আমাদের মিঞা কবিরা
মওলানা বন্দে আলি
চরুয়ার কথামূল ভাষা: অহমিয়া রচনাকাল: ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ
কে বলে বঙ্গদেশ মোর জন্মভূমি
পেয়ে যার তিক্ত নির্যাতন,
ঘর ছাড়ি হই দেশান্তরী
পিতা-মাতা আর কতজন!
তখন দেখেছি তারা কতই না কুটুম
যেসকল নেতা দিচ্ছে এখন ভাও,
জেনো এসকলই ফন্দি স্বার্থের কারণে
তাকে কেবল শুনছ তুমি বাউ
কদাপি নই মুই নেমকহারাম
ধর্ম মোর নয়কো তেমন,
যে দেশে আছি মুই সে দেশেরই
হিতচিন্তায় হই যে মাতাল
যে দেশে আসিয়া মোর আব্বাজানে
এ দুনিয়ায় পাইল আসমান
সেই থেকে মোর দেশ এই সোনার অসম
ইয়ার চেয়ে নাই কোনও পুন্যস্থান।
যে দেশের মাটি লিয়ে হল ঘরবাড়ি
সে মোর আপনার দেশ,
পরম পবিত্র এ যেন কোরানের বাণী
নাই এতে অসত্যের লেশ।
এ দেশের অধিবাসী সরল নির্মল
অসমিয়া আপন আমার,
সকলে মিলেমিশে এখানে ঘরে
পাতলাম সোনার সংসার।
না মুই চরুয়া না মুই পমুরা[1]
আমিও যে অসমিয়া
অসমের জল-বায়ু অসমের ভাষা
বেঁচে থাকি সমান ভোগিয়া।
মরে যদি অসমিয়া আমিও মরিব
বিরূপ কোনও কথা কেন হতে দিব!
নতুন উদ্যমে আমি সবই যে যুঁজিব
ভবিষ্যৎ আমিই গড়িব।
ছোট ছোট ক্ষেতি জুড়ে এনেছি কতই না স্নেহ সমাদর
কত ক্ষেতি দিয়েছে এই দেশ
হাল দিয়ে জুড়ে চলি এর সোনার চাপর
নাই যার মহিমার শেষ।
কী স্নেহে অসম দিচ্ছে স্তন্যধারা
আনন্দেতে নাচে মোর হিয়া,
গাও আহা সমস্বরে— মুই অসমিয়া
নই আর মৈমনসিঙিয়া।
সীমারেখার প্রয়োজন নাই আর
এক ভাই দিল আরেক ভায়েরে ঠাঁই,
দেখি কোন বিদেশি আমাকে লুটে
বাধা দিব বুক ফুলায়।
খবির আহমেদ
বিনীত নিবেদন এই যেমূল ভাষা: ইংরেজি রচনাকাল: ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দ
বিনীত নিবেদন এই যে
মুই একজন পমুরা, একজন লাঞ্ছিত মিঞা
যাই হোক না কেন মোর নাম
ইছমাইল শেখ, রমজান আলি কিংবা মাজিদ মিঞা
জ্ঞাতব্য বিষয় এই যে মুই অসমরেই অসমিয়া
যার ভাষা অসমের সাধুভাষার মতই প্রাচীন
যার গল্প তোমাদের ধমণীতে বয়
রক্তকণিকাও এর আদিম…
কোনও সহৃদয় লেখকের লেখায় তবু মোর নাই ঠাঁই
কোনও চিত্রশিল্পীর তুলিতে না হল আঁকা মোর ছবি
বিধানসভা বা সংসদ ভবনে এবারও মোর কথা উঠল না
কোনও শহিদ বেদি বা কোনও সংবাদপত্রে
ঘুণাক্ষরেও লেখা না হল মোর নাম
কোনও সংজ্ঞা না পেয়ে দেগে দেওয়া হল
মুই মিঞা: ন-অহমিয়া; নই অহমিয়া।
মনে মোর এসব নদীর মতোই গভীর হয়ে বয়
