Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নাগরিকত্ব রাজনীতি: অসমের ধর্মীয় ও ভাষিক সংখ্যালঘুদের ভূত-ভবিষ্যৎ

তানিয়া লস্কর

 

ভাবুন। আপনাকে একটি অন্ধকার গুহার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আপনি হাঁটছেন আর হাঁটছেন। পথ শুধু দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। মুক্তির কোনও নিশ্চয়তা নেই। ওপাশে হয়ত অন্ধকার আরও ঘুটঘুটে। বন্দী জীবন। এ মুহূর্তে অসমের প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষ ঠিক এরকম অনুভব করছেন। শুধু উনিশ লক্ষ কেন, অসমে বসবাসকারী প্রায় প্রত্যেক বিবেকবান ব্যাক্তি বিশেষ করে বাঙালিদের অনুভূতি এমনটাই। এক অসহ্য শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। বলা হয়েছে বাদ পড়া লোকদের ১২০ দিনের মধ্যে আপিল জমা করতে হবে। কিন্তু কোথায় আপিল করতে হবে? নিয়ম-কানুনগুলো কী, কিছুই এখনও পরিষ্কার নয়। চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের দু-তিনদিনের ভিতর আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন ৫ জন লোক। মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। ৬৫ জন মানুষের মৃতদেহের উপর দিয়ে নাকি একটি জাতির ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হবে। বাঘা বাঘা প্রগতিশীল নেতারাও এবিষয়ে একমত। চলুন সেই ভবিষ্যৎটা একপাক ঘুরে আসি।

ওরা মানুষের ধার ধারে না, ওরা ধার ধারে শুধু মুনাফার

ধরুন, সব ব্যাটা অনুপ্রবেশকারীদের কব্জা করা গেছে। একদম কম করেও কয়েকলাখ। কারণ এর কম হলে অসমীয়া সংঘটনগুলো মানবে না। এবার আন্তর্জাতিক আইন মোতাবেক তাদের নিজেদের দেশে ফিরিয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে দেশ মানে বাংলাদেশ। তার জন্য একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি প্রয়োজন। এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের এই বিষয়ে কোনও দ্বিপাক্ষিক চুক্তি নেই। সুতরাং ওটি আপাতত হচ্ছে না।

দ্বিতীয়ত, এদেরকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পুরে রাখতে হবে। তারও প্রচুর হ্যাপা। আন্তর্জাতিক আইন ছাড়াও খরচা আছে প্রচুর। আর এত লোক রাখবে কোথায়?

একটিই পথ অবশিষ্ট। আমেরিকান স্টাইলে যদি জেল সংস্কার করে জেলের বেসরকারিকরণ করে এদেরকে ক্যাম্পে রেখে কাজ করানো হয়। কিন্তু যেহেতু এরা সবাই ভারতীয় (অন্তত সার্কামস্টানশনাল এভিডেন্স তাই বলে) তাদের প্রত্যকের জ্ঞাতি-গোষ্টি এখানে রয়েছে। তারা কি এসব হাসিমুখে মেনে নেবে। প্রতিরোধ হবেই। নিটফল অসম হয়ত আবার অশান্ত হবে। তাতে কি শুধু বাঙালিদের ক্ষতি হবে? আর রহিঙ্গাদের মতো জাতিগত নির্মূল্যকরণ এখানে প্রায় অসম্ভব। কারণ বাজারে প্রায় আধা পুঁজি বাঙালি ব্যাবসায়ীদের।

হ্যাঁ, যদি অসমকে অনুপ্রবেশ-এর নামে অশান্ত করা যায় তাহলে, ছত্তিসগড়ের ইত্যাদি জায়গার খনিজ লুট হয়ে গেলে অসম হয়ে উত্তরপূর্বাঞ্চলের বিস্তৃত খনিজ ভাণ্ডার লুটের পথ প্রশস্ত হতে পারে। এই যে বিদেশির নামে বিভ্রম ছড়িয়ে অসমকে উত্তপ্ত করা, হিংসার মুখে ঠেলে দেওয়া, এর আসল উদ্দেশ্য হয়তো এটাই। সুতরাং যেসব প্রগতিশীলরা মনে করেন এনারসি অসমিয়া ভাষার নিরাপত্তার জন্য এনারসি হচ্ছে, তারা অমর্ত্য সেনের ভাষায় বললে “কান দিয়ে দেখছেন”। এককথায় তারা বিভ্রমের শিকার হচ্ছেন। অল্প পরিসংখ্যান ঘাঁটলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে।

