Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এনআরসি ও অনুপ্রবেশ সমস্যা

সুজন ভট্টাচার্য

 

এনআরসি-র পরিপ্রেক্ষিতে প্রায়শই একটা কথা বলা হচ্ছে, ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গে অবৈধ মুসলিম অনুপ্রবেশ ইদানিং মাত্রাছাড়া হয়ে গেছে। পৃথিবীর কোনও দেশেরই সম্পদ অসীম নয়। এই বাড়তি জনসংখ্যার চাপে বৈধ নাগরিকদের প্রাপ্তব্য সুযোগসুবিধার উপর আঘাত আসছে। তাই নাগরিকদের সুরক্ষার জন্যই এদের দেশ থেকে তাড়ানো দরকার। একটা কথা প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো। এই জাতীয় একটি লেখার ক্ষেত্রেও আমি মানবিকতার দোহাই পাড়ি না। কারণ যে বস্তুটা নেই এবং থাকা মানে অপরাধ বলেই বিবেচিত হয়, তার দোহাই পাড়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। যে কারণে আমি ঈশ্বর বা ভূতের প্রার্থনা করি না, ঠিক সেই কারণেই মানবিকতার ওজরও তুলি না। আমার একমাত্র অবলম্বন তথ্য ও যুক্তি। আর হ্যাঁ, উইকি-পণ্ডিত আমি নই। কিঞ্চিৎ পরিশ্রম করে প্রামাণ্য উৎস থেকেই তথ্য সংগ্রহ করি। তথ্য ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের কারখানাও আমার নেই, সেটা সর্বাগ্রে সবিনয়ে স্বীকার করে নিই।

তাহলে মূল প্রতিপাদ্যে আসা যাক। প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল, অনুপ্রবেশ আছে, এবং অবশ্যই আছে। বিশ্বের যেখানেই রাজনৈতিক সীমান্ত আছে, সেখানেই অনুপ্রবেশ আছে। এবং তার গতি যে কেবল একমুখী, এমনটাও সর্বত্র নয়। অনুপ্রবেশের প্রথম দলে থাকেন নিতান্ত হতদরিদ্র মানুষেরা, নিতান্ত রুটিরুজির সন্ধানে তারা এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলে যান। সত্যি বলতে কি, গরিব মানুষের আদৌ কোনও দেশ হয় কিনা, সেটাই ভেবে দেখার। যাই হোক, দ্বিতীয় স্তরে থাকে দেশিয় আইনে অপরাধী হিসাবে যারা ঘোষিত কিংবা অভিযুক্ত, তারা। এদের মধ্যে যেমন সাধারণ চোর-ডাকাত আছে, তেমনই অবশ্যই আছেন রাজনৈতিক কর্মীরা। যেমন ধরুন, ১৯৫১ সালে নেপালে রাণাতন্ত্র উচ্ছেদে মূল ভূমিকা নিয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল। ১৯৫২ সালে দলটি বে-আইনি বলে ঘোষিত হয়। এই দলটির একমাসব্যাপী প্লেনাম হয়েছিল বিহারের দারভঙ্গায়, ১৯৬১ সালে। আবার পরের বছর বারাণসীতে হয়েছিল তাদের তৃতীয় পার্টি কংগ্রেস। বোঝাই যায়, এই দীর্ঘ সময় ধরে CPN-এর নেতৃত্ব ও কর্মীরা এদেশেই ছিলেন। এবং ভারত সরকার যেহেতু সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেননি, তাই এরাও ছিলেন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী।

এর পরে থাকে তৃতীয় স্তর। যদি এই আগমনে দ্বিতীয় রাষ্ট্রটির সায় থাকে, তখন এদের বলা হয় উদ্বাস্তু বা শরণার্থী। যেমন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যে অসংখ্য মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদের শরণার্থীই বলা হয়ে থাকে। আর যদি সেই সায় না থাকে, তাহলেই এদের পরিচিতি হয়ে যায় অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। যেমন বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আগমনের প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলাদেশের সরকার ও সাধারণ মানুষের আবেগ কাজ করেছিল। তখন তারা ছিলেন শরণার্থী। কিন্তু বর্তমানে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ফলে, তাদেরই ধীরে ধীরে অনুপ্রবেশকারীর আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। প্রশ্ন হল, দলে দলে মানুষ দেশত্যাগ করেন কেন? বন্যা-খরা-মহামারী একটা কারণ হতে পারে, কিন্তু কখনই একমাত্র ও প্রধান কারণ নয়। আসলে যখন একটা বিশাল সংখ্যায় মানুষ মনে করেন যে দেশে সাম্প্রদায়িক বা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন, একমাত্র তখনই এমন গণ-পলায়ণ ঘটে, যারাই আবার অন্য দেশে আশ্রয় নিয়ে কখনও শরণার্থী, কখনও অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলে চিহ্নিত হন। ।

