Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মুসলমানের তালাক নিয়ে বিভ্রান্তি কেন

জিয়াদ আলী

 

ইসলামের উদ্ভব আরব দেশে ৬২২ সালে। পৃথিবীর যাবতীয় মুসলমান আরব দেশকে নিজেদের ‘মক্কা’ বলে মনে করে। কিন্তু আরবের মুসলমান ভারতীয় মুসলমানকে বিন্দুমাত্র মান্যতা দেয় না। বলে ‘কাফের’-এর দেশের বাসিন্দা। খাঁটি পয়লা নম্বরের মুসলমান নয় ভারতীয়রা।

ভারতের হিন্দুরা ভারতীয় মুসলমানকে বস্তুত দ্বিতীয় স্তরের নাগরিক বলে মনে করে। এ মুসলমানের শিক্ষা নেই। অর্থ নেই। মাথা গোঁজার ভালো মতো কোনও ঠাঁই নেই। চাকরি নেই। ধরাধরি করার মতো তেমন সরকারি মুরুব্বি নেই। এ মুসলমান অচল। স্থবির। প্রগতির স্বপ্ন তার কাছে হিন্দুর তুলনায় একেবারেই অধরা। এ মুসলমান আট ফুট জায়গায় আঠাশজন মাথা গোঁজাগুঁজি করে টিকে থাকে গরুছাগলের মতো। এ মুসলমানের সম্বল নেই বড় হওয়ার। অথচ এ মুসলমানের একটা ধর্ম আছে, যা খুবই জলজ্যান্ত। অন্ধ আবেগ-আপ্লুত। আর সেই ধর্ম নিয়ে দেড় হাজার বছর পরও কোনও কাঠামোগত সংস্কার নেই। দেশ বদলাচ্ছে। দুনিয়া বদলাচ্ছে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির নতুন নতুন আবিষ্কার, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে আধুনিক ভাবনার বিচ্ছুরণ ঘটছে। মানুষ চাঁদে যাচ্ছে। মুসলমানের সেদিকে নজর নেই। হুঁশ নেই।

পৃথিবীর অন্তত বিশখানা ইসলামি দেশে ‘তিন তালাক’ বাতিল হয়ে গেছে আইনগতভাবে। ভারতীয় মুসলমান আঁকড়ে আছে সেই তিন তালাক। মুসলমানের মুরুব্বিরা ফতোয়া দিচ্ছে শ্বশুর যদি তার নিজের বৌমাকে ধর্ষণ করে, তাহলে সেই বৌমা হবে শ্বশুরের স্থায়ী যৌনসঙ্গী। কেউ যদি বৌকে রাগের বশে এক মিনিটে তিনবার ‘তালাক’ বলে তাহলে সেই বৌ আর তার ঘরণী থাকতে পারবে না। ভুল শোধরাতে হলে সে বৌয়ের সঙ্গে অন্য পুরুষের বিয়ে দিয়ে (শাদী বা নিকাহ্‌ হালাল) তার কাছ থেকে তালাক নিয়ে স্বামী তার হারানো বৌকে ফিরে পেতে পারে। মুসলমান নারী যেন হাঁড়ি-কলসি। যৌন পণ্য। তাকে নিয়ে যা খুশি করার অধিকার একমাত্র পুরুষেরই। নারী দাসী ছাড়া কিছু নয়। নারীর ওপর পুরুষের এই স্বেচ্ছাচার চলে আসছে ইসলাম ধর্ম সৃষ্টিরও আগে থেকে। যুদ্ধ জয়ের পর পরাজিত দেশের নারী হয় প্রথম লুণ্ঠনের শিকার। শুধু ইসলামী দেশ নয়, সব ধর্মের দেশেই এটাই দস্তুর।

মুসলমানের মহানবি হজরত মহম্মদ জীবদ্দশাতে এমন কুশ্রী ব্যবস্থা নিয়ে আরবে কিছু সংস্কারমূলক বিধান চালু করেন। এ দেশের অশিক্ষিত মোল্লা-মৌলবীরা সেই সংস্কার ভাবনার খোঁজ রাখে না। ধর্মীয় মাতব্বররা নিজেদের কায়েমি স্বার্থে ধর্মীয় আচরণের সংস্কার সাধনকে অগ্রাহ্য করে। অচল, অকেজো অনাধুনিক আচার আঁকড়ে থাকে।