ইতিহাসের ঘুরপথ ভুলপথ গ্লানি হিংসা অন্ধকার ভয় আরও ঢের আছে

স্বাধীনতার আগে থেকেই অসমে জন-প্রব্রজন শুরু হয়। মূলত, ‘৭৬ এর মন্বন্তর এবং তৎপরবর্তী খাদ্য-সঙ্কট এর মোকাবিলা এবং এর সাথে মাথাচাড়া দিয়ে উঠা বিদ্রোহ সমূহ যেমন সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ ইত্যাদির মোকাবিলার একটি পন্থা হিসেবে ব্রিটিশ সরকার বাংলার ভূমিহীন কৃষকদের অসমে আসতে উৎসাহ দিতে শুরু করে। ফলে একটি বড় সংখ্যায় বাঙালি কৃষকেরা অসমে চলে আসেন। ১৯১১ সালের লোকগণনা অনুসারে অসমে প্রায় ৫৪ হাজার প্রব্রজনকারী ছিলেন। যারা মূলত, মৈমনসিংহ, রঙ্গপুর এবং জলপাইগুড়ি থেকে এসেছিলেন এবং ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান ছিলেন। সেসময় অসমের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৩,৫৫,৫৪০ জন। ১৯২১-এ সেই সংখ্যা বেড়ে গিয়ে হল ৫,৯৪,৯৮১ এবং ১৯৩১-এ হয় ৯,৫৩,২৯৯ জন। ১৯২১ সাল পর্যন্ত অসমে প্রব্রজনের বিরুদ্ধে কোনও নিয়মনীতি ছিল না। প্রব্রজনকারীরা প্রথমে চর-অঞ্চলে বসবাস করলেও ধীরে ধীরে সমতলেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেন। তখন বিষয়টি নিয়ে অসমিয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভের জন্ম হয়। অনেকে এর বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেন। এর মধ্যে ‘অসমিয়া সংরক্ষিনী সভা’র কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরই সমাধান হিসেবে ১৯২০ সালে অসমে “লাইন সিস্টেম” (Line system) শুরু হয়। এই নিয়মের অধীনে প্রব্রজনকারীদের অসমের কিছু কিছু জায়গায় বসবাস নিষিদ্ধ করা হয়। এবং তাদেরকে মূলত চর অঞ্চল এবং অনুর্বর জায়গাগুলিতে বসবাস করতে বাধ্য করা হয়। কিছু কিছু জায়গায় ম্যাপে লাইন কেটে বঙ্গ-মূলীয় প্রব্রজনকারী এবং অসমিয়াদের মধ্যে এলাকা ভাগ করে দেওয়া হয়। এরপর ১৯২৪ সালে স্বরাজ পার্টির নেতা রোহিনিকান্ত হাতি বরুয়ার নেতৃত্বে আবার প্রব্রজনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চাগাড় দিয়ে উঠে। ১৯২৫ সালে তিনি অসম বিধান পরিষদে জমি বন্টনের ক্ষেত্রে অসমীয়াদের প্রাধান্য দাবিজ করে একটি প্রস্তাব দেন। তিনি অসমীয়াদের “Children of Soil” বা ভূমিপুত্র হিসেবে দাবি করে তাঁদের প্রাধান্যতার উল্লেখ করেন। কিন্তু মুসলিম নেতারা এবং ইউরোপিয়ান সদস্যরা এর বিরোধিতা করেন। ইউরোপিয়রা বিশেষ করে একে ‘Cry of Class Preference’ বা ‘শ্রেণি প্রাধান্যের জন্য রোদন’ আখ্যা দেন।