বৃক্ষের কথা খোদাই হয়ে থাকে, নীল পাহাড়ের দেশ অসম
মোর শিরদাঁড়া বৃক্ষের মতই কঠিন আর অটল
বৃক্ষের ছায়াই মোর স্বাভাবিক ঘর
কৃষক শ্রমিকের কথা খোদাই হয়ে থাক, কৃষিপ্রধান দেশ অসম
কৃষি আর শ্রমের প্রতি মোর শ্রদ্ধা জন্মগত
মুই যে কৃষকেরই সন্তান…
মুই এক পমুরা, ঘৃণ্য এক মিঞা
যাই হোক না মোর নাম
খবির আহমেদ কিংবা মিজানুর ভূঞা
জ্ঞাতব্য বিষয় এই যে মুই অসমরেই অহমিয়া
পদ্মার ঝড়ে মোর ঠিকানা হারাল শতাব্দী আগে
বন্দর খুঁজে বণিকের জাহাজে উজিয়ে এলাম মুই
চিরদিনের তরে আপন বুলির সার নিল এই দেশ এই মাটি
তারপর শুরু হল মোর নতুন আবিষ্কার
শদিয়া থেকে ধুবুড়ি[2]
রাঙামাটির পাহাড় কেটে সমতল করেছি ভূমি
বন কেটে করেছি নগর মাটি গুঁড়িয়ে ইট
ইটের পর অট্টালিকা
রাস্তায় পাথর পিটিয়ে কালা করে দিয়েছি গাঁ
কারখানায় কুলিগিরি করেছি খাঁ খাঁ প্রান্তর সবুজ করেছি মুই
মুই নদী সাঁতরেছি নদীর বুকে উপুড় হই
বানে দিয়েছি বাঁধ মুই
এইভাবে প্রতিদিন রোদ মাখা ঘামে উর্বর করেছি মাটি
বাপের লাঙল দিয়ে মাটিতে লিখেছি একটিই নাম
অ…স…ম
চড়াইয়ের মত খড়কুটো দিয়ে বাসা সাজাচ্ছিল
অনাবিল আনন্দে ভাটিয়ালি গান গাইছিল
জাতির ভব্যিষতের প্রধান[3] যখন অসমে এসেছিল
তখন মুই লুইতিয়া[4] গান শুনছিলাম,
সূর্যাস্তের সময় কপিলীর[5] কাদাময় কলজে সোনার মত লাগছিল
মোর তিরাশির জ্যোৎস্না ভাসা আলো
নেলির[6] বিধ্বস্ত ভিটায় দাঁড়িয়েছিল মোর দেশ
মেঘাচ্ছন্ন হল আকাশ
মিঞাদের সেই ছায়া ঢাকা পাখি ডাকা গ্রাম শশ্মান হল…
চুরাশির প্রবল বান ছিনিয়ে নিল মোর সোনারঙা ক্ষেত
পঁচাশিতে একদল বাজিকর ভাঁজ করে নিলামে বিক্রি করল আমায়
বিধানসভার মেঝেতে
ইছমাইল শেখ, রমজান আলি কিংবা মাজিদ মিঞা
জ্ঞাতব্য বিষয় এই যে মুই অসমরেই অহমিয়া
মোর বহু কথা ছিল
স্বাধীনতার দুকুড়ি বছর পিছোলে মোর কথা শুরু
নদীতে কথা পোঁতা থাকে, অসম নদীমাতৃক দেশ
বিনীত নিবেদন এই যে
সেইদিনের পরে মুই
বাঁচার জন্য আকুল ছিলাম
হঠাৎ কারও কঠিন হাতের ছোঁয়ায় ঘুম গেল চিরতরে
যাই হোক না কেন মোর নাম।
হাফিজ আহমেদ
লিখে নাও মুই এক মিঞামূল ভাষা: ইংরেজি রচনাকাল: ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ
লিখো
লিখে নাও
মুই এক মিঞা
এনারছিতে[7] মোর ছিরিয়াল নং ২০০৫৪৩।
মোর দুই ছেলেপুলে,
সামনের গরমে
আরেকজনা আসিতেছে।
উয়ারেও ঘেন্না করিবা তো
যেমন হামারে করো?
