্রাচীন পদ্ধতির জলপথ হিসেবেও এগুলো ব্যবহৃত হতে পারবে। আসলে এ দেশের মানুষকে প্রাচীন পদ্ধতি দিয়ে নিতান্ত পশ্চাৎপদ করে রাখবার যুক্তিই তিনি দিয়েছিলেন।

১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাসে আমি লিখেছিলাম, যতদিন না রাষ্ট্রতরীর কর্ণধারগণ তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করেন, ততদিন কোনও পরিকল্পনা, কোনও আইন, কোনও ব্যবস্থা দেশের সাধারণ মানুষের কল্যান সাধন করতে পারে না৷ দামোদর উপত্যকার বহুমুখী পরিকল্পনা তাই আজ সাধারণ মানুষের ভালো না করে মন্দই করছে বেশি। আমি সন্দেহ প্রকাশ করেছিলাম বিপুল অর্থ ব্যয়ে নির্মিত জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের কার্যকারিতা সম্পর্কে। আজ ১৯৮৭-র সেপ্টেম্বরে সারা দেশের মানুষ অবিশ্বাসের চোখে দেখছেন দামোদর উপত্যকার জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রকে৷