এরপর ধীরে ধীরে লাইন সিস্টেমের বিরুদ্ধেও আন্দোলন শুরু হয়। মূলত মৌলানা ভাসানির নেতৃত্বে। তিনি ৬১ দিন একনাগাড়ে অনশন করেন। তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হলে বিষয়টি চাপা পড়ে যায় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিকভাবে এ নিয়মের অবলুপ্তি ঘটে। অবশ্য ততদিনে এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবন নদীর সাথে একাত্ম হয়ে গেছে। এদিকে ভারত ভাগের ফলে প্রায় লক্ষাধিক মুসলিমরা পাকিস্তানে ফিরে যান। পরবর্তীতে নেহেরু-লিয়াকত চুক্তির ফলে যদিও পূর্ব প্রব্রজনকারীরা নাগরিকত্ব পেয়ে যান কিন্তু এই প্রব্রজনবিরোধী আবেগ একাংশের লোকের মনে থেকে যায়। প্রথম মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ ঘোষণা করেছিলেন- অসম শুধু অসমীয়াদের জন্য। তখন গান্ধীজী এবং অন্যান্যরা এর বিরোধীতা করেন। কিন্তু জনমনের পরিবর্তন হয়নি। ১৯৭৯ থেকে ‘৮৫ পর্যন্ত অসম আবার উত্তাল হয়ে উঠে। এবার বাংলাদেশ থেকে অবাধ অনুপ্রবেশ ঘটছে এই দাবিতে অসম ছাত্র সংস্থার নেতৃত্বে শুরু হয় অনুপ্রবেশ বিরোধী আসাম আন্দোলন। প্রায় ৪৫ লাখ বিদেশি অনুপ্রবেশকারী লোকের উপস্থিতির দাবীতে অসম ছাত্র সংস্থা ১৯৮৩ সালের নির্বাচন বয়কটের ডাক দেয়। তখনি অসমের নেলীতে প্রায় ৩০০০ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। যাদের মধ্যে মহিলা এবং শিশুর সংখ্যাই বেশি ছিল। এর কয়েকদিন পর চাউলখোয়া চরেও আরও একটি গণহত্যা সংগঠিত হয় যেখানে প্রায় একশোর অধিক লোক মারা যান। বঙ্গাইগাঁও, বরপেটা জেলায় অনেক মুসলিম অধ্যুষিত গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। অবশেষে ১৯৮৫ সালের ১৫ই আগষ্ট সরকার এবং অসম ছাত্রসংস্থার মধ্যে একটি চুক্তির মাধ্যমে এই হত্যাযজ্ঞের সমাপ্তি ঘটে। এই‍ আন্দোলনের একটি দাবি ছিল অসমে ১৯৫১ সালের অসমাপ্ত এনআরসিটি নবায়ন করা। এরপর ১৯৯০, ১৯৯৯ এবং ২০০৫-এ তিনবার তিনটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠক করা হয় এনআরসি-র মডালিটি তৈরি করার জন্য, কিন্তু কোনও ঐক্যমতে পৌঁছানো যায়নি। এরপর অসম সম্মিলিত মহাসংঘ এবং অসম পাবলিক ওয়ার্ক্স নামে দুটি তথাকথিত এনজিও সুপ্রিমকোর্টে অনুপ্রবেশ বিষয়টির সমাধান চেয়ে দুটি রিট-আবেদন দাখিল করলে সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে এনারসি বিষয়টি শুরু করতে নির্দেশ দেয়। ২০১০ সালের ১৭ই মার্চ তরুন গগৈর নেতৃত্বাধীন অসম বিধানসভায় এনআরসি নবায়নের একটি প্রস্তাব ধ্বনিভোটে পাশ হয়। ২০১০ সালে রেজিস্টার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া একটি নোটিফিকেশনের মাধ্যমে বরপেটা এবং কামরূপে একটি পাইলট প্রজেক্ট শুরু করেন। কিন্তু ২১ জুলাই তারিখে একটি প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশের লাঠিচার্জের ফলে ৫ জনের মৃত্যু হয় এবং আরও ৪০ জনের মতো লোক আহত হন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পাইলট প্রজেক্ট বন্ধ করে দিতে হয়। কিন্তু ১৬ জুলাই ২০১২ সালে অসম সরকার আবার রেজিস্টার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া-র কাছে নতুন নোটিফিকেশনের জন্য অনুরোধ জানায়। এরপর ৬ ডিসেম্বর ২০১৩ তে নোটিফিকেশন জারি হয় এবং এ সংক্রান্ত কাজ শুরু হয়।

ধর্মাবতাররা শুনছেন

এত রক্তক্ষয়, এত সংগ্রামের পরেও অসমের ধর্মীয় এবং ভাষিক সঙ্গখ্যালঘুরা সুপ্রিম কোর্টের উপর ভরসা রেখে আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন, বারবার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারে কড়া নেড়েছেন। কিন্তু দ্বিতীয় তালিকা প্রকাশের একরাত পূর্বে যখন লাখ লাখ লোকের নাম অন্তর্ভুক্তির বিপক্ষে বেনামে আপত্তি জমা হয়, চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের একসপ্তাহ আগে মানুষকে একরাত্রের নোটিশ দিয়ে শ, দুশ কিলোমিটার দূরে শুনানির জন্য ডাকা হয় তখন মানুষের আস্তাটা একটুখানি নড়বড়ে হয়ে যায়। তখনি বোধহয় মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেয়ে। যারা চলে যায় তারা ত সব কিছু থেকে মুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু তাদের পরিবারের লোকদের পরীক্ষার শেষ হয় না। তাই তো তালিকা প্রকাশের দিন সকালে প্রথম ফোনটি আসে রুকসা খানের। তিনি হানিফ খানের সহধর্মীনি। হানিফ খান ২০১৬ সনের ৩১শে ডিসেম্বর প্রথম তালিকা প্রকাশের দিন রাত্রে মানসিক ধকল সইতে না পেরে ভাড়াবাড়ির পিছনের একটি গাছে প্লাস্টিকের দড়ি নিয়ে ঝুলে পড়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের নাম এবারেও আসেনি। পাঁচ ছেলে মেয়ের দুটি কেরালায় পাড়ি দিয়েছে। বাবা চলে যাওয়ার পর সংসারের দ্বায়িত্ব যে তাঁদের কাঁধে। এখন আপিল ফাইল করার জন্য তাঁদেরকে যদি আবার অসমে ফিরে আসতে হয়, তাহলে পরিবার চলবে কী করে। সে চিন্তায় মা রুকসা খানের রাতের ঘুম উধাও হয়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিন ফোন করে আপিল কোথায় ফাইল করতে হবে, কবে ফাইলিং শুরু হবে, এসব প্রশ্ন করেন। কী জবাব দেব তাঁকে? এখনও যে কিছুই স্পষ্ট নয়। তাই তাঁর সাথেও আমি, আমরা শুভাকাঙ্ক্ষীরাও অন্ধকার গুহার পদযাত্রী বটে।