লিখো
মুই এক মিঞা
হেই বাদাপোড়া পাঁকের জমিকে
মুই সবুজ ক্ষেতি করেচি
তুমাকে খাওয়াতে,
ইটের পর ইট বয়েচি
তুমার বাড়ি বানাইতে,
তুমার গাড়ি চালাইছি
তুমার আরামের লগে,
খানাখন্দ সাফ করেচি
তুমার স্বাস্থ্যের লগে,
তুমার খাটুনির লগে
মুই হাজির যেকোনও সময়।
তবু যদি মন না ভরে
লিখে নাও
মুই এক মিঞা
হেই গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রজাতন্ত্রের
অধিকার লগে অধিকার ছাড়া এক নাগরিক।
হামার মাকে ডি ভোটার[8] বানায়ে দিল,
উয়ার মা বাপ ছিল যদিও ভারতীয়।
ইচ্ছা হইলেই জানে মারি দিতে পারো, লাথ মারি
ভাগাইয়া দিতে পারো হামার গ্রাম হতে,
হামার সবুজ ক্ষেতি কাড়ি নিতে পারো,
বেলন দিয়া বেলি দিতে পারো হামারে,
তুমার গুলি
হামার বুক ফুঁড়ে দিতে পারে,
জানি, তুমার কোনও শাস্তি না হইবে।
লিখো
মুই এক মিঞা
ব্রহ্মপুত্রে বাঁচি আছি
তুমার জ্বালাতন সইতে সইতে,
হামার শরীল কালো হয়া গেছে
চক্ষু আগুনে লাল।
খাড়াও!
রাগ ছাড়া রসদে কিছু নাই।
দূর হটো!
নাইলে
ছাই হই যাও।
মুর্গি জবাই চলিছে...মূল ভাষা: অহমিয়া রচনাকাল: ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ
মুর্গি জবাই চলিছে: মুর্গি।
কসাইয়ের কোনও দোষ নাই,
নাই কোনও ভুল।
সমবেদনায় মধু লাগি আছে:
একটুক লাগবে না
চোখা ছুরি দিয়া
গর্দানে দু পোঁচ
লাগবে না একটুক।
দু এট্টা মুর্গি কোঁককোঁকাবে ভাবলেও
কসাইয়ের চোখা ছুরির দিকে চেয়ে
ভাবনাটা মনে গিলে নিল।
দু এট্টা ধড়পড়ানো পালক
জাপটে ধরি
কসাই শুনাচ্ছে সবাইরে
সাবধানবাণী: “খবর্দার ভুলবি না তোরা হামার
পোষা মুর্গি
যা মন চায়
তাই করিব
যাকেই মন চায়
তাকেই করিব জবাই।”
ছান মিঞা
আজকে হামি হামার নাম জানি নামূল ভাষা: দোয়ান ডায়ালেক্ট অহমিয়া অক্ষরে লেখা। রচনাকাল: ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ
আজকে হামি হামার নাম জানি না।
ভুল বানান, ঠাট্টা-মস্করা, গালি-গালাজ
আর তুমার অফিসের দস্তাবেজ কাগজ
তার মধ্যে হারিয়ে গেছে হামার নাম।
ফজরের কালে জন্ম নেওয়া
ফজর আলি থেকে
ক্লাছ কেপ্টেন ফজল আলি।
ক্ষেতের মাগনা কামলা ফজল মিঞা থেকে
গৌহাটির রাজমিস্ত্রির যোগালি[9] ‘বাংলাদেশি লেবার’।
হামার মেলা নাম, মেলা জীবন
কিন্তু একটাও হামার নিজের না।
যখন হামি কামলা দিতাম মনে আসত
ইছকুল আর এ প্লাছ বি হল ইছকোয়ারের ফর্মূলা।
যোগালি করার সময় মাগনায় গান কইরা
বাইর করতাম মনের বেদনা।
হেই ডিটেনছন ক্যাম্পে[10] বইসা মনে পইড়ল
“হারে হেই বিল্ডিংখান তো হামিই বানাইছিলাম।”
এহন হামার কিছুই নাই।
আছে এক জোড়া পুরানা লুঙ্গি, আধপাকা দাড়ি
