Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ফুলতির প্রয়াণে জৌলুষ হারাল ষাইটোল

ফুলতি গীদালি | ষাইটোল শিল্পী

গৌতম সরকার

 

চলে গেলেন ফুলতি গীদালি। ষাইটোলের কী হবে? ষাইটোল একরকম রাজবংশী লোকাচার। ব্রতকথা বলাই ভালো। আরও অনেক লোকপার্বণ, লোককথার মতো ষাইটোলেরও আর তেমন কদর নেই। কিন্তু ফুলতির কদর ছিল। রাজপাট তো দূরের কথা, চালচুলোও কোন কালে ছিল না। বাউন্ডুলে জীবন। শুধু ষাইটোলের কথা শুনলেই লাঠি হাতেই তাঁর কোমর দুলত। ঢাকের বোলে পায়ে নাচের ছন্দ ফিরত। হ্যাঁ, এই পাঁচ কুড়ি আট বছর বয়সেও। তিনি ষাইটোল সম্রাজ্ঞী। রাজবংশী জনজীবনের গন্ডি পেরিয়ে এই বিশেষণেই তিনি সম্মানিত ছিলেন। সরকার তাঁকে বঙ্গবন্ধু পুরস্কার দিয়েছিল। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানিত করেছিল। কেউ একজন তাঁকে নিয়ে ডকুমেন্টারি করেছিলেন। এসব ফুলতিকে স্পর্শই করত না। ষাইটোল তাঁর নেশা, ষাইটোল তাঁর প্রাণ, ষাইটোল তাঁর জীবন। ষাইটোল তাঁকে সংসার করতে দেয়নি। ষাইটোলের টানে তিনি যে বাউন্ডুলে হয়েছিলেন। রাজবংশী লব্জে বাউন্ডুলেকে বলা হয় বাউদিয়া। ফুলতি ষাইটোলের বাউদিয়া।

পুরো নাম ফুলতি বর্মন। তবে লোকে তাঁকে ফুলতি গীদালি বলে চেনে। যে শিল্পী পালা পরিবেশন করেন, রাজবংশী সংস্কৃতিতে তাঁকে গীদাল বলা হয়। স্ত্রীলিঙ্গে গীদালি। ফুলতি ষাইটোলের গীদাল। ষাইটোল আর বাঙালির লোকাচারে ষষ্ঠীর কিন্তু কোন ভেদ নেই। সন্তান কামনা কিংবা সন্তানের মঙ্গলকামনার ব্রত ষষ্ঠীপুজো। রাজবংশী লোকাচারে সেটাই ষাইটোল। বাঙালি যাকে মা ষষ্ঠী বলে, রাজবংশী লোকজীবনে তিনি ষাইটোরি মাও। তাঁকে আরাধনার ব্রতকথা হল ষাইটোল। কিন্তু লক্ষীর পাঁচালির মতো ষাইটোল বই দেখে পাঠ করলে হয় না। নেচে গেয়ে ষাইটোরি মাও-এর আরাধনা করতে হয়। এ ব্রতকথা লিখিতভাবে পাওয়া যায় না।

আরও নানা রকম লোকাচারের মতো ষাইটোল মুখে মুখে ফেরে। সুরের একটি নির্দিষ্ট ধাঁচ আছে বটে। তাতে ভাষা, শব্দ জোগানের কাজটি গীদালির। এই ব্রতে পুরুষের ঠাঁই নেই। ফুলতির মুখে ষাইটোল ভাষা পেত, তাঁর সুরে ছন্দ পেত, তাঁর নাচে আকর্ষণ পেত। এই ব্রতকথায় একজন বাজনদার থাকেন বটে, তিনি ঢাক বাজিয়ে ছন্দটা ধরে দেন শুধু। বাকি কাজটা গীদালির। আরও অনেক লোকাচার এখন লুপ্তপ্রায়। শুধু রাজবংশী কেন, আরও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর নানা ব্রত, পার্বণ আর প্রচলিতই নেই।