ভারতবর্ষ আরব দেশের মতো মুসলমানের শাসনাধীন নয়। এখানে ৮০ ভাগ মানুষ অমুসলমান। সেই অমুসলমানের সঙ্গে সমঝে চলার আদবকায়দা এতকাল পরেও এদেশি মুসলমান রপ্ত করতে পারেনি। চায়ওনি। দেশভাগের পরেও নয়। পাকিস্তানে ঠেলে পাঠানোর হুমকির মুখেও তারা অনড়। মুসলমানের ভালোমন্দ নিয়ে হিন্দু শাসক কিছু করতে চাইলে বিবাদ বেধে যায় দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে।

তিন তালাক নিয়ে পুরুষের একতরফা স্বেচ্ছাচার বন্ধ করার কথা বিবেকবান মুসলমানদেরই এতদিনে উত্থাপন করা উচিত ছিল। যেমন ১৯৫৬ সালে ভারতীয় সংসদে হিন্দু কোড বিল পেশ করা হয় হিন্দু সাংসদদের উদ্যোগেই। হিন্দুদের সকলে যে সে ব্যাপারে একমত ছিলেন তা নয়। কিন্তু হিন্দু মহাসভার নেতা ব্যারিস্টার এন সি চ্যাটার্জি সংসদে সেই বিল সমর্থন করেন। এই বিলে হিন্দু নারীকে সম্পত্তির অধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়।

তিন তালাক নিয়ে সংসদে নানান বিতর্ক শুরু হয় ১৯৮৯ সালে। বিষয়টা নিয়ে সম্প্রতি বিজেপি সরকার এত চাঙ্গা হয়ে উঠেছে কেন সেটাই ধন্দের বিষয়। বিজেপি চাইছে এদেশে মুসলমানকে অনুপ্রবেশকারী বলে শায়েস্তা করতে। মুসলমানের ধর্মীয় সত্তা বিলোপ করতে। মুসলমানকে ভারতীয়করণ-এর দর্শনে অন্তরিত করতে। স্বাধীনতার দশ দিন পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই পটেল তো মাদ্রাজের বি পোকার বাহাদুর নামের এক মুসলমান কংগ্রেস নেতাকে বলেই ছিলেন— যদি সম্প্রদায়ভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের দাবি তোলেন, তবে এখানে নয়, পাকিস্তানে চলে যান। ১৯৪২ সালে মনুমেন্টের পাদদেশে এক সভায় শ্যামাপ্রসাদ বলেন— মুসলমান এদেশে থাকবে কেন? তারা ইরাকে গিয়ে খেজুর খাক। এসব হুমকির মুখে যে মুসলমান অহরহ হিন্দুর চোখরাঙানি সহ্য করছে, সেই মুসলমানের জন্য পটেলের উত্তরসূরিরা হঠাত তিন তালাক উচ্ছেদের নামে এত বদ্ধপরিকর কেন?

তিন তালাক বিষয়টা কি শুধু নীতিগত, না পদ্ধতিগত? মুসলমান এটাও ভালো করে বোঝে না। তাদের ধর্মগ্রন্থ আল কোরান-এ এ নিয়ে কী নির্দেশ আছে সেটাই বুঝে নেওয়া এখন খুব জরুরি। কারণ আল কোরান ছাড়া মুসলমানের আর কোনও ধর্মগ্রন্থ নেই। সব মুসলমান সব হাদিশ মানে না।

মুসলমানের মুশকিল হল চুরি-ডাকাতি, খুন-জখম, ঘুষ দেওয়া-নেওয়া, কর আদায়, ঋণ শোধ করা, কালোবাজারি, দেশদ্রোহিতা, অন্যকে অসম্মান করা, বে-আইনি সম্পদ মজুত করা থেকে শুরু করে বাড়িঘর বানানো, গাড়ি চাপা, এমনকি জমি-জোত কেনা পর্যন্ত সব ব্যাপারে ভারত সরকারের সাধারণ ফৌজদারি ও দেওয়ানি আইন মেনে চলতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু বিয়ে করা ও বিয়ে ভেঙে দেওয়া নিয়ে মুসলমান ভারতীয় দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন মানতে বাধ্য নয়। সম্পত্তির ভাগ নিয়েও মুসলমান অভিন্ন দেওয়ানি আইনের পক্ষে নয়। প্রেম করার সময় ভারতীয় ফৌজদারি আইনের আওতায় থাকবে, অথচ বিয়ে করা ও বিয়ে ভাঙার সময় বা খোরপোশ দেওয়ার বেলায় মুসলমান ধর্মীয় শরিয়ত আইন ছাড়া চলবে না। সম্পত্তি নিয়ে মামলা মোকদ্দমার সময় মুসলমান কোর্ট-কাছারি করবে সাধারণ ভারতীয় পেনাল কোডের আইন মেনেই। কিন্তু পারিবারিক সম্পত্তি ভাগের সময় তার চাই মুসলিম ব্যক্তিগত আইন।