আর বড়দাদার নাম থাকা ৬৬র ভোটার লিস্টের[11] এফিডেফিট কপি।
হ, আইজকা হামার নাম নাই
কিন্তু তুমার দেওয়া নামেরও দরকার নাই।
কইয়ো না হামারে আর বাংলাদেশি
লাগবে না তুমার টিটকারি
লাগে না হামার সহানুভূতি ভরা ‘না-অসমিয়া’।
লাগবে কিছুই তুমার,
হামার যেটুক প্রাপ্য সেটুক দাও।
হামার নাম হামি নিজেই বানামু একদিন।
নিজের দমেই।
রেজাউল ইসলাম বুলবুল
কাশেম মিঞার কাঁপা কলজেমূল ভাষা: দোয়ান ডায়ালেক্ট অহমিয়া অক্ষরে লেখা। রচনাকাল: ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ
কমলপুর গাঁয়ের কাশেম মিঞা
লুঙ্গিতে তার লেগেছে গিঁট
হাতে পায়ে তার ময়লা অনেক
সারা শরীরে কমলপুরের কাদা-মাটি
কাশেম মিঞার শরীরের রক্ত, ঘাম আর চোখের জলে
কমলপুরে নদীর পার ভাঙে
সারাদিন লাঙল তার হাতের মুঠোয়
কাঁধের উপর জোয়াল
লুঙ্গির গিঁট খুলে গেলে
লাঙল তার থেমে গেলে
খিদায় কাঁদে ছেলে
কাশেম মিঞার শরীরের রক্তের স্বাদ বেশি
রাত এলে মশায় খায়
সকাল হতে না হতে কমলপুর চরের জোঁকে খায়
ডি ভোটারের ভয় দেখিয়ে পাড়ার মাতব্বররা খায়
থানার ওসি বলে— “কাশেম তোর মেয়েকে পাঠাস”
কোর্টের উকিল বলে— “কাশেম তোর এনআরসি নাই; তুই তো বাংলাদেশে যাবি।”
এখন কাশেম করে কী— আর তো রক্ত নাই
সকাল বিকাল ক্ষয়ে ক্ষয়ে কাশেম মিঞার দিন ছোট হয়ে গেছে
কমলপুরের জমি বলে— “কাশেম তুই আমাকে আর কত চিরবি?”
লাঙল তো ক্ষয়ে গেছে।
কাশেম কিছু বলে না— খালি কাঁদে
না বললেও সবাই জানে
এই মাঘের শীতে কাশেমের রান্নাঘরে আগুন জ্বলে না।
পোস্টঅফিসের কাগজ এলেই কাশেম মিঞা দৌড়ে আসে, বলে—
“এটা কি এনার্ছির কাগজ?”
কাশেম মিঞার কলজে কাঁপে।
–“না।”
কাশেম মিঞার কলজে তবু জুড়ায় না
ছেলিম এম হুছেইন
নানা মুই মিঞা: হাফিজ আহমেদের প্রতিমূল ভাষা: ইংরেজি রচনাকাল: ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ
নানা মুই লিখে লিয়েছি, এটেস্টেড কাউন্টারসাইন কইরে
পাব্লিক নোটারিকে দিয়া ভেরিফাই করি নিয়েছি যে
মুই এক মিঞা
এহন দেখো হামারে
বানের জল থেকি উঠি
ধ্বসের উপর ভাসি
বালুচর, পাঁক আর সাপ মাড়িয়ে আসিতেছি
মাটির অনিচ্ছায় কুড়াল দিয়ে আঁকিছি পরিখা
হামাগুড়ি দিতেছি ধান ক্ষেতির ভিতর দিয়া
ডাইরিয়া আর আখের ক্ষেতের ভিতর দিয়া
১০% সাক্ষরতা হারের ভিতর দিয়াও
দেখো হামারে কাঁধ ঝাঁকায়ে কেমনে দুলাইচ্ছি ঝামড়া চুল
পড়ো দু’ডা কবিতা, কষো কিছু অঙ্ক
কেমন ভেবলে আছে দেখো পাষণ্ডরা হামারে বাংলাদেশি বলা কালে
আর আমার ধুকপুকে কলিজাকে বলে দিও
মুই কিন্তু মিঞা।
দেখো মুই হাতে ধরি আছি
সংবিধান
দিল্লির দিকে আঙুল তুলি আছি
