Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অসম: অনুপ্রবেশ থেকে অস্থিরতার দিকে

সুদীপ চক্রবর্তী

 

আকাঙ্ক্ষা যেন দূরদর্শিতাহীন না হয়- এই আপ্তবাক্য এনআরসি কাণ্ডে যেভাবে প্রতিফলিত হল, আর কোথাও তেমনভাবে হয়নি। এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর এক সপ্তাহও কাটেনি। অথচ নানা অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরেছে কুড়ি লাখ মানুষকে দেশহীন করে দেওয়ার প্রক্রিয়াকে।

তাঁরা ১২০ দিনের মধ্যে আপিল করতে পারেন। কিন্তু অধিকাংশর সে সামর্থ্য নেই। অধিকাংশ মানুষ থাকেনও এনআরসি ট্রাইবুনাল থেকে অনেক দূরে। নিজেদের নাগরিক প্রমাণ করতে না-পারা মানুষের জন্য ডজনখানেক ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি হয়েছে। এ’ এখন এক বৃহৎ মানবিক ও রাজনৈতিক সঙ্কট, যা মানুষের নিরাপত্তার সঙ্কটও বটে।

অসমকে যে এখন অনিচ্ছুকভাবে পাঁচন গিলতে হচ্ছে, তা স্পষ্ট হয়েছে দেশহীন বিশাল সংখ্যক মানুষের পক্ষ নিয়ে খোদ বিজেপি-সহ নানা পার্টির কট্টর প্রতিবাদে। বিরাট সংখ্যক অ-মুসলিম মানুষও বাদ পড়েছেন এই তালিকা থেকে। অথচ অনুপ্রবেশকারীদের উৎখাত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েই বিজেপি ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোট জিতেছিল অসমে, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটেও ভাল ফল করেছিল।

এদিকে বিজেপির জাতীয় পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে অন্যতম হল অ-মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের ‘নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫’-এর পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশে আশ্রয় দেওয়া৷ ‘(সংশোধনী) নাগরিকত্ব বিল, ২০১৯’, যা ২০১৬ সালের অনুরূপ একটি বিল-পর্যালোচনাকারী সংসদীয় বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ী লিখিত হয়েছে, তাতে কেন্দ্রীয় সরকার ‘আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আসা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যথা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি ও খ্রিস্টানদের’ এ দেশের শরণার্থীর মর্যাদা পেতে গেলে বসবাসের কাঙ্ক্ষিত সময়সীমা এগার বছর থেকে কমিয়ে ছয় বছর করেছেন।

অসমে নাগরিক পঞ্জি ও নাগরিকত্ব বিল এক পরস্পরবিরোধী ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় মানুষের ‘বহিরাগত’ ও ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ সংক্রান্ত দীর্ঘদিনের ক্ষোভ নিরসনের জন্য গৃহীত এক পদক্ষেপ ছিল এনআরসি, যে ক্ষোভ মাঝে মাঝে সহিংস চেহারাও নিয়েছে অহমিয়া ও বোড়ো সংগ্রামের মাধ্যমে। অন্যদিকে তাঁরাই মনে করেন, ‘নাগরিকত্ব আইন সংশোধনী’-র মাধ্যমে ফাঁকতালে সেই অনুপ্রবেশকারীদেরই বৈধতা দেওয়া হবে। ফলে প্রতিবাদ তীব্র হয়। ২০১৯ সালের মে মাসে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের প্রথম দফার মেয়াদ শেষ হলে বিলটিও থিতিয়ে যায়৷ কিন্তু এনআরসি প্রক্রিয়া চলতে থাকে, যাকে পরবর্তী বিজেপি সরকার নিজেদের উদ্যোগ বলে দাবি করে। বর্তমানে দিসপুর ও দিল্লিতে একই পার্টির সরকার। কিন্তু অসমের বরাক উপত্যকা-কাছাড় অঞ্চলের থেকে শুরু করে রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত ধর্ম-ভাষা-সংস্কৃতির সংমিশ্রণ সর্বাপেক্ষা জটিলতা ও এক দাহ্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

এই অঞ্চল আগে অসমের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি ১৮২৬ সালে অসম দখল করে আর তার ছয় বছর পর কাছাড়। অঞ্চলগুলিকে বাংলা প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ সিপাহি বিদ্রোহের পর যখন প্রশাসনিক অঞ্চলগুলির পুনর্বিন্যাস হচ্ছিল তখন সিলেট, কাছাড়, গোয়ালপাড়া এবং আরও কিছু পার্বত্য প্রদেশকে নতুন মুখ্য কমিশনারের অসম প্রভিন্সে সংযুক্ত করা হয়। এইভাবে প্রশাসনিক কারণে বাংলাভাষীরা বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান, সিলেটিরাও হয়ে পড়েন বিচ্ছিন্ন।

দেশভাগের পর পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়। ১৯৪৭ সালে মুসলিম অধ্যুষিত সিলেট যায় নবনির্মিত পাকিস্তানে, সে বছরেরই গণভোটের রায় অনুযায়ী। শুধু সিলেটের একেবারে পূর্বদিকের অংশটি, যেখানে বেশিরভাগ মানুষই হিন্দু ও বাঙালি, সেটি ভারত তথা অসমে থেকে যায়। ১৯৬০ এর দশকে বাঙালি-বিরোধী হিংসাত্মক অভ্যুত্থান, তৎপরবর্তীকালে কাছাড়ের ভাষা আন্দোলনকে সংহিসভাবে দমন করা ইত্যাদি বিরোধ আরও বাড়িয়ে তোলে। তারপর প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান ও পরে ১৯৭১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের ভিড় অসমের চাপ বাড়ায়, চাহিদাও বদলাতে থাকে।

বর্তমানে ২০১৯ সালে বিজেপি শিলচর লোকসভা সিটটি ছিনিয়ে নেয় কংগ্রেসের হাত থেকে। করিমগঞ্জের সিটটি মুসলিম-দরদী অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (AIDUF)-এর হাতছাড়া হয়ে বিজেপির হাতে আসে। ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনেও বিজেপি কাছাড়ের অধিকাংশ সিট পেয়েছিল, যে কাছাড়ের সদর শিলচর। বরাক উপত্যকার হাইলাকান্দি আর করিমগঞ্জ অবশ্য সেবার দখল করে কংগ্রেস ও এআইইউডিএফ।

এখন বিজেপিকে এনারসি-কেন্দ্রিক সন্দেহ প্রশমিত করতে হবে আসাম ও কাছাড়ের মানুষের মন থেকে, ঠিক বিপরীত কারণে। এনআরসি থেকে বাদ পড়া কাছাড় অঞ্চলের বহু অমুসলমান মানুষের কাছেই ‘(সংশোধনী) নাগরিকত্ব বিল’-এর প্রস্তাবিত প্রতিষেধকটি নেই। এ এক অদ্ভুত বিভ্রান্তিমূলক পরিস্থিতি, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠকে খুশি করতে গিয়ে তাদেরই অখুশি করা হয়েছে। অসমকে যে প্যারামিলিটারি বাহিনীর পাহারায় রাখতে হয়েছে, তা প্রমাণ করে মানুষ এনআরসি ক্ষোভে এখনও ফুটন্ত।

 

(মূল নিবন্ধটি মিন্ট পত্রিকায় প্রকাশিত ও লেখকের অনুমতিক্রমে পুনর্মুদ্রিত)