ভারতে শরিয়ত আইন গ্রহণের সময়, ১৯৩৭ সালে, এই স্ববিরোধিতা নিয়ে বিতর্ক উঠেছিল ইংল্যান্ডের হাউস অফ কমন্সের মধ্যে। তখন তার কোনও সুরাহা হয়নি। ব্রিটিশ শাসকেরা হিন্দুদের জন্য হিন্দু আইন, খ্রিস্টানদের জন্য খ্রিস্টান আইন বা রোমান ল বজায় রেখেছিল কিছু কিছু ক্ষেত্রে। এমনকি, উনিশ শতকে ব্রাহ্ম ধর্মের বিখ্যাত ধনী ব্যক্তি কেশব সেনের মেয়ের বিয়ে নিয়ে সমস্যা হওয়ায় আলাদা করে সিভিল ম্যারেজ আইনও চালু হয়েছিল। ভারতীয় পার্সি সম্প্রদায়ের জন্যও এমন আলাদা আইন আছে। আলাদা আইন শুধু মুসলমানের জন্য এ কথা ঠিক নয়।

এ কারণেই বোধহয় মুসলমান বিয়ে করা বা বিয়ে ভেঙে দেওয়া নিয়ে ফৌজদারি বিধির ১২৫ ধারা মেনে চলতে চায় না। আর এ ধরনের অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর প্রস্তাবেও মুসলমানের ঘোরতর আপত্তি।

মুসলমান বিয়ে ভেঙে দেওয়া বলতে বোঝে বৌকে ‘তালাক’ দেওয়া। তালাক শব্দটা আরবি ভাষার অন্তর্গত। তালাক শব্দের মানে যদি হয় বিয়ে ভেঙে যাওয়া বা বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়া তাহলে স্বামী ও স্ত্রী উভয় পক্ষের তরফ থেকেই তা হতে পারে। কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তালাক বলতে বেশিরভাগ মানুষ ধরে নেয় স্বামী তার স্ত্রীকে ছেড়ে দিচ্ছে। ধর্মগ্রন্থ কোরানের মধ্যে অবশ্য স্ত্রীও স্বামীকে তালাক দিতে পারে বলে উল্লেখ আছে।

আর স্ত্রীকে ছেড়ে দেওয়ার রীতিনীতি নিয়ে অনেকরকম হাস্যকর কাণ্ডকারখানা চলে আসছে ভারতীয় মুসলমানের মধ্যে। যেমন একজন স্বামী ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছে যে সে তার স্ত্রীকে তিনবার ‘তালাক’ বলেছে। অমনি গাঁয়ের মোল্লা-মাতব্বররা ঠিক করে ফেলল যে তার আর স্বামী-স্ত্রী হিসেবে ঘরকন্না করতে পারবে না! তাতে পাপ (গুনাহ্‌) বর্তাবে।

অভাব অনটনের কারণে ঝগড়াঝাঁটি করতে করতে হয়তো কোনও স্বামী রাগের মাথায় স্ত্রীকে শুনিয়ে দিল তালাক, তালাক, তালাক। ব্যস, সেই স্ত্রী সেই স্বামীর কাছে অবৈধ হয়ে গেল!

কোনও স্বামী হয়তো চাকরি, ব্যবসা বা অন্য কোনও কারণে বিদেশে বা অন্যত্র কোথাও থাকে। ছুটিছাটায় স্ত্রীর কাছে আসে। সেই স্বামী বিদেশ থেকে চিঠি লিখে স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিল! এখন তো মোবাইল বা হোয়াটসঅ্যাপেও তালাক চালু হয়েছে।

স্বামী নিজের মুখে তালাক না বলে অন্যকে প্রতিনিধি বানিয়ে তাকে দিয়ে তালাক, তালাক, তালাক বলিয়ে দিলেও তালাক সাব্যস্ত হয়ে গেল!