হামার পার্লামেন্ট, হামার সুপ্রিম কোর্ট, হামার কনটপ্লেসের দিকে হাঁটিছি
এমপিদের, মান্যিগণ্যি জাজেদের
আর যে মেয়েটি জনপথে বেচে ঝুটো সোনার গয়না আর তার রূপ
তাদের সবাইরে বলে দিও
হ মুই এক মিঞা।
হামারে দেখতে পাবে কলকাতায়, নাগপুরে, সীমাপুরী বস্তিতেও
হামারে দেখতে পাবে স্যুট পড়ি সিলিকন ভ্যালিতে, ম্যাকডোনাল্ডেও
হামারে দেখতে পাবে মেওয়াটে চালান হয়ে যাওয়া বিয়ার কনেতেও
হামার ছোটোবেলার ছোপগুলি দেখো
দেখো হামার পিএইচডির সার্টিফিকেটের উপর ঝোলা গোল্ড মেডেলগুলি
তারিপর হামারে সালমা বলি ডাকিও, ডাকিও আমান বলি,
আব্দুল বলি ডাকিও, ডাকিও বাহাতন বলি
কিংবা গোলাম।
হামারে দেখো প্লেন ধরিতে, ভিসা পাইতে, বুলেট ট্রেনে চড়িতে
বুলেট ধরিতে
স্রোতে বইতে
রকেটে চড়িতে
লুঙ্গি পরিয়া মহাকাশে যাইতে
আর অইখানে তোমার চিল্লামিল্লি শুনিবার কেউ নাই,
বাজ পড়ে যেন কোথাও
মুই এক মিঞা।
মুই গর্বিত।
রাজ্যের পাঁঠামূল ভাষা: দোয়ান ডায়ালেক্ট অহমিয়া অক্ষরে লেখা। রচনাকাল: ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ
রাজ্যের আছে এক পাঁঠা
আগার ঠ্যাং বড় পিছের ঠ্যাং ছোটা
পাঁঠার যদি মঙ্গল চাও
ঠেলেঠুলে লিয়ে যাও
রাজ্যের পাঁঠার চামড়া কালো
মোটা তাজা বেশ ভালো
পাঁঠা যদি চুরি যায়
দিতে থাকো আল্লার দোহাই
রাজ্যের পাঁঠার জাত খারাপ
হয় না তা দিয়া ভালো কাবাব
তাও পাঁঠা পড়বে পাতে
নিকট হবে সস্তা মদে
পাঁঠার ছাল কে কিনবে
চুরির মাল কাকে বেচিবে
হাট বাজারে যাইয়া দেখো
জল্লাদ আর দালাল ঢুঁনো
পাঁঠার কোনও উপায় নাই
নরকেও তো ভাই নাই ঠাঁই
তুমার হাতে গছিয়ে দেই
মুই হালা বেঁচে যাই
কাজী নীল
যদি আর কোনও ভাষা না থাকে দুনিয়ায়মূল ভাষা: দোয়ান ডায়ালেক্ট অহমিয়া অক্ষরে লেখা। রচনাকাল: ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ
যদি আর কোনও ভাষা না থাকে দুনিয়ায়
যদি হারাইয়া যায় সব অক্ষরমালা
যদি ভাইস্যা যায় খাতাকলম, কবিতার উপমা
যদি কোনও সাঙ্কেতিক ভাষায় আর না কইতে পারি
তোমারে আমার এই নীরব দুঃখ
এই মইর্যা যাওয়া মন যদি
আর না পায় গানের ঠিকানা
যদি না লিখা হয় চিঠি এই আগুন জ্বলা বসন্তে
যদি বোবা হয়ে যাই, যদি আমাদের চোখ
আর না কয় কোনও কথা
যদি নদী থাকে নদীর মতন, ঢেউয়ের কোনও শব্দ নাই
যদি পাখি থাকে গাছের ডালে, ঠোঁটে কোনও বাঁশি নাই
যদি আমরা ছটফট করি সারা রাত
কথা গুনে উড়ে বেড়াই শিমূল তুলার মতন
আর বুঝতে না পারি বুকফাটা মেঘের বিষাদ
যদি সব ভাষা হারাইয়ে যায় দুনিয়া থেকে
যদি থেমে যায় এই কলম
ভালোবাসার কথা কি আমি কইব না, কও?