ফুলতি আপন খেয়ালে, প্রাণের তাগিদে ষাইটোল ধরে রেখেছিলেন। নাহলে এর প্রয়োজনীয়তা কিংবা আকর্ষণ এখন সমাজে অধিকাংশই আর অনুভব করেন না। ষাইটোল দাঁড়িয়ে ছিল বিশ্বাসের ওপর। রাতভর নাচ-গানে আরাধনায় ষাইটোরি মাও বাড়ির আঙিনায় নেমে এসে বর দেবেন। তারপর বাঁজা নারীর গর্ভসঞ্চার হবে। ফুলতির বিশ্বাস ছিল, তাঁর ডাকে ষাইটোরি মাও মর্ত্যে আসেন। যে গৃহস্থ ষাইটোলের আয়োজন করেন, তাঁর মনস্কামনা পুর্ণ করেন। গীদালির সঙ্গে আরও অনেকে নাচেন, গান। কিন্তু গীদালিই মুখ্য। ব্রতকথা তাঁর মুখেই উচ্চারিত হয় সুরে, ছন্দে।

এই বিশ্বাসটাই যে নেই। কত গর্ভবিষয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন। হাজারটা ফার্টিলিটি ক্লিনিক আছে। সামর্থ্য না থাকলে কত কবিরাজ আছেন। কে আর ষাইটোরির মাও-এর আরাধনার তোয়াক্কা করেন? এই সঙ্কটে ফুলতির অবদান এটাই যে তিনি ষাইটোলকে ব্রতকথার উঠোন থেকে মঞ্চে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাঁর হাত ধরে সমাজে শিল্পের মর্যাদা পেয়েছিল ষাইটোল। সেই কাজটি নিষ্ঠার সঙ্গে করেছিলেন বলেই তিনি ষাইটোল সম্রাজ্ঞী। ২০১০-এ তাঁর জন্যই ষাইটোলকে শিল্পের মর্যাদা দিয়েছিল রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। পান-সুপুরি, দই-খই, আটিয়া কলা, হাঁসের ডিম, পদ্মের গোড়ের মাটি সাজিয়ে যে ব্রতের নৈবেদ্য সাজানো হয়, সুরের জাদুতে আর নাচের ছন্দে সেই উপকরণ ছাড়াই মঞ্চে তাকে বাঙ্ময় করে তুলতেন ফুলতি। রাজবংশী লোকাচারে এমনই অনেক গীদালের মৃত্যুতে ম্লান হয়ে গিয়েছে বেশ কিছু পালাগান।

রাজ্য সরকারের লালন পুরস্কার প্রাপ্ত ললিত কুশানির মৃত্যুর পর আকর্ষণ হারিয়েছে কুশান গান। এই পালাগানে ব্যানা নামে একটি তারের বাদ্যযন্ত্রে যেন শুধু ললিত কুশানির হাতেই সুর খেলা করত। ব্যানা বাজানোর দক্ষ শিল্পী আর নেই। চলতি বছরেই রাজবংশী লোকজীবনের আর এক পালাকার রাজকুমার গীদালকে আমরা হারিয়েছি। তিনিই ছিলেন বিষহরার শেষ সফল পালাকার। বিষহরা বাঙালি লোকজীবনে পদ্মপুরাণের সমগোত্র। ললিত কুশানি আর রাজকুমার গীদালের মৃত্যু কুশান গান আর বিষহরা পালার জৌলুষ কেড়েছে। ফুলতির অনুপস্থিতিতে তাই ভয় হয়, ষাইটোলেরও কি একই পরিণতি হবে? এমন নয় যে কুশান গান আর কেউ গান না। বিষহরারও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু চর্চা আছে। ষাইটোলও আরও কেউ কেউ গেয়ে থাকেন বটে। কিন্তু ললিত, রাজকুমার, ফুলতিদের ক্ষেত্রে পেশার তাগিদ ছিল না। তাঁরা এই শিল্পকে কখনও জীবিকা হিসাবেও দেখতেন না।

ষাইটোলের জন্য পাগল ফুলতির কাছে ঘর কখনও আপন হয়নি। সেভাবে সংসারও করা হয়নি তাঁর। অল্পবয়সে বিধবা। তারপরেও কখনও নিজের দিকে তাকানোর সময় পাননি ফুলতি। ষাইটোলই তাঁর প্রেম, ষাইটোলেই ছিল তাঁর সংসার। তিনি যেখানেই থাকুন, ঘরের মেঝেতে, বাড়ির উঠোনে কিংবা আলো ঝলমল মঞ্চে ষাইটোলের তান ধরলেই তাঁর কোমর দুলত, পায়ে নাচের ছন্দ নামত। স্থানকাল যাই থাকুক, তাঁর গলায় জাদু খেলত ষাইটোলে।–