এসব ঘটনার কথা শুনলে যে কোনও সুস্থ মানুষেরই মনে হতে পারে তালাক দেওয়াটা পুরুষের পক্ষে যেন জলভাত। হাঁড়ি-বাসন ফেলে দেওয়ার মতো বিষয়। তালাক যেন পুরুষের একতরফা স্বেচ্ছাচারের ব্যাপার। কোনও স্ত্রী তার স্বামীকে এরকমভাবে তালাক দিচ্ছে এমন ঘটনা কোথাও শোনা যায় না। তাই মনে হতে পারে স্ত্রীর বোধহয় এভাবে স্বামীকে তালাক দেওয়ার কোনও অধিকার নেই। ধর্মগ্রন্থে সেই অধিকারের কথা বলা হলেও ব্যবহারিক জীবনে তা প্রায় দেখাই যায় না।

প্রশ্ন হল এরকম পদ্ধতিতে তিনবার তালাক বললেই তালাক কি সাব্যস্ত হয়? স্বপ্নের মধ্যে বা রাগের মাথায় এভাবে তিনবার তালাক শব্দ উচ্চারণ করলে সত্যি সত্যি কি স্বামী স্ত্রীর বিয়ে ভেঙে যেতে পারে? অন্য পুরুষের মুখ দিয়ে তালাক বলিয়ে দিলে কি তালাক সিদ্ধ হয়? এসব গালগল্পের কোনও অনুমোদন আছে কি মুসলমানের একমাত্র ধর্মগ্রন্থ কোরানের মধ্যে? মুসলমান কি তার জীবন নির্বাহের ক্ষেত্রে কোরান বর্ণিত নির্দেশ ছাড়া অন্য কিছু বিশ্বাস করে? মুসলমান তো কোরানকে আদি ও অনন্ত বলে মনে করে। যুগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে কোরানের কাঠামোগত পরিবর্তনে মুসলমান বিশ্বাস করে না।

হাদিশের, মোল্লা-মৌলবীর বা ইমামের ফতোয়া বলে যা উচ্চারিত হয় তার পেছনে কি মুসলমানের ধর্মগ্রন্থ কোরানের অনুমোদন আছে? মুসলমানের মহানবি প্রয়াত হন ৬৩২ সালে মক্কা থেকে প্রায় চারশো কিলোমিটার দূরে মদিনা শহরে। তাঁর মৃত্যুর পরে অনেকে অনেক রকমের হাদিশ লিখেছেন। সব হাদিশ আরব দেশের মানুষের লেখাও নয়। বোখারির হাদিশের অনেক কথা মোসলেম শরিফের সঙ্গে মিলবে না। অথচ বলা হয় হাদিশ হল মহানবির বলা কথা ও আচরণের বিবরণ। ইতিহাসের দৃষ্টিতে দেখলে বোঝা যায় ইসলাম ধর্ম আরব দেশের ভৌগোলিক সীমা থেকে অনারব ভূমিতে বিস্তার লাভ করার পর জাতিগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই জাতীয়তা, ভাষা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, এমনকি ইসলামি আইনের ও লোকাচারের ভিন্নতা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও রক্তক্ষয় বেড়েছে মুসলমানের নিজেদের ভেতরেই। ৬৮০ সালের কারবালা যুদ্ধের ঘটনাই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ইরান জয়ের তিনশো বছর পর সে কারণেই ইরানীয় জাতিসত্তা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং আরবি ভাষাকে সরিয়ে ইরানে আবার পার্সি ভাষার প্রাধান্য তৈরি হয়।

১৯২২-এর পর একই কারণে বিপ্লবোত্তর তুরস্কের মুসলমান আরবি ভাষায় আজান দেয় না। আজান দেয় তুর্কি ভাষায়। তুরস্কের মেয়েরা বোরখা ত্যাগ করে। এমনকি, আরবি ভাষার মাদ্রাসা শিক্ষাকেন্দ্রগুলোকে আইন করে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় ১৯২৪ সালে। তুরস্কের অটোমান সুলতানি ব্যবস্থাকে উৎখাত করেন কামাল আতাতুর্ক। আতাতুর্কের এমন সমাজ সংস্কার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও প্রাণিত করে। তুরস্ক ঘুরে এসে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় হিন্দু ও মুসলমানকে তুর্কির দৃষ্টান্ত অনুসরণের আহ্বান জানান ১৯৩৮ সালের শান্তিনিকেতনের এক অভিভাষণে। আতাতুর্কের মৃত্যুদিন স্মরণেই আয়োজিত সভায় রবীন্দ্রনাথ ওই আহ্বান জানান ১৯৩৮ সালের ১৮ নভেম্বর। আতাতুর্কের মৃত্যুর খবর পেয়ে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ছুটি ঘোষণা করেন।