আমি কি কইব না এই নীরব দুঃখের কথা
অন্য কোনও আদিম ভাষায়?
একটা আধা গ্রাম, আধা শহরের ভিতর দিয়া হাঁটি যাইমূল ভাষা: দোয়ান ডায়ালেক্ট অহমিয়া অক্ষরে লেখা। রচনাকাল: ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ
একটা আধা গ্রাম আধা শহরের ভিতর দিয়া হাঁটি যাই,
মাথার উপর কমদামী আকাশ খুলে নাইছে বৃষ্টির দোকান।
আন্ধার সব রাস্তা ছোট ছোট বাড়ির উপরে
একশো বছরের আন্ধার জমে বরফ,
বৃষ্টির পানিতে ডুবে বইছে ডোবা-খাল
বৃষ্টিতে আমিও ভিজতেছি ভিতরে বাইরে
আমার মনের ভিতর বৃষ্টির তুলা উড়ে অস্ফূট কাদার মতন…
আন্ধারের ভিতর দিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে পিছলাই পড়ি
মৃত্যু শুয়ে থাকে সেই গাড্ডার ভিতর।
মৃত্যুর মতন চরম আঘাত লিয়ে উঠি আসি
ল্যাংড়াইতে ল্যাংড়াইতে আমি হাঁটি যাই একটা কমদামী শহরের ভিতর…
হাঁটিতে হাঁটিতে মনে পড়ে সেই এক পাখির কথা,
যে পাখি দূর কোনও বৃষ্টিহীন শহরে বসে থাকে
ডাল-পাতা ছাড়া গাছের উপর…
সেই পাখি মনে পড়লেই আমি ভুলি যাই
আন্ধারের কথা, ল্যাংড়া পা দু’ডার কথা,
এই কমদামী আকাশের কথা, আমার শৈশব
যন্ত্রণার সেই কালো দিনগুলান যৌবনের।
না খাইয়া থাকার কথা ভুলিতে ভুলিতে আমি অন্ধ হই আর
গাড্ডায় পড়ার ডর থাকে না আমার।
সেই পাখিরে আমি কথা দিয়া ফেলেছি
তার লগে আমি গাছের জীবন নিব।
ডাল না থাক পাতা না থাক আমি আমৃত্যু ছায়ার
মতন খাড়াইয়ে থাকব,
তার শহরের সব কালো রাত শেষে
আমি আইব সকালের রেলগাড়িতে উশের পাহাড় পার কইরে…
সব উপকথায় যেমন যেমন হয়ে থাকে
ঠিক তেমন হইবে না আমার এই যাওয়া,
আমি জানি এই আন্ধার এই তুফান এই মৃত্যুময় শীতলতা কিছুই না
আরও এক বিশাল যন্ত্রণার সাগর আমার পাড় হওন লাগে… আরও শক্তিশালী দানবের মতন
এক শতাব্দী পাড়ি দেওয়া লাগে…
তারে আমি কথা দিয়া ফেলেছি
আমি আইব বুকের ভিতর বৃষ্টি ভিজা স্বাদ নিয়া,
একটা উপবনের সমস্ত ডাল-পাতা নিয়া
প্রজননকালীন ব্যাঙের ডাক নিয়া আমি আইব।
সেই ধূসর শহরের বন্দরে প্রাচীন এক নাবিকের মতন
একটা আধা গ্রাম আধা শহরের মধ্যে দিয়ে হাঁটি যাই…
মৃত্যুর মতন যন্ত্রণা নিয়া আমি হাঁটি গেছি
ল্যাংড়াইতে ল্যাংড়াইতে।
মাথার উপর কমদামী আকাশ খুলে নাইছে বৃষ্টির দোকান
আমার মনের ভিতর অস্ফূট কাদার মতন বৃষ্টির তুলা উড়ে…