স্বর্গ হইতে নামিল ষাইটোরি
মঞ্চে দিলেন পাও
কোনঠেখানে আসন হইবে
চিন করি ন্যাও মাগো
চিন করি নাও।

ষাইটোলের প্রতি এই নিবেদিত প্রাণই জীবিত অবস্থাতেই ফুলতিকে কিংবদন্তী করেছিল। ষাইটোলও প্রাণ পেত তাঁর এই দরদে। বাউন্ডুলে না হলে এমনভাবে ছিন্নমূল হয়ে কোনও শিল্পের ধারক হওয়া যায় না। ফুলতি তার বড় প্রমাণ। সে কারণেই ষাইটোলের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হওয়া স্বাভাবিক। কোচবিহার জেলায় দিনহাটার কাছে এক অখ্যাত গ্রামে নিজের আস্তানাতেই গত ২১ অগাস্ট ফুলতির মৃত্যু হয়েছে। আস্তানা বলতে পঞ্চায়েতের দেওয়া বাংলা আবাস যোজনার ঘর। এক কামরার সেই ঘরে তক্তাপোষ। একচিলতে উঠোন। এক বিধবা কন্যার সঙ্গে সেখানেই সম্রাজ্ঞীর মতো জীবন কাটিয়েছেন তিনি। মুখ ফুটে কিছু চাইতেন না কখনও। স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতা, চিকিৎসক, সংস্কৃতি প্রেমী বিভিন্ন সময় নানা ভাবে সাহায্য করেছেন। বিধবা ভাতার ব্যবস্থা করেছিল পঞ্চায়েত। তাতেই জীবন টেনে নিয়ে গিয়েছেন। তাঁর আনন্দ ছিল শুধু কেউ যদি তাঁকে ষাইটোল গাইতে ডাকত। কালের নিয়মে পার্বণে ষাইটোল গাওয়া কমে এসেছে। সরকারি, বেসরকারি নানা সাংস্কৃতিক মঞ্চে তাঁর ডাক পড়ত। ডাক পেলেই বাঁশের লাঠি হাতে প্রস্তুত ফুলতি। সাদা থানে বিধবার বেশ। উস্কোখুস্কো খাটো চুল।

মঞ্চে হাজার ওয়াটের বিদ্যুৎবাতিও নিষ্প্রভ হয়ে যেত ফুলতির ষাইটোলের ঔজ্জ্বল্যে। একারণেই সম্রাজ্ঞী তিনি। একক প্রচেষ্টায় একটি শিল্পকে বহন করেছেন, বাঁচিয়ে রেখেছেন। নাচ, গানের সঙ্গে যে কথকতা ষাইটোলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, তাতেও ফুলতি অনন্য ছিলেন। নেশা ধরানো ছিল তাঁর সুর। আসর বন্দনা শুরু করলেই নীরবতা নেমে আসত উঠোনে বা মঞ্চে। উঠোন হলে পার্বণের উপকরণ শোলার তৈরি ষাইটোরির পট এবং নৈবেদ্য, তেল-সিঁদুর। মাইক-লাইট, কোনও কিছুরই আর দরকার হত না। গানে-নাচে-কথকতায় রাত ফুরিয়ে যেত। তাঁর গানে-কথকতায় বিশ্বাস হত যেন নেমে আসছেন স্বর্গের দেবী। তাঁর বরে মনস্কামনা পূরণ হবে গৃহস্থের। ঘর আলো করে আসবে সন্তান।

অনামী এক লোকগানকে বাঁচিয়ে রাখতে অনলস ছিল তাঁর প্রয়াস। আক পাঁচটি লোকাচারের মতো তিনি ষাইটোলকে আধুনিকতা দোষে দুষ্ট হতে দেননি। যে শিল্পে প্রচারের আলো ছিল না, অর্থের ফুলঝুরি ছিল না, শিল্পীর মর্যাদা পাওয়া উপায় ছিল না, তাকে বাঁচিয়ে রাখার দায় তো ফুলতির মতো খাঁটি সংস্কৃতিপাগলরাই নিতে পারেন। ভোগবাদের হাতছানির মাঝে ষাইটোলকে বাঁচিয়ে রাখার দায় আর কে নেবে? ফুলতি শুধু রাজবংশী লোকজীবনে নয়, গোটা সমাজের সামনেই এই প্রশ্ন ছুড়ে রেখে গেছেন। ষাইটোল এখন গভীর সঙ্কটে।