ভারতীয় মুসলমানের মুশকিল হল সে তার ধর্মগ্রন্থ কোরান মাতৃভাষায় পড়ার মতো মুক্ত মনের অধিকারী হয়ে ওঠেনি। তাহলে মুসলমানের বুঝতে কোনও অসুবিধা হত না যে কোরান হল এমন এক ধর্মগ্রন্থ যা মানুষের ব্যবহারিক জীবনের প্রধান প্রয়োজনীয় দিকগুলো সম্পর্কে মানুষকে ওয়াকিবহাল করে তুলতে চেয়েছে। যেমন দাঁড়িপাল্লার ওজন কেমন দেবে, নারী পুরুষের সঙ্গম কেমন হবে, ব্যবসায় মুনাফা করলে কীভাবে কতটা পরিমাণ করা উচিত, মহাজনি সুদ মানুষের কী ক্ষতি করে, কেন মানুষকে ঠকানো বা শোষণ করা অনুচিত, আয়ের একটা নির্দিষ্ট অংশ কেন ফিৎরা বা জাকাত হিসেবে গরিবদের দান করতে হয়, কেন তোমার প্রতিবেশী অনাহারে থাকলে তোমার ঘরে খাবার মজুদ করা যাবে না, কেমন করে যুদ্ধ করবে, কেন আক্রান্ত না হলে কাউকে আক্রমণ করা ঠিক নয়, কখন যুদ্ধে সন্ধি করবে, শত্রুর সঙ্গে কেমন আচরণ করবে, কীভাবে সম্পত্তি ভাগ করবে, প্রেম, ধর্ষণ, নেশা করা, ব্যাভিচার, নারীর রজঃস্রাব, পরিচ্ছন্নতা, ধারশোধের পদ্ধতি, আত্মীয় বিবাহের লাভক্ষতি, খাদ্যাভ্যাস, শ্লীলতা-অশ্লীলতা, মানসম্মান, চাষবাস, পশুপালন, মিতব্যয়িতা, রাস্তাঘাট, যানবাহন, ক্রীতদাসের প্রতি মানবিক ব্যবহার, পুরুষের সন্তান প্রজনন ক্ষমতার অভাবের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি কতরকমের বাস্তব সমস্যার উল্লেখ আছে কোরানে। সেই তুলনায় দর্শনের কথা কতটুকু! কোরান এইভাবে জীবনযাপনের গাইডলাইন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

সব সমস্যা সমান গুরুত্ব না পেলেও যুদ্ধ, সম্পত্তিভাগ, বিবাহবিচ্ছেদের মতো বিষয়গুলো আটঘাট বেঁধেই উল্লেখ করা হয়েছে৷ মুসলমানের মুশকিল হল, ব্যবহারিক জীবনের এরকম অতিবাস্তব সমস্যাগুলোকে ঠিকঠিকভাবে অনুধাবন না করে দোজখ-বেহেশত নিয়ে মজে থাকা। তারপর দ্বীন (ধর্ম) ও দুনিয়া কোনওটাই হয় না ঠিকমতো। শাদি-তালাকের ফতোয়া নিয়েই মুসলমানকে ঘুরপাক খেতে হয়। হাস্যাস্পদ হতে হয় দুনিয়ার বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে।

বস্তুত, বিবাহবিচ্ছেদ যে শুধু পুরুষের একচেটিয়া অধিকারের বিষয় নয়, কোরানের চতুর্থ অধ্যায় ‘নিশা’ (নারী)-তে ১২৮ অংশে বা আয়াতে তা বলে দেওয়া হয়েছে। সেখানে আছে:

কোনও স্ত্রী যদি তার স্বামীর কাছ থেকে দুর্ব্যবহার ও উপেক্ষার আশঙ্কা করে, তারা উভয়ে আপস-নিষ্পত্তি করতে চাইলে তাতে দোষ বর্তাবে না। শান্তিই অধিকতর উত্তম।

