Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দুই গ্রামের গপ্প

স্বাতী মৈত্র

 

নয়ডার অত্যাধুনিক, ঝাঁ চকচকে মহাগুণ মডার্ন নামক গেটেড কমিউনিটিতে হয়ে যাওয়া একটা ছোটখাটো বিদ্রোহ নিয়ে অনেকেই অনেক কিছু শুনে ফেলেছেন এতক্ষণে নিশ্চয়। ‘বাংলাদেশি’ মুসলমানেদের ‘মব’ কেমন ভাবে ভাংচুর করে, খিস্তি করে, অসহায় মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে সমস্যায় ফেলে দেয়, এ সব নিয়েই অনেক চর্চা হয়েছে, ‘রায়ট’ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়ে গেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। উত্তর ভারতের অনেকেই ‘বাংলাদেশি’ পরিচারিকা জোহরা বিবির টাকা চুরি করা নিয়ে গুরুগম্ভীর মত দিচ্ছেন, যেই বাঙালি প্রতিবেশিনী এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর উদ্দেশ্য নিয়েও এখন অনেক কথাবার্তা চলছে। জোহরা বিবির বিচার হয়ে গেছে।

মহাগুণ মডার্নে আমি গিয়েছি। সে কাহিনীও শোনাব, তবে তার আগে আপনাদের মাসুদপুরের গল্প বলি।

বসন্ত কুঞ্জে যে ছোট এক ঘরের ফ্ল্যাটটায় থাকতাম, তার পাশেই মাসুদপুর ভিলেজ। রাজধানী দিল্লীর মধ্যেও যে অনেকগুলো ‘গ্রাম’ আছে, মাসুদপুর তার মধ্যে একটা– সেখানে আলাদা খাপ পঞ্চায়েতও আছে। সেখানেই গাদাগাদি করে থাকেন অনেক বাঙালি অভিবাসী। এখানে থাকে ফচকে মেয়ে মর্জিনা, সদ্যবিবাহিত হিন্দু দাদা-দিদি বীফ খায় জেনে কাবাব বানিয়ে দেয় ভালোবেসে। চন্দা’স ক্যাটারিং-এর মালকিন দিদিও এখানে থাকে– বাড়ি বাড়ি রান্না করে ছেলেমেয়েদের বড় করে এখন নিজের ছোট্ট খাবার ডেলিভারির ব্যবসা খুলেছে দিদি, এবং সেই সাথে নেশাখোর স্বামীটিকে বিদায় করেছে। অনেক ঘরছাড়া বাঙালি ছেলেমেয়ের ভরসা এই দিদি, ফোন করলেই টিফিন বক্সে রান্না চলে আসে। মন খারাপ হলে কখনও মাসুদপুরের হাটে চলে গেলেই হল– কে বলবে দিল্লী শহর? সবাই বাংলা বলে, সবাই।

মাসুদপুরে কে পশ্চিম বাংলা থেকে আর কে বাংলাদেশ থেকে এসেছেন অত হিসেব থাকে না, বোঝাও যায় না। প্রশ্ন করলে উত্তরও পাওয়া যায় না, স্বাভাবিকভাবেই। বেশির ভাগ মানুষেরই আইডি আছে– একটা ভোটার কার্ড, অধুনা আধার, এগুলো সবার কাছেই থাকে (কীভাবে পাওয়া সেই নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে)। বসন্ত কুঞ্জ ও তার পাশের বড়লোক পাড়া, বসন্ত বিহার, এই দুটো জায়গায় কাজের লোকের চাহিদাও কম না। মাসুদপুরের এই বাঙালিদের কদর বেশ, বিশেষত রান্নার লোক হিসাবে। সেখানে অবাঙালিদের মধ্যে একটা ধারণাও কাজ করে, যে বাঙালি মানেই বাংলাদেশী, বিশেষত যদি মুসলমান হয়। সাধারণ মানুষের তাতে খুব একটা কিছু এসে যায় না। তাঁরা জীবন সংগ্রাম করে সংসার চালাতে ব্যস্ত থাকেন। এ ভাবেই বছর গড়িয়ে যায়, কেউ কেউ মাসুদপুর ছেড়ে আবার দেশে ফিরে যায়, কেউ কেউ পাড়ি দেয় অন্য কোনওখানে। মাঝে মাঝে মিউনিসিপালিটি এসে বাড়িগুলো ভেঙ্গে দেয়, মাঝে মাঝে আগুন লেগে যায়, মাঝে মাঝে জলে সব ভেসে যায়, তাও মাসুদপুর থাকে মাসুদপুরেই। মানুষের যাওয়া আসা লেগেই থাকে।

