রোমেল রহমান
ভোর
মা পাখি ঘুম ভাঙালেন সন্তানদের এবং জানালেন এক অদ্ভুত খবর…
–ওঠো আমার যাদুর পাখিরা। আর শোনো, আজ থেকে একটা নতুন জীবন আমাদের শুরু হতে যাচ্ছে। আমাদের এই ভূমি আর আমাদের নেই। আমরা ভূমিহারা হয়ে গেছি।
সন্তানেরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। যেন তারা এক অদ্ভুতুড়ে গল্প শুনছে যা তারা আগে কখনও শোনেনি। তারা জিজ্ঞেস করল…
–কেন?
–আমাদেরকে সরকার বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করেছে। আমাদের এখন থেকে এই মাটির প্রতি আর অধিকার নেই! আমরা আর আজ থেকে এদেশের নাগরিক নই! চারদিকের সব গাছগাছালি আজ থেকে আমাদের নিজেদের না।
এক বাচ্চা পাখি জানতে চাইল…
–আমরা কী দোষ করেছি? আমরা তো কাউকে বিরক্ত করিনি। কারও ঘরে হামলে পড়িনি।
মা পাখি বলল…
–পৃথিবী এক অদ্ভুত জায়গা। এখানে রাষ্ট্র নামক এক এমন ব্যবস্থা আছে যার কাছে মানুষের মূল্য রাজা মন্ত্রীদের ইচ্ছার সমান!
অন্য এক বাচ্চা পাখি জানতে চাইল…
–আমাদেরকে কি ওরা খাঁচায় বন্দি করে ফেলবে?
হতাশ মা পাখি বলল…
–আমি জানি না। তবে আমরা অপেক্ষা করব ঘৃণা নিয়ে আমাদেরকে যারা এমন উদ্ভট ভাগ্যচক্রে ছুঁড়ে ফেলে দিল তাদের ফরমানের দিকে।
প্রথম বাচ্চা পাখিটি বলল…
–আমাদেরকে কি মেরে ফেলবে?
মা পাখি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল…
–আমরা কি আর বেঁচে আছি?
দ্বিতীয় বাচ্চা পাখিটি জিজ্ঞাস করল…
–মা আকাশটা কি আমাদের আছে?
মা পাখিটি ডুকরে উঠে বলল…
–না।
মাছেদের গল্প
পুকুরের মাছেদের মধ্যে হইচই পড়ে গেল। ছোটাছুটি চলতে লাগল পালাবার। কিন্তু সীমান্তের সীমাবদ্ধতা তাদেরকে বারবার হুমড়ি খেতে বাধ্য করল।
–শুনেছ খবরটা?
–হ্যাঁ। এক্ষুনি শুনলাম!
–কখন আসছে?
–এসে গেছে প্রায়। পুকুর পাড়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন জাল হাতে।
–কিছুদিন ধরে শুনছিলাম জাল ফেলে সবাইকে তুলে নিয়ে যাবে!
–হুম। আজ সেই বীভৎস দিন।
–চলো পালাই।
–কোথায় পালাবে?
–সবাই পালাচ্ছে!
–লাভ নেই, একটু দেরিতে হলেও ধরা পড়তেই হবে।
–চেষ্টা তো করে দেখি…
–লাভ নেই।
–আমরা তো এই জলাশয়টাকে জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসি। আমাদের জন্ম এখানে, এটা আমাদের।
–উঁহু। শুধু জীবনকে ভালোবাসার অধিকার আমাদের দেয়া হয়েছে। পুকুরটা নাকি ওদের। ওরা বলেছে আর থাকতে দেবে না।
পথের কুকুরদের গল্প
–শুনেছ সাঁজোয়াযান নাকি নেমেছে?
–হ্যাঁ!
–বন্দুক নিয়ে তাড়া করছে!
–ঘরে ঘরে তল্লাশি…!
–তল্লাশির কী আছে?
–নেই কিছু তাতেই করছে, থাকলে ছাই করে দিত।
–আমাদেরকে জন্মাতে দিল কেন তবে?