স্বাভাবিকভাবেই ভারতবর্ষেও অনুপ্রবেশকারী আছে। এবং তাদের সবাই যে খুব বৈধ পথে এসেছেন, এমনটাও নিশ্চয়ই নয়। ধরুন, জাফনায় যখন শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী গণহারে তামিলদের উপর আক্রমণ শুরু করেছিল, তখন অনেক তামিল সমুদ্র পারিয়ে তামিলনাড়ুতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এখনও হয়তো আছেন। রোহিঙ্গারা ভারতেও আছেন, ঘোষিতভাবেই তাদের জন্য উদ্বাস্তু শিবিরও আছে। প্রচুর নেপালি আছেন। যদিও ১৯৫০ সালের চুক্তি অনুযায়ী নেপালি নাগরিকরা ভারতে বসবাস, ব্যবসাবাণিজ্য কিংবা সম্পত্তি ক্রয় করতে পারেন। এবং সেই সংখ্যাটা এতটাই যে আদতে লেপচা-অধ্যুষিত দার্জিলিং এখন গোর্খাল্যান্ড বলে পরিচিত।

গোটা ভারতেই শেষ সেনসাস হয়েছে ২০১১ সালে। সেই তথ্যটাই এখনও পর্যন্ত সরকারিভাবে স্বীকৃত শেষতম তথ্য। সেই সেনসাসের তথ্য অনুযায়ী ভারতের মোট জনসংখ্যা ছিল ১২১.০১ কোটি, যার মধ্যে হিন্দু জনসংখ্যা ৯৬.৬৩ কোটি (৭৯.৮%) এবং মুসলিম জনসংখ্যা ১৭.২২ কোটি (১৪.২৩%)। সেনসাস রিপোর্টের Chapter 3, Statement II একবার দেখা যাক, যেখানে জনসংখ্যাবৃদ্ধির ধারাবাহিক হার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

সেনসাস           জনসংখ্যা           বৃদ্ধির হার      হার পরিবর্তন
১৯০১           ২৩.৮৩ কোটি            x                 x
১৯১১           ২৫.২০ কোটি           ৫.৭৫               x
১৯২১           ২৫.১৩ কোটি            ০.৩১            (-)৬.০৬
১৯৩১           ২৭.৮৯ কোটি           ১১.০০            ১৭.০৬
১৯৪১           ৩১.৮৬ কোটি           ১৪.২২            (-)৩.২২
১৯৫১           ৩৬.১০ কোটি           ১৩.৩১            ১৬.৫৩
১৯৬১           ৪৩.৯২ কোটি           ২১.৬৪             ৫.১১
১৯৭১           ৫৪.৮১ কোটি           ২৪.৮০             ৩.১৬
১৯৮১           ৬৮.৩৩ কোটি          ২৪.৬৬           (-)০.১৪
১৯৯১           ৮৪.৬৪ কোটি           ৩.৮৭            (-)০.৭৯
২০০১           ১০২.৮৭ কোটি         ২১.৫৪           (-)২.৩৩
২০১১           ১২১.০১ কোটি          ১৭.৬৪           (-)৩.৯০

অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের ক্রমিক হ্রাস ১৯৬১ সাল থেকেই দেখা যাচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে এবার পশ্চিমবঙ্গের তথ্যটা একবার দেখা যাক-

সেনসাস                 জনসংখ্যা           বৃদ্ধির হার          হার পরিবর্তন
১৯১১                  ১.৮০ কোটি            ৬.২৫                  x
১৯২১                  ১.৭৪ কোটি            ২.৯১                (-)৯.১৬
১৯৩১                  ১.৮৯ কোটি            ৮.১৪                ১১.০৫
১৯৪১                  ২.৩২ কোটি            ২২.৯৩              ১৪.৭৯
১৯৫১                  ২.৬৩ কোটি            ১৩.২২              (-)৯.৭১
১৯৬১                  ৩.৪৯ কোটি            ৩২.৮০              ১৯.৫৮
১৯৭১                  ৪.৪৩ কোটি            ২৬.৮৭             (-)৫.৯৩
১৯৮১                  ৫.৪৬ কোটি            ২৩.১৭             (-)৩.৭০
১৯৯১                  ৬.৮১ কোটি            ২৪.৭৩               ১.৫৬
২০০১                  ৮.০২ কোটি            ১৭.৭৭             (-) ৬.৯৬
২০১১                  ৯.১৩ কোটি             ১৩.৮৪             (-) ৩.৯৩