মানরী, কদম ফুলের গন্ধ ছড়াইলেই একটা কোকিল ডাকবে
দূর সাগর থিকা উঠি আইব হাওয়া উড়বে লাল উত্তরীয় তোমার
আর
আমি আইব সকালের রেলগাড়িতে…
বিজু জাহান
নদীমূল ভাষা: দোয়ান ডায়ালেক্ট অহমিয়া অক্ষরে লেখা। রচনাকাল: ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ
একজন কামলা দিন রাইত মাটি কাটে,
চর নামের ভিটা বানায়।
কাশগুলা, আর ঝাউ গাছগুলা
কতই না পায়ে পড়ে:
“হাম্মারে আর শেষ করিচ না হাম্মার বাচ্চাগুলাকে শেষ করিচ না।”
কারা যে কামলা লাগাইছে
কইবার পারি না,
কোন খিদাতে কামলা দেইছে
তাও জানি না।
পুবে, পছিমে, উতরে, দখিনে… চার দিকেই… কামই কাম।
হামি অনেক দিন ভাবেছি
কাশগুলার কথা, ঝাউ গাছগুলার কথা।
তারা কেন এপার-ওপার ভেগে ভেগে আসে খালি?
কীসের মায়ায়?
হামি কিছুই বুইঝতাম না।
বাবার আশার রক্তচাপ
পানির ফোঁটা হইয়ে গেঞ্জি ভিজাইত,
আইর দেখত
এই যুগের এঁটোখাকিদের ভিতর উতরপুরুষের নাম।
হামি কিছুই বুইঝতাম না… বুঝার বয়সও ছিল না…
বাবার চেষ্টার সকাল বিকাল।
বালুর ভিতর গাছ গাড়া,
বানে এসে নিয়ে যাওয়া,
বাবার ফের গাছ গাড়া—
হামি বুইঝতাম না…
বাবার গাছ গাড়া,
পাড়ার মানুষের শহর যাওয়া,
হামি বুইঝতাম না…
বাবা কেন দাঁড়ায় থাকত নদীর ঘাটে নাও লয়ে?
কে ফিরি আসিবে?
হাসমত, মইনুল?
হামি তো দেইখলাম না তারা ফিরি আসিল,
সেই যে গেল তো গেল।
হামি বুইঝতাম না…
বইয়ের পাতায় লিখা
“আপেল খেয়ে তার বীজ রোপণ করা মহৎ কাজ।”
হামি তাও বুইঝতাম না
দর্শন, সত্যি, চারপাশ কিছুই,
খিদার বাইরে কিছুই ছিল না।
সারা গ্রাম জুড়ে… খালি খিদা আর খিদা…
বহু মানুষের মতো
তবুও বাবার চোখে কয়লার আগুন জ্বলত,
কোথাকার বাতাস আইসে আগুনটা লাল কইরে দিত…
আর বাবা নিথর হয়ে যাইত বরফের মতো।
আর জড়ায় ধইরত হামাকে…
আর হামার কাছে কিছুই ছিল না,
না ছিল বলার মতো ভাষা, কান্দার মত শব্দ।
সৌরজগতের কেন্দ্রের মতো হামার সব ভাবনার কেন্দ্র ছিল
…খিদা…
হামি তখন বুইঝতাম না
রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে তুফানে, বানে খরায়
খাড়া থাকার অর্থগুলা,
শীত গরমের সুখগুলা।
আজিকে অনেক দিন পর… বাবার মতো অনেকজন চইলা যাবার পর
হামি হামার পকেট হাতড়ে দেখি
বাবা কি গেড়ে গেছে গাছের বীজ?