–ওদের ইচ্ছে!
–এখন তাহলে হত্যা করবে?
–জানি না।
–তাহলে আমাদেরকে তুলে নিয়ে যাবে কেন?
–ওদের ইচ্ছে!
–এসব কী বলছ?
–ওরা তাই করবে যা ওদের উপর হুকুম!
–আমাদের কথা কেউ শুনবে না?
–না। সব শেষ।
–আমি শেষ কামড়টা দেব একজন সৈনিককে অন্তত।
–দিও। শেষ কামড়টা দেয়া জরুরি!
এক অন্ধ ভিক্ষুকের নাগরিকত্ব
–জীবনটারে স্যার দেখতিই পারলাম না। আমারে কোন দুঃখে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন?
–চুপ।
–আমি অন্ধ স্যার! মাফ করেন আমারে, ভিক্ষে করে খাই!
–খাস তো আমাদেরটা!
–আমি স্যার দেশটারেই একবার দেখার সুযোগ পালাম না, মায়ের পেটের মতন অন্ধকারেই বড় হলাম হাতড়ায় হাতড়ায়!
–অন্ধকারেই হারায় যা!
–আমারে মাফ করেন স্যর! আমি ভিক্ষে করতি করতি চলে যাব।
সিপাহি তার ঊর্ধ্বতনকে জিজ্ঞেস করে…
–এই অন্ধটারে কি করব স্যার?
–অন্ধ দার্শনিক ভয়ঙ্কর। বইতে গেলে গন্ধ ছড়াবে। গুলি করে দাও!
দুই সৈনিকের সংলাপ
–মেয়েটা সুন্দর স্যার।
–উদ্বাস্তু খাতায় নাম লিখো না, জ্যান্ত গুম করে দাও।
প্যালেট গান দিয়ে গুলি ছোড়া শেষে ক্লান্ত সৈনিকদের আলাপ
–চোখগুলো শেষ!
–চোখের ডাক্তার থাকলে অপারেশন করতে করতে হিমশিম খেয়ে যেত। হা হা হা…!
–হুঁ। চোখ গলে রক্ত ঝরছে। দৃশ্যটা সুন্দর না।
–একটা অন্ধ জেনারেশন দাঁড়াবে!
–আর কেউ বিদ্রোহের সাহস দেখাবে না।
–উঁহু! এখনও অনেক চোখ জ্যান্ত!
দুই নারী
–হিসস! বাচ্চাটার মুখ চেপে ধরো!
–মরে যাবে।
–নইলে আমরা মরব!
–ও…ও…ও… কাঁদে না… কাঁদে না!
–হিসস!… তুমি কি আমাকেও মারবে?
–কী করে থামাব?
–গলা টিপে ধরো! ওরা খোঁজ পেলে তোমাকে আমাকে রেপ করে মেরে ফেলবে।
–আমাকে এখনই মেরে ফেলো।
বৃদ্ধার স্বর
–নানী ওঠো। জলদি! কোলে উঠবে? পালাতে হবে! দাঙ্গাবাজরা আসছে।
–তুই চলে যা, আমি আর কোথাও যাব না।
কয়েকজন কিশোর কিশোরী
–ঢিলটা একেবারে মাথায় গিয়ে লেগেছে পুলিশটার। শুয়োরের বাচ্চাটা আমার আব্বাকে মেরেছে!
–আস্তে!
–কী?
–মনে হচ্ছে ট্যাঙ্ক আসছে!
–উফফফ!
–এখন?
–ঢিল তুলে নে হাতে!
অবরোধবাসিনী
–শুনলাম লুট হচ্ছে নাকি বাজার?
–হ্যাঁ। কিচ্ছু নেই।
–এরা নাকি আমাদেরকে নিরাপত্তা দেবে?
–এ-ই তার নমুনা!
–সত্যিই কি ক্যাম্পে নিয়ে যাবে আমাদেরকে?
–হয়তো!