এরকম ছোট ছোট অভিবাসী পাড়া অনেক আছে দিল্লী/এনসিআরে, একেকটা জায়গায় একেক জাতির, একেক স্থানের মানুষজন জড়ো হন, তাঁরা একেক রকম কাজ করেন। তাঁদের শ্রম রাজধানী দিল্লীকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। মাসুদপুরের মতন বাঙালি পাড়াও আরও অনেক আছে, এবং বাঙালি অভিবাসী, বিশেষত মেয়েরা, সাধারণত বাড়ি বাড়ি গৃহকর্ম করেন। দিল্লীতে এনাদের অনেকেই বাড়িতে জল পর্যন্ত খেতে দেয় না, বাথরুমও ব্যবহার করার অনুমতি মেলে না, তবে তাই নিয়ে প্রতিবাদ তেমন হয় না। যন্তর মন্তরে গেলে হরেক রকমের প্রতিবাদ দেখবেন, তবে প্রতিদিনের এই ছোট ছোট অন্যায়গুলোর বিচার চাওয়ার সময় কারওরই খুব একটা থাকে না।

মাসুদপুর গ্রামের সাথে মহাগুণ মডার্নের কী তুলনা হয় আদৌ? জাঠ কৃষকদের জমি কিনে তৈরি হওয়া শহরতলি নয়ডা, সেই শহরতলিতে থাকেন উঠতি উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনেক মানুষ। অর্থ আছে, আকাঙ্ক্ষা আছে, শাইনিং ভারতের স্বপ্ন আছে, তবে নেই রাজধানী দিল্লীর বুকে বাংলো হাঁকিয়ে থাকার সামর্থ্য– সেটা যাঁদের আছে তাঁরা আরও কয়েক ধাপ উপরে, তাঁরা হয় উঁচু পাঁচিল দেওয়া সাদা বাংলোয় নয় সৈনিক ফার্মস-এর ফার্ম হাউজের ছায়ায় দিন কাটান (দিল্লীর আকাঙ্ক্ষার শেষ ধাপ ফার্ম হাউজ, মহানগরের বুকের উপর জবরদখল জমিতে বাগান বাড়ি– সেই গল্প শোনাব অন্য কোনও সময়)। নয়ডায় গাড়ি ছাড়া যাওয়া মুশকিল, তাতেই বা কী এসে যায়? আকাঙ্ক্ষার নাম নয়ডা, এবং সেই নয়ডার কয়েক শত ছোট ছোট গ্রাম, থুড়ি, গেটেড কমিউনিটিগুলোর একটা এই মহাগুণ মডার্ন।

