Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ইস বিন ভারয়ানডেট: ভার্চুয়াল রিয়্যালিটিতে কাফকা

রোহন দত্ত

 

শিল্পমাধ্যম হিসেবে সদ্যোজাত ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি। ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির সঙ্গে বাংলাবাসী তথা ভারতবাসীর পরিচয় এক অর্থে এখনও হয়নি। শহুরে সচ্ছল তরুণজীবনে যদিও এর প্রবেশ ঘটেছে ভিডিও গেম-এর মাধ্যমে কিন্তু শিল্পমাধ্যম হিসেবে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি এখনও আমাদের কাছে অপরিচিত। ভার্চুয়াল রিয়্যালিটিতে অ্যানিমেশন এবং সিজিআই এফেক্ট ব্যবহার করে তৈরি করা হয় একটি ভার্চুয়াল দুনিয়া। বিশেষ হেডগিয়ার ব্যবহার করে দর্শক প্রবেশ করতে পারেন এই দুনিয়ায়। হেডগিয়ারে লাগানো বিশেষ চশমার সাহায্যে দর্শক দেখতে পান শিল্পীর কল্পনা, বিশেষ স্পিকার কানে লাগিয়ে শুনতে পাওয়া যায় সেখানে কী ঘটছে। এই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে গেমাররা নিজেদের পছন্দের চরিত্র হয়ে ওঠেন ভিডিও গেমে। বিশেষ চশমা পরে আপনি হাঁটতে আরম্ভ করলে আপনার ভার্চুয়াল শরীরও হাটতে শুরু করে। বিশেষ যে হ্যান্ডগিয়ারটি দেওয়া হয় সেটা হাতে নিয়ে আপনি হাত উঁচু করলে আপনার ভার্চুয়াল সেলফের হাতও শূন্যে মেলে ওঠে। সিনেমা অথবা থিয়েটারে দর্শকরা দেখেন প্রথম পুরুষে, ভার্চুয়াল রিয়্যালিটিতে দর্শক উপনীত হন উত্তম পুরুষে। থিয়েটারে যে চতুর্থ দেওয়াল ভাঙার কথা আমরা শুনেছি আপাত অর্থে সেটাই ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি দিয়ে ভেঙে দেওয়া যায়। সুদূর চেক প্রজাতন্ত্রবাসী শিল্পী মিকা জনসন কাফকার মেটামরফোসিস গল্পের একটি পুনর্নির্মাণ করেছেন এই ভার্চুয়াল রিয়্যালিটিতে, নাম দিয়েছেন ভিআরওয়ানডলুং।

ফ্রাঙ্কফুর্ট, মাদ্রিদ, বটোকিও, অসলো সহ মোট তেত্রিশটা শহরে ভিআরওয়ানডলুং-এর প্রদর্শনী করে কলকাতায় এসেছিলেন তিনি। গত পাঁচ সেপ্টেম্বর থেকে দশ সেপ্টেম্বর অবধি গ্যেটে ইনস্টিটিউট লাইব্রেরির এক অংশে চলেছে ভিআরওয়ানডলুং-এর প্রদর্শনী।