কী আশ্চর্য! ভারতবর্ষের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের ধনাত্মক পরিবর্তন হয়েছে ১৯৩১, ১৯৫১, ১৯৬১, ও ১৯৭১ সালে। এর মধ্যে ১৯৩১ আর ১৯৬১ সালে পশ্চিমবঙ্গেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের ধনাত্মক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু ১৯৫১ আর ১৯৭১ সালে সেই পরিবর্তন হার হয়ে গেল ঋণাত্মক। ১৯৫১ মানে দেশ বিভাগ ও ‘বাঙাল’ উদ্বাস্তুদের আগমনের কাল আর ১৯৭১ মানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। তাহলে? ব্যাখ্যা কী? আছে, অবশ্যই আছে। তবে তার জন্য আরও কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরা দরকার। আবার দেখা যাচ্ছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিবর্তনের হার ধনাত্মক হয়েছে ১৯৬১ সালে। ধরে নেওয়াই যায়, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আবার বহু হিন্দু শরণার্থী হয়ে চলে এসেছিলেন। আবার ১৯৯১ সালেও। এটারও একটা চটজলদি ব্যাখা আছে। বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ১৯৮২ সালে ক্ষমতায় আসেন হুসেইন মহম্মদ এরশাদ। তার আমলেই বাংলাদেশ ইসলামি রাষ্ট্র বলে ঘোষিত হয়। ১৯৯০ পর্যন্ত এরশাদের আমল। এই সময়ে হিন্দুদের উপর গণনির্যাতন চলেছিল বাংলাদেশে। ফলে অজস্র হিন্দু প্রাণের ভয়ে চলে এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে। ঠিক, একদম ঠিক। কিন্তু ১৯৪১ সালেও একই ঘটনা ঘটল কেন?

আবার গোটা ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের ঋণাত্মক পরিবর্তন ঘটে গেল ১৯২১, ১৯৪১ আর ১৯৮১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত চারটি সেনসাসেই। ১৯২১ সালে পশ্চিমবঙ্গেও এই হার ঋণাত্মক এবং সর্বভারতীয় হারের থেকেও কম। একই পর্যবেক্ষণ ১৯৯১ ছাড়া বাকি তিনটি ক্ষেত্রেই সত্যি। তাহলে? হ্যাঁ, ব্যাখ্যা আছে এবং দেবও। তবে তার আগে আরো কিছু তথ্য ঝালিয়ে দেখতে হবে আমাদের।

জানি, অনেকেই অধৈর্য হয়ে পড়ছেন একের পর এক সংখ্যার সারি দেখে। বলতে চাইছেন, মোদ্দা কথাটা বলো না হে বাপধন, মুসলমানরা ব্যাপকহারে বাড়ছে, আর কমছে হিন্দুরা। নাকি সেই কথাটা বলতে চাইছ না বলেই এত স্পিনের ছররা! ঠিক আছে, তাহলে এবারে আমরা ভারতের জনসংখ্যায় হিন্দু ও মুসলমানের আনুপাতিক তুলনার সংখ্যাতত্ব দেখেই নিই। এক্ষেত্রে ১৯৫১-পূর্ববর্তী সংখ্যা আর বিচারে আনা হয়নি, কারণ ১৯৪৭ সালের আগে অখণ্ড ভারতের জনসংখ্যার যে সম্প্রদায়গত বৈশিষ্ট্য ছিল, সেটা অনেকাংশেই ব্যাহত হয় দেশভাগের ফলে। নিচের তালিকায় ১৯৫১ থেকে ২০১১ সালের সেনসাসে ভারতে হিন্দু ও মুসলিম জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার কত শতাংশ, সেই হিসাব দেওয়া হয়েছে।