মহাগুণ মডার্ন-এ গত বছর গিয়েছিলাম। যেতে হয়েছিল। এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় এক কিশোরী ছাত্রী প্রাণ হারায়– তার বাবা-মা এসে উঠেছিলেন ওখানে কারও কাছে, সেই মহাগুণ মডার্নে। সেই শোকের আবহে যেতে হয়েছিল সেই ঝাঁ চকচকে গ্রামে, ওলার ট্যাক্সি নিয়ে যাওয়ায় গেটে তেমন জিজ্ঞাসাবাদও হয়নি, বরং ইউনিফরম পড়া গার্ডেরা সেলাম ঠুকেছিল। মডার্ন বানান, লক্ষ্য করবেন, ‘moderne’– যেন এই ভুল বানানই আভিজাত্যের প্রমাণ দেবে। এই প্রকারের আভিজাত্যের ছাপ সর্বত্র ওখানে। বিশাল এলাকা, বড় বড় টাওয়ার, তারও বিদেশি নাম। একেকটা অদ্ভুত ভাস্কর্য সারা কমপ্লেক্স জুড়ে, চোখ ধাঁধানো সব কাঁচের বাড়ি। এত বড় কমপ্লেক্স যে ভিতরে গলফ কার্ট চলে বাসিন্দাদের জন্য– হাঁটা তো কঠিন, তাই।

এই কমপ্লেক্সের রক্ষণাবেক্ষণ করতে একটা ছোটখাট আর্মির প্রয়োজন পরে। সেই আর্মি কাদের? বেশির ভাগই অভিবাসী কর্মী, এবং আবার, বাঙালি প্রচুর– মাসুদপুরে যাঁদের দেখেছি তাঁদের মতনই মানুষজন, এখানেও তাঁদের একটা বস্তি আছে, সেখানে তাজা মাছও পাওয়া যায়। এঁদের ঢোকার সময় সার্চ করা হয়। কী কী নিয়ে ঢুকতে পারেন তার কড়া নিয়ম আছে। ব্যাগে কত টাকা আছে সেটা দেখা হয়। টাওয়ারে গিয়ে আবার সার্চ, আলাদা সার্ভিস লিফট আছে, বাথরুম আছে কিনা জানি না। ব্যবহার– সে তো আগেই বলেছি, জল খেতে দিলেই যথেষ্ট। মাইনে– বেঁধে দেওয়া থাকে, রেট কার্ড আছে। বেরনোর সময় একই গল্প। যদি একটা বাসি খাবারের টিফিন বাক্সও নিয়ে যেতে হয়, সেটারও আলাদা পারমিশন লাগে। ব্যাগে কত টাকা আছে আবার দেখা হয়, যদি বেশি থাকে তার কারণ দর্শাতে হয়। বেশ ফুলপ্রুফ ব্যাপার আর কী। এ ছাড়াও সিসিটিভি তো আছেই! অভিজাত আধুনিক গ্রামের বাসিন্দাদের এটুকু সুরক্ষা তো দিতেই হয়, তা ছাড়া তাঁরা মেন্টেনেন্সের মোটা টাকা গোনেন মাসে মাসে– তাঁরা কেমন করে জানবেন মিউনিসিপালিটির ডেমলিশন ড্রাইভ হলে কী হয়? হুকিং করে বিদ্যুৎ নেওয়ার ফলে অগ্নিকাণ্ডের কথাও তাঁদের ভাবতে হয় না, কাঁচের ঘরে বসে বৃষ্টি দেখেই তাঁরা খুশি।

এ হেন গ্রামে জোহরা বিবির মতন অদৃশ্য মানুষেরা যখন দৃশ্যমান হয়ে ওঠেন, যখন মহাগুণ মডার্নের মতন আধুনিক গ্রামে মাসুদপুরের মতন অভিবাসী গ্রামগুলোর লোকজন অধিকারের চেয়ে কিছু বেশিই চেয়ে ফেলেন, তখন ‘রায়ট’ মনে হতেই পারে সেখানকার বাসিন্দাদের, এটা আশ্চর্য কিছু নয়। এই দুই জগতের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ততক্ষণই সম্ভব যতক্ষণ এক জগতের মানুষজন আরেক জগতে অদৃশ্য শ্রমদান করে চুপচাপ যথাস্থানে ফিরে যান। জোহরা বিবির বিচার তো হয়েই গেছে, কিন্তু তাঁর বিচার যারা করলেন তাঁদের বিচার করবে কে?