ভার্চুয়াল রিয়্যালিটিতে কাফকার মেটামরফোসিস— এমন বিষয় ভাবনার রোমাঞ্চেই আমরা কয়েকজন পৌঁছে গিয়েছিলাম গ্যেটে ইনসটিউটে। লাইব্রেরির একটি অংশ কালোপর্দা ঘিরে দেওয়া হয়েছিল। বিশেষ হেডগিয়ারটি পরে নিলেই মুহূর্তের মধ্যে পোঁছে যাওয়া যাচ্ছিল গ্রেগর সামসার শরীরে। গ্রেগরের হয়ে কাটানো যাচ্ছিল প্রায় পাঁচ মিনিট। মাথায় গিয়ারটি পরে নেওয়ার পর দেখলাম গ্রেগরের ঘরের এক কোণায় খাটের ওপর দাড়িয়ে আছি। জড়তায় বেশ কিছু মুহূর্ত কাটল। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম ঘরের জানালার দিকে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। জানালার বাইরের উঁচু ইমারতগুলো ঝাপসা হয়ে আছে। কানে শুনতে পাচ্ছি বৃষ্টির ঝম ঝম শব্দ। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ শুনলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম ঘরের দরজা দুটোর একটি কেউ বাইরের দিক থেকে খোলার চেষ্টা করছে। চাপা কান্নার আওয়াজ শুনলাম। বুঝতে পারলাম এটা গ্রেগরের বোন গ্রিটের গলা। শুনতে পেলাম গ্রেগরের মায়ের দরজা খুলে দেওয়ার কাকুতি মিনতি। ঘরে রাখা আছে তিনখানি আসবাব, একটি বুককেস, একটি ড্রয়ার শেল্ফ আর একটি ড্রেসিং টেবিল। আয়নার দিকে চোখ ফেরাতেই দেখলাম বদলে গিয়েছি এক প্রকাণ্ড আরশোলায়। অনেকেই সেই দৃশ্যে শিউড়ে উঠেছেন। কপালে জমে উঠেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। একটানা বৃষ্টির শব্দ, চাপা কান্নার শব্দ, দরজায় বারংবার আঘাত থেকে আয়নায় নিজের বদলে যাওয়া বীভৎস সেই শরীর দেখে প্রথমে ভয় না লাগলেও ভীষণ বিভ্রান্ত লাগছিল। ভাবতে চেষ্টা করছিলাম এরকম অবস্থায় কী করা উচিত। এরকম হলে কেউ কী করে? দরজাটা এই মুহূর্তে ভেঙে গেলে কী হবে? কে ঢুকে আসবে? উদভ্রান্তের মত এদিক সেদিক খুঁজতে চেষ্টা করছিলাম কিছু। কিন্তু কী খুঁজছিলাম সেটা পরে ভাবার চেষ্টা করেও বুঝে উঠতে পারিনি। দেখলাম বইয়ের তাকে রাখা রয়েছে পাস্কাল। ড্রেসিং টেবিলে রাখা রয়েছে ফেলিস, ওয়ালসারের নামে চিঠি। বিছানার নিচে খুঁজে পেলাম জামাকাপড়ে ভর্তি বাক্স। নকশা জাতীয় একটি কাগজ।লেখার টেবিলের ওপর একরাশ কাগজপত্র। বইয়ের তাকের ওপরের দেওয়ালে দেখলাম একজন মহিলার ছবি। প্রায় ৫ মিনিট ধরে কাটালাম একটা দুঃস্বপ্নের ভিতর। তারপর খুলে গেল ঘরের দরজা আর সাদা আলোর ঝলকানিতে সারা ঘর ছেয়ে গিয়ে শেষ হল গ্রেগর সামসার দুঃস্বপ্ন।

কাফকা এবং মেটামরফসিসকেই বেছে নিলেন কেন প্রশ্ন করাতে মিকা বললেন কাফকার যে দুঃস্বপ্নের জগত আমরা কল্পনা করি তাঁর গল্পগুলো পড়তে পড়তে সেগুলি প্রত্যেকের কাছে খুব ব্যক্তিগত। তাঁর কল্পনায় মেটামরফোসিস-এর ধারণাটা খুব পরিষ্কার ছিল এবং সেই দুঃস্বপ্নটাই তিনি ভাগ করে নিতে চেয়েছেন সকলের সঙ্গে। মিকার মতে এখন অবধি ভার্চুয়াল রিয়্যালিটিকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তাতে মাধ্যামটির মধ্যে যে প্রভূত সম্ভাবনা আছে তাকে পুরোপুরিভাবে উপলব্ধি করা যায়নি। তাঁর ইচ্ছে তিনি ভিআরওয়ানডলুং-কে নিয়ে আরও এগোবেন। গ্রেগরের ঘর থেকে বেরিয়ে আপনি পৌঁছে যেতে পারবেন কাফকার অন্য কোনও গল্পের ভিতর। বইয়ের পাতার যে অক্ষরগুলো আমাদের প্রত্যেকের মনে দাগ কেটেছে সেগুলোকে জীবন্ত হয়ে ওঠার সম্ভাবনা সকল কাফকাপ্রেমীর মনেই আলোড়ন সৃষ্টি করবে। হয়তো কোনওদিন গ্রেগরের ঘর থেকে বেরিয়ে আমরা জশেফ কে-এর অফিসে পোঁছে দিতে যাব। উঁকি মারতে পারব হুইপ্পারদের রুমে। কাফকা একান্তই ব্যক্তিগত। তাঁর গল্পগুলো এক-একটা হাড় হিম করা দুঃস্বপ্ন। মেটামরফিসের গ্রেগর একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখেন তিনি একটি প্রকাণ্ড আরশোলাতে বদলে গেছেন। ঘুম ভেঙে একটা দুঃস্বপ্নে জেগে উঠেছিলেন গ্রেগর? কাফকা এই গল্প লেখাকালীন যে বাড়িতে ছিলেন সেই বাড়ির নকশা মনে রেখেই তৈরি করা হয়েছে গ্রেগরের ঘর। কাফকার জীবনী এবং ডাইরির ওপর ভিত্তি করে কল্পনা করে নেওয়া হয়েছে আধুনিক কালের অন্যতম সেরা লেখকের ঘরে কী কী থাকতে পারে। শিল্পী গ্রেগরকে বানিয়েছেন কাফকা করে। তাহলে কি কাফকার কাছে তাঁর জীবনটাই ছিল একটা মস্ত দুঃস্বপ্ন? মিকা ভাবনার রসদ জুগিয়েছেন বিস্তর ।