সেনসাস   হিন্দু সংখ্যা  শতাংশ  মুসলিম সংখ্যা শতাংশ
২০১১        ৯৬.৬২    ৭৯.৮০     ১৭.২২      ১৪.২২
২০০১        ৮২.৭৬    ৮০.৫০     ১৩.৮২      ১৩.৪০
১৯৯১        ৬৯.০১     ৮১.৫৩     ১০.৬৭      ১২.৬১
১৯৮১        ৫৬.২৪     ৮২.৩১     ৮.০৩       ১১.৭৫
১৯৭১        ৪৫.৩৩     ৮২.৭০     ৬.১৪        ১১.২০
১৯৬১        ৩৬.৬৫     ৮২.৭৬     ৪.৬৯       ১০.৬৮
১৯৫১        ৩০.৩৬     ৮৪.১০     ৩.৫৪        ৯.৮০

উপরের তালিকা থেকেই পরিষ্কার, ভারতে মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাত বাড়ছে, আর কমছে হিন্দু জনসংখ্যার অনুপাত। ৬০ বছরে হিন্দুদের শতাংশ কমেছে ৪.৩০ আর মুসলমানদের বেড়েছে ৪.৪২। কি আশ্চর্য! হিন্দুরা অনুপাতে কমেছে, মুসলমানদের বৃদ্ধির হার তার থেকে সামান্য হলেও কিন্তু বেশি। জানি, অনেকেরই মুখ হাসিতে ঝকঝক করছে। ভাবছেন, আর কী! প্রতিপাদ্য তো প্রমাণ হয়েই গেল। অতএব অনুপ্রবেশের তত্ত্ব সঠিক। এবার তাড়াও ওদের। দাঁড়ান, দাঁড়ান, হাতে লাঠি নিতে গেলেও আগে দেখে নিতে হয় লাঠিতে ঘুন ধরেছে কিনা। তাহলে আসুন পরিসংখ্যানের আরও কয়েকটা অঙ্ক সেরে নেওয়া যাক।

প্রশ্ন – ১/ ১৯৫১ সালে হিন্দু জনসংখ্যা ৩০.৩৬ কোটি আর ২০১১ সালে ৯৬.৬২ কোটি। এই ৬০ বছরে তাহাদের মোট বৃদ্ধি কত? আর তাহাদের বৃদ্ধির বার্ষিক গড় কত?
উত্তর – হিন্দু জনসংখ্যার মোট বৃদ্ধি ৬৬.২৬ কোটি। তাহাদের বৃদ্ধির বার্ষিক গড় ১.১০ কোটি।
মন্তব্য – উত্তর সঠিক

প্রশ্ন – ২/১৯৫১ সালে মুসলিম জনসংখ্যা ৩.৫৪ কোটি আর ২০১১ সালে ১৭.২২ কোটি। এই ৬০ বছরে তাহাদের মোট বৃদ্ধি কত? আর তাহাদের বৃদ্ধির বার্ষিক গড় কত?
উত্তর – মুসলিম জনসংখ্যার মোট বৃদ্ধি ১৩.৬৮ কোটি। তাহাদের বৃদ্ধির বার্ষিক গড় ০.২৩ কোটি।
মন্তব্য – উত্তর সঠিক

প্রশ্ন – ৩/ তাহা হইলে আজ হইতে কত বর্ষ পরে ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা হিন্দুদের সমান হইবে?
উত্তর – ৬০ বছরের গড় হিসাবে, প্রতি বছরে ভারতে হিন্দু জনসংখ্যার বৃদ্ধি মুসলিমদের তুলনায় ৮৭ লক্ষ বেশি। হিন্দুদের মোট শতাংশ এবং এই হিসাবকে মাথায় রেখে বলা যায়, হিন্দুরা গণ-নির্বীজকরণ না করালে অথবা গণ-আত্মহত্যা না করলে কিংবা গণহারে ধর্মান্তরিত না হলে, সেটা কোনওদিনই সম্ভব নয়।

 

এইবারে আসুন দ্বিতীয় তালিকায়। ১৯৫১ সালকে ভিত্তিবর্ষ ধরলে, ১৯৬১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ভারতে হিন্দু ও মুসলিমদের দশকব্যাপী বৃদ্ধির হার ও তার পরিবর্তন কত হয়েছে, সেটা দেখা যাক।

সেনসাস          হিন্দু                    মুসলিম
                বৃদ্ধি      হার পরিবর্তন     বৃদ্ধি    হার পরিবর্তন
২০১১       ১৬.৭৬    (-)৩.১৬         ২৪.৬      (-)৪.৯২
২০০১       ১৯.৯২    (-)২.৭৯         ২৯.৫২    (-)৩.৩৬
১৯৯১       ২২.৭১     (-)১.৩৬        ৩২.৮৮       ২.১
১৯৮১       ২৪.০৭       ০.৩৯        ৩০.৭৮    (-)০.১৪
১৯৭১       ২৩.৬৮       ২.৯২        ৩০.৯২    (-)১.৫৭
১৯৬১       ২০.৭৬     অপ্রযোজ্য      ৩২.৪৮   অপ্রযোজ্য