–আমার ফুলের গাছগুলো!
–বাচ্চাদের কথা ভাবো!
–(ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে)
সংবাদকর্মী
–ইন্টারনেট কানেকশন কি আর আসবে না?
–আপাতত না।
–একটা ফোন কলও করার উপায় নেই।
–আশা করো কী করে?
–ফুটেজ পেয়েছি একটা দুর্দান্ত। বাইরে পাঠাতে পারলে অন্তত দুনিয়া আমাদের পরিস্থিতি জানতে পারত!
–দুনিয়া কি বোকা? তারা জানে না এই অবস্থায় কী ঘটে? কেন কেউ এগিয়ে আসছে না? এত বড় অন্যায়ের পরও?
–উফফ! কী করা যায় বলো তো?
–কয়েকটা ফোটোগ্রাফ পাঠাতে পারো কিনা দেখো। রাতে কেউ কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালাতে চেষ্টা নিচ্ছে।
–আছে কেউ চেনজানা?
–আজ রাতে আমিই চেষ্টা করব পালাতে!
–কী বললে?
–হ্যাঁ! হয় বাঁচব নইলে মরব।
–কার্ফুর মধ্যে বেরোলে গুলি!
–একঘরে আটকে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো!
–তুমি শিওর যাচ্ছে?
–ফুটেজটার একটা কপি আমার কাছে দিয়ে দিও।
–তুমি শিওর পালাবে?
–হ্যাঁ। আমি সরকারের বেইন্সাফি হুকুম মানি না।
–গুলি খাবে নির্ঘাত!
–বন্দিত্বের চেয়ে শাহাদাৎ খারাপ কি।
প্রভুপ্রেম
–যা! চলে যা! আমি তোকে সঙ্গে নিতে পারব না! আসিস না। যা।
–যাবে না।
–ওকে আমি নেব কী করে? খাওয়াব কী?
–যাবে না। ওর তুমি ছাড়া কোনও রাষ্ট্র নেই।
শেষ আশ্বাস
–শুনেছ খবর?
–কি?
–সারা দুনিয়া আমাদের জন্য ফুঁসে উঠছে।
–বাহ! কোথায় শুনলে?
–এক সিপাহি আরেক সিপাহির সঙ্গে আলাপ করছিল! কে যেন আড়াল থেকে শুনেছে ওদের কথা।
–তাহলে ঘটনা সত্য। ওরা কি ভয় পাচ্ছে?
–জানি না। তবে আর কটা দিন পাড়ি দিতে পারলে হয়তো একটা ঘটনা ঘটবে।
–কেমন ঘটনা?
–জানি না। হয়তো…
–নাগরিকত্ব ফিরে পাব? ঘর ফিরে পাব? কিন্তু ঘরের সব মানুষগুলো তো নেই!
–অন্তত আমরা বেঁচে যাব!
–মহল্লার সব মানুষগুলো আগের জীবনে ফিরতে পারবে?
–না।
–যাইহোক আমরা তো আছি কি বল?
–হুমম…।
–অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেবে হয়তো আমাদের।
–কে বলেছে, ঐ সৈনিকেরা?
–না। আমার মনে হচ্ছে।
–জন্মালেই জন্মভূমি নিজের হয় না তাই না?
–এখন তো তাই দেখছি!
–বইপুস্তক ভুল শিখিয়েছিল আমাদের!
–হ্যাঁ।
–বই লেখে কারা?
–যাদের দেশ আছে তারা হয়তো!
–হা হা হা! আমাদের একজন লেখক থাকলে মজা হত তাই না?
–কী লিখত সে?
–আমাদের জ্যান্ত মৃত্যুর গল্প।
–তোমার কী মনে হয় কোনওদিন কি আমরা আবার দেশ পাব?
–কোনওদিন কি ভেবেছিলে তুমি দেশহারা হবে?
–ধুর!
–আমি একটা বোমা বানাব।
–কেন?
–নিজেকে উড়িয়ে দিতে।