তবে পুরুষের দিক থেকে তালাক দেওয়া নিয়ে যেরকম বিস্তারিত উল্লেখ আছে কোরানের মধ্যে, নারীর দিক থেকে তালাক দেওয়ার পদ্ধতি নিয়ে তেমন কোনও পদ্ধতিগত নির্দেশ নেই৷ তালাকের অনুষঙ্গে স্ত্রীর চারিত্রিক নষ্টামির বা ধর্মত্যাগজনিত কারণের উল্লেখ আছে কোরানে৷ কিন্তু পুরুষের স্বেচ্ছাচার, ব্যাভিচার ও ধর্মত্যাগের কথাও বলা নেই ‘তালাক’ সম্পর্কিত অধ্যায়ে।

সমগ্র কোরানের মধ্যে সর্বপ্রথম ‘পুরুষ ও স্ত্রীর বিচ্ছেদ’— এই তিনখানা শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে কোরানের দ্বিতীয় অধ্যায় ‘বাকরাহ’ (The Cow)-এর ১০২ আয়াত বা অংশে৷ বস্তুত কোরানের এই দ্বিতীয় অধ্যায়টাই কোরানের অনেক মূল ও মূল্যবান কথার আকর হিসেবে বিবেচিত হতে পারে৷ এর বেশিরভাগ অংশের সৃষ্টি মদিনা নগরে ৬২২ ও ৬২৩ সালে, দুবছর ধরে। পরবর্তী সময়ে সৃষ্ট কিছু অংশও এই অধ্যায়ে যুক্ত হয়েছে।

ইহুদিদের রাজা ডেভিডের পুত্র ও জেরুজালেমের শাসক রাজা সলোমনের আমলে মানুষের সাধারণ জ্ঞানের বাইরে গুপ্ত বিজ্ঞান (কেউ তর্জমা করেছেন ‘জাদু বিদ্যা’ বলে) নিয়ে যে চর্চা হত সেই প্রসঙ্গ টেনে এনে হারুত ও মারুত নামের দুই দেবদূতের ভূমিকা বর্ণনা করতে গিয়ে ‘স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানোর বিদ্যা শিক্ষা করা’ বলে কোরানে কয়েকটা শব্দের উল্লেখ আছে খুবই বিচ্ছিন্নভাবে।

তাই বলা যেতে পারে কোরানে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে যথাযথ আলোচনার সূত্রপাত ঘটেছে দ্বিতীয় অধ্যায় সুরা ‘আল বাকরাহ’-এর ২২৬ অংশে। যেখানে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে:

যারা স্ত্রী পরিত্যাগ করবে বলে শপথ নেয় তারা অবশ্যই পরপর চার মাস অপেক্ষা করবে। তারপর তারা যদি মত বদলায়, সেই স্ত্রীকেই পুনরায় গ্রহণ করতে পারে।

এই দ্বিতীয় অধ্যায়ের ২২৭ অংশে বলা হয়েছে:

আর তারা যদি বিবাহবিচ্ছেদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে (তারা মনে রাখুক যে) আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ। (Allah is hearer, knower)

এই দুই অংশেই যে মর্মার্থ বেরিয়ে আসে তা হল বিচ্ছেদ ঘটানোর সিদ্ধান্ত নিলেই বিচ্ছেদ হয়ে যায় না। পরপর চার মাস অপেক্ষা করতে হয়৷ এর মধ্যে স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণও করা যায়।

আর এই চার মাস অপেক্ষার পদ্ধতি কী হবে তা নিয়ে একই অধ্যায়ের ২২৮ অংশে বলা হয়েছে:

তালাক পাওয়া নারী তিন ঋতুকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে বিচ্ছিন্নভাবে, আর তারা যদি শেষ বিচারের দিনই  আল্লাহকে বিশ্বাস করে থাকে, তাহলে আল্লাহ তাদের গর্ভে যা সৃষ্টি করেছে তা লুকানো বৈধ হবে না— আর এই অবস্থায় তারা (স্বামীরা) যদি পুনর্মিলন চায়, তাহলে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেবার দাবি থাকবে৷ আর পুরুষদের যেমন নারীদের সম্বন্ধে অধিকার আছে, ন্যায়ত নারীদেরও অধিকার আছে পুরুষদের ওপর; আর পুরুষদের মর্যাদা (অধিকারের মাত্রা) তাদের (নারীদের) কিছু ওপরে।