স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, ভারতে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষেরই বৃদ্ধির পরিবর্তনের হার ঋণাত্মক। হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমছে ১৯৯১ সাল থেকে। আর মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির আনুপাতিক হার ১৯৯১ বাদে ধারাবাহিকভাবেই কমছে। এবং প্রতিটি সেনসাস-বছরেই মুসলিমদের অনুপাত কমার সেই হার হিন্দুদের থেকেও বেশি।

নিশ্চিত জানি, এত তথ্য বা তার বিশ্লেষণের পরে কেউ কেউ বিদ্রূপ করছেন, ষাট বছরের হিসাব কেন মশাই! কী আড়াল করতে চাইছেন? শেষ দশ বা বিশ বছর নিয়ে বলুন। তালেই তো আপনার ভাণ্ডা ফুটো হয়ে যাবে। হিন্দু আর মুসলিমদের মধ্যে সংখ্যার পার্থক্য যে কমছে, সেটা দেখতে পাচ্ছেন না? কিছু তাত্ত্বিক আবার আছেন, যারা বলবেন, দুটো Block যে convergent, সেটা বুঝতে পারছেন না! সাম্প্রতিক প্রচারের বহরে কিংবা দাদনের দায়ে এমন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তাহলে আসুন, দেখাই যাক, গত ষাট বছরের প্রতিটি সেনসাসে হিন্দু আর মুসলিমের সংখ্যার পার্থক্য কী হারে কমেছে।

সেনসাস      হিন্দু সংখ্যা(কোটি)      মুসলিম সংখ্যা(কোটি)     পার্থক্য(কোটি)
২০১১          ৯৬.৬২                   ১৭.২২                  ৭৯.৪০
২০০১          ৮২.৭৬                   ১৩.৮২                 ৬৮.৯৪
১৯৯১          ৬৯.০১                    ১০.৬৭                 ৫৮.৩৪
১৯৮১          ৫৬.২৪                    ৮.০৩                  ৪৮.২১
১৯৭১          ৪৫.৩৩                    ৬.১৪                   ৩৯.১৯
১৯৬১          ৩৬.৬৫                    ৪.৬৯                  ৩১.৯৬
১৯৫১          ৩০.৩৬                    ৩.৫৪                  ২৬.৮২

সে কি কাণ্ড! ফারাক কমছে কোথায়! উলটে প্রতিটা সেনসাসেই যে বেড়ে যাচ্ছে। তাহলে? মুসলিমরা নাকি একেকজন ১০-১২টা করে বিয়ে করে আর প্রতিটা বিবির গর্ভেই প্রত্যেক বছর বাচ্চা পয়দা করে, জানেন তো! তাহলে ফারাকটা কমছে না কেন? এ কী রহস্য! নাকি হিন্দুরাও লুকিয়েচুরিয়ে চারটে-পাঁচটা পত্নী বা উপপত্নী পুষে একই খেলা খেলে যাচ্ছে? তাহলে এবার আসুন, এই পার্থক্যের শতাংশ বৃদ্ধি হারের ওঠানামা দেখা যাক

সেনসাস       পার্থক্য (কোটি)        বৃদ্ধি (কোটি)
২০১১            ৭৯.৪০               ১০.৪৬
২০০১            ৬৮.৯৪              ১০.৬০
১৯৯১            ৫৮.৩৪              ১০.১৩
১৯৮১            ৪৮.২১               ৯.০২
১৯৭১            ৩৯.১৯               ৭.২৩
১৯৬১            ৩১.৯৬               ৫.১৪
১৯৫১            ২৬.৮২             অপ্রযোজ্য

তাহলে কী দেখলাম? প্রতিটি সেনসাসেই মুসলিমদের তুলনায় হিন্দুদের সংখ্যার পার্থক্য বৃদ্ধি ক্রমাগত বাড়ছে। ২০১১ সালের সেনসাসে কমেছে যৎসামান্য, ১৪ লক্ষ। জানি কেউ কেউ লাফিয়ে উঠতে চাইছেন। তারা বলবেন, মুসলিম মহিলাদের সন্তান বেশি হয়, এটা সবাই জানে। তাহলে আসুন, আরেকটা পরিসংখ্যান দেখে নেওয়া যাক।