অনুবাদ ও ফুটনোট: অভিষেক ঝা
কবিতাগুলি নেওয়া হয়েছে “ত্রস্তের শিকড়বাকড়: নির্বাচিত মিঞা কবিতা” থেকে।
সম্পাদনা ও ভাষান্তর: অভিষেক ঝা,
সম্পাদনা সহযোগিতা: হাফিজ আহমেদ, ছেলিম এম হুছেইন
প্রকাশনা: বৈভাষিক প্রকাশনী।
ভেতরের ছবি: https://www.livemint.com/mint-lounge/features/-poetry-will-be-turmeric-caught-in-the-cracks-1564746117022.html
[1] ছোট ছোট অস্থায়ী ক্ষেতকে বলা হয় ‘পাম’। সেই পামের অস্থায়ী কৃষকদের বলা হয় পমুরা। চরের বাসিন্দাদের মতই অস্থায়ী পমুরাদের ক্ষেতিবাড়ি।
[2] সমগ্র অসম বোঝাতে প্রচলিত প্রবাদ হল ‘শাদিয়া থেকে ধুবড়ি’।
[3] অটলবিহারী বাজপেয়ির কথা বলা হচ্ছে। নেলি গণহত্যার কিছুদিন আগে অসমে এসে তিনি বাংলাজাত মুসলিমদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত উস্কানিমূলক একটি বক্তৃতা দেন। সেই বক্তৃতা এতটাই উস্কানিমূলক ছিল যে বিজেপি দল হিসেবে তার দায় এড়িয়ে এটিকে বাজপেয়ির ব্যক্তিগত মতামত বলে দেয়।
[4] অসমে ব্রহ্মপুত্র নদের প্রচলিত নাম বুড়া-লুইত। ‘লুইত’ শব্দটি এসেছে ‘লোহিত’ শব্দ থেকে রক্তের অনুষঙ্গ নিয়ে। ব্রহ্মপুত্র সম্বন্ধীয় বোঝাবার জন্য ‘লুইতিয়া’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
[5] ব্রহ্মপুত্রের একটি প্রধান উপনদী। মেঘালয় থেকে উৎপত্তি হয়ে অসমের কার্বি আংলং, ডিমা হাসাও, কামরূপ ও নগাঁও জেলার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্রে মিশেছে।
[6] নেলি গণহত্যা স্বাধীন ভারতের হিংস্রতম ঘটনাগুলির মধ্যে একটি। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে ছয়ঘণ্টার ভিতর মধ্য অসমের নগাঁও জেলার ১৭টি গ্রাম জুড়ে সরকারি হিসাবে ২১৯১ জন মানুষ (বেসরকারি হিসাবে সংখ্যাটি দশ হাজারের বেশি) খুন হন। নেলি গ্রাম থেকে এই গণহত্যা শুরু হয়। খুন হওয়া মানুষেরা সবাই ছিলেন দেশভাগের বহু আগে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বাংলা থেকে চলে এসে অসমের ভূমিকন্যা/পুত্র হয়ে যাওয়া মুসলিম ধর্মাচরণ করা মানুষ।
[7] ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস (এনআরসি) বা রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জিকরণ ভারতবর্ষের ‘প্রকৃত নাগরিকত্ব’ নিয়ে চলে আসা এক রাষ্ট্রীয় হাতিয়ার যার বীজ ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের অসম। এনআরসিতে কারও নাম না থাকলে তাকে ডি-ভোটার ঘোষণা করা হয় যা নাগরিকত্ব হারানোর প্রথম ধাপ।
[8] ডুবিয়াস ভোটার বা ডাউটফুল ভোটার হল সেই শ্রেণির ভোটার যাদের ভোটার লিস্টে নাম থাকলেও রাষ্ট্র তাদের নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দিহান। তাই এদের সচিত্র ভোটার কার্ড দেওয়া হয় না।
[9] রাজমিস্ত্রির সহায়ক
[10] ২০১১ খ্রিস্টাব্দে গৌহাটি হাইকোর্ট রায় দেয় যে ডি ভোটারদের ‘অবৈধ নাগরিক’ ঘোষণা করে ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখতে হবে।
[11] ০১/০১/১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দ, এই তারিখের আগে অসমে আসা মানুষদের নতুনভাবে এনআরসি-র প্রয়োজন নেই বলে প্রাথমিকভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু এই তারিখ সীমার আগে আসা বেশিরভাগ মুসলিম পরিবারকে বারবার ‘অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি’ বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়ে চলেছে।