শিল্পীর নিজের মুখেই আমরা শুনলাম টোকিও শহরে ভিআরওয়ানডলুং সাধারণ মানুষের সমাদর পেয়েছে। এর কারণ বলতে গিয়ে মিকা বললেন জাপানের ব্যাক্তিমানুষের জীবনে সময় এবং স্পেস-এর অভাব। সপ্তাহে ৬০-৭০ ঘণ্টা অফিসে নিরলস পরিশ্রমের পর ভিড় ঠাসা ট্রেন করে পায়রার খুপরির মত বাড়িতে ফিরে কাফকার গল্পের দুঃস্বপ্নগুলোর  মাঝে নিজেদের খুঁজে পেতে তাদের অসুবিধা হয় না। খুব সহজেই বুঝলাম মেটামরফোসিস কিংবা কাফকাকে সময়, ভাষা, দেশ কোনওটাই বেঁধে রাখতে পারেনি। ১৯১২ সালের ইউরোপ হোক কিম্বা একবিংশ শতাব্দীর জাপান, কাফকা সবার। কাফকার কাজের সঙ্গে পরিচয় না থাকলেও ভারচুয়াল রিয়্যালিটিতে কাফকাকে অনুভব করতে কারও অসুবিধা না হওয়াটাই বোধহয় মিকার সাফল্য। এর অন্যতম উদাহরণ হিসেবে সেই সব সদ্য কিশোরদের কথা বলা যেতে পারে যারা এই প্রদর্শনীটি দেখতে এসেছে। এবং একরাশ কৌতূহল নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। কলকাতাতেও আমরা দেখেছি একটি  ১০-১১ বছরের বাচ্চাকে নিয়ে তাঁর বাবা এসেছেন।

আমাদের বন্ধুদের কাফকা উৎসাহে  মাঝে মধ্যে ঘৃতাহুতি দেন আমাদের স্যার অধ্যাপক পরিমল ভট্টাচার্য। গ্যেটে ইনস্টিটিউটে এই প্রদর্শনীটিরও সন্ধান দেন স্যার। স্যার-এর মুখেই প্রথম শুনেছি বাঙ্কসির কথা, এশিয়ার বৃহত্তম সমসাময়িক ইনস্টলেশন শিল্পের প্রদর্শনী কোচি মুজিরিস বিয়েনালের কথা।

আর সব কিছুর মতই শিল্পও বদলাচ্ছে। শিল্পের ভাষা, পরিভাষা বদলাচ্ছে। এক একটি মাধ্যম নিজের মধ্যেও বদল ঘটাচ্ছে। সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন বব ডিলান। শিল্প বলতে আমরা যা বুঝি সেটাই বদলে যাচ্ছে প্রত্যেকদিন। ইউনিভারসিটি, আর্ট গ্যালারি আর মিউজিয়ামের চার দেওয়াল টপকে শিল্পকে আনা হচ্ছে রাস্তায়। আক্ষরিক অর্থেই রাস্তায়। নব্বই-এর দশেক শেপার্ড ফেরি আমেরিকার রাস্তা মুড়ে দিয়েছিলেন “Andre the Giant Has a Posse” স্টিকার দিয়ে। পথচলতি মানুষদের বাধ্য করছেন ঘুরে ঘুরে তাকাতে। বিরক্ত করছেন ডিটেল-এর প্রতি নজর দিতে। আবার ২০১৪ সাল থেকে নিউ ইয়র্ক শহরে শুরু হয়েছে ওয়াটার ট্যাঙ্ক প্রজেক্ট। বড় বড় বাড়ির ছাদে রাখা জলের ট্যাঙ্ক মুড়ে দেওয়া হচ্ছে ছবি দিয়ে। নামজাদা শিল্পী থেকে অ্যামেচাররাও নিরন্তর কাজ করে চলেছেন। একইভাবে রাতের অন্ধকারে নাম না জানা এক শিল্পী ইংল্যান্ড এর রাস্তায় এঁকে দিয়ে যাচ্ছেন দারুণ সব ছবি। মানুষ তাঁকে জানছেন বাঙ্কসি দা স্ট্রিট আর্টিস্ট নামে। সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা, একরাশ বিরক্তি, আশা আকাঙ্ক্ষা জায়গা করে নিচ্ছে এইসব শিল্পীর ভাবনায়। দেওয়ালগুলো থেকে যাচ্ছে সাক্ষী। ভাবতে অবাক লাগে হাজার বছর আগে আলতামিরা গুহার শিল্পীদের হৃদস্পন্দন কি তাহলে এঁরা ধরতে পেরেছেন? মোয়াই-এর বিশাল মাথাওয়ালা মূর্তিগুলোর সামনে দাঁড়ালে যে প্রকাণ্ড অবাক করা অনুভূতি গ্রাস করতে পারে সেখান থেকে ভারচুয়াল রিয়্যালিটির চশমার দূরত্ব কতদূর হতে পারে?