২০১৫-১৬ সালে ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে অনুযায়ী ভারতে মুসলিম মহিলাদের ফার্টিলিটি রেট ২.৬ আর হিন্দু মহিলাদের ২.১। তার মানে গড়ে মুসলিম মহিলাদের সন্তান হয় ২.৬ জন আর হিন্দু মহিলাদের ২.১। জানি অনেকেই লাফিয়ে উঠবেন। ওই তো, মুসলমানদের বাচ্চা বেশি হয়, বোঝাই তো গেল। তাহলে এত গালগল্পের মানে কী? তাহলে আসুন, ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের তথ্যগুলো দেখা যাক –

        ফার্টিলিটি রেট

সাল            হিন্দু            মুসলমান        পার্থক্য         হ্রাস

১৯৯২-৯৩      ৩.৩              ৪.৪            ১.১            X

১৯৯৮-৯৯         ২.৮           ৩.৬            ০.৮         ২৭.২৭%

২০০৫-০৬        ২.৬            ৩.৪            ০.৮         ০.০০%

২০১৫-১৬         ২.১            ২.৬            ০.৫         ৩৭.৫০%

তার মানে ভারতে হিন্দু-মুসলিম সর্বস্তরেই ফার্টিলিটি রেট রেট কমছে। ১৯৯২-৯৩-কে ভিত্তি করলে হিন্দুদের কমেছে ১.২ (৩৬.৩৬%) আর মুসলিমদের ১.৮ (৪০.৯১%)। আবার যদি শেষ ১০ বছরের হিসাব করা হয়, তাহলে হিন্দুদের মা-প্রতি সন্তানের জন্ম কমেছে ০.৫ (১৯.২৩%) আর মুসলিম মহিলাদের ক্ষেত্রে ০.৮ (২৩.৬০%)। অর্থাৎ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগে ২০১৫-১৬ সাল পর্যন্ত শেষ ২৫ বছরে মুসলিম মহিলাদের সাফল্য হিন্দু মহিলাদের তুলনায় বেশি।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, মুসলিমদের বৃদ্ধি হার যে হিন্দুদের থেকে বেশি, এটাও তো এই প্রবন্ধে আগেই দেখানো হয়েছে। তাহলে স্বাভাবিক প্রতিপাদ্যের ঠিক উলটো ফল দেখা যাচ্ছে কেন? তাহলে কোনটা ঠিক? উত্তর হল, দুটোই ঠিক।

আসলে হিন্দুদের ভিত্তি সংখ্যাটাই মুসলিমদের তুলনায় এতটাই বেশি যে মুসলিম বৃদ্ধি হারের বাড়তি অঙ্ক সেখানে প্রভাব ফেলতে পারছে না। আর বাস্তবত মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির যে অঙ্ক দেখিয়ে ভীতি জাগানো হচ্ছে, সেটিও একপাক্ষিক, কোনও যুক্তিসম্মত পর্যালোচনা ছাড়াই। ভিত্তি বাদ দিয়ে পরিসংখ্যানগত কোনও আলোচনাই হয় না। যেমন ভিত না বানিয়ে করা যায় না ছাদ ঢালাই। টক কমলালেবুর বদহজমে অবশ্য আজকাল কেউ কেউ ভিত না বানিয়েই সাত তলার ছাদ ঢেলে দেন। তাতে প্রভুরা খুশি হন, হয়তো দাদনের মান বাঁচে। কিন্তু তাতে সত্যের কোনও প্রতিফলন ঘটে না।

প্রকৃত বাস্তব হল, ভারতে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের বৃদ্ধি হার কমছে। বাড়ছে মুসলিমদের তুলনায় হিন্দুদের সংখ্যার পার্থক্য। ফলে ভারতে মুসলিমরা একদিন সংখ্যাগুরু হয়ে যাবে বলে যে ভয় দেখানো প্রচার হয়, সেটা ভিত্তিহীন, মিথ্যে। মোদ্দা কথা হল, দেশের অর্থনীতির যখন যক্ষারোগ ধরেছে, একের পর এক উন্মাদ সিদ্ধান্তে তাকে ভেন্টিলেটরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, তখন সেই সামগ্রিক সংকট থেকে সাধারণ মানুষের চোখ ফিরিয়ে রাখার জন্যই এইসব গালগল্পের জন্ম।

এরপর আমরা পশ্চিমবঙ্গের আলোচনায় ঢুকব।

 

(আবার পরের সপ্তাহে)