এখানে যে ‘তিন ঋতু’-কাল বা three (monthly) course কথাগুলো বলা হয়েছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময়। আমাদের দেশে এই ভুল ধারণা চালু আছে যে একসঙ্গে (এক জবানে) তিনবার ‘তালাক’ শব্দ উচ্চারণ করলেই তালাক সাব্যস্ত হয়ে যায়। এই ধারণা যে একদম ভুল এবং মুসলমানের ধর্মগ্রন্থ কোরানের বিরোধী তা আলোচ্য অধ্যায়ের এই ২২৮ এবং তার পরবর্তী ২২৯, ২৩০ ও ২৩১-এ স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে।

কোরানের এই দ্বিতীয় অধ্যায় আল বাকরাহ-তে ২২৯ অংশে বলা হয়েছে:

বিচ্ছেদের কথা দুবার৷ তারপর স্ত্রীকে হয় রেখে দেবে, না হলে সদয়ভাবে বিদায় দেবে৷ আর স্ত্রীকে দেওয়া কোনও কিছু ফেরত নেওয়া উচিত নয়; যদি তাদের উভয়ের আশঙ্কা থাকে যে, তারা আল্লাহ-র সীমারেখা রক্ষা করে চলতে পারবে না, আর তোমরা যদি আশঙ্কা করো যে তারা আল্লাহ-র নির্দেশিত সীমার মধ্যে থাকতে পারবে না, তাহলে স্ত্রী তখন কোনও কিছুর বিনিময়ে মুক্ত হতে চাইলে তাতে কারও কোনও অপরাধ হবে না।

এরপরই ২৩০ অংশে বলা হয়েছে:

এরপর যদি সে বিবাহবিচ্ছেদ করে (তৃতীয়বার) তাহলে সেই স্ত্রী তার পক্ষে বৈধ হবে না৷ যদি না সেই স্ত্রী অন্য আর একজনকে বিয়ে করে। দ্বিতীয় স্বামী বিবাহবিচ্ছেদ করলেই তবে প্রথম স্বামী আবার সেই স্ত্রীকে বৈধভাবে গ্রহণ করতে পারবে।

কোরানের এই বিধানটা একটু জটিল ঠিকই। কিন্তু এই বিধান দেওয়া হয়েছে এই কারণেই যাতে কোনও পুরুষ খেয়ালখুশিমতো স্ত্রীকে তালাক না দেয়। তখন সেই স্ত্রীকে অন্যের দ্বারা যৌনকর্মে ব্যবহার করিয়ে আবার গ্রহণ করার অর্থ হল বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনাকে তামাশায় পরিণত করলে পুরুষকে এ ধরনের মানসিক দুর্ভোগ ও অসম্মানের বিড়ম্বনা সইতে হবে। বোঝাই যায় এই বিধানের উদ্দেশ্য হল ঝোঁকের মাথায় বা স্বেচ্ছাচারের বশে যখন তখন স্ত্রীকে তালাক না দেওয়া।

বিবাহ-বিচ্ছেদের ব্যাপারটাকে যে তামাশায় পরিণত করা উচিত নয় সে ব্যাপারে পরবর্তী ২৩১ অংশে বলা হয়েছে:

আর যখন স্ত্রীকে বিচ্ছেদ করবে এবং নিজেদের নির্ধারিত সময় পূরণ হবে তখন তাদের সদয়ভাবে নিজের কাছে রাখো অথবা তাদের ভালোভাবে বিদায় দাও। নির্যাতনের জন্য তাদের আটকে রেখো না, তাতে তোমরা সীমা লঙ্ঘন করবে, আর যে সীমা লঙ্ঘন করে (বাড়াবাড়ি করে বা নির্দেশ অমান্য করে) সে নিজের ওপর নিজেই অন্যায় করবে। আর আল্লাহ-র নির্দেশকে তামাশায় পরিণত করবে না।

মুসলমানের মান্যতা পাওয়া একমাত্র ধর্মগ্রন্থ কোরানের এই অংশে বিবাহবিচ্ছেদকে প্রকৃত অর্থে উৎসাহব্যঞ্জক ঘটনা বলে মনে হতে পারে না। বিবাহবিচ্ছেদের যে পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে কোরানের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ২২৮ থেকে ২৩১ অংশে তাতে ধরেই নেওয়া যায় বিবাহবিচ্ছেদ ব্যাপারটা খুব সহজসাধ্য বিষয় বা কাজ নয়।

 

(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)